দিগন্তে ডিমার মিলন কালজানির সঙ্গে। তারপর দীর্ঘপথে সহবাস। তিস্তা আর রঙ্গিতের মতোই প্রেমকাহিনি। তবে ডিমা-কালজানির মিলনগাথা কোথাও লেখা হয়নি। এই দুই নদীর ভাব-ভালোবাসার সঙ্গে পরিচয় ছিল শিবচরণ রাভার। গাঁও বুড়ো। রাভা সমাজে পদমর্যাদায় মণ্ডল। উত্তরবঙ্গে মুখিয়াও বলে। বয়স জানতে চাইলে গাছের সঙ্গে তাঁর বেড়ে ওঠা বোঝাতেন। বলতেন “১৯৩০ সালে যখন এই প্ল্যানটেশন হয়, তখন আমার জন্ম।” প্ল্যানটেশন মানে শাল, সেগুন, শিশু, শিরিষ। বনভূমি। ব্রিটিশ জমানায় পরিকল্পিত বনসৃজনের যুগে কার্যত বেগার শ্রমিক ছিলেন শিবচরণের বাবা। তাঁর মতো আরও অনেকের রক্ত, ঘামে বন গড়ে উঠেছিল। পোরো জঙ্গল। বর্তমান বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের একখণ্ড বনভূমি। তার দুই ভাগ। সভ্যতার প্রয়োজনে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক বিভাজন করেছে জঙ্গলের। উত্তর পোরো, দক্ষিণ পোরো।
ভাগ হয়েছে মানুষগুলিও। তবে ধর্মে, জাতে, সম্প্রদায়ে, বিশ্বাসে নয়। আলাদা হয়েছে কেবল বসত। দুই আলাদা বনবস্তি। উত্তরবঙ্গের বনভূগোলের এ এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য। জঙ্গল ঘেরা বিচ্ছিন্ন কিছু দ্বীপের মতো জনপদ। সেখানে বসত করে কয় জনা। বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্ক নেই। গঙ্গা-মহানন্দা-তিস্তা পেরিয়ে এই দেশে বাংলা পৌঁছয়নি। ভিন্ন এক সংস্কৃতি ডানা মেলেছে পোরো, জয়ন্তী, বালা, রায়ডাক, সংকোশ নদীর পাড়ে।
তবে বনবস্তির এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলিতে আবার একই সংস্কৃতির পবন বয় না। পোরোতে শুধুই রাভা ভাষা, রাভা সংস্কৃতি। হান্দাবারু নাচের উত্তরাধিকার। যুদ্ধের রূপক এই নাচে। জাকোই দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরার নাচ নাক চেংরানি। জাকোই হল বাঁশের তৈরি মাছ ধরার সরঞ্জাম। পাহাড়ি নদীতে কিংবা ঝোরায় জল ছেঁচে মাছ ধরে রাভা মহিলারা। তার হাতিয়ার। ওঁদের পরনে থাকে লুফং-কাম্বাং। আপার ও লোয়ার গারমেন্ট। হাতে তৈরি। নিজেদের চরকায় সুতো বুনে নিজেদের আদিম তাঁতে তৈরি হয় রাভা পোশাক। ঝকঝকে পোশাকে আদিমতার ছোয়া।
এই উত্তর পোরোর গাঁও বুড়ো ছিলেন শিবচরণ রাভা। হ্যাঁ, রাভা জনজাতি নিজেদের পদবি রাভাই লেখে। যেমন ওরাওঁ, মুণ্ডা, নাগেশিয়ারা। কালজানি, ডিমার জলে পা ভিজিয়ে শিবচরণ ফোসকাডাঙা, বারোকোদালি হয়ে যখন বাড়ির পথ ধরতেন, আকাশ তাঁর সঙ্গে কথা বলত। পাখিরা তাঁর সঙ্গে ভেসে বেড়াত যেন। শিবচরণ প্রকৃতির কথা বুঝতে পারতেন। সেই কবে লালন ফকির গেয়েছেন, লালন কী জাত সংসারে? নির্দ্বিধায় শিবচরণও হয়তো অস্ফুটে গাইতেন! অন্তত তিন দশক আগে এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুরে ডিমা, কালজানি পেরিয়ে উত্তর পোরোর দিকে ছুটে চলার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার এক আদিবাসী বিষয়ক গবেষক বন্ধু কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে।
“ও শিবচরণবাবু, ও শিবচরণবাবু।” থমকে যায় শিবচরণের চরণ। এ তল্লাটে তো তাঁকে বাবু সম্বোধন করার তো কেউ নেই! আপনি বলে সম্মান দেখায় মাত্র হাতে গোনা কজন। বাঙালি মাত্রই তাঁর কাছে স্যর। চিনতে পেরে কৃষ্ণপ্রিয়র সামনে দাঁড়ান শিবচরণ। “হ্যাঁ, স্যর বলেন।” মুখে অমলিন হাসি। বন্ধুর প্রশ্নের জবাবে অকপট শিবচরণ। কলকাতায় গিয়েছিলেন বালক ব্রহ্মচারীর আশ্রমে। বালক ব্রহ্মচারী তখন জীবিত। তাঁর মন্ত্র ‘রাম নারায়ণ রাম’ ধ্বনিতে তখন বাংলা মুখরিত। সেই নামে কি আলোড়িত রাভা বনগ্রামও? মোটেও না। সন্তান দলের কেউ বা কারা দল ভারী করার জন্য শিবচরণকে টোপ দিয়েছিল। বিনামূল্যে কলকাতা ঘোরার সুযোগ। শিবচরণও একটি ঝোলা ব্যাগ কাঁধে সুখচর ঘুরে এলেন।
শিবচরণের কাছে ধর্মের ছুৎ-অচ্ছ্যুৎ নেই। রাভা জনজাতি নিরীশ্বরবাদী। প্রকৃতির উপাসক। শিবচরণ দু’বার খ্রিস্টান হয়েছিলেন। কেন? শিবচরণের মুখে শুনুন। “মিশন থেকে একবিঘা জমি দিল। একবার কিছু টাকাও দিল।” মাঝে কিছুদিন পোরো গ্রামের পাশে প্রচলিত এক ধর্ম ‘জনযোগী’-তেও মজেছিলেন শিবচরণ। পোশাক পাল্টানোর মতো ধর্ম পাল্টাতে উত্তরবঙ্গের এই সহজ, সরল উপজাতিদের কোনও সমস্যা হয় না। গরিবের ধর্ম নিয়ে এত ছুঁৎমার্গ থাকলে চলে না। শিবচরণের ছিল না। ছিল না তিলেশ্বর রাভারও। তিলেশ্বরও গাঁও বুড়ো। তবে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের দক্ষিণে দক্ষিণ পোরো বনবস্তির।
তিলেশ্বর গুণী শিল্পী। গান-বাজনায় মেতে থাকতেন। তাঁর নাচের দল ছিল। মঞ্চে উঠে রাভা মেয়েরা নাচত তাঁর তত্ত্বাবধানে। তিনি বাঁশি বাজাতেন। বাম আমলে তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের নানা কমিটির সদস্যও হয়েছিলেন। সেই তিলেশ্বরকে শেষের দিকে গ্রাস করেছিল অবসাদ। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে পোরো নদী। তিনি আর পোরো নদীতে যেতেন না। যেতে মন চাইত না। তিলেশ্বরবাবু শুধু আক্ষেপ করতেন, “সেই নদী আর নেই। নদীর যৌবন নেই। নদী মরে গিয়েছে। এই নদী আর দেখা যায় না।” শুধু কি পোরো? উত্তরবঙ্গে আরও কতশত নদী মজে হেজে যাচ্ছে। মানুষের প্রয়োজনে মেরে ফেলা হচ্ছে। সভ্যতার বিকাশের নামে, উন্নয়নের অজুহাতে পোরো, মুজনাই, নোনাই শুকিয়ে যাচ্ছে।
যেমন শুকিয়ে গিয়েছে রাভা গ্রামের আদি সংস্কৃতি। এখন পর্যটন কেন্দ্রে নেচে নেচে মনোরঞ্জন করেন রাভা মেয়েরা। কোথাও সেই কাজ করেন ওরাওঁ, মুণ্ডা মেয়েরা। কোথাও নেপালিরা। মেয়েদের কিছু রোজগার হয়। কিন্তু সংস্কৃতির আদিমতা উবে যায় পোরো, শিলটং বনবস্তি থেকে। কোথায় চাঁদের আলোয় জঙ্গল ঘেরা গ্রামে নাচ-গানের মাদকতা? নাচ-গান এখন পর্যটকদের দেখানোর জন্য। তাঁদের আবদার রাখতে। নাচের ছবি তুলে নিয়ে গিয়ে পর্যটকরা বেচেও দেন। রাভা মহল্লার নাচও ক্রমে পণ্য। গাছের সঙ্গে বেড়ে উঠেছিলেন শিবচরণরা। প্রকৃতির সঙ্গে অনাবিল বন্ধুতা। দিনভর শাল, সেগুনের ছাওয়ায় খেলা। গাছে চড়ে কাঁঠাল খাওয়া। গাছের ঝরে যাওয়া ডাল, পাতায় জ্বালানি, রান্নাবান্না, ঘরকন্যা। শিবচরণদের সেই সব দিন গিয়াছে চলিয়া।
উত্তর পোরোয় জঙ্গল কেটে সাফ হয় রোজ। শহুরে মহাজনদের দেওয়া যৎসামান্য পারিশ্রমিকের লোভে গাছে কুড়ুল চালায় গ্রামের রাভা যুবকরা। জীবদ্দশায় বুকেই যেন কুড়ুলের কোপ পড়ত শিবচরণ, তিলেশ্বরদের। নিজের চোখেই দেখা, চলৎশক্তি থাকা অবস্থায় রাতের অন্ধকারে শিববুড়ো, লণ্ঠন জ্বেলে জাতীয় সড়কের ধারে গাছে চড়ে বসতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, তিনি পাহারায় থাকলে আর কেউ গাছ পাচারের সাহস পাবে না। চোখের শক্তি কমে আসা শিবচরণের সামনে দিয়েই কাঠ পাচার করত তাঁর উত্তর প্রজন্ম। অথচ সামনে পড়ে গেলেও হাতি তাঁকে কোনও দিন ছুঁয়েই দেখত না। পাশ কাটিয়ে চলে যেত। এই জঙ্গলে শিবচরণদের সমান ভাগীদার ভাবে হাতিরাও।
কেউ মনে করতেই পারেন, এ আবার কেমন প্রতিবেদন? এ তো গল্প ফেঁদে বসেছি।
আসলে এই গল্পেই যে উত্তরবঙ্গের অতীত, আপন খেয়াল, বৈশিষ্ট্য, চরিত্র, সারল্য, মেজাজ। এসব কি শুধু বেড়াতে এলে জানা যায়? মূর্তি নদীর ধারে কিংবা রায়মাটাংয়ে হাত বাড়ালে পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে অপার বিস্ময়ে প্রকৃতিকে দেখে “আহা কী সুন্দর” বলে রোমাঞ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু উত্তরের এই আকাশ-বাতাস, ধানখেত, জঙ্গল, বনবস্তি, উপজাতি জীবনে লুকিয়ে থাকা অন্য পৃথিবীর সন্ধান তাতে মেলে না। অথচ এ এক আশ্চর্য জগৎ! প্রথা, রীতির বাইরে অন্য পৃথিবী, যার পরতে পরতে নানা রং। এই প্রতিবেদন সেই রংয়ের হদিস দেওয়ার জন্যই। না, শুধু রাভাদের কথা বলার জন্য নয়, শুধু উপজাতি মহিলাদের দেহসৌষ্ঠব বর্ণনা করার জন্য নয়, শুধু নদী শুকিয়ে যাওয়ার আক্ষেপ শোনানোর জন্য নয়।
এই কাহিনিতে আরও থাকবে নদীর আদিম গল্প। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের এই ভিন্ন পৃথিবীর রং, রূপ, রস, গন্ধ। সংকোশ থেকে তিস্তা নদীর মধ্যিখানে ডুয়ার্স। সংকোশ যেন ভৌগোলিক ভাবেই ভাগ করে রেখেছে অসম আর বাংলাকে। সংকোশের গল্পে আছে ঐক্যের সুর। সেই কবে ভূপেন হাজারিকা গেয়েছেন, “একই পাখি গান গায় আসামে আর বাংলায়।” তিস্তায় আছে ধ্বংস, আছে সৃষ্টিও। প্রেম শেখায় তিস্তা। তিস্তা থেকে নেপাল সীমান্তের মেচি নদীর মধ্যিখানে তরাই। এই তরাইয়ের আর এক রূপ। এখানে দেখা মেলে ধীমল উপজাতির। ওরা ভাষা হারিয়েছে। হারিয়েছে তপশিলি উপজাতির স্বীকৃতিও। সময়ের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা ধীমলরাও এই কাহিনির চরিত্র। উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ তাই প্রকৃতি, পরিবেশের পাশাপাশি এক আদি-সাংস্কৃতিক পর্যটনও বটে।
পরবর্তী পর্ব ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
কর্মসূত্রে কলকাতায় দীর্ঘদিন বসবাসের পর থিতু শিলিগুড়ি শহরে। নিজেকে ডুয়ার্সের সন্তান বলতে ভালোবাসেন। গ্রামের আদি বাড়ির একপাশে বোড়ো আদিবাসী বসত, অন্যপাশে সাঁওতাল মহল্লা। বক্সার রায়ডাক জঙ্গল গ্রামের কাছেই। শৈশব, কৈশোরে বাড়ির উঠোনে চলে আসতে দেখেছেন হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ। জঙ্গলে কুল কুড়োতে কুড়োতে আর নদীতে ঝাঁপিয়ে বড় হওয়া। প্রকৃতি আর উপজাতিরাই প্রতিবেশী। যৌবনে এই পরিবেশে কিছুকাল বাউন্ডুলে জীবনের পর সিদ্ধান্ত, সাংবাদিকতা ছাড়া আর কোন কাজ নয়।
এ এক অন্য গল্প। মনকে পড়া শেষ হওয়ার পরেও মায়ায় ভরিয়ে রাখে।
অনবদ্য । শিহরিত । এক ঝলকে নিজেকে ফিরে দেখা । জন ও প্রকৃতির অকৃত্রিমতা , যেন দূষণ মুক্ত অক্সিজেন । অভিনন্দন । চালিয়ে যান ।এই নগন্যকে গন্য করার জন্য ধন্যবাদ ।