এক বাগান গাছ মুখে নিয়ে দোতলা বাড়িটা ঘুমোচ্ছে। শেষরাতের ঝিম এখনও ঝুলে আছে বাগানের ঝোপেঝাড়ে, আবছা শিশিরভেজা কাদামাটি, আম বাদাম খিরিশ মহানিম জামরুল গাছেদের আর্দ্র চামড়ার আনাচেকানাচে। কিছুটা কুয়াশার আভাস, যদিও শেষ-চৈত্রের ভোরবেলা ব্যাপারটা বিভ্রমও লাগতে পারে। অথবা, এমনও হতে পারে যে হাবুর খালি পেট তাকে খোয়াব দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কুয়াশা থাকুক, বা রাতভোর জ্যোৎস্নার দুধের সরের মত তলানি, সেটুকু চেঁছেপুঁছে গিলে খেয়ে হাপিশ করে দিতে হাবু একদম রেডি, যেহেতু একবার ঢুকেছে যখন আর ফেরা চলে না। হাবু একহাতে বাগানের গেট খুলে অন্যহাতের আঙুল ঠোঁটের ওপর রেখে টাবুর দিকে ফিরল। ফিসফিস করে বলল, ‘পা টিপে টিপে ভেতরে আয়। কুকুরটা যেন উঠে না পড়ে।’ 

টাবু ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকল। এত ভোরবেলায় এই ভুতুড়ে বাগানে ঢুকতে শিরশিরে লাগছিল, কিন্তু দাদার ওপর কথা চলে না। কাল রাত্রেই কানাওঠা বাটি থেকে জলমুড়ি ভাগ করে খাবার সময়ে ফিসফিস করে পুরো প্ল্যানটা হাবু যখন বলেছিল, নেচে উঠেছিল টাবু। কিন্তু এই ডাক্তারের বাগানে অনেকে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। রাতবিরেতে আবছা কুয়াশার ভেতর কাউকে কাউকে এখন ঝুলতে দেখা যায় নাকি। তার ওপর আছে ব্যান্ডেজ ভূত। সারা গায়ে সাদা ব্যান্ডেজ জড়িয়ে বসে থাকবে। কাছে গেলেই মুখ ফেরাবে, তখন দেখা যাবে মাথাটা নেই, শুধুই ব্যান্ডেজ। তাদের পাড়ার পটল বা ফটিক বহুবার সন্ধের আড্ডায় গল্পগুলো করেছে। টাবুর শরীরটা কেমন করছিল। ভোর থাকতে উঠে এসেছে বাজার যাবার বড় থলিটা জামার ভেতর লুকিয়ে। মনে হল, পেছন ঘুরে ছুটে পালায়। সে হাবুর জামা ধরে টান দিল, ‘দাদা, ফিরে চল’। 

‘ধুর, ফিরে যাব বলে এসেছি নাকি? এই সময়টায় বুড়োটা ঘুমোয়। কুত্তাটাও। কিন্তু গায়ের গন্ধে জেগে উঠবে। বাঁদিক ঘেঁষে চল।’ 

দোতলা বাড়িটা যেন দাঁত খিঁচিয়ে হাসছে। ইট খসে পড়ছে, কার্নিশ ফাটিয়ে বটচারা। কেউ থাকে না। এক ডাক্তারবাবু থাকত, অনেকদিন আগে। হোমিওপ্যাথির বড়ি দিত মিষ্টি মিষ্টি। ভোরবেলা লুঙ্গি পরে বাগানের পুকুরে স্নান করতে সবাই দেখেছে তাকে। মরে যাবার পরে এখনও প্রায়ই দেখে। ডাক্তারবাবুর ছেলেপুলে নাতিরা সব বাইরে থাকে। বছরে একবার আসে কি আসে না। এই বিশাল বাগান আর বাড়ি, সব সামলায় একটা বুড়ো বিহারি দারোয়ান আর তার পোষা বাঘের মত তিন ঠেঙে কুকুর। বুড়োটা হেভি হারামি, বাচ্চারা  ঢুকলেই লাঠি হাতে তেড়ে আসে। এদিকে বাগানের ভেতর বিশাল আমগাছের দল, জামরুল, পেয়ারা, কালোজামের দংগল ভরন্ত পোয়াতি হয়ে যে বৃথাই বয়ে যায়, কে তার খবর রাখে ! কাক শালিখ ভাম ভোঁদড়ের সেবায় লাগে, তবু হাতে করে একটা দেবে না। মোল্লাপাড়ার ছেলেরা দারোয়ানের নাম দিয়েছে যখ। মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলা বুড়োটা হাঁটতে হাঁটতে সোদপুর-কালীতলা অঞ্চলে বাজার করতে আসে, তখন লোকাল বিচ্ছুরা পেছন থেকে চেঁচায় ‘যখবুড়ো’ ‘যখবুড়ো’ বলে। কুকুরটা দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে, বুড়োটাও হাতের ভাঙা ছাতিটা তুলে দেহাতি ভাষায় হুংকার দেয়। আমোদগেঁড়ে বাগান ভরন্ত শরীর বার করে তখন হাসে। 

পা টিপে টিপে বাড়ি পেরিয়ে পেছনের আমবনের দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ টাবু আঁতকে উঠল। জোরে হাবুকে খামচে ধরল, ‘দাদা রে, ভূত !’ 

হাবু চমকে তাকায়, তারও বুকটা কেঁপে ওঠে যেন। হাত পা প্রায় জমে যাচ্ছিল, কিন্তু কয়েকটা মুহূর্ত পরেই সে নিঃশ্বাস ফেলে বড়। ‘ধুর, ওটা তো কাকতাড়ুয়া !’ 

টাবু চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। হাবুর কয়েকবার ধাক্কায় আস্তে আস্তে চোখ মেলে। আধ অন্ধকারের মধ্যে মাথায় কেলে হাঁড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে বাঁশের একটা ভূত। তার মাথায় ছাতা হয়ে মহানিম, সে নিজে যেন বা পুরনো বাকলের গায়ে আলতো হেলান দিয়ে অলস ভোর পোয়াচ্ছে। হাবু গলা নিচু করেই হি হি করে হাসে, ‘হাবা ছেলে ! শুধুমুধু ভয় পায় !’ 

টাবু সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে জায়গাটা পার হয়ে আসল। যদিও দুই বছরের বড় হবার সুবাদে দাদা যাবতীয় খবরদারি তার ওপরেই সারে, তবে এ কথাও ঠিক যে আজকের আসার পেছনে তার নিজের উৎসাহ না থাক তাড়না তো ছিলই। শহরে কার্ফু, বাবা গত পনেরোদিন কাজে যেতে পারেনি, ফলত দিনের বেলায় কোনওমতে এখান ওখান থেকে ধার করে আনা আলুসেদ্ধ ভাত, আর  রাত করে শুধু জলমুড়ি। তাও মায়ের কাছে কাল মুড়িতে চিনি চেয়ে মার খেয়েছে টাবু। গালে মুড়ি লেগেছিল, খুঁজে পেতে বার করে মুখে দেবার সময়ে কেমন নোনতা স্বাদ, চোখের জল মিশে গেছিল মনে হয়। টাবুর একটু একটু মজা লাগছিল চাখতে। তখন দাদা কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘কাল সকালে ডাক্তারের বাগানে যাবি? প্রচুর আম পড়ে থাকে। ব্যাগ ভর্তি করে এনে কালীতলা বাজারে নারাণদার কাছে বিক্রি করলে টাকা দেবে। খুব মিষ্টি হয়, বাগানের আম।’ 

বেড়ালের থাবার মত নির্জনতা যখন এ চরাচরে, নিঃঝুম ভুতুড়ে বাড়ি, বন্ধ কারখানার গেট, মরে যাওয়া চুল্লির আগুন, ভাঙা বাসের কঙ্কাল নিয়ে গোটা অঞ্চল কার্ফুর রাতে লেপমুড়ি। এরকম সময়েই মজলিশ আরা রোডের মসজিদের কবর থেকে জেগে উঠে আসে তারা । সিরিটি শ্মশান, পদ্মপুকুর, ডাক্তারের বিশাল বাগান জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। টাবুর পেটের ভেতর পাক দিয়ে টকজল উঠে আসতে চাইছে। কাল বাদশাদাদাদের বাড়িতে  মাংস রান্না হচ্ছিল। সেই গন্ধটা ওদের পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে সে চেখেছিল অনেকক্ষণ ধরে, প্রেশারের শেষ সিটি পর্যন্ত। এখন যে বমিটা উথালিপাথালি, তার  ডানায় পিত্তি পড়া পাকস্থলীর আঁচড় যতটা, তার থেকেও বেশি মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে সেই না দেখা মাংসের ঝোলের গন্ধ, নলির ভেতরের মজ্জা সুড়ুৎ করে গলার ভেতর চুষে নেবার আনন্দটুকু। পেটটা খামচে ধরে দাদার পেছন পেছন টাবু আমবনের ধারে এসে দাঁড়ায়। 

‘দেখেছিস? কত আম? তাড়াতাড়ি কুড়ো। কিন্তু শুকনো পাতায় পায়ের আওয়াজ যেন না হয়।’ 

টাবু হাঁ করে দেখতে থাকে বাগানটা। কী বিশাল ! কত গাছ, একসঙ্গে জড়ামড়ি করে যেন হিম হিম অন্ধকার তৈরি করেছে। বুনো ঝোপ সাপের গর্ত পেরিয়ে জংগলটার একদম মাঝখানে দাঁড়ালে আকাশ দেখা যায় না। আবার দেখো, মাঝের জায়গাটুকু ঘাস নিড়িয়ে ফাঁকা করেছে, যেন দোলনা টাঙাবে। টাবুর হঠাৎ হাসি পেয়ে যায়। দাদা অনেকটা এগিয়ে গেছে। এখন যদি মগডাল থেকে ঝপ করে ফাঁসির দড়ি বেয়ে ঝুলতে ঝুলতে নক্সাল ভূত দাদার সামনে এসে দাঁত খিঁচোয়, বেশ মজা হবে। একটু আলো ফুটেছে বলে ভয়ের ওমটাও যেন নিভু নিভু। কিন্তু হাবু তখন পেছন ফিরে রাগের গলায় বলে, ‘আচ্ছা হাঁদা ছেলে তো তুই ! এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য এসেছিস? তোকে নিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে।’ 

টাবু তাড়াতাড়ি থলে বার করল। দাদাটা যেন কী! এগারো বছর, উফ সে কী বিশাল বয়েস, এমন ভাবে। টাবুর যখন এগারো হবে, সে-ও দাদার ওপর খবরদারি করবে, আর অনেক অনেক খাবে। সন্ধেবেলায় বাদশাদাদা রুটি আলুভাজা খায়, নাহলে চায়ের সঙ্গে সিঙ্গাড়া। টাবু নানা ছলছুতোয় তখন বাদশাদাদার বাড়ি যায়। কিন্তু হাবু তার মাথায় চাঁটা মেরেছিল, ‘হ্যাংলা কোথাকার! ওরা বোঝে, তুই কেন যাস।’ তারপর ছেলে ভোলাবার স্বরে, যদিও তাতে ভরসা হারাবার নিরাশ তলানিটুকুও পুজোর বাসি সিন্নির চাঁছির মত লেগেছিল, ‘আমরা খাব তো ! লুচি খাব। ডাল দিয়ে তোপসে মাছ কড়কড়ে ভাজা খাব, তেলাপিয়ার ঝাল খাব।’ টাবু মাথা নিচু করে আম কুড়োতে থাকে প্রাণপণে, যাতে টকসানিটুকু বেরিয়ে না যায়। 

দুই ভাই মিলে ব্যাগ প্রায় ভর্তি করে ফেলল। হাবু হি হি করে হাসে, ‘মজা, না? কাল আবার আসব। রোজ কত আম পড়ে থাকে, বল? আমরা বড়লোক হয়ে যাব। একটা স্মার্টফোন কিনব, হ্যাঁ? আমি  আর তুই মিলে। সারুকখানের সিনেমা দেখব।’ 

টাবুও আহ্লাদে হাসতে থাকল। নাক থেকে কাঁচাজল গড়িয়ে পড়ছিল, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে নিল, ‘একটা আম খাব?’ 

‘খালিপেটে খেতে নেই তো ! আচ্ছা, বাইরে বেরিয়ে খাস। এখন জলদি পা চালা।’ 

কিন্তু পা চালাতে গিয়ে হাবু থমকে যায়। দুম করে মনে হয়, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা গুবরে পোকা উঠে যাচ্ছে। একটু দূরে তাদের দিকে মুখ করে বসে সেই তিন-ঠেঙে কুকুর। এক দৃষ্টে দেখছে। কুকুরটার একপাশে খাটিয়া, তার ওপর চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে যখবুড়ো। কুকুরটা একবার ডাকলেই উঠে পড়বে। এতক্ষণ অন্ধকারের মধ্যে তাদের কারওর চোখে পড়েনি, যখবুড়োর ঘরটা এখানেই। 

টাবুও দেখেছিল। সে আচমকা নীরব হয়ে যায়। একটু দূরে কুকুর, আর পেছনে ভয়াল কাকতাড়ুয়া। টাবুর মনে হয়, কাকতাড়ুয়াটা এবার জ্যান্ত হয়ে তেড়ে আসবে। এমনকি ঘাড় ঘোরালেই হয়ত দেখতে পাবে যে কাঁধের ওপর মুখ বাড়িয়েছে। কিন্তু টাবু ঘাড় না ঘুরিয়ে কুকুরটার দিকেই তাকিয়ে থাকে। হাবু টাবুর হাতে চাপ দেয়। ‘নড়িস না।’ 

কুকুরটার হয়ত ঘুম পেয়েছিল, অথবা  ডাকতে চায়নি, আবার এমনটাও হতে পারে যে বাধা দেবার ইচ্ছে তার ছিল না, যেটাই হোক না কেন, সে আবার দুই থাবার ফাঁকে মুখ গুঁজে শুয়ে চোখ বুজল। দুই ভাই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। একটু পরে হাবু হাতের ইশারায় ভাইকে ডাকল। দুজন পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। কুকুর একইরকমভাবে শুয়ে আছে। অথচ আগে আগে কত তেড়ে আসত ! নিঃশ্বাস চেপে এগোতে গিয়ে, হয়ত বা কপাল ভাল ছিল এ যাত্রায়, আর নাক মলছি কান মলছি আসব না, কিন্তু হাবু থমকে দাঁড়ায় আবার। টাবু তার পেছনে ধাক্কা খায়। ‘কী হল?’ 

হাবু হাত তোলে। দারোয়ানটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তার মাথার কাছে রাখা একটা বাটি, ভেতরে কী খাবার আছে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু দুটো আমের চোকলা হাবু দেখতে পাচ্ছে, বাটির পাশে রাখা। কী মনে হল, হাবু পা টিপে টিপে সেদিকে, আর টাবু তার জামা ধরে ভয়ার্ত টান, ‘দাদা !’ হাবু গ্রাহ্য না করে আবার এগোতে লাগল, অগত্যা টাবুকেও। কুকুরটা একবার ডেকে উঠলেই টেনে দৌড় লাগাবে, কিন্তু যেন গভীর ঘুমে। হাবু জানে না, তার কোথা থেকে সাহস বাড়ল এত, কিন্তু একটা অদৃশ্য দড়ি তাকে টানছে। বিহারীদের ঘুম খুব কড়া  হয়, বাবা বলেছিল। বাবাদের কারখানার দুবেজির গায়ের ওপর দিয়ে নাকি মোষ হেঁটে গেলেও টের পাবে না। হাবুর পা ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটার মত ধীর , আর  দূরে কাকতাড়ুয়া নির্জন। 

বাটির ভেতর অনেকটা চিঁড়ে আর দই। দইটা আলাদা করে রাখা। পাশে আমের টুকরো। দারোয়ানটা তাহলে রোজ এই খায় ! হাবুর চোখ চকচক করে উঠল। সে দইয়ের গায়ে আঙুল ছোঁয়াল। ঠাণ্ডা শিশির জমে যেন আইসক্রিম ! যা থাকে কপালে ভেবে খপ করে বাটিটা তুলে টাবুর হাতে দেবার সময়ে দেখল, কুকুরটার কান খাড়া, কিন্তু তবুও চোখ বুজে। টাবুর জিভ ততক্ষণে রসস্থ, হাবুর ইঙ্গিতে সে খেতে শুরু করল গোগ্রাসে। মিষ্টি দইয়ের টাকনা লাগিয়ে নতুন কোটা শালি চিঁড়ের আস্বাদ তার আলজিভ, মাড়ি, গালের দেওয়ালকে অদ্ভুত আদরে মাখামাখি করে দিচ্ছিল। হাবু ততক্ষণে একটা আমের টুকরো চুষতে শুরু করেছে। মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে হলুদ রস। সে টাবুর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হি হি হাসল। টাবুর ঠোঁটের চারপাশে চিঁড়ে আর দইয়ের টুকরো, তাড়াতাড়ি খাবার জন্য ভাল করে গিলতেও পারছে না। সে দাদার দিকে বাটিটা বাড়াল। হাবু আধমুঠো চিঁড়ে দইয়ের দেওয়ালের ওপর দিয়ে রঙ বোলাবার মত করে বুলিয়ে নিচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখনই একটা জোরে হাওয়া দিল। সে স্পর্শে যেন জলছবির মত ভেঙে যাচ্ছিল ডাক্তারের বাগান, আর দারোয়ানের মুখ থেকে চাদরটা খসে পড়ল। 

হাঁ করা, চোখ খোলা একটা মুখ। সেখানে এখনও চিঁড়ের কণা লেগে। খোলা পেয়ে দুটো মাছি উড়ে এসে বসল ঠোঁটের ওপর। মাড়ির গ্রন্থি, ঠোঁটের শুকিয়ে যাওয়া লালারস, নাকের তখনো ভেজা ফুটো থেকে তারা প্রয়োজনীয় খাদ্য খুঁটে নিচ্ছিল। কুকুরটা একবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে দুই ভাইয়ের দিকে তাকাল। তার চোখে এক ধরণের শূন্য দৃষ্টি, যেন ডাকতে ভুলে গেছে। 

বিস্ফারিত টাবুর হাত থেকে বাটি খসে পড়ে  চিঁড়েগুলো হাওয়াতে উড়ে যাচ্ছিল এদিক সেদিক। মনে হচ্ছিল, মড়ার গাড়ির খই যার সঙ্গে জুড়ে থাকা পয়সাগুলো কুড়িয়ে নেবার জন্য বহুবার দুই ভাই দৌড়িয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে বসেই পড়ছিল মাটিতে, হাবু তার হাত ধরল। ‘দৌড় লাগা।’ তারও গলা ভয়ে কেঁপে গেছিল। 

টাবু পারছিল না, যেন হাঁটু খুলে পড়ে গেছে। কিন্তু তার থরথরানি ও সাদা ঠোঁটকে উপেক্ষা করেই হাবু ঠেলা মারল, ‘পালা টাবু ! এক্ষুনি।’ কোনওমতে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় দৌড় দেবার সময়ে দেখল, একলা কুকুর ভ্যাবলার মত তাকিয়ে আছে। টাবু ভাবল, পেছন ফিরে ডাকে একবার। কিন্তু হাবু ততক্ষণে তাকে টেনে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এসে ফেলল গেটের বাইরে। তার পরেও দৌড়ে আরও কিছুটা। 

আকাশের কোণায় ঝুলতে থাকা পাতলা অন্ধকারটুকুও আস্তে আস্তে গায়েব হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দোকানপাট বা ব্যস্ততা কিছু নেই, যেহেতু কার্ফু এখনও অনেকদিন। পাশাপাশি হাঁটছিল, যদিও বেশ কিছুটা সময় কেউ কথা বলেনি।  কিন্তু টাবু এবার কাঁদতে শুরু করল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে, তার দুই চোখ বেয়ে খিদেগোলা নোংরা জল নেমে আসছিল। হাবু দেখল, আমের ব্যাগটা তারা বাগানেই ফেলে এসেছে। 

‘হাবা ছেলে ! বাজারের ব্যাগ নেই, মা জানতে পারলে চামড়া ছাড়িয়ে নেবে !’ হাবু রাগ করল। 

টাবু ফোঁপাচ্ছিল, ‘আমরা মড়া মানুষের মুখের খাবার খেয়েছি রে দাদা ! কী হবে? ঠাকুর পাপ দেবে? মরে যাব?’ 

হাবু অন্যমনস্কের মত দূরের দিকে তাকাল, ‘তোর পেট ভরেছে?’ 

টাবু দুদিকে মাথা নাড়ল। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মোছার চেষ্টা করল, এবং ফুঁপিয়ে উঠল আবার। ‘লোকটা মরে গেছিল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ! কেমন ভাবে হাঁ করে শুয়েছিল ! আর আমরা ওর খাবার খেলাম।’ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তোর আমটা খাসনি, না? আমারও সবকটা চিঁড়ে উড়ে মরে গেল।’ 

হাবু একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর পেটের ভেতর পাক দিয়ে ওঠা গতকালকের  খিদের কুঠুরি থেকে অন্য এক অনির্দেশ্য খিদের দিকে পা চালাতে চালাতে উৎসাহের সঙ্গে বলতে শুরু করল, ‘কাল মাইতিপাড়ার বাগানে যাব। ওখানে বড় বড় আতা গাছ আছে, বুঝলি? কী মিষ্টি হয় রে ! যেন দুধপুলি… ‘ 

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *