ফরিদ খান ছিলেন প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের অধীনে বিহারের সাসারাম অঞ্চলে এক সামান্য জাগিরদারের পুত্র। সামান্য জাগিরদারের পুত্র হলেও ফরিদ খান কিন্তু একেবারেই সাধারণ ছিলেন না। মুঘল সম্রাট বাবর তার চোখের ভাষা, বাক চাতুর্য ও বুদ্ধিমত্তা দেখে তার প্রধান উজির নিজাম উদ্দিন খলিফাকে লক্ষ্য করে বলেন, “লোকটি খুব চালাক। তার চোখে-মুখে রাজকীয় অভিব্যক্তি। আমি বহু আফগান অভিজাতকে দেখেছি। কিন্তু তার মত কাউকে দেখিনি। তাদের কেউ আমার উপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। আমি তার মধ্যে মহত্ত্ব ও বিশালত্বের ছায়া দেখেছি।“   

বিহারের জঙ্গলে বাঘ মেরে ফরিদ খান শের খান নামে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে এই শের খান বাবর পুত্র হুমায়ুন কে চৌসার যুদ্ধ (১৫৩৯) ও কনৌজের যুদ্ধ (১৫৪০) পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। শেরশাহ সুরি উপাধি ধারণ করে দিল্লির সিংহাসন আরোহণ করেন। সিংহাসন আরোহণের সঙ্গে শুরু হয় রাজ্য বিস্তার। ১৫৪৫ সালে মার্চ মাসে কালিঞ্জর দুর্গ আক্রমণের সময় এক বিস্ফোরণে শেরশাহ মারাত্মক ভাবে অগ্নিদগ্ধ হন। তাদের প্রিয় সম্রাটকে বাঁচাতে রাজ চিকিৎসকরা গোলাপ জলে গোলা চন্দন কাঠের প্রলেপ সম্রাটের ক্ষতস্থানে লেপে দেন। কিন্তু কোনও কিছুতেই কোনও কাজ হয়না। তিন দিনের মাথায় মৃত্যু হয় শেরশাহের। তাকে সাসারামের বিশাল মকবরা অর্থাৎ সমাধিতে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। 

শেরশাহ নির্মিত জি টি রোডের উপর সাসারামের অবস্থান। রেল পথে হাওড়া – মোগলসরাই লাইনে সাসারাম একটি স্টেশন। রাজধানী ও দুরন্ত বাদে প্রায় সব ট্রেনই সাসারামে থামে। হাওড়া থেকে সময় লাগে ১০ ঘন্টার মত। রাতে ট্রেনে উঠলে সকালে পৌছে যাবেন সাসারাম। স্টেশন থেকে বড় রাস্তা দু মিনিট হাঁটা। এখানে বেশ কিছু সাধারণ হোটেল আছে, কোন একটাতে চেক ইন করে একটু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ুন সাসারাম ভ্রমণে। 

সাসারামে কিন্তু শেরশাহের মকবরা ছাড়াও আরও অনেক কিছু দেখার আছে। শেরশাহের মাকবারার পাশেই তার বাবা হাসান শাহের মকবরা। একটু দূরে শেরশাহের পুত্র ইসলাম শাহেরর অর্ধসমাপ্ত মকবরা। শেরশাহ ও হাসান শাহের মকবরার স্থপতি ছিলেন আলিওয়াল খান। আলিওয়াল খানের মকবরাটি তিনি নিজেই  নির্মাণ করেন এবং সেটিও সাসারামে অবস্থিত। এছাড়াও সাসারামে আছে এক পরিত্যক্ত কেল্লার ধ্বংসাবশেষ। দেখার জিনিস কিন্তু খুব কম নয়, তাই সকাল সকাল কচুরি ও জিলিপি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে সাসারাম দর্শনে বেরিয়ে পড়ুন। 

সাসারাম শহরটি বেশ ঘিঞ্জি, রাস্তাতে কোন ফুটপাথ নেই এবং ট্রাফিক আইন মানার কোনও বালাই নেই কিন্তু হেঁটে শহর দেখার মজাই আলাদা, তাই পদযুগল কে ভরসা করে এগিয়ে চলুন। হোটেল থেকে একটু এগোলেই পোস্ট অফিস মোড়। মোড়ের ঠিক পর বাঁদিকে একটি রাস্তা, যে রাস্তার মুখে একটা গেট। মধ্যযুগীয় রীতিতে তৈরি এই নবনির্মিত গেট শেরশাহর মাকবারাতে আসা পর্যটকদের স্বাগত জানায়। গেট দিয়ে ঢুকে আবার সেই আঁকাবাঁকা ফুটপাত বিহীন পথ ধরে কিছুটা হাঁটার পর চোখে পড়বে শেরশাহের মকবরার বিশাল গম্বুজ। গাছপালা ও ঘড়বাড়ির উপর দৃশ্যমান এই গম্বুজ পুরনো ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। 

একটু এগোলেই শেরশাহের মকবরার প্রাঙ্গন। বিশাল পুকুরের মাঝে তৈরি কৃত্রিম দ্বীপে সুউচ্চ এই মকবরার অবস্থান। জলের মধ্যে থাকার জন্য স্থানীয়দের কাছে এটি ‘পানি রোজা’ নামে বেশি পরিচিত। পুরো প্রাঙ্গনটি রেলিং দিয়ে ঘেরা আর এর তত্বাবধানে আছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এ এস আই)। 

হাসান শাহ-এর মকবরা। ছবি রঙ্গন দত্ত।

তবে আপাতত পানি রোজা দর্শন না করে ‘সুখা রোজা’ দিয়ে সাসারাম দর্শন শুরু করুন। শেরশাহের মকবরার প্রাঙ্গনের পূর্বে অবস্থিত তার বাবা হাসান শাহের মকবরা। এর অবস্থান কিন্তু জলে নয় বরং ডাঙ্গাতে, তাই নাম সুখা রোজা। হাসান শাহের মকবরাটি একটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা যার চার কোণে চারটে গম্বুজ আকৃতির ছতরি। তিন দিকের দেওয়ালের মাঝে আছে খিলান যুক্ত প্রবেশ দ্বার, পশ্চিম দেওয়ালে প্রবেশ দ্বারে বদলে আছে একটা ছোট মসজিদ।  

হাসান শাহের মকবরা আটকোণা। আট দিকে তিনটে করে মোট চব্বিশটা খিলান যুক্ত প্রবেশ পথ। মকবরাটা দোতলা। প্রথম ও দ্বিতীয় তলের মধ্যে প্রতিদিকে তিনটে করে ছোট গম্বুজ। দ্বিতীয় তলের কোণায় গম্বুজ আকৃতির ছতরি আর মাঝে বিশাল গম্বুজ। মকবরার ভেতরে হাসান  শাহের কবরের সঙ্গে আরও বেশ কিছু কবর আছে, তবে মকবরার গেটে তালা তাই ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। হাসান শাহের মকবরাটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এ এস আই) তত্ত্বাবধানে থাকা সত্ত্বেও এর রক্ষণাবেক্ষণ খুব ভালো নয়। মকবরা প্রাঙ্গনে স্থানীয় ছেলেরা ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত থাকে।   

এর পর পায়ে পায়ে চলে আসুন সাসারামের মূল আকর্ষণ শেরশাহর মকবরায়। বর্গাকার বিশাল পুকুরের মাঝে একটা কৃত্রিম দ্বীপে অবস্থিত এই মকবরা। হাসান শাহের মকবারার মত এটাও আটকোণা এবং দোতলা। দুই তলের প্রতি কোনায় একটা করে ছতরি। সব মিলিয়ে ষোলটা। সবার উপরে একটা বিশাল গম্বুজ, যার ব্যাস ২০ মিটার। মকবরার আট দিকে তিনটে করে খিলান যুক্ত প্রবেশ পথ। ভেতরে শেরশাহের কবরের সঙ্গে আরও বেশ কিছু কবর রয়েছে আর পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে কিবলা, যার থেকে বোঝা যায় মকবরাটি মসজিদ হিসেবেও ব্যবহার হত। দ্বীপটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা যার চার কোণে চারটে গম্বুজ আকৃতির ছতরি। দ্বীপে পৌছনর জন্য একটা সাঁকোর মতন হাঁটা পথ আছে। 

শের শাহ সুরির মকবরা। ছবি রঙ্গন দত্ত।

এরপরের গন্তব্য শেরশাহের ছেলে ইসলাম শাহ (যিনি সেলিম শাহ নামেও পরিচিত ছিলেন) এর অর্ধসমাপ্ত মাকবরা। এটা বড় রাস্তার অন্য পারে সুতরাং আবার সেই আঁকাবাঁকা পথে বড় রাস্তা অবধি গিয়ে তার পর ফ্লাইওভারের পাশের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে কিছুটা গিয়ে ইসলাম শাহের মকবরা। সেই শেরশাহের মকবরার মতই এর নক্সা, তবে শোনা যায় তার চেয়েও বড় পুকুর ও মকবরা তৈরির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু প্রথম স্তরের পর আর কাজ এগোয় নি। বর্তমানে পুকুর ও মকবরার অবস্থা খুবই করুণ। কয়েকটা খিলানওয়ালা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। সেখানে খোলা আকাশের নিচে অনেক কবর, তার মধ্যে কিছু একদম সাম্প্রতিক। 

অনেক মকবরা দর্শন হল কিন্তু এতক্ষণে তো পেটে ছুঁচো ডন মারছে, তাদের এবার শান্ত করতে হবে। পায়ে পায়ে ফিরে আসুন পোস্ট অফিস মোড় অঞ্চলে। এখানে অনেক খাবার দোকান, বিক্রি হচ্ছে বিহারের জনপ্রিয় খাবার লিট্টি। লিট্টির সঙ্গে আছে আলু চোখা বা বেগুন ভর্তা। আর আছে নন ভেজ লিট্টি। লিট্টির সঙ্গে চিকেন ও মাছের হাল্কা ঝোলওয়ালা তরকারি। নন ভেজ লিট্টি দিয়ে পেটের ছুঁচোগুলোকে শান্ত করে বাকি সাসারাম ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ুন। 

খন্ডহর কিলা। ছবি রঙ্গন দত্ত।

হাসান শাহ ও শেরশাহের মকবরার স্থপতি ছিলেন আলিওয়াল খান। আলিওয়াল খান শেরশাহের নির্দেশে সাসারামে তিনটাে মকবরা নির্মাণ করেন। তিন নম্বর মকবরাটি ছিল তার নিজের জন্য। শেরশাহ চিরকালই একজন ব্যতিক্রমী রাজা ছিলেন এবং তার প্রিয় স্থপতিকে সম্মান জানানোর এই রীতি গোটা পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল। সাসারাম শহরের দক্ষিণ প্রান্তে একটি মুসলিম গোরস্থানের মধ্যে আলিওয়াল খানের মকবরা। এই বার পদযুগলের ভরসা ছেড়ে উঠে পড়ুন অটোতে (আটোটা রিজার্ভ করতে হবে)। তবে গোরস্থানের গেটে তালা তাই বাইরে থেকেই আলিওয়াল খানের মাকবরা দর্শন করতে হবে। এরপর সাসারামের শেষ গন্তব্য একটি পরিত্যক্ত দূর্গ। সাসারামের সবজি বাজারেরর মধ্যে এর অবস্থান, সঠিক ইতিহাস ঠিক জানা যায় না তবে স্থানীয় লোকজন বলে খন্ডহর কিলা।  কেল্লার অবস্থা খুবই খারাপ, সামনের অংশটা প্রস্রাবখানা ও ময়লা ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার হয়। ভেতরে কিছু লোক মদ্যপানে ব্যস্ত থাকে। এবার অটো করে ফিরে আসুন হোটেলের সামনে, একটু জিরিয়ে নিয়ে নানা ধরনের কাবাব দিয়ে ডিনার সারুন। আর হাতে আর এক দিন সময় থাকলে পরের দিন ঘুরে নিতে পারেন সাসারামের কাছের দূর্গ ও জলপ্রপাত।  

প্রয়োজনীয় তথ্যঃ

কলেজে পড়ার সময় টিউশনির টাকা জমিয়ে ভ্রমণ শুরু। তারপর ভ্রমণের নেশায় আর চাকরি করা হয়েই ওঠেনি। বর্তমানে একটি কলেজের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি। সেই সঙ্গে চলে ভ্রমণকাহিনি লেখা, ছবি তোলা, নিজের ব্লগ চালানো আর উইকিপিডিয়া সম্পাদনার কাজ।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *