২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ড্রেসডেন, রাত ১:২০২০১২ সালে ইস্তানবুল পাড়ি দেওয়ার পর থেকেই মূলত পড়াশোনার কারণে বাকেট-লিস্টের জায়গাগুলো ছাড়াও আরও বেশ কিছু ইতিহাস-প্রোজ্জ্বল জায়গার উপরও বেশ প্রখর একটা লোভ জন্মেছিল। ২০১৩ সালে সেলচুক দেশে ‘সিরিঞ্জ’-এর ফ্রুট-ওয়াইন ও হিয়েরাপোলিস-পামুখালের নান্দনিকতা সে তেষ্টা কিছুটা মেটালেও দুটো জায়গা আমার ছ’বছরের তুরস্কবাসেও গিয়ে ওঠা হয়নি। এক নম্বর “মাউণ্ট নেমরুট” আর দু’ নম্বর তুরস্কের মধ্য-প্রাচ্য অঞ্চলের “ক্যাপাডোকিয়া”। তুরস্ক ছেড়েছি গত ফেব্রুয়ারি মাসে। বাসা বেঁধেছি ড্রেসডেন শহরে। চাকরির প্রোবেশনারি পিরিয়ড শেষ হতে না হতেই ঠিক করেছি – ক্যাপাডোকিয়া — হয় এবার নয় নেভার। প্রবীরদা-চিত্রালিদির সঙ্গে এই সুযোগে একটা রি-ইউনিয়নও হয়ে যাবে।২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর – ছ’দিনের ট্রিপ। যাওয়ার পথ— জার্মানির বার্লিন থেকে ইস্তানবুলের সাবিহা গোকচেন এয়ারপোর্ট। প্রবীরদাদের বাড়িতে দিন দু’য়েক জমিয়ে আড্ডা দিয়ে, পয়লা অক্টোবর আমরা উড়ে যাব ক্যাপাডোকিয়ার কায়সেরি এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। ক্যাপাডোকিয়ার উপর আমার এই অপরিসীম আকর্ষণের ভিত্তি যতটা ঐতিহাসিক, ঠিক ততটাই ভূতাত্ত্বিক। প্রায় ছ’কোটিবছর আগে এই জলাভূমিহীন বদ্ধ অঞ্চলটির ভৌগোলিক বিবর্তনের সূত্রপাত।এমন সুররিয়ালিস্টগঠনবিশ্বেরঅন্যতমবিস্ময়।ইউরোপীয়আল্পসছাড়াওদক্ষিণআনাতোলিয়ারটরাসপর্বতমালাভূতাত্ত্বিকবিকাশেরতৃতীয়তরঙ্গের সময়কালে (খ্রিস্টপূর্ব ৬.৫কোটি–২০ লক্ষ্যবছরআগে) গঠিতহয়েছিল।এই বিবর্তনের “আলপাইনপিরিয়ড” চলাকালীনগভীরফিশার (ফাটল)এবংবিরাট বিরাটনিম্নচাপ (গর্তের মতোঅঞ্চল) তৈরিহয়। এই “ফ্র্যাকচারিং”প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাবসারফেস ম্যাগমা শঙ্কুর আকারে উপরে উঠে আসে। সেই ছাই টাফের মতো শক্ত হয়ে তৈরি হয় ব্যাসল্ট-স্তরে আবৃত এক-একটা ছিদ্রযুক্ত ভুশভুশে শিলা। এবার পালা বাতাস, বৃষ্টি, তুষার এবং নদীর হাত ধরে এক সুদীর্ঘ অবক্ষয়ের। সহস্রাব্দ পেরিয়ে, নরম টার্ফের সাময়িক অবক্ষয়ের পর পড়ে থাকে প্রায় ১৩০ ফুটেরও বেশি উঁচু উঁচু থাম। যেহেতু ব্যাসল্টের অবক্ষয়ের হার তুলনায় অনেক কম, তাই থামগুলোর উপর প্রতিরক্ষামূলক মাশরুম-আকৃতির টুপি তৈরি হল। এই থামগুলোরই নাম “ফেয়ারি চিমনি”।
ব্যাসল্ট পাথরের থামের উপর প্রতিরক্ষামূলক মাশরুম-আকৃতির টুপি। তারই নাম ফেয়ারি চিমনি। ছবি সৌজন্য – travelonspot.comক্যাপাডোকিয়ায় মানববসতির সূত্রপাত আদিপ্রস্তরযুগে, হিট্টাইটদের হাত ধরে।খ্রিস্টপূর্বদ্বাদশশতাব্দীতেহিট্টাইটসাম্রাজ্যেরপতনেরপর আসিরিয়াএবংফ্রিগিয়ারপ্রভাবের সাহায্যেকিছু বিতাড়িতহিট্টাইটরাজা ফিরে এসেঅঞ্চলটিশাসনকরেছিলেন।এইরাজ্যগুলিখ্রিস্টপূর্বষষ্ঠশতাব্দীর পারস্যআগ্রাসনঅবধিস্থায়ীছিল।আসলে ফার্সি ভাষায় ক্যাপাডোকিয়াশব্দেরঅর্থ “সুন্দরঘোড়ারদেশ“।খ্রিস্টপূর্ব৩৩২-এ, সেকেন্দার শাহফার্সিদেরপরাজিতকরলেওক্যাপাডোকিয়ায়দুর্দান্তপ্রতিরোধেরসম্মুখীনহন, যদিও তিনি নিজে কখনও এ অঞ্চলে আসেননি।এই যুদ্ধের হাত ধরেই ক্যাপাডোকিয়া সাম্রাজ্যের স্থাপনা হয়।খ্রিস্টপূর্বতৃতীয়শতাব্দীরশেষেরদিকেএইঅঞ্চলেরোমানশক্তিঅনুভূতহতেশুরুকরে। (খ্রিস্টপূর্ব) প্রথমশতাব্দীরমাঝামাঝিসময় থেকেনানান রোমান সেনাপতিরা রোম থেকে বিতাড়িত হয়েএকে একে ক্যাপাডোকিয়ার সিংহাসনে উপনীত হতে থাকেন।প্রথমখ্রিস্টাব্দেকাপাডোকিয়ারশেষরাজাপ্রয়াত হলেঅঞ্চলটিরোমেরএকটিপ্রদেশেপরিণতহয়।তৃতীয়শতাব্দীর সময় থেকেখ্রিস্টানদের আগমনের উপর ভিত্তি করে এই অঞ্চল ধীরে ধীরে শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। তা ছাড়া জায়গাটি তখন খ্রিস্টানদের জন্য রোমান অত্যাচারের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করাএবং একই সঙ্গে নিজেদেরমতবাদবিস্তারেরআদর্শস্থান।রোমান সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচতে তাঁরা ফেয়ারি চিমনির ভিতরের নরম পাথর কেটে গুহা তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করেন। সে সমস্ত গুহা-ঘর আজ ঐতিহাসিক স্তম্ভ তো বটেই, তা ছাড়া তাদের কিছু কিছুতে একাধিক বিলাসবহুল হোটেলও গড়ে উঠেছে। একসময়হিট্টাইটরাযেসবজায়গায়বসবাসকরতসেগুলিওপরবর্তীকালেখ্রিস্টধর্মেরগুরুত্বপূর্ণকেন্দ্রহয়ে ওঠে।গুহার দেওয়ালেএবংগির্জার দেওয়ালে ফ্রেস্কোর সারি তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। চতুর্থশতাব্দী“ক্যাপাডোকিয়ারপিতা” দেরসময়।রোমেরসম্রাটতৃতীয়লিওনখ্রিস্টান-আইকনগুলিকেনিষিদ্ধকরারসময়এইঅঞ্চলেরগুরুত্বচূড়ান্তপর্যায়েপৌঁছয়।এইপরিস্থিতিতে, কিছুআইকনোক্লাস্টিক অনুগামী এখানেআশ্রয়নিতেশুরুকরেন।এই আইকোনোক্লাজ়মআন্দোলনএকশোবছরেরওবেশিসময়ধরে (৭২৬-৮৪৩) চলেছিল।কিছুগির্জাএইসময়ে আইকনোক্লাজ়মেরপ্রভাবেপড়ায়আইকনপন্থীলোকেরাএখানেসহজেই তাঁদেরপূজাচালিয়েযেতেপারতেন।আবারএকইসময়কালেআরবঔপনিবেশিক আগ্রাসনআর্মেনিয়াথেকেক্যাপাডোকিয়াপর্যন্তআনাতোলিয়ারখ্রিস্টানঅঞ্চলগুলিকেপ্রভাবিতকরতেশুরুকরে।আক্রমণথেকেপালিয়েআসামানুষেরাএইঅঞ্চলেগির্জা-শৈলীরপরিবর্তনঘটান।একাদশওদ্বাদশশতাব্দীতেক্যাপাডোকিয়াসেলচুকতুর্কীদেরহাতেযায়।একটা বিস্তীর্ণ সময় এ অঞ্চল অটোমানদের অধীনে বেশ শান্তিতেই ছিল। ১৯২৪–২৬সালেলসানচুক্তির নাগরিকবিনিময়েরকারণেসর্বশেষখ্রিস্টানরাক্যাপাডোকিয়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হনএবংকয়েক হাজার বছরের স্থাপত্যের নিদর্শন তৎকালীন তরুণ তুর্কীদের উপহার দিয়ে যান। এছাড়াও ইতিহাসজুড়েবিভিন্ন উপনিবেশ ও দেশেরমধ্যেবাণিজ্যিকওসামাজিকসেতুবন্ধনের মাধ্যমে, ক্যাপাডোকিয়ানিজেকেসিল্করুটেরঅন্যতমগুরুত্বপূর্ণশহর হিসাবেও প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
***
১ অক্টোবর ২০২০, কোজা কেভ হোটেল, ক্যাপাডোকিয়া, রাত ১২:১৫মন মেজাজ এক্কেবারে ভাল নেই। চিনা নববর্ষ আর আবহাওয়া মিলে, আমাদের বছর ছয়েক ধরে জমিয়ে রাখা প্ল্যানের যে এই ভাবে বারোটা বাজাতে পারে তা জানলে টিকিটটাই কাটতাম না! যত্তসব! যাই হোক লিখতে যখন বসেছি তখন শুরু থেকে শুরু করি।২৮ তারিখ আমাদের ফ্লাইট যখন সাবিহায় নামলো তখন সন্ধ্যে গড়িয়েছে। সেপ্টেম্বর মাস, মৃদু চেনা ঠান্ডা, ভরপুর ইস্তানবুলীয় নস্টালজিয়ায় একটা ট্যাক্সি নিয়ে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস পৌঁছতে মিনিট কুড়ি। দিনদুটো হুহু করে শহর, পুনরাবিষ্কার, জমিয়ে আড্ডা আর পেটপুজোয় কীভাবে কেটে গেছে টের পাইনি। গতরাতে প্রায় জোর করেই আমরা গল্পের শেষটা অন্তিম-ইস্তানবুল-রজনীর জন্য তুলে রেখে নিদ্রাগত হয়েছি।ফেয়ারি চিমনির ভিতরে তৈরি হোটেল কোজ়া কোভ। ছবি লেখকের তোলা।আজ সকালে গোছগাছ করতে করতে আবার খানিক খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা হয়েছে। সাড়ে দশটা নাগাদ অতি পরিচিত সেকের-ট্যাক্সিকে ফোন করে ডেকে নেওয়া হল। ফ্লাইট অল্প সময়েরই। দুপুর ১২:১০ এ সাবিহা থেকে ছেড়ে আমাদের কায়সেরি নামাবে ১:৩৫ নাগাদ। অন্যান্য কিছু ছোট ছোট জায়গা থাকলেও ক্যাপাডোকিয়ার মূল আকর্ষণ ‘গোরেমে’। এই ‘গোরেমে’ জুড়েই ফেয়ারি চিমনিদের রাজপাট। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে গোরেমেরই “কোজা কেভ হোটেলে”। নামটা শুনেই পাঠক নিশ্চই বুঝতে পারছেন এই সেই সুপ্রসিদ্ধ ফেয়ারি চিমনি খুঁড়ে তৈরি খ্রিস্টান গুম্ফার নতুন বিলাসবহুল চেহারা। এটা অবশ্যই আমাদের ট্রিপের একটা প্রধান আকর্ষণ।
***
আমরা যেখানে নেমেছি, সেই কায়সেরি থেকে গোরেমে খানিকটা দূর। গোরেমের দিকে একটা এয়ারপোর্ট আছে ঠিকই তবে সেদিকে ফ্লাইটও কম আর টিকিটের দামও আকাশছোঁয়া। সুতরাং এই ব্যবস্থা। এবার ঘটনা হল, আমাদের সঙ্গে হোটেলের যা কথা হয়েছে, তাতে একটা শাটল বাসের আসার কথা। কিন্তু তার লেশমাত্র কোথাও নেই। অতএব একটা ট্যাক্সি বুক করা গেল। আমার মতে অবশ্য বেড়াতে এসে এক আধবার পকেট খসিয়ে গাড়িতে চড়া কাজেই দেয়। নিজের চোখে নিজের মতো করে গোটা রাস্তাটা উপভোগ করা যাবে।৭২ কিলোমিটারের পথ। ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগবে, বেশ লম্বা ড্রাইভ। ইস্তানবুলের মতো সেপ্টেম্বরের দুপুরে এখানে তেমন ঠান্ডা পড়ে না। তবে সেটা দুপুর বলে। পাঠক মনে করুন এই অঞ্চল মূলত আগ্নেয়গিরি থেকে উৎসারিত পাথর দিয়ে তৈরি, মানে ভলকানিক রক টেরেইন। দিনেদুপুরে যতই গরম থাকুক, রাতে বেশ ঠান্ডাই আশা করছি আমরা। তাই সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে শীতের পোশাক রয়েছে। এয়ারপোর্ট চত্বর পেরিয়ে যে রাস্তাটা ধরেছি সেটা এই অঞ্চলের ডি-২৬০ হাইওয়ে। আমরা কায়সেরি শহরে ঢুকব না, কারণ এই সময়টায় রাস্তায় ভিড় হতে পারে। বরং তাকে বাঁ হাতে রেখে এগিয়ে গিয়ে ডি- ৩০০ ধরব। এই রাস্তাই আমাদের পৌঁছে দেবে ফেয়ারি চিমনির দেশে।ফেয়ারি চিমনির ভেতরে হোটেলের ঘর। নিচু পাথুরে ছাদ আর ঘেঁষাঘেঁষি দেয়াল। ছবি সৌজন্য – booking.comএমন দেশ পৃথিবীর বুকে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে, ভাবলে অবাক লাগে। একটা সময়ের পর গোটা রাস্তাটায় গাছপালা প্রায় দেখিনি বললেই চলে। তবে বালি নেই, কারণ এ তো আর মরুভূমি নয়। শুধুই পাথর, কেবল পাথর। খয়েরি, হলুদ, বাদামি নানা রঙ এই সমস্ত পাথরের, আর তার সঙ্গে রয়েছে এই সমগ্র প্রস্তরখণ্ডের উপর কয়েক লক্ষ-কোটি বছর ধরে বয়ে চলা বায়ু-বৃষ্টি-বরফের চিরাচরিত অবক্ষয়ের চিহ্ন, যা আজও বহমান। এই বিপুল সাময়িক বিস্তারের তুলনায় আমাদের গোটা মানবসভ্যতার অস্তিত্বকাল একবার চোখের পলক ফেলার সময়টুকুর সমানও হবে না। সৃষ্টির কি বীভৎস পরিহাস! আর সেটা না বুঝে-সুঝে আমরা নিজেদেরই এই বিশ্ব সাম্রাজ্যের সম্রাট ঠাউরেছি। হায় রে মানব চেতনা! ডি-৩০০ ছেড়ে আভহানোস শহরের ধার ধরে বাঁ দিক নিলেই “গোরেমে ইয়োলু” অর্থাৎ যে রাস্তা গোরেমে চলেছে। আভানোস, তুরস্কের বৃহত্তম নদী “কিজ়িলিরমাক”-এর পাশে গড়ে ওঠা এক বর্ধিষ্ণু শহর। আর মাত্র মিনিট পনের। আমাদের আশেপাশের ল্যান্ডস্কেপ বলে দিচ্ছে পাথরের রঙ পালটাচ্ছে, তার সঙ্গে মাঝে-সাঝে উঁকি দিচ্ছে এক আধটা ছোট থেকে মাঝারি টিলা। গন্তব্যে পৌঁছে কি নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে পাব সেই প্রত্যাশায় দু’জনের কেউই বেশ অনেকক্ষণ কথাই বলিনি।
***
গোরেমে নিরাশ করেনি মোটেই। বেশিরভাগ বেড়ানোর জায়গায় যা হয়- গুচ্ছ হোটেলের ভিড়ে সে জায়গার নিজস্ব মজাটা হারিয়ে যায়- এ ক্ষেত্রে তেমন কিছুই হয়নি। নেড়া পাথুরে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ একনাগাড়ে চলার পর আমাদের গাড়ি যে কাঠামোটির (হ্যাঁ কাঠামোই মনে হয় প্রথমে) সামনে আমাদের নামাল, তা দেখে একটু হকচকিয়েই গিয়েছিলাম। এই নাকি আমাদের কোজা কেভ হোটেল? একটা দরজা আছে ঠিকই, তাতে বেশ ফুল-পাতাও রয়েছে, তবে সেটা হোটেল হলে থাকার জায়গা কোথায়?সে সমস্যা মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মিটিয়ে দিলেন সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা হোটেলের তরুণী ম্যানেজার। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁ হাতে উঠে গিয়েই একটা ছোট্ট চত্বর পড়ল। তার ঠিক পেছনেই খাড়া উঠে গেছে বেশ কয়েকটা টিলা। তেমনই একটি টিলায় কোনা করে একটা গুহার মধ্যে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। এ তেমন ঘর, যেমন ঘরে হয়তো বা কখনও সদ্য রোম থেকে বিতাড়িত এক খ্রিস্টান সাধক নিজের বাঁচার শেষ সম্বলটুকু খুঁজে পেয়েছিলেন। ঘরের মধ্যে কোনওরকমে নিজেদের জিনিসপত্র রেখে হাত-মুখ ধুয়ে আমরা প্রায় তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তার গায়ের পাঁচিল ধরেই নেমে গেছে ফেয়ারি চিমনির জমজমাট রাজত্ব। ছবি: শারদীয়া বর্ধন রায়আমাদের “ফেয়ারি গৃহকোণের” বাইরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাঁ হাতে মিনিট দুয়েকের চড়াই রাস্তা ছাড়াতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল- তেমন পার্থিব সৃজন নিজের চোখে দেখার জন্য ছ’বছর কেন ছ’ জন্ম তপস্যা করা যায়। যে রাস্তায় আমরা হাঁটছি, সেই রাস্তার ঠিক ধার ঘেঁষে একটা পাঁচিল। পাঁচিলের গা ঘেঁষে বেশ নিচু একটা খাদ নেমে গেছে। আর সেই খাদের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সেই সৃষ্টির আদি পর্বে গজিয়ে ওঠা টাফ-ব্যাসল্টের “মাশরুম স্ট্রাকচার”- অর্থাৎ ফেয়ারি চিমনি। আর ওই যে তার গায়ে খোদাই করা গর্ত, ওগুলো সেই সমস্ত ঐতিহাসিক বসবাসকারীদের আলো ও বায়ুর সংস্থান। এ চত্বরটা গোরেমের সরকার হোটেল তৈরির জন্য বরাদ্দ করেনি এবং তার ফলে এর আশপাশে যে সব থাকার জায়গা গজিয়ে উঠেছে, সেগুলোতে রাত কাটানো আমাদের মতো পর্যটকদের কাছে উজাড় করে দেয় এক প্রাগৈতিহাসিক যাপন। এমনই তো কথা ছিল!
ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।