“…history is the recollection of societies while folklore is the memory of societies.”
– Aurthur L Campa
বিগত ন’-দশ বছরে যতবারই কোনও অজানা শহরে গিয়েছি, সে শহরের ইতিহাসকে নিজের জন্য, নিজের মতো করে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি, নেহাতই নিজের ডায়রি লেখার অভ্যেসে। এ আমার নিজেরই খেয়ালখুশির অরাজকতা। গবেষণার কাজে, অথবা কনফারেন্সে একাধিক নামীদামি শহরে যেতে হয়েছে ঠিকই, তবে সে সব জায়গা এমনই পর্যটকে ঠাসা, যে ভিড় সরিয়ে তার অজানা ইতিহাসের কণামাত্র খুঁজে পেতে হলে কাজকম্মো ছেড়ে ইতিহাসবিদ হতে হয়। সে এলেম আমার নেই।
তবে গত ডিসেম্বরের ‘প্রাগ’ (চেক রিপাবলিকের রাজধানী শহর) যাত্রায় আমার সে দুঃখটা খানিকটা হলেও লাঘব হয়েছে। সে কথাই লিখতে বসা। তাছাড়া পুরনো প্রাগ “লেসার টাউনের” একটা গলির পুরনো বইয়ের দোকানের আলমারি ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাতে এসে পড়েছে এক অভাবনীয় সম্পদ। সে কথাও হবে, তবে একেবারে শেষে। আপাতত কয়েকটা জরুরি কথা বলা প্রয়োজন।
***
এমন ভাবা হয়ে থাকে যে ইতিহাস ও লোকসাহিত্য বৈপরীত্যের মাধমেই বিবর্তিত হয়েছে। যেন, ইতিহাস নিজে এক বিজ্ঞান এবং লোকসাহিত্য কেবলই ঠাকুমা-দিদিমার ঘুমপাড়ানি গপ্পোকথা। ইতিহাসের শৈলী ও বিবর্তনের গভীরে ডুব দিলে কিন্তু একেবারেই অন্য দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আসলে ইতিহাসের সঙ্গে লোকসাহিত্যের বন্ধুত্বই চোখে পড়ে, তার কারণ, দুইই শেষমেশ মানুষেরই গল্প বলে।
আধুনিক ইতিহাসের বিবর্তনের শুরু নিশ্চয়ই কোনও এক প্রাচীন গল্পকারের হাত ধরে। শ্লোক, মহাকাব্য বা ব্যালাডের সুরে সুরে বহু শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাপঞ্জি স্বেচ্ছায় সেই গল্পকারের ঠোঁট ছুঁয়ে যেত। তাতে অবশ্যই মিশত গল্পকারের রাজনৈতিক বা সামাজিক ঝোঁক বা Inclination। সামাজিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই গল্পকারেরা তাঁদের অভিজ্ঞতার গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হন এবং ধীরে ধীরে এই মহাকাব্য বা শ্লোকগুলিকে গদ্যাকারে রূপান্তরিত করতে শুরু করেন। সে সমস্ত গদ্যকেই আমরা পৌরাণিক কাহিনি বলে জানি। এমনই বহু পৌরাণিক গল্পকে কোনও না কোনও সময়ে কোনও না কোনও অভিজ্ঞ, দক্ষ সংকলক ঐতিহাসিক বিবরণ সমেত বই হিসেবে প্রকাশ করেন। আর সেটাই হয়ে ওঠে শতাব্দী-প্রাচীন লোকসাহিত্য।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, ইতিহাসে ক্ষেত্রে তথ্যের অভ্রান্ততার যে প্রয়োজনীয়তা, তা লোকসাহিত্যে কোথায়? ঘটনা হল, তথ্যের অভ্রান্ততার প্রয়োজন লোকসাহিত্যেও আছে। তবে তার ধরন কিঞ্চিৎ আলাদা। লোকসাহিত্যের একটি ব্যালাড বা কাহিনি এক কথক থেকে অন্য কথকের মুখে অল্প হলেও পরিবর্তিত হয়, সেই তার মাধুর্য। লোকসাহিত্যের নিজস্ব জীবন্ত বহমান সত্তা আছে এবং এই বহমানতাই তার স্পন্দন, তাত্ত্বিক স্থবিরতার জগদ্দলেই তার এপিটাফ। এক পুরা-কথনেই যেমন বলা হয়েছে;
“Facts are like stack, they won’t stand up untill you put something into it.”
পাঠক, তেমনই এক শহরের কথা আজ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। প্রাগ বা প্রাহা। আপনার হাতে হাত রেখে নিয়ে যেতে চাই তথ্য-রূপকথার অন্ত্যমিলের হাঁটাপথে। চলুন, দক্ষিণের ভায়সহ্রাড দুর্গ থেকে শুরু করে পুরনো প্রাগের অলিগলি ঘুরে, ভ্লাটভা নদীর উপর তৈরি বোহেমিয়ান চার্লস ব্রিজ হয়ে প্রাগ ক্যাসল পর্যন্ত ইতিহাস-লোককথার যুগলবন্দি নিজের চোখে দেখে আসা যাক।
***
হাজার-হাজার বছর আগের কথা। ভ্লাটভা (Vlatva) নদীর উপকুলবর্তী অঞ্চল তখনও একেবারেই মানব সান্নিধ্যে আসেনি। একদিন, এক পৌরাণিক ডিউক, “ডিউক ক্রক” সপারিষদ ঘুরতে ঘুরতে একটি পাহাড়ের নীচে এসে উপস্থিত হন। তাঁর দলেরই কিছু মানুষ হাঁটতে হাঁটতে পর্বতশিখরে পৌঁছন এবং চুড়া থেকে দৃশ্যমান ভ্লাটভার তীরবর্তী উপত্যকার দৃশ্য তাদের এতটাই মুগ্ধ করে যে পরবর্তী সময়ে ডিউক, তাঁর পারিষদ এবং প্রজা সমেত পর্বত-পাদদেশে ফিরে আসেন। ডিউকের আদেশে চুড়ার বন-জঙ্গল সাফ করে বানানো হয় দুর্গ। এভাবেই জন্ম হয় ভায়সহ্রাড দূর্গের।

বেশ কিছু বছর পর ডিউকের রানি তিন কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। তাদের নাম রাখা হয় কাজি, টেটা এবং লিবুসে। ভায়সহ্রাড দুর্গের দেখভালের দায়িত্ব বর্তায় যুবতী লিবুসের উপর। ছোটরাজকন্যা একাধারে ছিলেন যেমন বুদ্ধিমতী, তেমনই ছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তিনি ‘প্রিমিজল’ নামক এক কৃষককে বিয়ে করেন।
একদিন, রাজপ্রাসাদের জানলায় ভ্লাটভার উপর অস্তমিত সূর্যের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে লিবুসের মনে হয় তিনি একটি নির্দিষ্ট দিকে একটি শহরের অবয়ব দেখতে পাচ্ছেন। তাঁর আরও মনে হয় সে শহরের খ্যাতি একদিন আকাশ ছোঁবে। লিবুসে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যে যদি ওই নির্দিষ্ট দিকে নদীর ওপারে জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়, তবে এক পুরুষের দেখা পাওয়া যাবে যিনি অমানবিক কর্মক্ষমতার অধিকারী।
যেই কথা সেই কাজ। রাজকন্যার সৈন্যসামন্ত জঙ্গল সাফ করতে করতে পেট্রিন নামক এক পুরুষের দেখা পান। সে তখন তার নিজের বাড়ি বানানোর জন্য কাঠ জোগাড়ে ব্যস্ত ছিল। এই সেই পাহাড় যেখানে প্রাগ দুর্গ তৈরি হয় এবং তার ছত্রছায়ায় বিরাট বিরাট পাথুরে প্রাচীরের মধ্যে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে স্বপ্নের “প্রাহা” বা প্রাগ – যার ইংরেজি অর্থ “দোরগোড়া” বা “প্রবেশস্থল”। এই অপরূপা প্রবেশদ্বারের সৌন্দর্যের কথা আজ বিশ্বখ্যাত যার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হয়তো রাজকন্যা লিবুসেরই ভবিষ্যদ্বাণী।
***
এই রে! গল্পের তোড়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে পুরনো শহরের এক্কেবারে মাঝখানে এসে পড়েছি, খেয়ালই করিনি। এখানে বেশ খানিকটা সময় আপনাকে কাটাতেই হবে। এই চত্ত্বরটার নাম টিন (Tyn) ইয়ার্ড। চোখের সামনে যে দু’ দু’টো উঁচু উঁচু মধ্যযুগীয় মিনার দেখছেন, ওটাই বহুল পরিচিত “দা চার্চ অফ আওয়ার লেডি বিফোর টিন” (The Church of Our Lady Before Tyn)-এর টাওয়ার। এক ঝলক দেখলে দুটো টাওয়ারকে দেখতে একইরকম লাগতে পারে, তবে একটু ভালভাবে নজর করলে দেখা যাবে তফাতটা। একটা পুরুষ এবং আর একটা নারীর প্রতীক। এ শহরে এত অগুন্তি গির্জা রয়েছে, বলা মুশকিল কোনটি প্রথম তৈরি হয়েছিল।
পেগান আমলে এই গির্জার পাশেই বাস করতেন বোহেমিয়ার স্বনামধন্যা রাজকুমারী লুডমিলা। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের জন্য সে এক কঠিন সময়। রাজকুমারী দ্রাহোমিরার অত্যাচারে শহরের সমস্ত গির্জায় তখন তালা পড়েছে। প্রত্যেকদিন ভোর হওয়ার আগে লুডমিলা তাঁর নাতি ওয়েন্সেসলাসের হাত ধরে এই গির্জার গোপন প্রার্থনাকক্ষে উষাকালীন প্রার্থনায় আসতেন। এই ওয়েন্সেসলাসই ভবিষ্যতে প্রাগের রাজা হবেন। ওয়েন্সেসলাসের প্রতি অন্ধ অপত্যস্নেহই দুই রাজকন্যার মধ্যে শত্রুতার সূত্রপাত ঘটায়, এবং শেষ পর্যন্ত দ্রাহোমিরার ভাড়াটে আততায়ীর হাতে নিহত হন লুডমিলা।

টিন গির্জায় ব্যবহৃত ঘণ্টা সম্বন্ধে এক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
বহু বছর আগে এই টিন অঞ্চলে এক ধনী মহিলা বাস করত। বিস্তর ধনদৌলত থাকা সত্ত্বেও সে ছিল অত্যন্ত অত্যাচারী ও দুর্মুখ। কাজেই কোনও ভৃত্যই তার বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারত না। অগত্যা সে স্থানীয় এক গ্রাম্য গরিব তরুণীকে কাজে রাখল এবং তার উপর শুরু করল অকথ্য মানসিক-শারীরিক নির্যাতন। একদিন বিকেলে মহিলা তার বন্ধুদের সঙ্গে সান্ধ্য আড্ডায় বেরোবেন। মেয়েটি মালকিনকে সাজুগুজু করতে করছে। সাজ শেষের আগেই রোজের মতো সান্ধ্য প্রার্থনার ঘণ্টা বাজল গির্জায়। মেয়েটি হাতের কাজ মাঝপথে বন্ধ করে প্রার্থনায় বসল। এই অপমানে, রাগে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য মালকিন গলা টিপে মেয়েটিকে খুন করল।
প্রচুর টাকা আর ক্ষমতাবলে শাস্তির হাত থেকে বেঁচে গেল সে। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই শুরু হল খুনির বিবেকদংশন। মূলত সান্ধ্য প্রার্থনার ঘণ্টাধ্বনি তাকে পাগল করে তুলতে লাগল। বিবেকের তাড়নায় ধীরে ধীরে বাস্তব-বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করল সে। পার্থিব সবকিছুর প্রতি বিতৃষ্ণা জাগতে লাগল। জীবনের শেষ পর্যায়ে যন্ত্রনা যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে, সে ঠিক করল বাকি জীবনটা শহরের কোনও কনভেন্টে কাটাবে। চলে যাওয়ার আগে কামার ডেকে টিন গির্জার জন্য একটা বিরাট ঘণ্টা বানানোর নির্দেশ দিল সে। তার ইচ্ছে ছিল এই ঘণ্টার শব্দ কখনই তাকে মেয়েটির করুণ আর্তি ভুলতে দেবে না এবং তার আত্মার শান্তি কামনায় সমস্ত মানুষকে প্রার্থনায় ডাকবে।

এই টিন অঞ্চলের অলিগলিই পুরনো প্রাগের স্পন্দনময় ধমনী। বাড়ি ঘরগুলোয় একাধিকবার রঙের পোঁচ পড়লেও, দরজার অতিকায় আর্ক এবং পোর্টালগুলি অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে। Tyn কথাটা স্লাভনিক, যার অর্থ “একটা বেড়া দিয়ে ঘেরা রসদ মজুত করার জায়গা”। আসলে আগে এখানে বাজার ছিল। খুব সম্ভবত দশম শতাব্দীতে বোহেমিয়ার ডিউকদের আনুকূল্যে এখানে এক বর্ধিষ্ণু বাজার গড়ে ওঠে।

মধ্যপ্রাচ্য,ইউরোপ, ও পৃথিবীর নানা জায়গার বিস্তর সামগ্রী নিয়ে সদাগরেরা আসতেন। গ্রিস এবং তুরস্ক থেকে আসত ডুমুর আর কাঠবাদাম, পোল্যান্ড থেকে আসত রেশমবস্ত্র,উল, ভেনিস থেকে পোশাক ইত্যাদি। ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ থাকত পাঁচটা দিন। তার মধ্যে বিক্রি শুরু করতে না-পারলে জায়গা ছেড়ে দিতে হত অন্য ব্যবসায়ীকে। খাদ্যসামগ্রীর জন্য বরাদ্দ ছিল তিনদিন। সমস্ত সামগ্রী জমিয়ে রাখা হত Tyn চত্বরেই। তৈরি হয়েছিল ব্যবসায়ীদের আরাম-আমোদের বিপুল ব্যবস্থা- আজকের মোটেলের প্রাচীন সংস্করণ। সে কারণেই জায়গাটার আর একটা নাম “fronholf” বা “আনন্দের চত্বর”।
মজার ব্যাপার হল, ডিউকদের আজব নিয়ম, কেবল বোহেমিয়ান বা মোরাভিয়ানরাই এখানে কেনাকাটি করতে পারতেন। নিয়মকানুনের নজরদারির দায়িত্ব থাকত ফড়েদের উপর। উপরি-পাওনার লোভে নিয়মের এদিক-ওদিক হলেই দুর্গতি। কাঠের তক্তায় পেরেক দিয়ে জিভ আটকে দেওয়া হত। ছাড়া পাওয়ার একটাই উপায়, জিভ টেনে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে।
ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।