উনিশ বছর বয়সী ছেলেটার চোখে ঘুম নেই। এক চাপা উত্তেজনায় ফুটছে সে। কারণ, আর মাত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যে তার জীবনে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটতে চলেছে। স্বাধীন সুরস্রষ্টা হিসেবে তার প্রথম গানটি জীবন্ত হয়ে উঠবে এই পৃথিবীর বুকে। আর গাইবেন দুই কিংবদন্তী শিল্পী – হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও গীতা দত্ত। চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত ছবি “লাইম লাইট”–এর থিম মিউজিক মাথায় রেখে করা সুরের বিন্যাসটি পছন্দ হয়েছে ছবির পরিচালক গুরু দত্ত সাহেবের।

ছবির নাম, “রাজ়”। উইলিয়াম ‘উইলকি’ কলিন্স-এর কালজয়ী উপন্যাস “দ্য উইমেন ইন হোয়াইট” প্রকাশিত হওয়ার প্রায় একশো বছর পর এটি নিয়ে ফিল্ম করবেন মনস্থির করেন গুরু দত্ত। নায়ক হিসেবে বেছে নেওয়া হয় সুনীল দত্তকে। নায়িকা ওয়াহিদা রহমান (ছবিতে তাঁর ডবল রোল ছিল)। স্থির হয়, ছবিটি পরিচালনা করবেন গুরু দত্তের ঘনিষ্ঠ সহকারী নিরঞ্জন। “পিয়াসা” (১৯৫৭) ফিল্মে শচিন দেববর্মণের সহকারী হিসেবে ওই উনিশ বছরের ছেলের কাজ নজর কেড়েছে সকলের। তাই এ বার তাকেই দেওয়া হল সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব।

RD Burman
রাজ় ছবির গান রেকর্ডিংয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও গীতা দত্তের সঙ্গে টিনএজার রাহুল। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

কিন্তু ভাগ্যের এমন পরিহাস, কয়েক রিল শ্যুট করার পর, সুনীল দত্ত বহিষ্কৃত হলেন ওই ইউনিট থেকে। সে জায়গায় নায়কের রোলে এলেন গুরু দত্ত স্বয়ং। পুরনো সিনগুলো নতুন করে তোলা হলেও ছবির কাজ তারপর আর এগলো না। স্বপ্ন ভেঙে গেল তরুণ কম্পোজার রাহুলের। রাহুল দেব বর্মণ, যাঁকে আমরা ‘পঞ্চম’ নামেও চিনি। এই ছবির জন্য তিনটি গান রেকর্ড করা হয়ে গিয়েছিল – দুটি ডুয়েট ও একটি গীতা, আশা ও শামসাদ বেগমের কণ্ঠে। কিন্তু একটিও বাণিজ্যিক রূপে জনসমক্ষে আসতে পারেনি।

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, সঈদ আলি আকবর মুম্বইতে কাজ করছিলেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। শাম্মি কাপুর–আশা পারেখ অভিনীত হিট ফিল্ম “দিল দেকে দেখো” (১৯৫৯)-তে সঈদ পরিচালক নাসির হুসেনকে অ্যাসিস্ট করেন। সেই সুবাদে ঘনিষ্ঠতা হয় অভিনেতা মেহমুদ ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে। বিয়েও করেন মেহমুদের বোন মিনু মুমতাজকে। অতঃপর মেহমুদ ঠিক করলেন আকবরকে দিয়ে ছবি তোলাবেন, নিজে হবেন নায়ক। হোম প্রোডাকশনে। সুরকার হিসেবে নতুন ব্রেক দিলেন পঞ্চমকে। ফিল্মের নাম আগেই স্থির ছিল- “ছোটে নবাব।”মেহমুদ ও ফাতিমা দেবী ইংলিশ হাইস্কুলের ছাত্র রূপে এই একাঙ্ক স্কিট-টিতে অভিনয় করেছিলেন। এই ছবিতে পঞ্চম অনবদ্য কাজ করলেন। তাঁর নিজের সৃষ্টে ‘মালগুঞ্জি’ রাগ (যা বাগেশ্রী ও রাগেশ্রী রাগদু’টির মিশ্রণ) আধারিত গান “ঘর আজা ঘির আয়ে”, লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে এক চিরকালীন বিস্ময়। এই ফিল্মের আরও একটি গান সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে দাগ কাটে – “মতওয়ালি আখোঁওয়ালে”, যাতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন মহম্মদ রফি ও লতা মঙ্গেশকর।

এ গানটির মূ্র্চ্ছনায় ছিল ক্যাস্টানেটস্ ও অ্যাকুস্টিক গিটারের যুগলবন্দি, যা বাজানো হয়েছিল ফ্ল্যামেন্সো স্টাইলে। এরপর শোনা যায় এক আশ্চর্য ‘হামিং’ যা স্থায়ী হয় প্রায় চল্লিশ সেকেন্ড। প্রিলিউডকে ছাপিয়ে গিয়েছিল এক মিনিট ও সাতাশ সেকেন্ডের এক অপূর্ব ভায়োলিন অনসম্বল–এর রেশ। হিন্দি ছবির সংগীতের ক্ষেত্রে এটিকে এক যুগান্তকারী সংযোজন বা আবিষ্কার বলা যেতে পারে। এখানে চিরাচরিত ২/৪ বা ৩/৪ বিট রিদম প্যাটার্ন অনুসরণ করলেন না সুরের কাণ্ডারী রাহুল দেব বর্মণ। তালের মূল যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হল সেকেন্ডারি পারকাশন ইন্সট্রুমেন্ট, রেসো রেসো। এই ফিল্মে আরও ছ’টি গান কম্পোজ করা হয়, যাতে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ সুস্পষ্ট। দীর্ঘ কোডা মিউজিক, ক্যাস্টানেটস্, বেলস্, ঘুঙরুর প্রয়োগ, মিশ্র তালের প্যাটার্ন, ব্রাস সেকশনের অভিনব ব্যবহার, এ ছবির সঙ্গীতকে তৎকালীন সব ছবির তুলনায় এক অনন্য জায়গা এনে দিয়েছিল।

১৯৬৫-তে মেহমুদের ভাই, উসমান আলি মহান অভিনেতা ও পরিচালক গুরু দত্তকে উৎসর্গ করে তৈরি করেন ছবি “ভূত বাংলা।” এ ছবির সঙ্গীতের দায়িত্বও বর্তায় রাহুল দেবের উপর। এ ছবিতে এক অনন্যসাধারণ গান তৈরি করলেন পঞ্চম, যা ছিল মূলত অপেরাধর্মী। সি-মাইনরে বাঁধা প্রোগ্রেশন, স্ট্রিং সেকশনের জোরদার প্রভাব, কাউন্টার মেলোডির প্রয়োগ, মাইনর টু মেজর কর্ডের চলনে গানটি এক দুর্দান্ত সুরের ধারক হিসেবে আজও সমাদৃত হয়ে থাকে। গানের নাম – “জাগো সোনেওয়ালো”। কিশোরকুমারের কণ্ঠ প্রয়োগ যেমন যুগান্তকারী, তেমনই ছিল এতে বাজানো মাইক ম্যাচাডো-র পিয়ানো ও অবনী দাশগুপ্তের ডুগগি। সব মিলিয়েই এ গান ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। এ ছাড়া, চাব্বি চেকারের “লেটস্ টুইস্ট এগেইন”-এর আদলে তৈরি মান্না দের গলায় “আও টুইস্ট করেঁ”, আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে।

সেই শুরু রাহুলের জয়যাত্রা। পরের বছর বিজয় আনন্দ নির্দেশিত “তিসরি মঞ্জিল”(১৯৬৬) পঞ্চমকে নিয়ে গেল আকাশচুম্বী সাফল্যের দরবারে। এই ছবিতে প্রয়োগ করা বোসা নোভা-র অনবদ্য প্যাটার্ন, ভাইব্রোফোনের স্ট্যাকেটো নোটস্ আজও আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। রফি ও আশার কণ্ঠে “ও হসিনা জুলফোঁওয়ালি” এবং “আজা আজা ম্যায় হুঁ প্যায়ার তেরা” অল-টাইম গ্রেট তালিকায় তাদের চিরকালীন স্থান পাকা করে নিল।

এর পরেই এল ১৯৬৭-তে “বাহারোঁ কে সপনে” ছবির সেই বিখ্যাত গান “আজা পিয়া তোহে প্যায়ার দুঁ!” এ সুর কিন্তু প্রথম শোনা গিয়েছিল শচিন দেববর্মণের সঙ্গীত পরিচালনায় “তিন দেবীয়াঁ” (১৯৬৫) ছবির আবহে। সেখানে সন্তুর বাজিয়েছিলেন শিবকুমার শর্মা। সঙ্গে ছিল হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি। পঞ্চম সেই সুরেরই প্রয়োগ করলেন “বাহারোঁ কে সপনে”-তে লতার গলায় দারুণ মাদকতায়, যেখানে সদ্য যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়া দু’টি মানুষের মধ্যে প্রেম পরিণতি পাচ্ছে। গানটির মূল উৎকর্ষ রয়েছে এর কোমলতার মধ্যে। মুখড়াতে সামান্য কয়েকটি নোটস্-এর প্রয়োগ প্রায় একই সাইক্লিক প্যাটার্নে দেখতে পাওয়া যায়। আজা পিয়া (সা-রে-রে-গা), তোহে প্যায়ার দুঁ (গা-মা-গা-রে), গোরি বইয়াঁ (সা-রে-রে-গা), তোহ পে ওয়ার দুঁ (গা-রে-রে-সা) । ‘তোহে প্যায়ার দুঁ’ আর ‘গোরি বইয়াঁ’-এর মাঝের ফাকঁটা ভরাট করলেন একটা ছোট্ট হামিং দিয়ে যাতে গা-রে-সা নোটগুলোর ব্যবহারই ঘুরেফিরে আসে। মূল ধুনটি শচিনকত্তার হলেও পঞ্চম একে ব্যবহার করলেন অসাধারণ চাতুরির সঙ্গে। কিছু শুদ্ধ নোটসের আমদানি করে মেজর স্কেলে বাঁধা এই গানকে চিরস্মরণীয় করে ফেললেন।

RD Burman
রেকর্ডিস্ট অশোক শুক্লার সঙ্গে কাজে মগ্ন। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

আসলে কিংবদন্তী বাবার সহকারি হিসেবে দীর্ঘকাল কাজ করার দরুণ পঞ্চম সুরের সাগরে ডুব দিয়েছিলেন বেশ কম বয়সে। কিশোরকুমারের গাওয়া “ফান্টুস” (১৯৫৬)–এর গান “অ্যায় মেরি টোপি পলট কে আ”-র মূল ছকটি তৈরি করেছিলেন হারমনিকায়। “পিয়াসা” (১৯৫৭)-র সেন্ট্রাল মোটিফের (মালা সিনহার দৃশ্যগুলিতে) ক্ষেত্রে সেই একই ব্যবহার দেখা গিয়েছিল। সরোদ বাজিয়েছিলেন বাংলা গান “ঘুম ভুলেছি নিঝুম”-এ, যা সিনিয়র বর্মণ পরে “হম বেখুদি মে তুমকো” গানে আরোপ করেন, “কালাপানি” (১৯৫৮) ছবিতে। সুতরাং পঞ্চমের বাজানো বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ হয়েছে ১৯৫০-এর দশক জুড়ে যার মধ্যে সকলের প্রিয়, “সোলবা সাল” (১৯৫৮)-এ মাউথ অরগ্যানে পরিবেশিত সেই অনবদ্য সুরেলা “হ্যায় অপনা দিল তো আওয়ারা”-র রিফ্রেন।

আবার ফেরা যাক পঞ্চম-চর্চায়। “বাহারোঁ কে সপনে”-র পরপরই ১৯৬৭-তে আমরা পেলাম রাহুল দেববর্মণ সুরারোপিত আরও একটি ছবি, ইসমাইল মেমন-এর “চন্দন কা পলনা।” এ ছবির এক নগমা পঞ্চমকে পৌঁছে দিল সঙ্গীত বোদ্ধাদের দরবারে। সুর-সিঙ্গার সংসদ পুরস্কারের নমিনেশন পেলেন লতার গাওয়া “ ও গঙ্গা মইয়া, পার লগা দে মেরি সপনোঁ কি নইয়া”-র জন্য। সুরটি কম্পোজ করা হয় পঞ্চমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাদল ভট্টাচার্যের সান্নিধ্যে, আউটরাম ঘাটে বসে। রাগ যোগিয়ায় বাঁধা সুরের অনবদ্য প্রয়োগ স্মৃতিমেদুর করে তুলল তামাম ভারতকে। সাস্পেন্ডেড কর্ডসের ব্যবহার একটি রাগাশ্রয়ী সুরে প্রথমবারের জন্য উপলব্ধি করলেন সঙ্গীতমনস্ক শ্রোতারা । থার্ড নোট (গা)-এর আধিক্য গানটিকে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেল, যদিও টনিক চেঞ্জ, রাগ কালিংড়াকে ছুঁয়ে গেছে, যা সুরের পকড়েও অনেকটাই সুস্পষ্ট।

ষাটের দশকের আরও একটি মূর্ছনার কথা এখানে বলা প্রয়োজন, যার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সে ভাবে হয়নি কখনও, যদিও গানটি প্রায় কিংবদন্তীতে পর্যবসিত। এ গান কিশোরকুমার ও মান্না দের সঙ্গীত জীবনের এক বৃহৎ চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছিল। পঞ্চম ও গীতিকার রাজেন্দ্র কৃষ্ণ অনুপম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তৈরি করেছিলেন সেই চিরকালীন “কমিক-ওয়ার” সং – “পড়োশন” (১৯৬৮) ছবির “এক চতুর নার।” এ গানের রিহার্সাল হয়েছিল প্রায় দশ ঘণ্টা ধরে, আর গানটি তৈরি করা হয়েছিল একরকমের মেডলি হিসেবে, বিগত দিনের বেশ কিছু গানকে মনে রেখে। যেমন প্রথম লাইনটি নেওয়া হয় অশোককুমারের গাওয়া “ঝুলা”(১৯৪১) ছবি থেকে যা রাগ ঝিঞ্ঝোটি-তে বাঁধা। আবার “দেখি তেরি চতুরায়ি” অংশটা বিষ্ণুপন্থ পাগনিসের বিখ্যাত ভজন “বন চলে রাম রঘুরাই” থেকে অনুপ্রাণিত। “কালা রে যারে যারে” আনা হয় লতার গলায় ছায়ানট-আশ্রিত “জিদ্দি” (১৯৪৮) ছবির অসাধারণ মেলোডি “চন্দা রে যা রে যা”–এর আদলে।

১৯৬৮-তে চলচ্চিত্র সম্পাদক অমিত বোস পরিচালিত ছবি “অভিলাষা” মুক্তি পায়। এই ছবির হাত ধরে পঞ্চমের মিউজিকাল গ্রুপে প্রবেশ ঘটল গায়ক-গিটারিস্ট ভূপিন্দর সিংয়ের। বাসু, মনোহারী, মারুতি-র সঙ্গে পঞ্চম-ভূপিন্দরের মেলবন্ধন জন্ম দিল এক কালজয়ী ট্রুপ। “অভিলাষা”-তে পঞ্চমের নির্দেশনায় প্রথমবার ডুয়েট গাইলেন কিশোর-লতা। “প্যায়ার হুয়া হ্যয় যব সে” আজও তার তারুণ্য বা আবেদন বজায় রেখেছে গান-পাগল শ্রোতাদের হৃদয়ে। এ ছবির আরও একটি মেলোডি – “মুন্নে মেরে আ” (যাতে মীনাকুমারীর স্ক্রিন প্রেজেন্স ছিল)-তে আশা ভোঁসলের গলা ব্যবহার করলেন পঞ্চম, যা এক ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ। কারণ গানটি আদতে লতাকে মাথায় রেখে তৈরি করেছিলেন। শেষ মুহূর্তে গলা পাল্টে আশাতীত সাফল্য পেয়েছিলেন সুরের যাদুকর। কলাবতী রাগটি প্রচলিত প্যাটার্নের বাইরে ব্যবহার করলেন ভেঙে-ভেঙে। এক দুর্দান্ত ঘুমপাড়ানি গানের সংযোজন ঘটল হিন্দি ফিল্ম সংগীতের ভাণ্ডারে। এই ছবির ট্যান্ডেম “ওয়াদিয়া মেরা দামন”, রফি ও লতার গলায় ( আলাদা আলাদা ভাবে) এক সময়ের জনপ্রিয় মেলোডি। রাগ নন্দ-এ আধারিত এই গানটির গিটার স্ট্রামিং আজও আমাদের মন উদ্বেল করে।

এরপর তো সত্তর দশক জুড়ে হিন্দি ছবির জগতে পঞ্চমের একাধিপত্য চলে। কটি পতঙ্গ, কারবাঁ, অমর প্রেম, নমক হারাম, অনামিকা, ইয়াদোঁ কি বারাত, শোলে, হরে রামা হরে কৃষ্ণ, জওয়ানি দিওয়ানি, আপ কি কসম, কিনারা – একের পর এক হিট গানে আসমুদ্রহিমাচল মাতিয়ে দিতে থাকেন রাহুল। আশির দশকেও শান, লাভ স্টোরি, মাসুম, সাগর, ইজাজ়ত, অগর তুম না হোতে, বসেরা-র মতো অসাধারণ সব কাজ করে গিয়েছেন। তাঁর গান এক এক করে বিশ্লেষণ করতে গেলে এ লেখা শেষ করা সম্ভব হবে না কোনওদিনই। অজস্র, অসংখ্য, অগণিত কালজয়ী গানের সৃষ্টিকর্তা তিনি। তবু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল বিষাদময়। সুরস্রোতে ভাসা মানুষ পঞ্চম খুবই সাদাসিধে ও চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন। তাই জীবনে দুঃখের মুহূর্তগুলি ঘুরে ফিরে এসেছে বারংবার, কিন্তু তা নিয়ে খুব একটা কথা বলতেন না।

তাঁর প্রথম বিয়ে সুখের হয়নি। প্রথম স্ত্রী রীতা পটেল গুজরাতি পরিবারের মেয়ে। বাঙালিদের জীবনধারণ ও আচার-আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন না। পঞ্চমের সঙ্গে মনের মিলও সম্ভবত খুব একটা হয়নি। সর্বোপরি শাশুড়ি মা, মীরা দেব বর্মণের সঙ্গে একেবারেই সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি পুত্রবধূ। পঞ্চমের রাত জেগে কাজ করার অভ্যাসেরও বিরুদ্ধে ছিলেন সনাতন গুজরাটি পরিবারে বড় হওয়া রীতা। এক সময় দু’জনের ভিন্ন রুচির খাদ্যাভ্যাসকে কেন্দ্র করে অশান্তির ঝড় ওঠে দেব বর্মণ পরিবারে। রীতা ছিলেন ঘোর নিরামিষাশী আর পঞ্চম আমিষ ছাড়া খেতে পারতেন না। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত রীতা সুরাসক্ত হয়ে পড়েন ক্রমশ। অশান্তি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পঞ্চম বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক হোটেলে আশ্রয় নেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই বিবাহ-বিচ্ছেদ। হতাশাগ্রস্ত রাহুল কিছুদিনের জন্য নিজেকে সরিয়ে নেন সুর সংযোজনার সুবিশাল কর্মকাণ্ড থেকে।

RD Burman
পরম সুহৃদ কিশোরকুমারের সঙ্গে। ১৯৬৯ সালে সন্মুখানন্দ হলে এক অনুষ্ঠানের আগে। ডানদিকে রয়েছেন মনহারি সিং। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

অক্টোবর ১৯৮৭। আর এক ধাক্কা খেলেন। চলে গেলেন পঞ্চমের আজীবনের সঙ্গী কিশোরকুমার। বন্ধু হারিয়ে মনের যন্ত্রণায় একা হয়ে পড়লেন পঞ্চম। তাঁর কেরিয়ারে নেমে এল নিকশ কালো রাত। আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরার উদাহরণ হিসেবে আমরা পেলাম বেশ কিছু নিম্ন মানের গান, “ইতিহাস” (১৯৮৭), “রামা ও রামা” (১৯৮৮), “জ়লজ়লা” (১৯৮৮), “জুররৎ” (১৯৮৯), “আগ সে খেলেঙ্গে” (১৯৮৯) ছবির সুর নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠল। সঙ্গীতপিপাসুদের মনে প্রশ্ন উঠল – সুরগুলো কি আদৌ পঞ্চমের সৃষ্টি? নাকি তাঁর সহকারিদের করে দেওয়া? শোনা যায়, স্বপন চক্রবর্তী নাকি পঞ্চমের করা সুরের কাঠামোর ওপর নিজের কারিকুরি ফলিয়ে নষ্ট করে দিতেন মেলোডির বিন্যাস।

অন্ধকার সময়ে একে একে সবাই ছেড়ে গেলেন সুরসম্রাটকে। ছেড়ে গেলেন দ্বিতীয়া স্ত্রী আশা ভোসলেঁও। চলে গেলেন দেবানন্দ, রমেশ সিপ্পি ও শেখর কাপুর, নতুন কম্পোজারের খোঁজে। শেষ আঘাত হানলেন সুভাষ ঘাই। নিজের ভাই অশোকের ছবি, “রাম-লখন”-এর জন্য পঞ্চমকে সই করিয়েও শেষ মূহূর্তে সরিয়ে দিয়ে নিয়ে এলেন লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালকে। যন্ত্রণায় ভেঙে পড়লেন রাহুল। তবু সুরের কাজ থামাননি। একা একাই ধুন বানাতেন নিজের মনে।

RD Burman
ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। হিন্দির মতো বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গেও ছিল তাঁর নাড়ির যোগ। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

১৯৮৮-তে হৃদরোগে আক্রান্ত হন সুরের জগতের মুকুটহীন বাদশা। বাইপাস সার্জারি করতে তাঁকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরে আর ছবির কাজ করতেন না। শেষ কাজ করেছিলেন ১৯৯৪ সালে বিধু বিনোদ চোপড়ার “১৯৪২: আ লাভ স্টোরি” ছবিতে। আর আশ্চর্যের কথা, চূড়ান্ত সাফল্যের মুখ দেখেছিল এই ছবির গান। কিন্তু পঞ্চম ততদিনে পাড়ি দিয়েছেন অন্য লোকে। জাগতিক সাফল্যের খবর তাঁর কানে আর পৌঁছতে পারেনি।

নানা ধরনের সুরের দক্ষতার পরিচয় প্রায় চার দশক ধরে দিয়ে গিয়েছেন আর. ডি. বর্মণ। হিন্দির মতো বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গেও ছিল তাঁর নাড়ির যোগ। যদিও এ লেখায় ইচ্ছাকৃত ভাবেই উল্লিখিত হয়নি সে প্রসঙ্গ। কিন্তু এ সত্য অনস্বীকার্য যে, প্রতিটি রুচিশীল সংগীতবোদ্ধার মননে তিনি চিরকাল রাজার মতো বিরাজ করবেন। তাঁর ভদ্রতাবোধ, পরিশীলিত রুচি আর নিরহঙ্কার ব্যক্তিত্ব এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে চিরকাল। বিপুল জনপ্রিয়তা আর সামাজিক সম্মান তিনি অর্জন করেছিলেন নিজেরই কৃতিত্বে, তবুও থেকে গিয়েছেন অতি সাধারণ বাঙালির ঘরের লোক হিসেবে – এখানেই পঞ্চমদা অনন্য। একমেবাদ্বিতীয়ম।

বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *