ওয়ল্ট হুইটম্যান উনবিংশ শতকের অন্যতম সেরা মার্কিন কবিদের একজন, যিনি মানবতাবাদী হিসেবেও সমান বিখ্যাত। বস্তুত, তাঁর বিষয়ে বলতে গেলে, দু’টি কথা না উল্লেখ করলেই নয়। প্রথমত: তাঁকে অনেকেই মুক্তচ্ছন্দের ইংরাজি কবিতার জনক হিসেবে অভিহিত করেন। দ্বিতীয়ত: পাশ্চাত্যের অতিন্দ্রীয়বাদ থেকে বস্তুবাদের রূপান্তরের পথের একজন অগ্রপথিক ছিলেন হুইটম্যান। কবি হিসেবে হুইটম্যান বরাবরই বিতর্কিত। বিশেষত তাঁর Leaves of Grass বইটিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে বারবার। বলা হয়েছে, সেসব কবিতা নাকি অতিরিক্ত কামোদ্দীপক। তাঁর নিজের জীবনও অবশ্য কম বিতর্কিত ছিল না, কারণ উনিশ শতকের অ্যামেরিকাতেও সমপ্রেম-কে খুব একটা উদার দৃষ্টিতে দেখা হত না। আর হুইটম্যান ঘোষিতভাবেই ছিলেন সেই পথের পথিক।
হুইটম্যানের জন্ম ১৮২১ সালের মে মাসে লং আইল্যান্ডে। বাপ-মায়ের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। চার বছর বয়সে তাঁর পরিবার ব্রুকলিনে চলে আসে। এখানেই ওয়ল্ট বেড়ে ওঠেন। প্রথম জীবনে সাংবাদিকতা করেছেন দ্য পেট্রিয়ট, লং আইল্যান্ড স্টার ইত্যাদি পত্রিকায়। পরে ব্রুকলিন ঈগল এবং অরোরা পত্রিকা সম্পাদনাও করেন কিছুদিনের জন্য। ১৮৫৫ সালে, হুইটম্যান স্থির করেন, কবিতা রচনাই হবে তাঁর জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য এবং একটি মহাকাব্য রচনার পরিকল্পনা করেন। Leaves of Grass সেই প্রচেষ্টারই খণ্ডিত ফলশ্রুতি বলা যেতে পারে। নিজের পয়সা খরচ করে ৭৯৫টি কপি নিজেই ছাপিয়ে ফেলেন হুইটম্যান।
যেহেতু উদ্দেশ্য মহাকাব্য রচনা, তাই বইয়ের গোড়ায় নিজের নামোল্লেখ করেননি তিনি। স্যামুয়েল হলেয়ার নামক শিল্পীকে দিয়ে নিজের একটি প্রতিকৃতি আঁকিয়েছিলেন কেবল। পরে কবিতার পাঁচশোতম পংক্তিতে গিয়ে এক জায়গায় নিজের নাম লিখে দেন তিনি। কবিতার অংশ হিসেবে। কিন্তু বই পড়েই বিশিষ্ট মার্কিন প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক ওয়ল্ডো এমারসন হুইটম্যানের ভূয়সী প্রশংসা করেন, তাঁকে চিঠিও লেখেন। ১৮৫৫ থেকে ৬৭-র মধ্যে একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয় এই বইয়ের। প্রতিবারই নতুন কিছু কবিতা সংযোজিত হয়ে। কিন্তু বিশিষ্টদের প্রশংসা সত্ত্বেও যৌনগন্ধী বলে দেগে দেওয়া হয় এই বইটিকে। অশ্লীলতার অভিযোগও ওঠে।
হুইটম্যান ছিলেন আব্রাহাম লিংকনের একনিষ্ঠ সমর্থক। ফলে অ্যামেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হতেই তাতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন তিনি। Beat!Beat!Drums নামে দেশাত্মবোধক কবিতাও এই সময়েই রচনা করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই জড়িয়ে পড়েন যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবামূলক কাজে। আব্রাহামের মৃত্যুতে O Captain!My Captain বলে একটি কবিতাও লিখেছিলেন হুইটম্যান।
১৮৭৩ সালে হুইটম্যান প্রথমবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ভাইয়ের কাছে নিউ জার্সি শহরে এসে থাকতে শুরু করেন তিনি। ১৮৯১ সালে, অর্থাৎ মৃত্যির একবছর আগেও Leaves of Grass-এর একটি সংস্করণ প্রস্তুত করছিলেন তিনি, যার নাম দেন, ডেথবেড এডিশন। আসন্ন মৃত্যুকে যেন চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। চার হাজার ডলার খরচ করে নিজের স্মৃতিসৌধও তৈরি করিয়েছিলেন নিজেই। অবশেষে ১৮৯২ সালের মার্চ মাসে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন হুইটম্যান। অতি ভগ্নস্বাস্থ্যে, বেদনার্ত হৃদয়ে লিখে গিয়েছিলেন শেষ একটি পংক্তি: “I suffer all the time: I have no relief, no escape: it is monotony—monotony—monotony—in pain.”
Leaves of Grass-এর প্রথম কবিতা (মূল)
- One’s-Self I Sing
One’s-self I sing, a simple separate person,
Yet utter the word Democratic, the word En-Masse.
Of physiology from top to toe I sing,
Not physiognomy alone nor brain alone is worthy for the Muse, I say
the Form complete is worthier far,
The Female equally with the Male I sing.
Of Life immense in passion, pulse, and power,
Cheerful, for freest action form’d under the laws divine,
The Modern Man I sing.
(কপিরাইট না থাকায় মূল ইংরাজি কবিতাটি মুদ্রিত হল)
অনূদিত কবিতা
আত্মগত স্বরলিপি
আমার সারল্য ও বিচ্ছিন্নতা ফুঁড়ে আত্মগত স্বরলিপি উৎসারিত হলেও
গণতন্ত্র উচ্চারণে ঐক্যের স্রোতে পাল তুলেছে তরণী।আশরীর গানে ভরে উঠি –
উপলব্ধি করি এ আবেশ, নির্বিকল্প রূপ ও মেধার মাপে তুলনীয় নয়।
আবর্ত সম্পন্ন হয়ে আসে…
নারী ও পুরুষের এযাবৎ ভেদ মুছে এলে
এ জীবন পূর্ণ হয় আবেশে, আবেগে ও আকীর্ণতার উপাচারে-
হে মুক্তির আনন্দ, শাশ্বত নিয়মের কাছে আমায় বাধিত কর
এ আমার আধুনিকতার অন্তরা…
2. As I Ponder’d in Silence
As I ponder’d in silence,
Returning upon my poems, considering, lingering long,
A Phantom arose before me with distrustful aspect,
Terrible in beauty, age, and power,
The genius of poets of old lands,
As to me directing like flame its eyes,
With finger pointing to many immortal songs,
And menacing voice, What singest thou? it said,
Know’st thou not there is but one theme for ever-enduring bards?
And that is the theme of War, the fortune of battles,
The making of perfect soldiers.
Be it so, then I answer’d,
I too haughty Shade also sing war, and a longer and greater one than any,
Waged in my book with varying fortune, with flight, advance
and retreat, victory deferr’d and wavering,
(Yet methinks certain, or as good as certain, at the last,) the
field the world,
For life and death, for the Body and for the eternal Soul,
Lo, I too am come, chanting the chant of battles,
I above all promote brave soldiers.
(কপিরাইট না থাকায় মূল ইংরাজি কবিতাটি মুদ্রিত হল)
অনূদিত কবিতা
নৈঃশব্দের গভীরে এক চিন্তামগ্নতায়
নৈঃশব্দের গভীরে এক চিন্তামগ্নতায়
কবিতার কাছে ফিরে আসি, লীন হয়ে থাকি দীর্ঘস্থায়িত্বে,
আমার সত্তা ফুঁড়ে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিভঙ্গী সহ এক অশরীরী জেগে ওঠে।
সৌন্দর্য, সময় ও অধিকারবোধের ভয়ঙ্কর মাত্রায়
প্রাচীন ভূখন্ডের কোন বিস্মৃত কবিপ্রতিভা দৃকপাতের শিখায় আমায় বিদ্ধ করে,
নির্দেশ করে অবিনশ্বর সঙ্গীতের প্রতি,
ভয় পাইয়ে দেওয়ার মত জিজ্ঞাসায় জানতে চায় – এ কোন সঙ্গীত?
সৃষ্টির উৎস সম্পর্কে আমার সংশয় চির-সহিষ্ণু চারণের সন্ধিৎসায় মিশে যায়,
এভাবেই যুদ্ধের ভবিতব্য নির্ধারিত হয়…সংঘাতের নিয়তি ঘনিয়ে ওঠে
প্রকৃত সৈনিক তৈরীর বিশুদ্ধ প্রক্রিয়ায়।
এমনটাই হওয়ার কথা ছিল ধরে নিয়ে আমার কেবলমাত্র এটুকু বলার ছিল যে-
আমিও তো যুদ্ধেরই গানে সুর মিলিয়েছি, যে যুদ্ধের ধারণা তথাকথিতের চেয়ে মহোত্তর
আমার পৃষ্ঠাজুড়ে বিবর্তিত ভাগ্যরেখার আঁকিবুকি, উড়ানের এগোনো ও পিছিয়ে আসার রশ্মিপথে জয়লাভ দোদুল্যমান ও বিলম্বিত হয়েছে –
(তবু নিশ্চিত ধরে নিতে হয়ই) এ বিশ্বের বিস্তৃত আঙিনা!
জীবন ও মৃত্যুর সীমারেখা পার হয়ে মানব শরীর ছাড়িয়ে প্রবর্ধিত হয়ে ওঠে আত্মার স্বরূপ।
আমার অন্তর থেকেও গুঞ্জরিত হতে থাকে যুদ্ধগীতি,
বীর সেনানীর প্রতি আমার সম্ভ্রম নিরবিচ্ছিন্ন প্রচারিত হতে থাকে…
জন্ম ১৯৭১ সালে কলকাতায়। বর্তমানে রাজ্য সরকারের কর্মচারী। রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প ও কবিতা দুই বাংলার একাধিক ছোট ও বড় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ পায়।
সুন্দর
ভাল লাগল। অনুবাদককে শুভেচ্ছা।