একটা দূর দেশ ছিল। সে দেশের নাম সন্দেশ। যে কোনও মানুষকেই সে দেশ চুম্বকের মতো টানে। কেউ গেলে আর ফেরত আসার নামই করে না। এদিকে, সেখানে না-আছে সব পেয়েছির জাদু— মুঠোফোন, না-আছে মুহূর্ত শেষ হতে না-হতেই তাতে দেওয়া ছবির মজা। তাহলে এমন কী ছিল সেই দেশে?
এই জানার ইচ্ছেতেই দুই বন্ধু একদিন নৌকোয় করে সেই দেশের দিকে পাড়ি দিল। এক বন্ধুর নাম অজানা। আর একজনের নাম অচেনা। অজানার সাহস একটু বেশি। আর অচেনা একটু দূরদর্শী— তাই দু’জনের বেশ জমত।
একটা লম্বা সাদা দোমড়ানো কাগজের নকশা বের করে তারা ভোরবেলায় ঘাটে পৌঁছল। এক মাঝির সঙ্গে দেখা হল। আলাপ করে জানল, মাঝির নাম কৌতূহল। নাম শুনে অজানা তো লাফ মেরে উঠেই পড়বে তার নৌকোয়। অচেনা তার হাত ধরে বলল– একবার দেখে নিলে হত না, কৌতূহল মাঝি সন্দেশ ঠিকমতো চেনে কিনা? অজানা বলল– চিন্তা নেই, এই কাগজের নকশা দেখে ঠিক পৌঁছে যাব।.
কৌতূহল গান গাইতে গাইতে নৌকো বাইছে। সে এগিয়েই চলেছে… এগিয়েই চলেছে… আর এগিয়েই চলেছে। অচেনা আর পারল না। জিগ্যেস করে বসল– ও কৌতূহল, আর কত দূর? কৌতূহল বলল– যখন আকাশ আর সমুদ্রকে আর আলাদা করা যাবে না, ততদূর। এ দিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। অজানার সূর্যাস্ত ভাল লাগে না। অচেনা আবার উল্টো।সূর্যাস্ত তার মনকে শান্ত করে। কোত্থেকে যে দু’জনে দু’জনকে খুঁজে পেল, কে জানে!
একটা লম্বা সাদা দোমড়ানো কাগজের নকশা বের করে তারা ভোরবেলায় ঘাটে পৌঁছল। এক মাঝির সঙ্গে দেখা হল। আলাপ করে জানল, মাঝির নাম কৌতূহল। নাম শুনে অজানা তো লাফ মেরে উঠেই পড়বে তার নৌকোয়।
অজানা চোখ বুজে বসে। মাথাটা দু’হাঁটুর সঙ্গে ক্রমশ জড়ো হয়ে আসছে। অচেনা পাশে বসে কখনও আস্তে আস্তে ওর চুল টেনে দিচ্ছে। কখনও হাতের পিঠে গোল-গোল নকশা কাটছে। আর বলছে– ওই দ্যাখ, এই তো এসে গেছি!
কৌতূহলের এদিকে থামার কোনও মতলব নেই। শিস দিতে দিতে যতক্ষণ গোধূলির আলো আর ঢাকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ততক্ষণ সে নৌকো বেয়ে চলেছে। অচেনা বুদ্ধি করে এইসময় তাদের কাগজের নকশাটা ব্যাগ থেকে বের করে বলল– ও কৌতূহল, নৌকোটা বাঁদিকে নিলে হয় না!
কৌতূহল বড় জেদি। তবে তার কাছে সেই সময় কথা শোনা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তাই সে দাঁড় বেয়ে নৌকোয় বাঁক নিল। এক সিন থেকে আরেক সিনে যেতে মঞ্চের আলো যেভাবে বদলায়, আস্তে আস্তে গোধূলির আলো সেইভাবে মুছে যেতে যেতে অন্ধকার হয়ে গেল। ঢাকের আওয়াজও কমতে কমতে জলের নীচে তলিয়ে গেল। দূর থেকে একটা ঝাড়লণ্ঠন দিয়ে সাজানো দ্বীপ দেখা গেল। অচেনা আর অজানা আবার সোজা হয়ে বসল।
নৌকো নোঙর ফেলতেই অজানা আগে লাফ মেরে কাদায় নামল। অচেনাকে একটু হাত ধরে নামাতে চাইলে, অচেনা মুচকি হেসে নিজেও লাফ মারল সেই কাদায়। সে এখানে প্রাণ খুলে হাসতে পারে, কারণ সে এখন রাজপুরী থেকে অনেক দূরে। নিশ্বাস নিতে সুবিধে হয় অচেনার এখানে। চোখ কম জ্বালা করে। ছাতাটাও যে নৌকোতেই পড়ে রয়েছে, সেটাও খেয়াল হল না।
সন্দেশ নামের দেশটায় নেমে তারা একটা বিশাল দোকান ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেল না। থাক-থাক কাজু বরফি, পেঁড়া, গুঁজিয়া, কালোজাম, শোনপাপড়ি আরও কত কিছু সাজানো সেখানে। অজানার তো আর কিছুই চাই না। কিন্তু সে ঘুরে তাকিয়ে দেখে, অচেনা ছবি তুলছে মন দিয়ে। তাই তাকে বিরক্ত না করে ওর জন্যে কয়েকটা জিলিপি আর নিজের জন্যে কয়েকটা শোনপাপড়ি নিয়ে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। অচেনা ফিরতেই তারা তড়িঘড়ি গপগপ করে সব খেয়ে ফেলল। অচেনার খিদে পেলে, আর খাবার পছন্দ হলে, খাবার সময় একটাও শব্দ শোনা যায় না। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে– আমার কঅতওটা খিদে পেয়েছিল ভাব তো! অজানার তো সেটা অজানা ছিল না। তাই জলের ঘটিটা ভরে রেখেছিল ওর সামনে। ও যখন সেটা খাচ্ছে, তখন জলের শব্দ পেয়ে নতুন একটা মাঝি এগিয়ে এসে তাড়া দিতে শুরু করল ওদের।
কৌতূহল বড় জেদি। তবে তার কাছে সেই সময় কথা শোনা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তাই সে দাঁড় বেয়ে নৌকোয় বাঁক নিল। এক সিন থেকে আরেক সিনে যেতে মঞ্চের আলো যেভাবে বদলায়, আস্তে আস্তে গোধূলির আলো সেইভাবে মুছে যেতে যেতে অন্ধকার হয়ে গেল। ঢাকের আওয়াজও কমতে কমতে জলের নীচে তলিয়ে গেল।
নতুন মাঝি যে ওদের ফেরত নিয়ে যাবে। তার নাম তাড়াহুড়ো। অচেনা তাকে দেখেই লাফ মেরে উঠল নৌকোয়। অজানা, মনে করে দোকানের দাম মিটিয়ে গিয়ে উঠল নৌকোয়। ভোর হওয়ার আগে বাড়ি পৌঁছতেই হবে।
অচেনার ভোরের আলো একদম পছন্দ নয়। অজানা সেটা জানত। তাই অচেনাকে কায়দা করে গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তাড়াহুড়ো বড্ড জ্বালাতন করছিল নয়তো। অজানার খুব ইচ্ছে করছিল তাড়াহুড়োকে এক ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিয়ে, নিজেই নৌকোটা বেয়ে নিয়ে যায়। অচেনার মুখ দেখে বুঝে নিল, থাক আজ না।
সারারাত অজানা বসে দোতারা বাজিয়ে গান করল। অচেনা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, কারণ তার বিশ্বাস তাড়াহুড়ো তাদের আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির ঘাটে পৌঁছে দেবে। সেখান থেকে তো আর দু’পা। ভোরের আলো অজানা খুব করে শুষে নিল। খুব ইচ্ছে করলেও অচেনাকে জাগাল না। একটু সকাল হতেই অচেনার ঘুম ভাঙল আর তাদের নৌকো ঘাটে এসে ভিড়ল। দু’জনে তাদের জরির চটি পরে ঘাটে নেমে এক-একটা সিঁড়ি ছেড়ে-ছেড়ে উঠে গেল নিজেদের দেশে। পিছনে তাকিয়ে দেখল, কৌতূহল, তাড়াহুড়ো বা তাদের নৌকো কিছুই নেই। অজানা ভুরু কুঁচকোল। অচেনা তার মিষ্টি গজদাঁত বের করে হাসল।
কারণ, এখন ওরা দু’জনেই জানে, সন্দেশ থেকে চাইলেই ফিরে আসা যায়।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে সমাজতত্ত্ব বিভাগে স্নাতকস্তরে পাঠরতা রুচিরা ছবি আঁকার পাশাপাশি, কবিতা ও গদ্য লেখেন। লোকসংগীত এবং নাটক নিয়ে নিয়মিত চর্চা করেন। সম্পাদনা করেছেন ছোটদের আশ্চর্য পত্রিকা ‘এলোমেলো’। শখ ট্রেক করা এবং দোতারা বাজানো।
খামখেয়াল,ছেলেমানুষী, ইচ্ছে, দোলাচল,দ্বন্দ্ব,বোঝাবুঝি র কথা অনায়াসে এত সুন্দর করে লেখা যায়,সেটা না পড়লে বুঝতাম ই না
চমৎকার লেখা। খুবই ভালো।