আলমারি ভর্তি জামাকাপড়। একটা নয়, তিন তিনটে আলমারি। তাও বনির মন ভরে না। কিছুদিন বাদে বাদেই জামাগুলোকে আউট অফ ফ্যাশন মনে হয়। ব্যাপারটা আগে এমন ছিল না। ছ’সাত বছরের পুরনো ড্রেসও যত্ন করে তুলে রাখত বনি। ইদানিং রঞ্জাবতীর সঙ্গে মিশে সেও নির্দ্বিধায় দু’তিন মাসের পুরনো স্কার্ট, সালওয়ার, জেগিংস ফেলে দেয়। মিডি, হলটার নেক কিংবা অফ শোল্ডার ড্রেসগুলো বড়জোর ছ’মাস।
রঞ্জাবতী ফ্যাশনিস্তা। নতুন যা কিছু বাজারে ওঠে, দৌড়ে গিয়ে কিনে ফেলে। বলে, ফ্যাশন ট্রেন্ডি হওয়াটাই নাকি এখনকার দস্তুর। বিশ্বায়নের মজা! সোশ্যাল মিডিয়ায় এইসব হালফ্যাশানের পোশাক পরে ফোটো দিলে ফলোয়ার বাড়ে। সপ্তাহে দু’দিন শপিং মল ঘুরতে না গেলে ওর মুখে ভাত রোচে না। রঞ্জাবতীকে সঙ্গ দিতে গিয়ে বনিও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে মল-জীবনে। আগাগোড়া শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রে মোড়া অত্যাধুনিক, সুসজ্জিত দোকানগুলোতে পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে কার না ভাল লাগে! থরে থরে রাখা লোভনীয় সম্ভার। জামাকাপড়, প্রসাধনী, জুতো, সানগ্লাস, হরেক রকম টুকিটাকি। যাপনের অ্যাকসেসরিজ়। বনির মায়ের মতে, বনি প্রচুর অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে ঘর বোঝাই করে। রেগে চেঁচান উনি।
– কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা নষ্ট। এত জামা রাখবি কোথায়?
বনিও তর্ক জুড়ে দেয়।
– কত ডিসকাউন্ট পাই জানো? ফিফটি সিক্সটি পারসেন্ট! বাই ওয়ান গেট ওয়ান। এমন লোভনীয় অফার পেলে তুমি ছেড়ে দিতে মা?
বনির মা ধমক দিতে গিয়ে চুপ করে যান। শাড়িওয়ালি মঞ্জুলিকা ইন্সটলমেন্টে দেয় বলে তিনিও দু’ একটা শাড়ি অনলাইনে কিনে ফেলেছেন। লোভের বশে। পড়েই আছে সেগুলো। অঙ্গে দেওয়ার সময় হয়নি। বনি ঈষৎ গাম্ভীর্যের সুরে বলল,
– আমাকে বকাবকি করছ, রঞ্জাবতীর কালেকশন দেখলে চোখ কপালে উঠবে!
– হয়েছে! পরের মেয়ের সাফাই গাইতে হবে না। রঞ্জাবতীরা টাকার কুমির। তা হলেও ফেলে ছড়িয়ে নষ্ট করার কোনও মানে নেই। ওইজন্য বলি, ঘন ঘন শপিংমলে যাস না। যেমন ভোগের উপচার, তেমন বিকৃতি!
মায়ের আপত্তির জন্যই রঞ্জাবতীর সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছে বনি। এমনিতেও গত পাঁচমাস ধরে রঞ্জাবতীর সাড়াশব্দ নেই। কলেজে আসে না। ফোন করলে ধরে না। টেক্সট মেসেজের জবাব দেয় না। এমনকী ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামও ডি-অ্যাক্টিভেট করে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: মন্দার মুখোপাধ্যায়ের কলমে খলিল জিব্রানের ‘দ্য প্রফেট’-এর বাংলা তর্জমা
কলেজের কেউ কেউ বলল, রঞ্জাবতী নিখোঁজ। বিশেষত থার্ড ইয়ারের সোহম আর পাস আউট সম্বিতদার কথা মিথ্যে হতে পারে না। রঞ্জাবতী দু’জনেরই ক্রাশ। ইকনমিক্সের শ্রমণা বলল, রঞ্জাবতী নাকি বিদেশে পড়তে গেছে। ওর সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসে দু’বার দেখা হয়েছিল। দিওতিমা আর রিয়া অবশ্য অন্য কথা বলল। রঞ্জাবতী নাকি একটা বাজে চক্রে জড়িয়ে পড়েছিল। মডেলিং করতে গিয়ে। তাই ওর বাড়ির লোক ওকে ভিনরাজ্যের হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বনি অবশ্য এখন একা একাই শপিংমলে যেতে ভালোবাসে। কলকাতার মতো আর্দ্র শহরে একটু হাঁটাহাঁটি করলেই প্যাচপেচে ঘাম হয়। কর্কটক্রান্তি রেখার উপর কিনা! শপিংমলে ঢুকলেই একঝলক ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ঝকঝকে সুন্দর, কাচে ঢাকা শোরুমগুলোর দিকে একবার তাকিয়েই মেপে নিতে শিখেছে বনি। কোনটায় লাভ, কোনটায় গচ্চা! যেখানে যত বেশি ছাড়, সেখানেই বনি দৌড় লাগায়। বস্তুত, এ তার একদম আলাদা জগৎ।
তিনতলায় কফিশপের পাশে একটা ব্র্যান্ডেড বিপণি আছে। যেমন স্টক, তেমন ক্লিয়ারিং সেল। সবচেয়ে লোভনীয় হল দোকানের সামনের শোকেসে রাখা ম্যানিকিনগুলো। হালফিলের আধুনিক পোশাক পরিয়ে রাখে। নামি ডিজাইনারদের জামার অনুকরণে এইসব ড্রেস তৈরি হয় খিদিরপুরের কারখানায়। বনি আড়ালে আবডালে শুনেছে, সেখান থেকেই নাকি এই কাপড়চোপর আসে। ম্যানিকিনগুলোর মতো পোশাক কিনতে পারলে এক ঢিলে দুই পাখি। ফ্যাশন ট্রেন্ড ফলো করাও হয়, আবার বাজেট শপিংও।
সমস্যা হল, দোকানটায় সবসময় ভিড়। বিশেষত ট্রায়ালরুমের সামনে লম্বা লাইন লেগেই থাকে। বনি মনে করতে পারল না, কবে পাতলা দেখেছে লাইনটা। মাপসই রেডিমেড পোশাক কিনতে গেলে একবার তো ট্রায়াল দিতেই হয়। ফিট করছে কি করছে না। আবার একটাই মোটে ট্রায়াল ঘর। এত ভিড়ভাট্টায় একাধিক জামা নিয়ে তাই ট্রায়ালরুমে ঢোকার নিয়ম নেই। সেলসগার্লগুলো তীক্ষ্ণ চোখে নজর রাখে।
আজ সকাল সকাল এসেছে বনি। শাটার উঠতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকেছে। উদ্দেশ্য, ফাঁকায় ফাঁকায় দোকানে ঢুকে পড়া। আগের হপ্তায় দু’বার চেষ্টা করেও ট্রায়ালরুমে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। দোকানের ফ্রন্ট শো কেসে নতুন ম্যানিকিন এসেছে! প্রথমে দুটো ছিল যখন রঞ্জাবতীর সঙ্গে ঘুরতে আসত বনি। বাড়তে বাড়তে এখন পাঁচ। ম্যানিকিনগুলো যেমন সুন্দর দেখতে, তেমন চকচকে পোশাক। বাঁদিকের ম্যানিকিনটাকে খেয়াল করল বনি। কোঁচকানো চুল। অপূর্ব সুন্দর একটা ড্রেস! কী নাম এটার? স্মক নাকি বলগাউন? জামাটার ফিটিংস এবং ফ্যাব্রিক ফল দুটোই দুর্দান্ত! সাদা নেটের ফ্রিল বসানো ঘন নীলরঙ। যেন শরতের আকাশ। আহা!
পাশের কফিশপে বোধহয় ক্যাপুচিনো বানাচ্ছে। ম’ ম’ করা গন্ধে পাগলপারা অবস্থা। বনি চটপট সেলসগার্লকে ডাকল।
– এই ড্রেসটা আমার সাইজে মিলবে?
মেয়েটি হেসে বলল, “ভিতরে আসুন ম্যাডাম।” কাচের সুইং ডোর ঠেলে ভিতরে যেতেই বনির মন নেচে উঠল। উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল আর একটু হলেই। বাই ওয়ান গেট থ্রি অফার! মানে একটা কিনলে ওই দামে আরও দুটো! বনির মনে হল সোনার খনির সন্ধান পেয়েছে। যে পোশাকটা ও পছন্দ করেছে তার প্রাইসট্যাগ লাগানো আছে বারোশো। তার মানে বারোশো টাকায় তিন তিনটে!
সোশ্যাল মিডিয়ায় এইসব হালফ্যাশানের পোশাক পরে ফোটো দিলে ফলোয়ার বাড়ে। সপ্তাহে দু’দিন শপিং মল ঘুরতে না গেলে ওর মুখে ভাত রোচে না। রঞ্জাবতীকে সঙ্গ দিতে গিয়ে বনিও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে মল-জীবনে। আগাগোড়া শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রে মোড়া অত্যাধুনিক, সুসজ্জিত দোকানগুলোতে পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে কার না ভাল লাগে! থরে থরে রাখা লোভনীয় সম্ভার। জামাকাপড়, প্রসাধনী, জুতো, সানগ্লাস, হরেক রকম টুকিটাকি। যাপনের অ্যাকসেসরিজ়। বনির মায়ের মতে, বনি প্রচুর অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে ঘর বোঝাই করে
দোকানের ভিতরেও সাত আটটা ম্যানিকিন। প্রত্যেকটা সুন্দর আর দারুণ দারুণ ড্রেস পরানো। তবে বনির চোখে লেগে গিয়েছে ফ্রন্ট শোকেসের ওই নীল জামাটা। কী যেন বলে? কোবাল্ট ব্লু? ওটা পরলে নিজেকে সাক্ষাৎ ম্যানিকিনের মতো লাগবে। তখন দেখা যাবে কলেজে তার ক্রেজ় বেশি হয় কিনা। ঢেউ খেলে গেল বনির বুকের মধ্যে। সেলসগার্লকে জিজ্ঞাসা করল বনি,
– ওই গ্লসি ড্রেসটা আমার সাইজের?
মেয়েটি বলল,
– এটাই কনফার্মড নেবেন তো? তবেই খুলব ম্যানিকিনের গা থেকে। জাস্ট লাস্ট পিস।
বনি ঘাড় কাত করতেই মেয়েটি শোকেসের ম্যানিকিনের থেকে জামাটা সন্তর্পণে খুলে আনল। বনি উত্তেজিত।
– এটার সঙ্গে আর কোন দুটো ফ্রি দেবেন?
পাশে দাঁড়ানো সেলসম্যান বলল,
– ম্যাম এই তিনটে শেলফ থেকে বাছুন। যা দেখছেন সব বারোশো এবং বাই ওয়ান গেট থ্রি অফারে।
আনন্দে কথা বেরলো না মুখ দিয়ে। মা আজ হাজার দুয়েক টাকা দিয়ে পইপই করে বলেছে,
– এর মধ্যে যা হয় তাই কিনবি। জীবনটা বিরাট বড়। সব কিছুই একবার ট্রায়াল দিয়ে দেখা দরকার। শুধু জামা কিনলে চলবে না বনি। নেশাগ্রস্ত হয়ে গেছিস!
উচ্ছ্বাসে হেসে উঠতে যাচ্ছিল বনি। সে কিনা বারোশোতে তিন তিনটে ফ্যাশনেবল আউটফিট কিনে ফেলছে! মার দিয়া কেল্লা। আজ নিশ্চয়ই কিছু বলবে না মা। ভাগ্যিস হাসি চেপেছিল। আড়চোখে দেখল বনি, সেলসম্যান ছেলেটা তাকে লক্ষ্য করছে। নাহ, পাগল ভাববে। দ্রুতগতিতে জামা বাছতে লাগল বনি।
আরও পড়ুন: অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের নভেলা: নন্দিনী আসছে…
ঝাড়াই বাছাই করে গোটা দশেক পছন্দ হল। এর মধ্যে থেকে দুটো! কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে বুঝে উঠতে পারল না। আয়নার সামনে যেটাই গায়ে ফেলছে সেটাই অপূর্ব লাগছে। সেলসগার্ল বলে ফেলল,
– এত ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না ম্যাডাম। যেগুলো চয়েস করবেন না সেগুলো তো বিক্রি হতে হবে। নোংরা হলে অন্য কাস্টমার কিনবে না।
বনি লটারির টিকিট কাটার মতো নিরুপায় হয়ে দুটো বেছে নিল। পড়ে থাকা জামাগুলোর জন্য মন খারাপ হতে শুরু করল।
এখনও হাতে আটশো টাকা। বাড়ি ফেরার অটোভাড়া ত্রিশ টাকা আর একটা জলের বোতল কিনতে হবে কুড়ি টাকায়। এক কাপ কফি খাওয়ার জন্য প্রাণটা আনচান করছে। কিন্তু সাড়ে সাতশোতে ওই যে নতুন লাল ড্রেসটা বদলিয়ে পরালো ম্যানিকিনটাকে, সেটাও পেয়ে যাবে বনি। ভাগ্যিস নজর করেছিল! চেরিরেড অফশোল্ডার মিডি। ম্যানিকিনটাকে যা পরায় তাতেই মানিয়ে যায়। ওই পোশাকটাও তার চাই। বাকি সাড়ে সাতশোতে ওটা তার হয়ে যাবে না?
একটা ফোন এসেছে। রিং টোন বলছে এটা মায়ের ফোন।
– হ্যাঁ বলো।
– বেশি দেরি করিস না। একসঙ্গে লাঞ্চ করব।
– এইটা বলার জন্য ফোন করলে মা? আসলে তুমি চাওনা যে আমি শপিং করি।
বনি ঝাঁঝিয়ে উঠল। ওপাশের গলা ধীর স্থির।
– অনর্থক গাদা গাদা কিনে তারপর বইতে পারবিনা। লাস্টবার তো ট্যাক্সিতে একটা প্যাকেট ফেলে এলি!
– আচ্ছা আচ্ছা। রাখো!
দ্রুত ফোন কেটে দিল বনি। দোকানে একটা ঘোষণা হচ্ছে মাইক্রোফোনে। গমগমে গলা ভেসে আসছে। ডিয়ার কাস্টমার, দিস হাফ অ্যান আওয়ার ইজ হ্যাপি আওয়ার। এভরিথিং ইউ বাই উইল বি এইট্টি পার্সেন্ট অফ। বনি বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের কানকে। একবার, দু’বার, তিনবার শুনল। তারপর নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখল। নাহ, স্বপ্ন নয়। সত্যিই ঘটে চলেছে। ঠিকঠাক কিনতে পারলে আজ প্রায় আধ ডজন দুর্দান্ত ট্রেন্ডি পার্টিওয়্যার হয়ে যাবে! আশি শতাংশ ছাড় মানে লাল জামাটা সে পাচ্ছেই।
আরও পড়ুন: স্বপ্না রায়ের কলমে: ফুল বলে ধন্য আমি
একদম দেরি করা চলবে না। ক্রমশ ভিড় বাড়ছে। ট্রায়াল রুমের সামনে ইতিমধ্যেই লাইন শুরু হয়েছে। সেলসগার্লটা ঠিক খেয়াল করেছে।
– একটামাত্র ড্রেসই আপনি ভিতরে নিতে পারবেন ম্যাম।
বনি অসহায়ের মতো বলল,
– জানি। কিন্তু না পরলে কীভাবে বুঝব?
– আমাদের এটাই নিয়ম। নয়তো এক এক জন কাস্টমার এক ঘণ্টা নিয়ে নেবেন। তাছাড়া ব্র্যান্ডেড গার্মেন্টস একটা নির্দিষ্ট সাইজের। তাই, সবগুলোর মাপই এক।
– তাহলে ট্রায়াল রুমটা রেখেছেন কেন ভাই?
মেয়েটা বনির বিদ্রুপ গায়ে মাখল না।
– সিম্পল। শুধু মাপটা দেখে নেওয়ার জন্য ম্যাডাম। তার জন্য তো একটাই যথেষ্ট। তাই না?
বনি চুপচাপ জামাগুলো নিয়ে ট্রায়ালরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। পিছনে আরও তিনজন। তাদেরকে ছেড়ে দিল বনি। অনেকদূর থেকে আরও একটি মেয়ে হেঁটে আসছে। হাতে বনির মতোই একরাশ জামা। সেলসগার্লটা তাকেও ধরেছে। বনির মাথায় হঠাৎ কী বুদ্ধি জাগল!
সেলসগার্লটা ওই মেয়েটাকে নিয়ে ব্যস্ত। মুহূর্তের ছিদ্রপথে ছ’সাতটা জামা নিয়ে বনি ঢুকে পড়ল ট্রায়াল রুমে। ভাগ্যিস সেলসগার্লটা তাকে দেখতে পায়নি। ট্রায়াল রুমে ঢুকে ভাল করে দেখে নিল বনি। কোথাও কোনও সিসিটিভি আছে কিনা! বলা যায় না, আজকাল অনেক কিছুই তো হচ্ছে মানুষের অগোচরে।
আজ সকাল সকাল এসেছে বনি। শাটার উঠতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকেছে। উদ্দেশ্য, ফাঁকায় ফাঁকায় দোকানে ঢুকে পড়া। আগের হপ্তায় দু’বার চেষ্টা করেও ট্রায়ালরুমে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। দোকানের ফ্রন্ট শো কেসে নতুন ম্যানিকিন এসেছে! … বাঁদিকের ম্যানিকিনটাকে খেয়াল করল বনি। কোঁচকানো চুল। অপূর্ব সুন্দর একটা ড্রেস! কী নাম এটার? স্মক নাকি বলগাউন? জামাটার ফিটিংস এবং ফ্যাব্রিক ফল দুটোই দুর্দান্ত! সাদা নেটের ফ্রিল বসানো ঘন নীলরঙ। যেন শরতের আকাশ।
বেশ সুন্দর ট্রায়াল রুমটা । চারদিকে আয়না। এমনকী ছাদেও। একের পর এক জামা পরতে লাগল বনি আর নিজেকে দেখতে লাগল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতিটি আয়নায়। ফিটিংস হয়েছে তো? কাঁধ, কোমর, ঝুল, হাতা সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে থাকল। নীলের পর লাল। তারপর সাদা। বনি মোবাইল বার করে খচাত খচাত করে সেলফি তুলতে লাগল প্রতিটি জামায়। আয়নার থেকে আয়না, তার ভিতরের আয়নার অজস্র প্রতিবিম্ব বনিকে ঘিরে যেন ব্যালে নাচ করতে থাকল মরাল গ্রীবা দুলিয়ে। বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত বনি খেয়ালই করেনি যে দু’বার ট্রায়াল রুমে নক করে গিয়েছে সেলসগার্ল। সে শুনতেই পায়নি। একের পর এক ফ্যাশন কস্টিউমে বনি হারিয়ে গিয়েছে এই নতুন ব্রহ্মাণ্ডে। ইন্দ্রিয়গুলো বুঁদ হয়ে গিয়েছে নতুন জগতের মায়ায়। ঠুকঠুক আওয়াজ। তিনবার।
– ম্যাডাম, শুনতে পাচ্ছেন? দরজাটা খুলুন। একঘণ্টার বেশি হয়ে গিয়েছে।
বনি ট্রায়াল রুমের ঘড়িটার দিকে তাকাল। কাঁটা তো সেই এক জায়গাতেই রয়েছে। তাহলে কি ঘড়িটা খারাপ? নিজের হাতঘড়িটা দেখল বনি। সেটাতেও এক সময়। নির্ঘাত মিথ্যে বলছে সেলসগার্লটা। এদের এটাই অভ্যাস। তাড়া দিয়ে দিয়ে কেনাকাটার মৌতাতটাকেই নষ্ট করে দেয়! জোরালো বিজলি আলোর নীচে আয়না দেখল বনি। ছ’নম্বর জামাটা পরে নিজেকে মনে হচ্ছে সাম্রাজ্ঞী। দুনিয়ায় সব মিথ্যে। সত্যি শুধু সে আর তার পোশাক। ড্রেসটায় নিজেকে একদম ম্যানিকিনগুলোর মতোই লাগছে। গোড়ালি ঠুকে নিজের রুচিকে তারিফ করল বনি। খুট করে একটা আওয়াজ হল। ট্রায়াল রুমের দরজা খোলার। সে তো লক করে রেখেছিল। তাহলে?
পরক্ষণেই অবাক হয়ে বনি দেখল সেলসগার্লটা তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে অবহেলায়। কী সাহস! অভব্যতার একটা সীমা থাকা দরকার। বনি রেগেমেগে ঝাঁঝিয়ে উঠতে যাচ্ছিল সেলসগার্লটাকে। একজন সামান্য কর্মচারীর এত স্পর্ধা!
হাত ছাড়াতে গিয়ে বনি অনুভব করল, সে হাত পা কিছুই নাড়াতে পারছে না। হলটা কী? এরপর প্রচণ্ড বিস্ময়ে দেখতে পেল বনি, হিড়হিড় করে তাকে টেনে ঘষটিয়ে দোকানের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। সেলসম্যানটা সামনের কাচের শোকেসের পাল্লাটা খুলে দিল আর মেয়েটা দুহাত দিয়ে আলগোছে ধরে বনিকে দাঁড় করিয়ে দিল ম্যানিকিনগুলোর মধ্যে। কাচের এপাশ থেকে বনি দেখতে পেল তাকে লক্ষ্য করছে দোকানের বাইরে অজস্র মুগ্ধ চোখ। কেউ কফিশপের কাউন্টারে, কেউ চলমান সিঁড়িতে, কেউ উইন্ডো শপিংয়ে। তাদের টুকটাক মন্তব্যগুলোও শুনতে পেল বনি…
সো নাইস!
ভেরি প্রিটি।
ফ্যাবুলাস ড্রেস!
বনি চিৎকার করে উঠতে চাইল। কিন্তু নাহ! তার গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছে না। তারস্বরে চেঁচাচ্ছে বনি, “হেল্প হেল্প!” জিভ নড়ছে না একচুল। বুঝতে পারল বনি। পাথরের মত শক্ত হয়ে গিয়েছে তার যাবতীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
জোরালো বিজলি আলোর নীচে আয়না দেখল বনি। ছ’নম্বর জামাটা পরে নিজেকে মনে হচ্ছে সাম্রাজ্ঞী। দুনিয়ায় সব মিথ্যে। সত্যি শুধু সে আর তার পোশাক। ড্রেসটায় নিজেকে একদম ম্যানিকিনগুলোর মতোই লাগছে। গোড়ালি ঠুকে নিজের রুচিকে তারিফ করল বনি। খুট করে একটা আওয়াজ হল। ট্রায়াল রুমের দরজা খোলার। সে তো লক করে রেখেছিল। তাহলে?
তাকে তো এখনই বাড়ি ফিরতে হবে। কী হল? অনেক কাজ বাকি। মায়ের সঙ্গে লাঞ্চ, বাবা অফিস থেকে ফিরলে চা করে দেওয়া। শীতের ছুটিতে পুরীর সমুদ্র দেখার প্ল্যান– সব ভেস্তে যাবে। বন্ধুদের সঙ্গে মাসের একটা দিন জমিয়ে আড্ডা, ফিল্ম দেখতে যাওয়া! কীভাবে হবে? হঠাৎ বনির মনে হল, বেশ কয়েকমাস ধরে এগুলো তার জীবন থেকে ক্রমশ মুছে গিয়েছে। যেটুকু ছিল তা মা-বাবা আর বন্ধুদের জোরাজুরিতে। শো কেসের কাচে নিজের ছায়া দেখতে পেল বনি।
নিজের চোখের দিকে তাকাল টানা তিন মিনিট। নাহ পলক পড়ছে না! বনি চমকে উঠল। কাচের উপর প্রতিবিম্বিত হয়েছে সবকটি ম্যানিকিন। তার পাশের ম্যানিকিনটাকে কেন এতক্ষণ চেনা লাগছিল বুঝতে পারল বনি।
এ তো রঞ্জাবতী!
বনির বুক ধড়াস করে উঠল। রঞ্জাবতীও তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। সে তাকানোতে কোনও ভাষা নেই, ভাব নেই, আবেগ নেই। নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো! বনি বুঝতে পারল, রঞ্জাবতী তাকে চিনতে পারেনি।
বনি অনুভব করল, ক্রমশ সেও হয়ে যাচ্ছে পাশাপাশি রাখা সার সার ম্যানিকিনগুলোর মতো।
পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।
বর্তমান কালের একদম সঠিক চিত্র উপস্হাপন করা হয়েছে,কি যে ভাল লাগল গল্প টা পড়ে
চমৎকার
অসাধারণ লিখেছেন গল্পটি। বেশ অন্যরকম 👌
darun legeche golpota ..khub sundorbhabei sohoj sorol jeeboner dikei arow besi korei jawa uchit ei kothin somoyei , bairer chakchikko eiriyei jawa e hobei busdhimaner kaaj ..golpo ti sundor korei abar taa amader bujhiyei dilow
খুব সুন্দর 🙂
দারুণ লাগলো গল্পটা ।
খুব ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে। লেখার মধ্যে নতুনত্য আছে 👍🌹🌹 ধন্যবাদ।
Chamatkar
Great.
রহস্যময় শেষটা… ভালো লাগলো
স্বপ্নের জগত হতে দুস্বপ্নের জগতে টেনে এনে হাজির করা হ’ল কাহিনীর চরিত্রকে। অবশ্যই কাল্পনিক, তবে লেখার গুণে গল্পটা কোথায় যেন এক শিক্ষামূলক সীমারেখা দেখিয়ে দিল। চমৎকার।
রহস্যময় শেষটা… ভালো লাগলো …
চমৎকার
দারুন সময়োপযোগী গল্প l খুব ভালো লাগলো ❤❤
তুমি যেই হও না কেন, মাটিতে তোমাকে পা রেখেই চলতে হবে, না হলে তোমাকে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে।
আধুনিকতাকে অবশ্যই সঙ্গী করতে হবে, কিন্তু আধুনিকতা তোমার নিজস্বতাকে, সংস্কৃতিকে, ভাবনাকে এবং মূল্যবোধকে যেন নাড়িয়ে দিয়ে না যায়।
খুব ভালো বাস্তবধর্মী লেখা আমাদের উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ।
শারদীয়ার আগাম প্রীতি শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাই।
চমৎকার লিখেছ… খুব ভাল লাগল
দারুন লেখা l ভোগবাদী মানসিকতার ভয়াবহ দিকটিকে যথার্থ ভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে l
খুব ভালো লাগলো Dr. Mam, শেষটা অসাধারণ
চারপাশে এমন প্রাণহীন ম্যা্নিকিন-ই ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে।
Fantastic laglo. Shash bondho kore porlaam. Khub bhalo golper badhuni.aro chai👌👌👌👌
দারুন বললে কম বলা হবে…সত্যি আমাদের মূল্যবোধের পৃথিবী ছোট হয়ে যাচ্ছে ……
Khub sundor, dhonnobaad ,bhogobaadi somaj k tule dhorar jonno erom ekta mishti golpe..❤️
খুব সুন্দর লাগলো গল্পটা
গল্পটিতে ভোগবাদী সমাজের এক বাস্তব চিত্র সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে।
Bah ! Besh bhalo laglo.👌👌👌
Excellent flow .. excellent ending.. darun. Khub realistic..
🙏🙏🙏🙏