এখন আমি ভারত থেকে অনেকটা দূরে, চাকরির দায়ে, পেটের টানে উড়ে চলে এসেছি ইউরোপে যেখানে জড়াজড়ি করে রয়েছে ইতিহাস, লোকগাথা, রূপকথার নিদর্শন। ইউরোপকে বলাই যায় ইতিহাসের মহাদেশ; গল্পের মহাদেশ; বৈচিত্র্যে ভরা বিভিন্ন দেশের আশ্চর্য সমাহার।
আমি যেখানে থাকি, সেখান থেকে বেলজিয়াম খুব দূরে নয় – এই ধরুন হাওড়া স্টেশন থেকে কর্ড লাইনের লোকাল ধরে বর্ধমান যেতে যতটা সময় লাগে, ঠিক ততটুকু সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায় ব্রাসেলস, বেলজিয়ামের রাজধানী।
বেলজিয়াম বললে কী কী মনে পড়ে প্রথমেই? গ্লাস, বেলজিয়ান গ্লাস, শান্তিনিকেতনের আশ্রমের বিভিন্ন বাড়িতে কিংবা ব্যান্ডেল চার্চের প্রেয়ার হল্এ রংবেরংয়ের বেলজিয়ান গ্লাসের কারুকার্য দেখেছি আমরা। এর বাইরেও বেলজিয়ান চকলেট, বেলজিয়ামের বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র টিনটিন, এসবের জন্যেও বেলজিয়াম বিশ্বে পরিচিত। হীরে – বেলজিয়ান ডায়মন্ড, যার মূল ব্যবসাকেন্দ্র বেলজিয়ামের অ্যান্টোয়ার্প শহরে, তার জেল্লাতেও বেলজিয়াম উজ্জ্বল। আর রাজনৈতিক পরিচয়ে – বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস সমগ্র ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেরও রাজধানী।
প্রবাসজীবনে সোম থেকে শুক্র অফিসের ব্যস্ততায় কেটে গেলেও শনি-রবিগুলো একান্তই নিজস্ব। এ রকমই একটা উইকেন্ড কাজে লাগিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় এদিক সেদিক, আমিও পড়লাম – তবে আমার গন্তব্য ব্রাসেলস হলেও, ব্রাসেলস নয়। ব্রাসেলস থেকে আরেকটু উত্তর পশ্চিমে।
ব্রুজ, আর ঘেন্ট নামে দুটি ছোট্ট ছোট্ট মধ্যযুগীয় শহর আছে এখানে। আজ আমরা ব্রুজের গল্প শুনব।
ব্রুজ, বা Brugge উচ্চারণটা একটু আলাদা হয়ে যায় ভাষাভেদে, কারণ ইউরোপের এই অংশে ইংরেজি G অক্ষরটা কখনও হ, কখনও নীরব, কখনও Zএর মত শোনায়। তাই ব্র্যুz, ব্রুহা, ব্রাহা – সবরকম নামই চলে। ইংরেজি ভাষাভাষীরা একে সাধারণভাবে ব্রুজ বলেই ডাকেন। রিই নদীর মাধ্যমে নর্থ সী-র সাথে যুক্ত হয়ে সেই সপ্তম বা অষ্টম শতকে এখানে গড়ে উঠেছিল ইউরোপের প্রথম বন্দর, এবং তার মাধ্যমে এই জায়গাটা পরিণত হয়েছিল এক জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্রে। নদীর ওপরে ছিল এক মনোরম ব্রিজ, এবং রোমান ভাষায় সেই ব্রিজ থেকেই শহরটার নাম হয় ব্রুজ।

সমুদ্র থেকে নদী, আর নদী বন্দর থেকে শহরের কোণায় কোণায় মাল পৌঁছে দেবার জন্য শহর জুড়ে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য খাল। সেইসব খাল বা ক্যানেল আজও আছে। আর সেই ক্যানেল দিয়ে এখন বোট রাইড হয় ঘণ্টায় ঘণ্টায়। গন্ডোলা যদিও চলে না এই ক্যানেলে, তবে খালের এই আধিক্যের জন্য এই শহরকে অনেকে উত্তরের ভেনিস বলেও ডেকে থাকেন। সময় থমকে আছে এখানে সেই ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ শতকে। অপূর্ব সুন্দর মধ্যযুগীয় বিভিন্ন বিল্ডিং, আর্কিটেকচার আর ইতিহাসের মিশ্রণে ব্রুজ আজ এক জমজমাট ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন।
শহরটা প্রথম প্রতিষ্ঠা করে ভাইকিংরা, ভাইকিং জলদস্যু, যাদের দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযানের গল্প আমরা ছোটবেলায় পড়ে এসেছি শুকতারা বা কিশোর ভারতীর মত পত্রিকায়। এই ভাইকিংরা আদতে ডেনিশ অরিজিনের। এদিক সেদিক ডাকাতি আর অভিযান চালিয়ে লুঠের মাল নিয়ে আসত এইখানে, আর সেইসব জিনিস কিনতে এখানে হামলে পড়ত সারা ইউরোপের ব্যবসায়ীরা। ইউরোপের প্রত্যেকটি দেশের ভাষা শুনতে পাওয়া এখানে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল একসময়ে।
বেলজিয়ামের উত্তর পশ্চিমদিকে নর্থ সী ঘেঁষে এই এলাকাটিকে বলা হয় ফ্ল্যান্ডার্স। ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলের মূল শহর আর ব্যবসাকেন্দ্র ছিল এই ব্রুজ, আর এখানকার তৈরি কাপড় ছিল ইউরোপে বিখ্যাত। ফ্লেমিশ ক্লথ নামে পরিচিত ছিল এখানকার কাপড়, আর কাপড় পরবার পদ্ধতিও। এই কাপড়ের ব্যবসার মূলে ছিল এখানকার চার্চ, এবং মহিলারা। সেই গল্পটা খুব অদ্ভূত।
ব্রুজ যখন আস্তে আস্তে পরিণত হচ্ছে একটা জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্রে, দেশবিদেশের নাবিক, ব্যবসায়ী, আরও নানারকমের লোকজন আসছে, মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব পড়ছে স্থানীয় জনজীবনে, সমাজে মেয়েদের অবস্থান কিন্তু বিশেষ পরিবর্তন হয় নি তখনও। মধ্যযুগের প্রথমদিকে মেয়েরা তখনও পর্দানসীন। এদিকে ব্রুজ জুড়ে বয়ে যাচ্ছে দেশবিদেশের হাওয়া, অথচ সেই হাওয়া এসে পৌঁছচ্ছে না ব্রুজের অধিবাসীদের অন্দরমহলে।
মেয়েদের আর্থিকভাবে, সামাজিকভাবে স্বাধীন হওয়া, স্বাধীন হওয়া বলতে নিজের জীবন নিজের ইচ্ছেমত কাটানোর অধিকারী হবার পথ খোলা ছিল দুটি। এক, চার্চের নান হয়ে যাওয়া, আর দুই, পতিতাবৃত্তি করা। মেয়েরা দুইই হত, নিজের নিজের মূল্যবোধের হিসেব অনুযায়ী (ইউরোপিয়ানদের শরীর নিয়ে ছুঁৎমার্গ আর ব্যক্তিগত মূল্যবোধের সংজ্ঞা ভারতীয়দের থেকে অনেক অনেক আলাদা – আজও)। চার্চে দলবদ্ধভাবে মেয়েরা এই কাপড় বুনতেন, সেলাই করতেন, চার্চের মাধ্যমে বিক্রি করতেন এবং অঢেল পয়সা উপার্জন করতেন। অন্যদিকে পতিতাবৃত্তিতে আসা মেয়েদের উপার্জনের রাস্তা ছিল শরীর। রোজগার কম হত না দেখে চার্চ সেখানেও হস্তক্ষেপ করেছিল। বাইবেলকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে কাস্টমারের সঙ্গে রতিক্রিয়া সারতে হত একজন ধর্মযাজকের চোখের সামনে। শেষ হলে কাস্টমারকে টাকা দিতে হত দুজনকেই, পতিতাকে তার সার্ভিসের জন্য, এবং যাজককে, তার পাপস্খালনের জন্য। অর্থাৎ, চার্চ কাপড়ের ব্যবসা এবং শরীরের ব্যবসা, দুদিক থেকেই ভাগ বুঝে নিত।
অষ্টম শতক থেকে চতুর্দশ শতক – প্রায় ছশো বছর ধরে ব্যবসার মূল ভরকেন্দ্র হয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে এর গুরুত্ব কমতে থাকে, কারণ ততদিনে নতুন পোর্ট আর ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে অ্যান্টোয়ার্প। ব্রুজের গুরুত্ব কমতে কমতে সপ্তদশ শতকের মাথায় একেবারেই কমে যায়। প্রায় দেউলিয়া হয়ে এই শহর ছেড়ে চলে যায় সমস্ত ব্যবসায়ী, শহরটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
এর পরের দুশো তিনশো বছর শহরটি লোকচক্ষুর আড়ালে ঘুমিয়ে থাকে, যতদিন না নর্থ সী-র ধার ঘেঁষে জীব্রুজ (Zeebrugge) নামে আরেকটি পোর্ট বানানো হয় (১৯০৭ সালে) আর ক্যানেলের মাধ্যমে এটির সাথে যুক্ত করা হয় মধ্যযুগের সেই ব্যবসায়িক ভরকেন্দ্রে থাকা শহরটিকে। ব্রুজ নতুন করে জেগে ওঠে, আর সেইভাবে ইউরোপের মূল ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে নয় যদিও, কিন্তু তার সমস্ত পুরনো কাঠামো, ঘরবাড়ি, অট্টালিকা সমেত ব্রুজ নতুন করে সেজে ওঠে এক ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে।

বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানির অধীনে আসে বেলজিয়াম সমেত এই ফ্ল্যান্ডার্স এলাকা, কিন্তু এত সুন্দর শহরটির রূপ দেখে মোহিত হয়ে নাৎসীবাহিনি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়, এখানে কোনওরকমের যুদ্ধ, বোমাবাজি ইত্যাদি ঘটানো হবে না, শহরটাকে তার সৌন্দর্যসমেত সংরক্ষণ করা হবে। সেই সংরক্ষণ আজও হয়ে চলেছে। একটা গোটা দিন নিয়ে ঘুরতে পারলে এর সৌন্দর্যের মর্ম বোঝা হয় তো কিছুটা সম্ভব হবে।
ও হ্যাঁ, বেলজিয়ান চকলেটের কথা বলছিলাম না? ইউরোপ তো বটেই দুনিয়ার সেরা চকলেটের আসল ভাণ্ডার আছে এখানেই, ব্রুজে। প্রতিটা মোড় ঘুরলে দেখতে পাবেন থরে থরে চকলেটের দোকান। হাজারো রঙ, স্বাদ, গন্ধ নিয়ে হাজির চকলেটের পশরা। কেউ কেউ তো আবার দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে বীনামূল্যে চকলেট বিতরণ করে সম্ভাব্য ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার আশায়। যে কোনও একটা দোকানে ঢুকে পড়ুন আর পছন্দমত চকলেট কিনে নিয়ে ব্রাসেলস ফেরার বাস ধরুন।
বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত, পেশায় ম্যানেজার হলেও ম্যানেজারিটা তেমন আসে না, পরিবারের থেকেও বেশি ভালোবাসে নিজের মোটরসাইকেলটিকে। সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ানো, আর সেই বেড়ানোর গল্প সবাইকে পড়ানো বিশেষ হবি। এর পরেও সময় বেঁচে গেলে ইতিহাস পড়ে। মানুষের ইতিহাস, যুদ্ধের ইতিহাস, আর ইতিহাসের ইতিহাস।
অসাধারণ বর্ণনা ও ইতিহাস।যা পড়তে পড়তে সত্যিই হারিয়ে যেতে হয় সেই দু তিনশো বছর আগে।খুব ভালো লাগলো।আমি ঘুরতে খুব ভালোবাসি।যদিও বেলজিয়াম আমার যাওয়া হয় নি।তবে ইউরোপের কিছু শহর আমি ঘুরেছি।সত্যি এর সৌন্দর্য্য বলে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যাইহোক আরও লিখুন আমরা পড়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করি।