ঘুমের ঘোরে বেশ টের পাচ্ছি মা ফাটা গালে চেপে চেপে ক্রিম মাখাচ্ছে। চারমিস ক্রিম। এখনও চোখ বন্ধ করে আমি চারমিস চিনে নিতে পারি। আর পারি তুহিনা। কেন? কারণ এটা শীত কালের মা। গরম কালের মায়ের সঙ্গে শীতের কালে তুহিনা মিশে শীত কালের মায়ের গন্ধটা একটু পাল্টে যেত। আসলে গন্ধ আমার কাছে শুধু সুবাস বা দুর্গন্ধের সীমানা ছাড়িয়ে জীবন জড়িয়ে থাকার একটা উপায় বলতে পারি।

ছোট বেলায় বাইরে থেকে এসে দরজা খুলে যেই বাড়িতে ঢুকতাম, তখনই পেতাম একটা বাড়ি বাড়ি গন্ধ। সে গন্ধের মধ্যে ছিল অপার নিশ্চিন্ততা, গভীর আশ্রয়, নিরুপদ্রব জীবনের একটা ইঙ্গিত। বেশ ফুরফুরে, নির্ভার গন্ধ। সে গন্ধ মনে ছাড়া আর জীবনে বইতে পারলাম কই। আবার, বাড়ি বিশেষে কলাইয়ের ডাল কিংবা রোববারের মাংসের গন্ধ। সে তো আালাদা করেই চেনা যায়। ফাটা ফাটা আলু-ঝোলের মধ্যে থেকে গরম মাংসের বাটির ওপর যে গন্ধটা উড়ে বেড়ায় ওটা আসলে মায়ের আদরের গন্ধ। আমি এখনও তারাশঙ্করের কোনও বই ফিরে পড়তে গেলে ছোটবেলার স্কুল লাইব্রেরির গন্ধ পাই। ক্লাস এইটে প্রথম হাতে পেয়েছিলাম তারাশঙ্করের ‘না’ বইটা। তাই তারাশঙ্করের গদ্যের মধ্যে মিশে আছে আমার স্কুলের লাইব্রেরির গন্ধ।

আগে ভাবতাম গন্ধ প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে গায়ে-পায়ে চলে বেড়ায়। কিন্তু এখন দেখছি গন্ধ জীবনকে দাগিয়ে দেয়, চিরস্থায়ী মার্কারের মতো। বহু বছর পর বই খুললে সেই নির্দিষ্ট জরুরি জায়গাটিই চিহ্নিত থাকবে।

বইমেলা মানে আমার কাছে ধুলো আর মরা-ঘাসের গন্ধ একত্রে। এ বইমেলা হল পার্কস্ট্রিট বইমেলা। ওটাই আমাদের মতো অনেকের কাছে আসল বইমেলা। প্রচুর ধুলো মেখে, হাঁটতে হাঁটতে পায়ের নড়া খুলে এলে আমরা যে সব মরা ঘাসের চত্বরে বসে পড়তাম, নতুন বইয়ের গন্ধের সঙ্গে সে সব গন্ধ মিশে গিয়ে নিত্য রূপকথার জন্ম দিত। যেমন জানুয়ারি মাস মানেই নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বইয়ের গন্ধ পাওয়া, একটা সেন্স অব অ্যাচিভমেন্টের আশ্বাস দিত।

বাইপাস মানে ধাপার মাঠের তীব্র দুর্গন্ধ, যা আশি আর নব্ব্ই দশকে নানা কেরামতি করে দক্ষিণ কলকাতা থেকে সল্টলেক যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয় আর ডিমের ডেভিল মনে করিয়ে দেয় বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের আট তলার ক্যান্টিন। আর শীতের শেষে বিশ্বাসঘাতক হাওয়ায় যে গন্ধটি ভাসে সারাক্ষণ আর জাপটে ধরে আমাদের, তাতে ভাঙা প্রেম, জোড়া প্রেম, খিলখিল, যৌবন, উল্লাস—সব মিলিয়ে এখনও বুকের ভেতর গাবগুবাগুব। যেমন বেপরোয়া হাওয়া, তেমনই একবগ্গা গন্ধ। নাছোড় নস্টালজিয়ায় আছড়ে ফেলবেই। আর একটা গন্ধ আছে যার মধ্যে নস্টালজিক ছোট বেলার জ্বরের গন্ধ, সে হল হরলিকস-এর। আমি এখনও হরলিকস খেতে পারি না, মনে হয় যেন জ্বর হয়েছে, গায়ে চাপা দেওয়া, খালি চোখ লেগে যাচ্ছে, কখন যে সকাল পেরিয়ে দুপুর আর দুপুর গড়িয়ে সন্ধে হয়ে আসছে, ভাল ঠাহর করা যাচ্ছে না। সন্ধে হয়ে যাচ্ছে, চোখ জ্বলছে, ঘরে আলো জ্বালানো হয়নি। মা কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখছে আর ডাকছে মৃদু মৃদু, “হরলিকসটুকু খেয়ে নাও”,  অদ্ভুত একটা ফিলিং হয়।

আর ফুচকার গন্ধ তো জীবনের সেলিব্রেশনের গন্ধ। ও গন্ধকে কেউ টেক্কা দিতে অক্ষম। হাহাহা, হিহিহি, একটু ঝাল দিয়ো তো আমারটায়, এরটায় কিন্তু ঝাল ছাড়া নুন বেশি, কী গো! পুর তো দিচ্ছই না, টক জলে আরও একটু লেবু দাও—এ সবের মধ্যে জীবনকে জাপটে, চেটেপুটে বাঁচার একটা ভরপুর এনথু থাকে।  আমার আবার লোহার গন্ধ পেলেই মনে হয় বাইরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি। ঠিক যেন রেললাইনের গন্ধ। যেমনটি পেতাম হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে ওঠার পরে। জানলা দিয়ে ঠিক একটা নির্দিষ্ট গন্ধ ভেসে আসত, যা হুস করে ছুটি ছুটি মোডে ট্রান্সফার করে দিতে সক্ষম ছিল এক নিমেষে। আচ্ছে, ট্রেনের জানলার শিকে বৃষ্টি পড়লে কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরতো না? কারও মনে পড়ে সে গন্ধ। সেই গন্ধের সঙ্গে দূরে পাড়ি দেওয়ার একটা যোগ ছিল।

অনেকের কাছে পুজোর গন্ধ মানে শিউলি ফুলের গন্ধ, আমার কাছে পুজোর গন্ধ মানে রাস্তায় এগরোলের গন্ধ আর আরতির ধুনোর গন্ধ, প্রদীপের তেল পোড়ার গন্ধ, ঘি মাখা হোমের টিপের গন্ধ। পুজোর সময় করেই আরও একটা ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে যায়। ছাতিম ফুলের গন্ধ। ছাতিমের গন্ধ মানেই আমার কাছে দশমীর বিষাদ। ছাতিমের গন্ধ আমার দারুণ লাগে। কেমন একটা মন খারাপ আছে। আর এতটাই তীব্র যে এক এক সময় অসহ্য হয়ে ওঠে। ওই যে অসহ্য হলেও তাকে পরিত্যাগ করতে পারি না, এর মধ্যে কেমন একটা আকর্ষণ আছে, যেটার হদিশ কোনও লজিক দিতে পারে না। তাই ছাতিমকে আমি লাভ-হেট রিলেশনেই গ্রহণ করেছি।

আমি আরও ভিন্ন গন্ধ চিনতে পারি, যেমন বিভিন্ন হাসপাতালের বিভিন্ন গন্ধ। আমরির এক রকম, মেডিকার অন্য রকম আর পিজি হাসপাতালের অন্য রকম। আমার শুধু গা-ছমছম করে ওই সব আইসিইউ-এর গন্ধ পেলে। ওটা আসলে প্রিয়জন হারানোর গন্ধ। ওই গন্ধে পা অবশ, ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া আর শিরায় শিরায় টেনশন বইতে শুরু করে।

তবে যাক সে কথা। কয়েকটা নির্দিষ্ট আনন্দের গন্ধ সব জায়গায় এক রকম। যেমন বিয়েবাড়ির গন্ধ। ফুল আর মশলাদার খাবারের গন্ধের পারফেক্ট মিশেল। সব মন্দিরের গন্ধও এক রকম, ফুলবেলপাতা, চরণামৃত, মিষ্টি আর ধুনোর গন্ধ মিশে মন্দির-মন্দির গন্ধ তৈরি করে। আর সব সিনেমা হলের গন্ধ এক রকম। মাল্টিপ্লেক্স আসার পর অবশ্য ততটা বোঝা যায় না। কিন্তু আগে সিনেমা হলে ঢুকলে যে গন্ধটা বেরতো, তার মধ্যে একটা ছটফটে প্রতীক্ষা থাকে, মনের মধ্যে বুড়বুড়ি কাটত, এখুনি প্রার্থিত ব্যাপারটা ঘটতে যাচ্ছে। স্ক্রিন জুড়ে সত্যজিৎ কিংবা উত্তমকুমার, টম ক্রুজ বা আমির খান অথবা টাইটানিক কিংবা ফাইন্ডিং নিমো, আরও আরও কত কী!

গত কয়েক বছর ধরে আমার সবচেয়ে প্রিয় গন্ধ— তেল, পাউডার, লোশন আর দুধের গন্ধের মিশেল। একটা ছোট্ট আলোর বলের সৌজন্যে সে প্রাপ্তি ঘটেছিল কয়েক বছর আগে। বেশ কয়েক বছর ছিল। এখন আলোর বলটি খানিক লায়েক হয়ে গিয়েছে। এখন তার অন্য লোশন। কিন্তু কেবলই মনে পড়ে সে গন্ধ। কেবল মনে হয়, যদি বেশ শিশি করে জমিয়ে রাখতে পারতাম সেই মায়াবি জিনিসটি, বড় ভাল হত। বুড়ো কালের সঙ্গী হত সে।

আমি রজনীগন্ধার গন্ধ ভালবেসেছিলাম দুটো গান শুনে। একটা “রজনীগন্ধা ফুল তুমহারি” আর অন্যটা “এক গোছা রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে বললাম”… বলা যেতে পারে এ গন্ধ আমার কাছে আপনাআপনি আসেনি, আমি বন্ধুত্ব পাতিয়ে ছিলাম। আমার বাবা খুব ভাল গাইত হেমন্তর গানটা। আমার বাবার গন্ধ ছিল পারফিং আর সিগারেটের গন্ধ মেশানো একটা দারুণ গন্ধ। বাবা চলে ফিরে বেড়ালে সে গন্ধে ম ম করত দশ দিক। কিন্তু এখন আমার বাবার গন্ধ মানে রজনীগন্ধা আর ধূপের গন্ধ। আমি সে গন্ধ ঘৃণা করি। আমি রজনীগন্ধার গন্ধ ঘৃণা করি। ঘোর ঘৃণা।

 

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র‌্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।

8 Responses

  1. আধুনিক প্রযুক্তির কারণে শব্দ, ছবি কি সুন্দর ধরে রাখা যায়, কিন্তু গন্ধ এখনও যায় না, তাই না! কতবার কতজনকে বুঝাতে চেয়েছি – পারিনি। মানুষ কতকিছু ঘাটে স্মৃতির কথা বলতে গেলে, আমি শুধু গন্ধ খুঁজি, গন্ধ পাই। সেটা এখনও শুধুমাত্র স্মৃতিপটে লেখা থাকে বা লেখা হয় বলে হয়ত এর মূল্য এত বেশী – যা আমাদের কখনও আনন্দ দেয়, কখনও কাঁদায়। ভাবনাগুলো মিলে যাওয়াতে খুব ভাল লাগল লেখাটা পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *