কারণে অকারণে মানুষ হত্যা করে। হত্যার স্বপক্ষে যুক্তি এবং নানা ইজম্ প্রতিষ্ঠিত। বাঘের হরিণকে মারা খাদ্যখাদক সম্পর্কের প্রাকৃতিক নিয়মে, অতএব যুক্তির প্রয়োজন নেই। ইতিহাস লেখা হয় হত্যাকান্ডের। বর্তমানে সর্বত্র প্রত্যক্ষ হয় হত্যার কাহিনী। এই ট্রাডিশন ভবিষ্যতেও ঘটে চলবে। মানবজাতি হয়তো বা একদিন এভাবেই বিলুপ্ত হবে। ভবিষ্যতের বুদ্ধিমান প্রাণীর লাইব্রেরিতে লেখা হবে, “নিজেকে ‘হোমো স্যপিয়েন্স’ অর্থাৎ ‘জ্ঞানী মানুষ’ বলে জাহির করা একদল প্রাণী লুপ্ত হয়ে গেল শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে”। “শিনডলারস্ লিষ্ট”, “সেভিং প্রাইভেট রায়ান” ইত্যাদি ছবি চেতনাকে নাড়া দেয়। শম্ভু মিত্রের কন্ঠে “হত্যায় খচিত এই ধরণীর ধূলি, হত্যা লোকালয়ে, হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে”, ইত্যাদি কৈশোরে মুগ্ধ করত।
তথাকথিত সভ্যমানুষের ইতিহাসে শুধু হানাহানি, যুদ্ধ, সাম্রাজ্যের উত্থান আর পতন। অগণিত মানুষের হত্যা। একটা পসট্যুলেট বলে হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স আজ থেকে এক লক্ষ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে নিকটতম জ্ঞাতি হোমো স্যপিয়েন্স নিয়নডার্থালিসকে শেষ করে। শেষ করে অন্য জ্ঞাতিদের। আবার জিনোম প্রজেক্টে সন্ধান মেলে জ্ঞাতির কিছু ডিএনএ-এর। হয়তো ইন্টারব্রিডিং হয়েছিল। প্রেম ভালোবাসার থিয়োরি। কিন্তু আজ অন্যান্য জ্ঞাতিরা নেই এবং হত্যা হয়ে চলেছে মানুষের, প্রাণিকুলের, অরণ্যের, প্রাকৃতিক সম্পদের।
মানব মস্তিষ্কের প্রধানতম বৈশিষ্ট উন্নত জ্ঞান ভিত্তিক চেতনার (কগনিটিভ) প্রকাশ। এভুল্যুসন থিয়োরিতে দেখা যায় দুর্বল নখদন্তহীন প্রাণী মস্তিষ্কের সঞ্চালনায় অন্য সব প্রাণকে পরাস্ত করে সভ্যতা গড়ে তুলেছে। কিন্তু সেই গড়ে তোলার জন্য হত্যা করেছে অনবরত। হয়ত প্রাগৈতিহাসিক দুর্বল অসহায় প্রাণীটি আজও ইনসিকিউরিটির শিকার। জ্ঞান ভিত্তিক চেতনা বোঝাতে ব্যর্থ হয় যে এই হিংসার পথে একদিন তারা নিজেদের শেষ করে দেবে।
বর্তমানে ফেরা যাক। করোনা মুক্তিতে স্বস্তির হাওয়ায় দেখা গেল চৌষট্টি মাইল জুড়ে ট্যাঙ্কের সারি এগিয়ে চলেছে। সঙ্গে আছে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি। করোনা ব্যাপারটা প্রকৃতির প্রতিশোধ। যুদ্ধ ব্যাপারটা কিন্তু কতিপয় মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত। জনগোষ্ঠী বাধ্য হয় যুদ্ধ করতে। নানান মারণাস্ত্রে ভাণ্ডার পরিপূর্ণ। একটা বোতামের চাপে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটা গোটা শহর। সত্যজিৎ রায় “আগন্তুক” এ সভ্যতা এবং সভ্য মানুষ নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন রেখেছিলেন। সেসব প্রশ্ন আরও বড় হয়ে উঠছে জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে বছর আশি বছর আগে লিখেছিলেন “সভ্যতার সঙ্কট”। সেই সঙ্কট আজ ঘনীভূত। হয়তো মানবসভ্যতার শেষ পর্ব চলছে। হয়তো মানব জাতি লুপ্ত হতে চলেছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু কীভাবে লুপ্ত হবার সম্ভাবনা প্রবল? হয় প্রকৃতির প্রতিশোধে না হয় মানবজাতির প্রবল হানাহানিতে। প্রকৃতির প্রতিশোধ দেখা গেছে খরায়, বন্যায় এবং বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবে। কিন্তু তাও প্রকৃতি সামঞ্জস্য বজায় রাখে।
অজানা কারণে (কনসপিরেসি থিয়োরি অগ্রাহ্য করা হল এই লেখায়) দুহাজার বিশ সালে দেখা মিলল করোনাভাইরাসের। অ্যামেরিকা, ব্রিটেন, ইতালি, স্পেনে দেখা গেল মৃত্যুর মিছিল। সমষ্টির মৃত্যু-প্রেডিকশন দেখতে দেখতে একসময় ব্যক্তি তুচ্ছ হয়ে যায়। ক্রমশ ভারতবর্ষও মৃত্যুর পরিসংখ্যানে পড়ে গেল। টিভির পর্দায়, খবরের কাগজে, তারপর প্রত্যক্ষে দেখা গেল এক অন্ধকার মৃত্যুযজ্ঞ। ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির মৃত্যু ঘটে চলেছে। শ্মশানে দীর্ঘ লাইন। কোথাও মৃতদেহ ভেসে চলেছে নদীতে। জীবনানন্দের চিত্রকল্পের মতো। “কড়ির মতন শাদা মুখ তার, দুইখানা হাত তার হিম; চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে”।
রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে বছর আশি বছর আগে লিখেছিলেন “সভ্যতার সঙ্কট”। সেই সঙ্কট আজ ঘনীভূত। হয়তো মানবসভ্যতার শেষ পর্ব চলছে। হয়তো মানব জাতি লুপ্ত হতে চলেছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু কীভাবে লুপ্ত হবার সম্ভাবনা প্রবল? হয় প্রকৃতির প্রতিশোধে না হয় মানবজাতির প্রবল হানাহানিতে। প্রকৃতির প্রতিশোধ দেখা গেছে খরায়, বন্যায় এবং বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবে। কিন্তু তাও প্রকৃতি সামঞ্জস্য বজায় রাখে।
ধীরে ধীরে জীবন তার ছন্দে ফিরে আসতে লাগল। করোনা ভাইরাসের পরের অবতারসমূহের প্রতাপ অনেক কম। তাকেও মানুষের সঙ্গে বেঁচে থাকতে হবে। রূপ বদলে হয়তো কোনও সাধারণ অসুখের রূপে অবস্থান করবে দৈনন্দিন জীবনে। প্রাণিতত্ত্ববিদদের মতে সাড়ে তিনশো ট্রিলিয়ন ভাইরাসের অবস্থান মানব শরীরে। এদের তোনওটা আমাদের অসুস্থ করে, আবার কোনওটা শুধু টিকে আছে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে। প্রকৃতি এভাবেই ভারসাম্য বজায় রেখে চলে। জীবনের গভীর অনেক রহস্য এখনও অধরা। অতিমারীতে অনেক ব্যক্তির বিনাশ হয় কিন্তু প্রাকৃতিক সামঞ্জস্যে সমষ্টি টিকে থাকে।
কিন্তু যুদ্ধ ব্যাপারটা অন্যরকম। এখানে কোনও ক্ষমা নেই। কোনও সামঞ্জস্য নেই। বোমার আঘাতে ধুলো হয়ে যায় ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল এবং মানুষ। প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়।
“মৃত স্পেন। ম্রিয়মান চীন।
কবন্ধ ফরাসীদেশ।
সে এখনও বেঁচে আছে কি না,
তা সুদ্ধ জানিনা।”
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শাশ্বতী যাদের পড়া তারা জানেন যে সেই মেয়ের চিকুরের রং পাকা ধানের মতো, আঁখির রং নীল। সহজিয়া অনুরাগে সে চেয়েছিল এবং তার আবেগের প্রতিনিধি ভরা নদী ইত্যাদি ইত্যাদি। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের অসাধারণ একটি কবিতা। রেফারেন্স জানলে, কনটেক্সটের বাধা অতিক্রম করলে সুধীন বাবুর এবং বিষ্ণু দের কবিতার রসগ্রহণ করা যায়। উপলব্ধির জটিল গভীরতায় জীবনানন্দের কবিতা বিরাজমান। যাইহোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সুধীনবাবু লিখেছেন “সে এখন ও বেঁচে আছে কি না, তা সুদ্ধ জানিনা।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিলিটারি আর সিভিলিয়নের ভেদরেখা মুছে দিয়ে ফ্যাট বয়ের মতো পরমাণবিক বোমার আঘাতে শেষ হয়।
সম্প্রতি একটি মালয়ালম ফিল্ম দেখা গেল। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের মতো। Genre শব্দটির যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ লেখকের অজানা কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে “কালা” বোধহয় আদিম অকৃত্রিম ভায়োলেন্স যা মস্তিষ্কের গভীরে চেতন-অবচেতনে স্বতত অবস্থান করে এবং সময়ে সুযোগে সে প্রকাশ করে তার সংহার-রূপ। পরিচালক রোহিত আনঅ্যাপোলোজেটিক। এত দীর্ঘ হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট দৃশ্য কোনও ভারতীয় ছবিতে দেখা যায়নি।
ছবিতে মুখ্য চরিত্র শুধু হিংসার উন্মত্ততায় নৃশংস ভাবে হত্যা করে অ্যান্টাগোনিস্ট অদিবাসী ছেলের একমাত্র সঙ্গী দেশী সারমেয়কে। এইভাবেই যুগ যুগ ধরে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তথাকথিত উপজাতিয় মানুষের অধিকার। অনেক অনেক উপনিবেশের, নগর সভ্যতার পত্তন এইভাবেই। প্রতিবাদ করার ভাষা নেই। যাইহোক ছেলেটি সেই হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায় কেন-করসো ব্রিডের ব্লাকিকে হত্যা করে। মানুষ খেলাচ্ছলে পশুকে হত্যা করে। তার নথি হয়না। হলেও শাস্তি হয়না। অপরাধ, শাস্তি, মরাল, এথিকস এসব শুধু মানুষের জন্য। মনুষ্যত্ব শব্দটিই শুধু মানুষের জন্য। অন্য প্রজাতিকে হত্যা করা হয় কোনও কারণ ছাড়াই। অবশ্য মানুষ অন্য রঙের মানুষকে বোমা মেরে হত্যা করে। কোল্যাটেরাল ড্যামেজ বলে। সভ্যমানুষের পাপের গাঙ বড় গহীন। ঘটনা পরের দিনে প্রবাহমান। সকালে স্বামী স্ত্রীর মিলনদৃশ্যটি ভালো লাগার মতো। হিংসার মতো সঙ্গমও এক প্রাগৈতিহাসিক চেতনা। তারপর এক দীর্ঘ হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট। ছবির শেষে দুজনে মুখোমুখি। রক্তাক্ত ক্লান্ত অবসন্ন দুই হোমো স্যপিয়েন্স। আদিবাসী ছেলেটিকে দেখে প্রতিপক্ষের চোখে ভয়। সে ভয় ঠিক মৃত্যুর নয়। হয়তো সর্বস্ব হারাবার ভয়। মস্তিষ্কের গভীরে যে ভয় রয়েছে সেই গুহাযুগ থেকে। ব্লাকিকে সঙ্গে করে আদিবাসী ছেলেটি এগিয়ে চলে। সে তখন প্রোটাগনিস্ট। ছবি একসময় শেষ হয়। রয়ে যায় কিছু মৌলিক প্রশ্ন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে দেখা গেল ব্রহ্মাস্ত্র ধারণে অক্ষম দুর্বল মানুষ অশ্বথামার হাতে অস্ত্রের প্রয়োগে পৃথিবী ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলে। স্নেহান্ধ পিতা অযোগ্য পুত্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন অস্ত্র। কিন্তু সে জানে না কীভাবে সংবরণ করা যায়। “ভারত এক খোজ”-এ বেনেগাল সাহেব এক অত্যন্ত বিষাদময় দৃশ্যে প্রতিষ্ঠা করেন সরীসৃপ সদৃশ অশ্বথামাকে।
মেধাবী মনন সৃষ্টি করে চলে নানাম ভোগের সরঞ্জাম। কিন্তু তার ভোক্তা খুব সীমিত কিছু মানুষ। বেশিরভাগ মানুষের দুর্গতি চরমে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা অপ্রতুল। বিশ্বের নানান শ্রেণী। প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব। রঙের ভিত্তিতে নানান মানুষ এবং এক এক রঙের এক এক রকম অধিকার। নানান ধর্ম, জাতি, দেশ। মানুষের সহ্যশক্তি সীমিত। অতএব অন্যকে মারো। আমি বড় ওরা ছোট। হানাহানি দিয়ে শুরু এবং মৃত্যুতে শেষ। এই নিয়ে গড়ে উঠেছে সভ্যতা।
অবশেষে লেলিহান শিখায় শরীর মিশে যায় মাটি, জল, হাওয়া, আকাশে। সনাতন ধর্মচেতনার পঞ্চভূত। সেই চেতনায় আত্মা ন হন্যতে। তাকে হনন করা যায় না। জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যে সীমিত জ্ঞাত সময়ই জীবন। আগে পরের ইতিবৃত্তের উত্তরের খোঁজ চলে ধর্মে, বিজ্ঞানে,দর্শনে। কোথাও উত্তর নেই। সভ্যতার এত আয়োজন কীসের? আমার কথাটি ফুরোল।
ছবি সৌজন্য: Rawpixel
অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কাজের ক্ষেত্র তথ্যপ্রযুক্তি। কিছুদিন স্মার্ট সিটিতে কাজ করেছেন। আড্ডাবাজ মানুষ। বইপড়া আর সিনেমা দেখা নেশা।
Insightful! Buddhidipto lekha .