২১ আগস্ট ২০১৩, সন্ধ্যে ৬:২০
যে হারে ছুটছি তাতে পরের দু’দিন লেখার সময় পাব বলে মনে হয় না। তাছাড়া, চোখের সামনে ইতিহাসের যে জ্বলজ্যান্ত বিবর্তন প্রত্যক্ষ করে চলেছি সারাদিনে, তেমন দ্রষ্টব্য যদি পরের দু’দিনও অপেক্ষা করে তবে সমস্তটা ঘেঁটে গিয়ে কোনওকিছুই আর ঠিক মতো বলা হবে না। বিগত বেশ কিছু দিনের ডায়েরি এন্ট্রিও বাকি পড়ে আছে।
আমাদের বাস এখন কুশাদাসির হোটেলের পথে। সকলেই ঘুমের দেশে। এই সময়টাই কাজে লাগানো যায়।
***
আমার পিএইচডি জীবনের শুরু বছর দেড়েক আগে, ফেব্রুয়ারী ২০১২-তে। ইস্তানবুলে ঘাঁটি গেড়েছি ঠিকই, তবে ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাস থেকে মানব সভ্যতার দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। তাছাড়া স্কলারশিপের টাকায় মাসের খরচ চালিয়ে হাতে যেটুকু বাঁচে তাতে “ভেকেশান” প্ল্যানও করা চলে না, আর বাড়ি যেতেও ঢের দেরি। । কাজেই “মরীচিকা স্থলে মরীচিকা”!
সুযোগটা পারভিন করে দিল। একটা ছোটখাটো টুরিজ়ম কোম্পানি জনা ত্রিশেক ছাত্রছাত্রীর জন্য সস্তায় একটা বাস-ট্রিপের আয়োজন করছে। আমার দায়িত্ব, চটপট খবর নিতে হবে। দিন চারেকের ট্রিপ। ফোন লাগালাম। আধা ইংরেজি আধা তুর্কীতে যা বোঝানোর বুঝিয়ে পাঁচ জনের ব্যাংক ট্রান্সফারও করা গেল। ঘণ্টা তিনেক পরে এফে (আমাদের টুর গাইড)-এর মেইলও হাজির। আমরা যাচ্ছি তুরস্ক-গ্রিসের মধ্যবর্তী এজিয়ান সাগরের তুর্কী উপকুলে। জায়গাটা প্রধানত অটোম্যান (ওসমান)-তুর্কদের তৈরি সেলচুক প্রদেশ।
***
ইস্তানবুল থেকে আমাদের বাস ছেড়েছে রাতে। রাস্তায় একটা বেশ মজার ঘটনা ঘটেছে। ঘণ্টাখানেক চলার পর হঠাৎ খেয়াল করি, ইস্তানবুলের একদম শেষ প্রান্তের (এশিয়ার দিকে) গেবজে বন্দর থেকে আমাদের বাস, সবশুদ্ধ প্রায় দুম করেই একটা বিরাট জাহাজে উঠে পড়েছে। প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেছিলাম। বাস থেকে ডেকে নামার পর আয়োজন দেখে তো চক্ষু আরও চড়কগাছ। গাড়ি, বাস, লড়ি, মানুষ, কারগো পেটের ভিতর নিয়ে এই বিরাট জলযান চলেছে গজেন্দ্র গমনে। আহারে! একজন বেগুন বিক্রেতা রমণী পেলে, আমার “কুম্ভীর বিভ্রাট” থিয়েটার করার স্কুল জীবনের স্বপ্নটার একটা স্টেজ রিহার্সাল হত। সে গুড়ে বালি। মিনিট ৪০ জলযাত্রার পর “ইয়ালোভা”য় পৌছে, বন্দরের কাগজপত্র সামলে আরও মিনিট পনেরো পর বাস আবার ছেড়েছে। এবার শুধুই স্থলযাত্রা। ভোর ভোর আমরা পৌছবো ইজমির শহরে।
***
ইজমির তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর একটি। প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো তার বসতি। সে সময়ে তার নাম ছিল স্মির্ণা। এই স্মির্ণাই ইলিয়াড-ওডিসি মহাকাব্য রচনার জন্য বিশ্বখ্যাত হোমার সাহেবের জন্মভিটে। এরপর মধ্যযুগ, পারস্য-রাজ, সেকন্দর শাহ, রোমান এবং সবশেষে ওসমানদের হাত ঘুরে ইজমিরের জন্ম আধুনিক তুর্কীদের হাতে। তাছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, গ্রেকো-তুর্কী যুদ্ধ, কুখ্যাত আরমেনিয়ান খ্রিষ্টানদের গণহত্যা… এমন নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্থানপতনের সাক্ষীও থেকেছে এ শহর।
আমাদের বাসটা যেখানে থেমেছে তার দু’দিকে ঝকঝকে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ। রাস্তাটা ধরে মিনিট তিনেক সোজা হাঁটলেই এজিয়ান উপকূল। বেশ জমিয়েই প্রাতরাশ সেরেছি। সমুদ্রতটে খানিকটা ঘোরাঘুরিও হয়েছে। সকাল সাড়ে দশটা বাজে। এবার বাস ছাড়ার পালা।
***
আমাদের পরের গন্তব্যটাই আমার কাছে এই ভ্রমণের সর্বোৎকৃষ্ট আকর্ষণ। জায়গাটার নাম “সিরিঞ্জে”। পাহাড়ের উপর তৈরি ছোট্ট একটা ঐতিহাসিক শহর। লিস্টে বড় বড় নাম থাকতেও সিরিঞ্জের উপর আমার এই বিশেষ আগ্রহের কারণ, তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ও গ্রিক পুরাণ।
সিরিঞ্জে শব্দটার অর্থ একটি নান্দনিক বা সুন্দর জায়গা। পাঠক শুনলে অবাক হবেন যে এ শহরের পূর্বনাম ছিল “চিরকিঞ্জে”- অর্থাৎ “কদর্য” (পরে অবশ্য নতুন নামটির সার্থকতা বেশ টের পেয়েছি)। তবে নামটার বুৎপত্তি নিয়েও একাধিক গল্প শোনা যায়। কোনও গল্পেরই অবশ্য বিশেষ তাত্ত্বিক ভিত্তি নেই।

খুব সম্ভবত তুর্কো-মোগল সম্রাট “তৈমুর”-এর ভয়ে পাশের শহর এফেসাসে বসবাসকারী কিছু মানুষ এখানে এসে বসবাস শুরু করেন, এবং নাম দেন “সলমিসোস”। অন্য একটি সংস্করণে শোনা যায়, কিছু গ্রিক ক্রীতদাস পালিয়ে এসে ওই পাহাড়ে জীবনযাপন শুরু করে। জায়গাটা যাতে অন্যান্য পথচারিদের আকর্ষণ না করে তাই নাম দেওয়া হয় “চিরকিঞ্জে”। গল্পের তৃতীয় একটি সংস্করণও রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ৪০ জন গ্রিক ক্রীতদাস পালিয়ে এসে এখানে বসতি স্থাপন করে, এবং জায়গাটার নাম দেয় “কিরকিঞ্জা”। তূর্কী ভাষায় “কির্ক” অর্থ চল্লিশ।
এছাড়া গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, ঐশ্বরিক যমজ, যুদ্ধের দেবী আর্টেমিস এবং সূর্য দেবতা অ্যাপোলো দু’জনেই এই অঞ্চলেই জন্মেছিলেন। এফেসাসের প্রজারা আর্টেমিসকেই তাঁদের আরাধ্যা দেবী হিসাবে পূজা করতেন। সে ধ্বংসস্তূপে আর্টেমিসের মন্দিরের ভগ্নাংশ এখনও রয়েছে। তাছাড়া কাছেই অবস্থিত গ্রিক মেট্রোপোলিস শহরের ধ্বংসাবশেষে রয়েছে অ্যাপোলোর মন্দিরের অংশবিশেষ। এফেসাসের অবস্থান ছিল Cenchrus (Kenxrios) নদীর তীরে। কাজেই এই নাম থেকেই সিরিঞ্জে নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও শোনা যায়। এই এফেসাসই পরবর্তিকালে অটোম্যানদের সেলচুক শহর হয়ে ওঠে।
যাই হয়ে থাকুক, এবার আমরা খ্রিষ্টপূর্ব গ্রেকো-রোমানদের পেরিয়ে প্রাক-মধ্যযুগীয় ও মধ্যযুগীয় পূর্ব-রোমান (বাইজানটাইন) রাজত্বের কথায় আসি। ১০০০-১২০০ শতাব্দীর মধ্যে তৈরি বাইজানটাইন অ্য়াকুইডাক্ট বা জলজ-নালার (এফেসাস ও আশেপাশের শহরগুলির মধ্যে) সন্ধান পাওয়া যায় সিরিঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। এছারাও বিভিন্ন ছোট বাইজানটাইন বাড়ি, সেলচুক থেকে সিরিঞ্জে আসার রাস্তায় বেশ কয়েকটি গুহার মুখে চলটা ওঠা ফ্রেসকোয় খ্রিস্টান পাদ্রিদের ছবিও দেখা যায়। গুহাগুলোর দেওয়ালে খোদাই করা একাধিক লেখায় পাওয়া যায় যিশুর প্রতি তখনকার মানুষের করুণ আর্তির কথা।

১৩৫৩ থেকে তুরস্ক অটোম্যানদের হাতে থাকলেও, ১৯২০ সাল পর্যন্ত সিরিঞ্জে মূলত অর্থোডক্স গ্রিকদের বাসস্থান ছিল। ১৮০০-১৯০০ শতাব্দীর মধ্যে, নিজেদের উৎপাদিত ডুমুর এবং তামাকের জন্য সিরিঞ্জের ইউরোপ জোড়া খ্যাতি (পাঠক আপনার কি “লর্ড অফ দা রিংস”-এর লং বটম টোবাকো লিফের কথা মনে আছে?), ধন সম্পদও বিস্তর। এই সময়েও সে শহরের নাম কিরকিঞ্জে।
১৯১২ সালে, বলকান যুদ্ধের সময়, কিছু কিরকিঞ্জেবাসী গ্রিক, শহরকে গ্রিসের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। তুরস্কের সুলতান নিজের বজ্রমুষ্টির জোরে তখনকার মতো অশান্তি সামলাতে সমর্থ হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রিক সৈন্যরা তুরস্ক আক্রমণ করার পর এ শহরের বহু মানুষ সেই বাহিনীতে সামিল হন। ১৯২৩ সালে মুস্তাফা কেমাল আতাতুর্কের হাত ধরে তুরস্কে গণতন্ত্র স্থাপনের পর, ১৯২৪ সালে গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে নাগরিক বিনিময় হয় এবং তার পর থেকে থেসসালনিকির তুর্কীয় সম্প্রদায় সিরিঞ্জেতে বসবাস করতে শুরু করেন। ঐতিহাসিক কিরকিঞ্জের গ্রিক সম্প্রদায় এখন উত্তর গ্রিসে থেসসালোনিকির কাছেই নিয়া-এফেসাস (নতুন এফেসাস) নামক এক শহরের বাসিন্দা। তুর্কী-গ্রিক যুদ্ধের কথা লিখতে গিয়ে লেখক ডিডো সোতিরিউও বলেছেন, “…মন্দ গ্রিক বা মন্দ তুর্কী বলে কিছু নেই, আছে কিছু মানুষ যারা শুধুই শিকার…”।
***
প্রায় ঘণ্টাখানেক রুক্ষ তুরস্ক-ভূমির বুক চিরে আমাদের বাস একটা মাঝারি সাইজের গেটের কাছে এসে থেমেছে। তাতে লেখা “আর্টেমিস সারাপলেরি”। জিজ্ঞেস করায় এফে তার তুর্কী ভঙিমায় এক চোখ মেরে জানিয়েছে “ইকি সাত সোনরা”, অর্থাৎ ঘণ্টা দু’য়েক পর। কিন্তু ঘণ্টা দু’য়েক পর যে কী হবে, তা একেবারেই বলেনি। সারাপ মানে তো সুরা। তা বেড়াতে এসে এক আধ গ্লাস দিনের শেষে চলতেই পারে। তবে এখানে তার প্রয়োজন কেন? যাইহোক. আমরা একটা টিলা লক্ষ্য করে দলবেঁধে এগোতে লাগলাম।

শহর বলে যেটাকে বলা হয়েছে, সেটা আসলে পাহাড়ের উপর কারপেটের মতো বিছিয়ে থাকা একটা চোখ জুড়নো গ্রাম। টিলা লক্ষ্য করে এগোতে এগোতে এদিক ওদিক তাকালেই দু’ধারে চোখে পড়ে শান্ত ছোট ছোট বাড়ি। তার মাঝখান দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, খ্রিষ্টপূর্ব-গ্রিসের সময়কার পাথুরে রাস্তা, ইতিহাসের হাত ধরে নেমে গেছে। এমনটাই তো দেখবার কথা ছিল! আমরা আরও একটু এগিয়ে চললাম। খানিকটা চলার পরই একটা বেশ জমজমাট চত্বর চোখে পড়ল। চতুর্দিকে ঠেলাগাড়ির উপর বোঝাই করা রাশি রাশি হাতে তৈরি পণ্য, তাছাড়া দোকান তো আছেই। এই সবই সিরিঞ্জের নিজস্ব উৎপাদন। শীতকালের সময়টুকু ছাড়া বিশ্বজোড়া পর্যটকের জন্য সে এভাবেই তার ডালি সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকে। এফে জানিয়েছে, আমাদের হাতে এখানে বসে জিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিনিট দশেক সময় আছে।

কাজেই হয় খাবার, নয় জল না হয় নেহাত বাথরুম সেরে আমরা আবার হাঁটতে শুরু করেছি। আরও অন্তত মিনিট কুড়ি চলার পর টিলার কাছাকাছি যে জায়গাটায় পৌঁছলাম সেখানে আসলে একটা অর্থোডক্স গ্রিক চার্চ রয়েছে। নাম সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট চার্চ। আমেরিকা প্রবাসী ইতিহাসবিদদের খননকার্যের ফল এই ইতিহাস-সমৃদ্ধ পাথরের টুকরোটি। কিন্তু আমার জন্য তার থেকেও অনেক বেশি আগ্রহের কথা হল, চার্চের উঠোন পেরিয়ে যে পাঁচিল, তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালে সমগ্র গ্রামটার একটা প্যানোরামা পাওয়া যাচ্ছে।
ছবিগুলো তুলতে গিয়ে অবাক হয়েই খেয়াল করেছি যে প্রত্যেকটি বাড়িই লাল টালি আর সাদা দেওয়ালের। ফলে গোটা গ্রামটাই এখনও মধ্যযুগের গ্রিক নান্দনিকতাকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। এই ছোট্ট পাহাড়ের কয়েকশো মানুষও জানেন ইতিহাসই মানবিকতার শেকড়, তবেই না বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ডানায় ভর দিয়ে ওড়া সম্ভব! এইতো আমার মানুষ, এই তো আমাদের বৃহত্তর অস্তিত্ব!
***
নিজের চোখে ধরা এই অভাবনীয় সময়-যাত্রা আর তা নিয়ে নিজের মনেই নানা কথার আনাগোনায় কখন যে সময় পেরিয়ে গেছে, খেয়াল করিনি। এফে কাঁধে হাত রেখেছে। এবার নামতে হবে। আর মাত্র ঘণ্টা দেড়েকেই সন্ধ্যা নামবে। তার আগে বাকিটুকু দেখা সেরে আমাদের কুসাদাশির হোটেলে ফিরতে হবে।

পরের গন্তব্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করায় ওই “সারাপ” রহস্যের উদঘাটন হল। সেই মধ্যযুগ থেকেই সিরিঞ্জে তার আবহাওয়া এবং অবস্থানের জন্য নানারকম বেরি (berry) উৎপাদনের জন্য আদর্শ। গ্রিকরা তাদের বসবাস শুরুর দিন থেকেই তাই নানাবিধ ফল থেকে ওয়াইন তৈরি করে এসেছে। ১৯২৪-এর নাগরিক আদানপ্রদানের পর যখন সিরিঞ্জের পর্যটন আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে শুরু করল, সেই শিল্পের সাহায্যার্থে তুরস্কের সরকার এখানে “ফ্রুট ওয়াইন টেসটিং”-এর ব্যবস্থা করে দেন। বর্তমান সিরিঞ্জের আর একটি অনবদ্য আকর্ষণ, যাকে বলে “আইসিং অন দ্য কেক”। সে কারণেই চার্চে ওঠার সময় সারি দিয়ে পানশালা আর ওয়াইনের দোকান দেখেছি।

শহরের মাঝামাঝি এসে এফে আমাদের আধঘণ্টা সময় দিল। আমরাও যে যার মতো যে দোকানে পারলাম ঢুকে পড়লাম। একের পর এক নানা ফল থেকে তৈরি ওয়াইন চেখে দেখার সঙ্গে সঙ্গে এক আধ বোতল করে পকেটস্থ করাও শুরু হল। ছাত্রজীবনে পকেট যতটা আবদার সইতে পারে আরকি। সে পালা সাঙ্গ হল যখন, তখন সন্ধ্যে হয় হয়। হাজার চেষ্টা, হুমকিতেও বেচারা এফে আমাদের ত্রিশ জনকে এক করতে পারেনি আধঘণ্টায়। বাস ছেড়ে দেবে এবার। এফে রেগে একেবারে আগুন হয়ে আছে!
এতজন মধুর তুরস্কবাসির নেশা-মাধুর্য্যই যে শহরের জীবনকাঠি, সে শহর যে ২০১২ সালের “মায়ান ডুমস ডে”র “সেফ হ্যাভেন” জায়গাগুলির একটি ছিল, এতে আর আশ্চর্য কী?
২৩শে অগস্ট ২০১৩, রাত ১২:৪০।
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়, ইউনিভার্সিটির কৃপায় পাওয়া স্টুডিও এ্যাপার্টমেন্টের দরজাটা দড়াম করে খুলে, উদাত্ত সোফাদু’টোয় নিজেদের ছুড়ে ফেলতে ফেলতেই ভেবেছিলাম, “যা গেল এই চারদিন, তাতে ভাতে-ভাত গুঁজে গোটা উইকেন্ডটা নাক ডাকিয়ে কাটিয়ে দেব।“ ভাববারই কথা। একে তুরস্কের গনগনে গরম, তার উপর আমরা বেড়ানোর নামে যা মোচ্ছব করে এসেছি, তাতে শরীর বাবাজি যে আমায় ফেলে উলটো মুখে হাঁটা লাগাননি এই রক্ষে।
কোনওক্রমে চান, আর দু’মুঠো ডাল-ভাত সেরে দু’জনেই ঠেলাঠেলি করে তিনহাত বিছানাটায় দেহ রেখেছি। অর্ধাঙ্গিনী এক কথার মানুষ। মিনিট পনেরোয় নাক ডেকেছেন। এদিকে আমি বিগত আধ ঘণ্টায় চোখের পাতা এক করতে পারিনি। মনটা আনচান করছে। এ ক’দিনে ইতিহাসের যে জীবন্ত স্বাক্ষর শরীর মনে বহন করে নিয়ে এলাম, তার বাকিটুকু খাতার পাতায় উগরে দিতে না পারলে আজ ঘুম আসবে না।
এক কাপ চা করে আনি। হস্টেলের পেছনের ট্যানারির সদা-খয়েরি আকাশ আরও অনেকক্ষণ তারাময়, মিশকালো থাকবে। সে দুর্ভাগ্যে চিরতরে ফিরে যাওয়ার আগের শেষ মুহুর্তগুলো জিউস-আর্টেমিস-অ্যাপোলো বা নেহাত সেলচুক রোম্যান্টিসিজ়মেই কেটে যাক।
ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।
ভালো লাগল