হাওড়ার পরে যে বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম, সেটিও ছিল একটি মস্ত জমিদারবাড়ি লাগোয়া দোতলা একচিলতে কাছারিবাড়ি। বাড়িওয়ালাদের পদবী চট্টোপাধ্যায়– মূল বাড়িটার বয়স নাকি দুশো বছর। নাতিবৃহৎ সদরদরজা, তারপর টানা রোয়াক। বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সেখানে ‘চুকিত্ কিত্’, ‘কুমিরডাঙা’ খেলতাম। সবথেকে মজার ছিল পুরনো ওই বাড়ির আনাচেকানাচে, থামের আড়ালে, প্রাচীন আসবাবের আবডালে লুকোচুরি খেলা। জমিদারি আর নেই, বোলবোলাও অন্তর্হিত। বনেদিয়ানা ধরা পড়ত পরিবারের সদস্যদের চেহারায়, ভদ্র, বিনয়ী ব্যবহারে আর কর্তাদের নামে।
সবাই প্রায় গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী আর বাড়ির পুরষদের নামের পর যুক্ত ছিল ‘প্রসাদ’– শিবপ্রসাদ, দেবীপ্রসাদ, চণ্ডিকাপ্রসাদ, কালিকাপ্রসাদ, তারিণীপ্রসাদ। আমাদের অপরিমিত প্রশ্রয় দিতেন বাড়ির ছোটভাই গঙ্গাপ্রসাদ– আমি ডাকতাম গঙ্গাকাকু। ওই পরিবার তখনও ছিল একান্নবর্তী। শব্দটা ‘বড়মা’ অর্থাৎ ‘প্রসাদ’ ভাইদের মায়ের মুখে খুব শুনতাম। পরিবারের সদস্যদের সংখ্যা আঙুলের কড়ে বারবার গুনেও ‘একান্ন’ কিছুতেই হত না। ছোটবেলায় এটা একটা সমস্যা ছিল। যেখানেই শুনতাম ‘ওরা একান্নবর্তী পরিবার’– গুনতে লেগে যেতাম। যথারীতি একান্ন হত না, তখন ভাবতাম বড়রা যে কতো ভুল কথা বলে! সন্ধিবিচ্ছেদ শিখতে তখনও কয়েকবছর বাকি।

যাই হোক, চাটুজ্জেদের ফর্সা ফর্সা লম্বা সুন্দর ছেলেমেয়েদের মধ্যে শ্যামলবরণ বেঁটেখাটো কন্যাটি হয়ে দিব্যি মিলেমিশে থাকতাম। বিশাল সেই সংসারের হেঁসেলের পুরো দায়িত্ব সামলাতেন যমুনাদি আর রাধাদি নামে দুই মধ্যবয়সী বিধবা। তাঁদের এতটাই দাপট ছিল, যে এঁরা যে এককালে দাসী ছিলেন, তা বাড়ির লোকের স্মরণে থাকত বলে মনে হয় না। ওঁদের সাহায্য করার জন্য জনা দুয়েক ভৃত্য ছিল। পুজো আর হত না ওই বাড়িতে, কিন্তু বিজয়াদশমীর দিন সিদ্ধির শরবৎ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আমরা বালখিল্যরাও এক চামচ করে পেতাম।
গঙ্গাকাকু বলতেন, যমুনাদির সিদ্ধির শরবৎ বানাবার হাত এত চোস্ত যে খবর পেলে কৈলাস থেকে বাবা ভোলানাথ এসে যমুনাদিকে নিয়ে যাবেন। বড়মা একমাত্র তাঁর সুউচ্চ গলায় ‘যমুনা’, ‘রাধা’ বলে ওই জুড়িকে নাম ধরে ডাকতেন। বাকি সবার কাছে তাঁরা সর্বজনীন দিদি। সিদ্ধির শরবৎ ছাড়াও বিজয়াদশমীর দিন বিশাল কড়ায় করে দারুণ মুখরোচক ঘুঘনি বানানো হত, সঙ্গে থাকত বাড়িতে বানানো জিবেগজা আর শ্রীদূর্গা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বিখ্যাত রসগোল্লা আর বোঁদে।
ওই বাড়ির অলিখিত নিয়মে বাড়ির বৌয়েরা রান্নাঘরে প্রায় পা দিতেন না। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষাশেষি ও ষাটের দশকের গোড়ায় চাটুজ্জেবাড়িতে আমি নিয়মিত বিকেলে নাপতেনী আসতে দেখেছি। দোতলায় লাল সিমেন্টের পালিশ করা মেঝের দালানে বাড়ির মেয়ে বৌয়েরা পা ছড়িয়ে বসতেন, তাঁদের পা ঝামা দিয়ে ঘষে আলতা পরানো হত। নাপতেনী দিন, বার, তিথি এইসব বুঝেশুনে নরুণ দিয়ে নখ কেটে দিত। ওঁদের কাছেই শিখেছিলাম যে বিকেলের গা ধোয়াকে ভদ্র ভাষায় ‘কাপড় কাচা’ বলতে হয়। ‘চুল টুল বেঁধে কাপড় কেচে এলুম’ মানে আসলে চুল বেঁধে গা ধুয়ে এলাম। কোথাও একটুকরো উনিশ শতক ঢুকে থাকত ওই বাড়িতে।
বাড়ির কর্ত্রী ছিলেন বড়মা, সকলেই তাঁকে খুব মান্য করত। অত বয়সেও টুকটুকে পাকা আমটির মতো চেহারা ছিল তাঁর। মাথার চুল কদমছাঁট, ধবধবে সাদা থান পরা। মাঝে মাঝে যমুনাদিকে সঙ্গে নিয়ে গঙ্গাস্নানে যেতেন। বাড়ির বেশ কাছেই গঙ্গা, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবেন, তাই বড়মা একখানি ঘিয়ে রঙের সিল্কের চাদর গায়ে চড়াতেন। বামুনের ঘরের নিষ্ঠাবতী বিধবা তিনি– একবেলা স্বপাক খেতেন। পুজোআচ্চা সেরে রাঁধতে খেতে বেলা হত। তাঁর খাবার সময় নাতিনাতনিরা কেউ তাঁর ঘরে ঢুকত না। খাবার সময় তাঁর কথা বলা বারণ। তবে বিকেল থেকে বড়মার আর কাজ নেই– তিনি কুরুশে লেস বুনতেন, আমাদের ডেকে গল্পগাছা করতেন। মাঝেমাঝে বাড়ির বৃদ্ধ সরকারমশাইকে ডেকে হিসেবের খাতা দেখতেন। আবার একখানি কালো মোটা ডায়েরি খুলে কীসব লিখতেন। আমার মা বলত, বড়মা নাকি কবিতা লেখেন, মাকে একবার পড়ে শুনিয়েছিলেন। আমাদের অবশ্য তিনি বালখিল্যবোধে পাঠক বিবেচনা করেননি।

বড়মা ছিলেন একাহারী, রাতে শুধু দুধ সন্দেশ খেতেন। রোজ তাঁর একটি নিয়মিত কাজ ছিল, ছেলেদের রাতের খাবার সময় একটি জলচৌকি নিয়ে সামনে বসা। ওই সময় সব ভাই একসঙ্গে দালানে পরপর পাতা পিঁড়িতে বসে নৈশাহার সারতেন। দিনের বেলা সকলেরই চাকরির তাড়া, রাতেই পারিবারিক গল্পগুজবের আসর বসত। চাটুজ্জে পরিবারে রাতে মাছ মাংস ডিম খাবার চল ছিল না। ওঁরা রুটি ভাজাভুজি, ডাল, তরকারি এবং শেষপাতে কাঁসার বড়ো জামবাটি ভর্তি দুধ দিয়ে খাওয়া সারতেন। আমাদের বাড়ির ভেতরের ঢাকা বারান্দার জানালায় বসে ওই দালান সামনেই দেখা যেত। নিরামিষ বলেই ছোঁয়ানেপার ভয় নেই, বড়মা নিশ্চিন্তে জলচৌকিতে বসে ছেলেদের সঙ্গে গল্প করতেন। যমুনাদি আর রাধাদি পরিবেশন করত। দৃশ্যটা প্রায় সিনেমার মতো।

একদিন বিকেলে ও বাড়ির মেয়ে, আমার প্রাণের বন্ধু শীলা বলল, ‘জানিস তো যমুনাদি আর রাধাদি আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, বড়মা ওদের খুব বকেছেন।’ বিস্তারিত শীলা আর তার ছোটবোন ইলার কাছেই জানা গেল। রাতে খেতে বসে গঙ্গাকাকু নাকি বলেছেন,
‘আলুপটলের আজ তেইশ দিন হল।’
তাতে ন’কাকু কালিকাপ্রসাদ যোগ করেছেন,
‘বাজারে কি আর কোনও সবজি পাওয়া যায় না?’
তারিণীকাকু বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। বড়মার মুখ নাকি সিঁদুরের মতো লাল হয়ে গিয়েছিল। যমুনাদি আর রাধাদি যে প্রায় একমাস ধরে আলু পটল ছাড়া রাতে কিছু রাঁধছেন না, সে খবর তিনি রাখতেন না। ছেলেরা উঠে যাবার পর ওঁদের তিনি খুব বকেছেন। কী বলেছেন সেসব শীলারা জানে না, তবে যমুনাদি কাঁদতে কাঁদতে শীলার মা সুমিত্রা কাকিমাকে বলেছে, ‘আপনাদের বাড়ির বাস এবার উঠল ন’বৌদি।’ আমরাও চিন্তায় পড়ে গেলাম! ওরা চলে গেলে আমাদের জন্য কাঁচা আমছ্যাঁচা কে বানিয়ে দেবে? চাটুজ্জেবাড়ির পিছনের হাতার দেশি আমগাছ দুটো আমাদের বিরাট আকর্ষণের বস্তু ছিল।
কার্যত ওঁরা কিন্তু কোথাও গেলেন না। সেদিন সন্ধ্যেবেলা দালানে দুটো তোলা উনুনে রান্না বসল। বড়মা যে আঁশ-রান্নাঘরে পা দেন না– তাই এই ব্যবস্থা। রান্না কী হয়েছিল জানি না, আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেল গাওয়া ঘিয়ে লুচি ভাজার সুগন্ধ। বড়মা তেইশ-দিন আলুপটলের ডালনা খাওয়ানোর প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা দরাজ হাতেই করেছিলেন। কিন্তু এ যে শুধু একদিনের ভোজ নয়! প্রায় রোজই দেখতাম যমুনাদি বিশাল এক তাল ময়দা মাখছে, রাধাদি লুচি বেলছে আর তারপরেই সেই পাগল করা সুঘ্রাণ। বড়মা ঠায় দালানের জলচৌকিতে বসা। মস্ত কাঠের বারকোশে লুচি স্তূপীকৃত হয়ে উঠছে। প্রথমে বাড়ির ছোটরা খাবে, তারপর কর্তারা, তারপর বৌয়েরা, শেষে যমুনাদি, রাধাদি আর চাকর দু’জন– বাঁধা নিয়ম।

গাওয়া ঘিয়ের গন্ধের ব্যাপারটা যে সবাইকেই চঞ্চল করেছে, শীঘ্রই বোঝা গেল। আমাদের বাড়িতে শুধু রবিবার সকালে আর অথিতি সমাগমে লুচি হত। এবার আমার বিপত্নীক ঠাকুর্দা, যিনি বাজারহাটের ধার বিশেষ মাড়াতেন না, তিনি বেশ বড়ো সাইজের ‘শ্রীঘৃত’র টিন এনে মাকে ধরিয়ে দিলেন। ইঙ্গিতটি বেশ সুস্পষ্ট। আমাদের বাড়িতেও প্রায় রোজ সংক্রামকভাবে লুচি ভাজা ও খাওয়া শুরু হল। তবে সুকঠোরভাবে শুধু সকাল বা বিকেলের জলখাবারে।
বাঙালবাড়িতে রাতে লুচি তরকারি দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবতে পারত না। ‘দুগা মাছভাত না হইলে আর খাওন কি!’ স্বাস্থ্যসচেতনতা, ডায়েট এইসব নিয়ে মাথা ঘামাতে তখন লোকের বয়ে গেছে। এখন ডাক্তারের পরামর্শমতো কেনা বিস্বাদ সাদা তেলে লুচি ভাজতে গেলে সেই গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ মনে পড়ে। শীলাদের চওড়া দালান পেরিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে বাতাসে ঢেউ তুলে তুলে চলে আসছে।
*ছবি সৌজন্য: Shutterstock, Youtube, Worldartcommunity
চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
Ganwoa-gheete bhaja luchir sugondher mato galpota khub bhalo laglo…
Aro porar ashaye roilam…namoskar
আমাদের এক বড়মা থাকতেন বাগবাজার রাজা রাজবল্লভ স্ট্রীট এ।ওনার জীবন যাত্রার সঙ্গে বেশ মিল খুঁজে পেলাম আপনার বর্নিত বড়মার কথা। ঐ ঝুল বারান্দায় বসে রান্না, একটা অমৃত সম শুকতো, কলাই ডাল আর পোস্ত বড়া।আর ছিল সন্দেশ রসমনজরি র রাত্রি কালীন আহার। ভালো কবিতা আওড়াতেন বড়মা। বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির এর সেবাইত ছিলেন । “”সে সব অতীত আজ কাঁদে নিরালায়””… তাই না , দিদি ??