ওয়াজেদ আলি শাহ যে ভারত ইতিহাসের নিছক এক নিঃসঙ্গ সম্রাট নন, তিনি যে কবি, পশুপ্রেমী এবং ভোজনরসিক, সে কথা আজ বাঙালিমাত্রেই জানেন। কারণটা খুবই স্পষ্ট। লখনউয়ে কোম্পানির হাতে গদিচ্যুত হবার পর কলকাতা শহরকেই আপন মনে করে তাঁর সমস্ত তামঝাম তত্ত্বতালাশ নিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। এবং মেটিয়াবুরুজ (গার্ডেনরিচ) অঞ্চলে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর সাধের ‘ছোটি লখনউ’। তার আগে অবশ্য দীর্ঘ সময় (প্রায় বছর দুয়েক) ফোর্ট উইলিয়ামে নজরবন্দি থাকতে হয়েছিল তাঁকে। মেনে নিতে হয়েছিল ব্রিটিশের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে বেঁচে থাকার চূড়ান্ত অবমাননা।

কিন্তু তা বলে ছোটি লখনউয়ের জৌলুস কিছু কম ছিল না! নবাব যে পারতেন না বিলাসব্যসন বৈভব ছাড়া থাকতে। তবে এখানে একদিকে সুবিধে। নবাবের অখণ্ড অবসর। রাজ্যশাসনের মতো গুরুদায়িত্ব নেই। ফলে নবাব কালাতিপাত করতে লাগলেন শেরো শায়েরি, গান, নাটক নিয়ে। এই মুঘল সংস্কৃতির ছায়া ততদিনে বিদায় নিয়েছে রাজধানি দিল্লি থেকে। সেখানে তখন একের পর এক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পালা চলেছে, ১৮৫৮ সালে মহারানির ঘোষণাপত্র দিয়ে যার সূচনা। শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে প্রত্যর্পিত হল সরাসরি রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে। 

Metiabruz Sultankhana
মেটিয়াবুরুজে নবাবের সুলতানখানা

ততদিনে বাংলায় এসে লেগেছে নবজাগরণের ঢেউ। প্রিন্স দ্বারকানাথের পর তাঁর পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের দায়িত্ব, তৈরি করছেন ব্রাহ্ম সমাজ, বিদ্যাসাগর সমাজসংস্কারে ব্রতী হয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স, এশিয়াটিক সোসাইটি, ভারতীয় জাদুঘর। কিন্তু এসব থেকে বহুদূরে থাকতেন নবাব ওয়াজেদ আলি। কোনও আধুনিকীকরণ, পাশ্চাত্য সংস্কার, এমনকী বাংলার গান-কাব্য-নাটক কোনওকিছুই তাঁকে স্পর্শ করেনি। বা তিনি নিজেই করতে দেননি। কলকাতার সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রের কাছে থেকেও বরাবরই নিজের ঘেরাটোপে নিজেকে ভরে রাখতেন। নবাব নিজেই রচনা করে নিতেন নিজের বিনোদনবৃত্ত। 

সুলতানখানায় বহাল ছিল তাঁর পছন্দের ২৪ জন নটনটী। লখনউয়ের খাস মঞ্জিলের ১১ জন শিল্পী ছাড়াও নকিওয়ালিয়াঁ বা ভাঁড়, তামাশাওয়ালিয়াঁ এবং আবৃত্তিকার মারসিয়া দলদেরও ডেকে নেওয়া হত নাচ-গান-নাটকের প্রয়োজনে। তাতে অভিনেতার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ২১৬। গাইয়ে বাজিয়ে সংখ্যায় ১৪৫। তাঁদের মাসিক মাইনে বাবদ খরচ হত ১৩০০ পাউন্ড। এভাবেই নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে, লখনউয়ের কাইজারবাগের সেই মুঘল সাংস্কৃতিক আবহ রচনা করে তুলতে জলের মতো টাকা খরচ করেছেন ওয়াজেদ আলি শাহ। সামান্য দূরের কলকাতা কিছুই খবর রাখত না ওঁর এই জীবনধারার, উল্টে তিনিও এমন এক ঘোরের মধ্যে ছিলেন যেন তিনি রয়েছেন লখনউতেই।

ওয়াজেদ আলি শাহের দিন কাটত কবিতা ও নাটক রচনায়, আর রাত কাটত গানবাজনার মজলিশে। কেউ কেউ তাঁকে হিন্দুস্তানি থিয়েটারের প্রথম নাট্যকার বলেও বর্ণনা করেছেন। বস্তুত, ওয়াজেদ আলি শাহ উর্দু ভাষায় এক বিশেষ ধরনের নাটকের প্রচলন করেন, যাঁকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘রহস’। এটা অনেকটা অপেরা ধরনের। নিজে মুসলমান হলে কী হবে, নাটকের মূল চরিত্রে লিখেছিলেন রাধাকৃষ্ণের প্রেমগাথা। গানে গানে ব্রজের মাঠেবনে রাধাকৃষ্ণের রাসলীলার স্বরূপ ফুটিয়ে তুলতেন কবি ওয়াজেদ আলি। নাম দিয়েছিলেন, ‘রাধা কানবাইয়া কা কিসসা’। মেটিয়াবুরুজে থাকাকালীন নাকি অন্ততপক্ষে তেইশবার এই নাটিকা অভিনীত হয়েছিল। আর শুধু তো গান নয়, ‘রহস’-এর আসল সৌন্দর্য্য ছিল তার অপরূপ নৃত্যকলায় যা নাকি স্বয়ং ওয়াজেদ আলি তৈরি করতেন। অর্থাৎ সেদিক থেকে দেখলে তাঁকে ভারতের প্রথম ‘নবাব কোরিওগ্রাফার’ আখ্যা দেওয়া যেতেই পারে। 

Sibtainabad Imambara
মেটিয়াবুরুজে নবাবের নাচঘর

কত্থক নাচকে তিনি সমৃদ্ধির এক চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। নাচ সম্পর্কে ওয়াজেদ আলি শাহের আগ্রহের শুরু অবশ্য অনেক আগে। শোনা যায়, তিনি নিজে মহারাজ ঠাকুরপ্রসাদের কাছে কত্থকের তালিম নিয়েছিলেন। মেটিয়াবুরুজে থাকাকালীন, ১৮৭৫ সালে তিনি কত্থক নৃত্যশৈলীর বিশেষত্ব ও আঙ্গিক নিয়ে একটি বই লেখেন। ‘মুসম্মি কি বানি’ নামে সে বই তখনকার দিনে লিথোগ্রাফ করে ছাপা হয়েছিল। আজও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহশালায় সযত্নে রক্ষিত রয়েছে সে বইয়ের পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত কপি। সে বইয়ে নবাব স্পষ্ট লিখেছেন, নাচের ক্ষেত্রে ধর্ম কোনওদিনই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। লখনউয়ের মুসলমান নর্তক-নর্তকীদের হাতে কত্থক সংস্কৃতি যে বিপুল উচ্চাঙ্গে বিস্তারলাভ করেছিল, সে কথাও ওই বইতে পাওয়া যায়। 

তবে একটি বিষয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতেই, ১৮৬৭ সালে দোলযাত্রার সময় নবাব স্বয়ং রাধা বেশে নৃত্য পরিবেশন করেন এবং ঠুমরি গেয়ে শোনান। যদিও আবদুল হালিম ‘শরর’-সহ অনেকেই এ কথা মানতে নারাজ।

তবে ঠুমরি যে ওয়াজেদ আলি শাহের বিশেষ পছন্দের ছিল, তার প্রমাণ বহু বইতেই পাওয়া যায়। নবাবের দাক্ষিণ্যে মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল ঠুমরিচর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সেকালের মহাপণ্ডিত সঙ্গীতরসিকেরা তাঁর দরবারে আসতেন ঠুমরি শুনতে। পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়ি থেকে সঙ্গীতবোদ্ধা রাজা সৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুর আসতেন নবাববাড়িতে ঠুমরির টানে। থাকতেন যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তীর মতো সুপণ্ডিতও। নবাব নিজে ঠুমরি রচনা করেছেন অনেক, যার মধ্যে একটি অতিপরিচিত ‘যব ছোড় চলে লখনউ নগরী / তব হাল আদম পর কেয়া গুজরি…’ যে গান ভেঙে পরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘কতকাল রবে বল ভারত রে / শুধু ডালভাত জল পথ্য করে…।’

Shatranj Ke Khiladi Scene
সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ ছবিতে ওয়াজেদ আলি শাহের ভূমিকায় অভিনেতা আমজাদ খান

শুধু কি গান? গানের সঙ্গতে নানা বাদ্যযন্ত্রে পরিপূর্ণ ছিল মেটিয়াবুরুজের সুলতানখানা। নবাব নিজে অনেক যন্ত্র বাজাতে পারতেন। তাঁর ‘তারিখ-ই-পরিখানা’ গ্রন্থে নবাব লিখেছেন তিনি সেকালের বিখ্যাত সেতার শিল্পী কুতুব আলি খানের কাছে সেতার শেখেন। মেটিয়াবুরুজে রবাব এবং সুরশৃঙ্গার বাজানোর জন্য ডাক পড়েছিল সেনিয়া ঘরানার নামজাদা উস্তাদ বসত খানের। পরে নবাব নিজেই এই যন্ত্রগুলি বাজাতে শেখেন। পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়ির সঙ্গীতসভায় সভাগায়ক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রখ্যাত পণ্ডিত ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। তাঁরই ছাত্র ছিলেন কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়। সেতার, সুরবাহার ও ন্যাসতরঙ্গ বাজনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। তাঁকেও ওয়াজেদ আলি শাহ আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন দরবারে।  এই দরবারেই নাকি উস্তাদ নিয়ামতুল্লা খান আধুনিক সরোদ সৃষ্টি করেন। এগারো বছর তিনি মেটিয়াবুরুজেই ছিলেন। এছাড়া তবলা, সানাই, এস্রাজ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র নিয়েও খুব উৎসাহী ছিলেন নবাব। নতুন নতুন বাজনায় নতুন নতুন আঙ্গিকে সুরসৃষ্টি তাঁকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাত।

এহেন সংস্কৃতিপ্রেমী নবাব ব্যক্তিগত জীবনে অত্যধিক রমণীবিলাসে অভ্যস্ত ছিলেন। লখনইতে তাঁর বিশাল হারেমে অসংখ্য সঙ্গিনী তো ছিলেনই, কলকাতায় এসেও একের পর এক নিকাহ করেছেন নবাব। লখনউ ছেড়ে আসার সময় তাঁর অসংখ্য বেগমের একটা বড় অংশ নবাবের সঙ্গে কলকাতা পাড়ি দেন। পরেও চলে আসেন অনেকে, জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩৭৫। গার্ডেনরিচের দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের সদর দফতরের কাছে বি.এন. আর হাউসকেই নবাবের থাকার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল। তাকে বলা হত পরিখানা। নিজের সুবিধেমতো সেই বাড়িকেই সুলতানখানা, আসাদ মনজিল, মুরাসা মনজিল নামে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। 

Wajid Ali Shah Grave
মেটিয়াবুরুজে ওয়াজেদ আলি শাহের সমাধি

লখনউয়ের স্থাপত্যরীতি মেনেই তৈরি করা হয় নানা কামরা। সেখানে লোকসংখ্যা প্রায় সাত হাজার। এদিকে মাসোহারা মোটে এক লক্ষ টাকা। ফলে নবাবের ধারকর্জেরও কোনও সীমা নেই। কিন্তু তা বলে ব্যক্তিগত নারীসুখে নিজেকে কখনও বঞ্চিত করেননি ওয়াজেদ আলি। ১৮৫৯ সালে ফোর্ট উইলিয়ামের কারাগার থেকে মুক্তি পাবার আনন্দে একই দিনে তিনটি নিকাহ করেন নবাব।

১৮৮৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন ওয়াজেদ আলি। তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার বুকে মুঘল সংস্কৃতিচর্চা চিরতরে হারিয়ে যায়। থেকে যায় শুধু সেইসব শূন্য প্রাসাদ, নর্তকীদের নূপুরনিক্কণ আর রবাবের সুর হাওয়ায় ভাসিয়ে।

*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Scroll.in, Jiyobangla
*তথ্যঋণ: আনন্দবাজার পত্রিকা
প্রতাপশালী নবাবের নির্বাসনকথন – ফাহিম আহমেদ ফাহিম
মেটিয়াবুরুজের নবাব – শ্রীপান্থ

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *