খট্ খট্ করে একটা শব্দ হচ্ছে। আওয়াজটা মনে হয় জানালা থেকেই আসছে। হাওয়া দিচ্ছে বোধহয়। ঘড়িতে দেখলাম রাত দেড়টা। ঘুম যখন ভেঙেই গেছে, একটু উঠে দেখি। বিছানার পাশেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি চারিদিক অন্ধকার। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়! এদিকে তো আলো জ্বলছিল, আর দূরের পাহাড়ের গায়ে আলো দেখা যাচ্ছিল। সন্দেহ হওয়ায় জানালা খুলে দেখি মেঘে ঢেকে আছে চারিদিক, জানলা খোলার ফলে ঘরেও মেঘ ঢুকে এলো। মা বাবা জেগে যাওয়ার আগে তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।
আজ আমরা এসেছি মিম বস্তিতে। মিম টি এস্টেট (Mim Tea Estate) বা মিম টি গার্ডেন হল সুখিয়াপোখরি থেকে লেপচাজগতের মাঝে একটু নীচের দিকে চা বাগানে ঘেরা এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা। এই চা বাগান ঘিরেই গড়ে উঠেছে মিম গ্রাম বা মিম বস্তি। আমরা এন জে পি থেকে একবারেই গাড়ি ভাড়া করে এখানে পৌঁছেছি, তবে শিলিগুড়ি বা এন জে পি থেকে শেয়ার গাড়িতে করে সুখিয়াপোখরি পর্যন্ত এসে সেখান থেকে আবার মিম আসার শেয়ার গাড়ি পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন- অন্য ভ্রমণ: নোভা স্কটিয়া
সুখিয়াপোখরি থেকে ডানদিকের জঙ্গলের রাস্তা ধরে কিছুটা নেমে গেলেই শুরু হয় চা বাগান। সেই চা বাগানের রাস্তা ধরে অনেকটা নীচে নেমে আমরা এসেছি আমাদের হোমস্টেতে। আজ আমরা পৌঁছানোর পরেই জোর বৃষ্টি নামলো। তাই আজ আর ঘুরতে পারিনি। কাল ঘুরে দেখবো গ্রামটা।

পরের দিন সকালে উঠে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। আমাদের ঘরের জানালা দিয়েই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। কিন্তু আকাশ খুব মেঘলা। তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা তো অনেক দূরের কথা, সামনের পাহাড়টাও দেখা যাচ্ছে না। তবু জলখাবার খেয়ে ছাতা নিয়ে তিনজনে বেড়িয়ে পড়লাম। এখন বৃষ্টি হচ্ছে না। চা বাগানের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। অসমান রাস্তা, বোঝা যায় এই অঞ্চলে খুব বেশি গাড়ির যাতায়াত শুরু হয়নি। লোকও বিশেষ আসে না এদিকে, তা আগেই লক্ষ্য করেছি। রাস্তায় আমরা ছাড়া আর ট্যুরিস্ট চোখে পড়ছে না। রাস্তার দুদিকেই চা বাগান, তার মাঝে মাঝে বাড়ি। যেন মনে হচ্ছে আমাদের গ্রামবাংলায় গ্রামবাসীরা যেমন বাড়ির সামনের ফাঁকা জমিতে সবজি, ফুলের গাছ লাগায় বা এক ফালি জমিতে চাষ করে, তেমনই ওরাও ওদের বাড়ির সামনের বাগানে ফাঁকা জমিতে চা চাষ করেছে। রাস্তার ধারে গাছে কত পাখি, তাদের ডাক শুনে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। প্রকৃতির টানেই তো এখানে আসা। গায়ের ওপর দিয়ে মেঘ ভেসে যাচ্ছে, কখনও সামনের রাস্তা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, আবার কিছুক্ষণ পরেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। চারিদিক নিস্তব্ধ— শুধু পাখির ডাক আর হাওয়ার একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ। দুদিকে চা বাগান দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ওই চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে। গল্পে যেমন পড়ি, পাহাড়ের কোলে চা বাগানের মধ্যে একটি ছোট্ট বাংলো, এ যেন ঠিক তেমনই। সামনে বিস্তীর্ণ চা বাগান, দূরে পরপর পাহাড়ের সারি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখা মিলবে কাঞ্চনজঙ্ঘারও। আহা যেন স্বপ্ন! মনে মনে ভাবলাম, যদি আমাকে একদিনও কেউ এখানে থাকতে দিত!

এই মিম টি গার্ডেন তৈরি হয়েছিল ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি। প্রায় ৩৯০ হেক্টর জুড়ে ছড়ানো এই চা বাগানটি দার্জিলিং–এর একমাত্র চা বাগান, যা ভারত সরকারের অন্তর্গত এবং আন্দ্রে ইউল চা কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত। এই ‘মিম’ কথাটি এসেছে ‘মেম’ কথাটি থেকে। এই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষজন মনে করত এই চা বাগানের মালিক এক ইংরেজ মহিলা এবং তাঁকে তারা ’মেমসাহেব’ বলত, সেই ‘মেমসাহেব’ থেকেই ‘মিম’ কথাটির উদ্ভব।
বাংলো থেকে বেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম আন্দ্রে ইউল চা কারখানার সামনে। শতাব্দী–প্রাচীন এই চা কারখানা হয়তো কতকিছুর সাক্ষী। কারখানার এক কর্মী আমাদের ভেতরটা ঘুরিয়ে দেখালেন। কোন যন্ত্রে চা পাতা শুকিয়ে কোন যন্ত্রের মাধ্যমে বাছাই করা হয় সবই আমাদের বোঝালেন। ফেব্রুয়ারি মাস বলে এখন চা পাতা তোলা বন্ধ। আবার পাতা তোলা শুরু হবে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে, তাই এখন কারখানার কাজও বন্ধ। তাও মনে মনে ভাবলাম, চা বাগানে কাজ করছে শ্রমিকরা, দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ি ছিঁড়ে পিঠের ঝুড়িতে রাখছে এবং সেই পাতা থেকে অনেক পদ্ধতির মাধ্যমে চা তৈরি হয়ে শহরে পৌঁছাচ্ছে এবং সেই চা–ই হয়তো সকালের কাপে আমাদের কাছে আসছে।

এই চা কারখানার উল্টোদিকেই আছে ব্রিটিশ আমলের এক হেরিটেজ হোটেল, এবং তার সামনে বিরাজমান চা বাগান। দূরে পাহাড়ের গায়ে রাস্তা দেখা যাচ্ছে, আর পাহাড়ের গা ঘেঁসে উড়ে বেড়াচ্ছে মেঘের সারি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকেও দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা।
আবার আমরা হাঁটতে শুরু করলাম গ্রামের রাস্তা ধরে। একটি ছোট্ট বাড়ির সামনে দেখি অ্যাজেলিয়া ফুলে ভরে আছে। সেই বাড়িরই এক খুদে সদস্য সাইকেল চড়ছে বাগানে, সামনে যেতেই ভয় পেয়ে বাড়িতে ঢুকে গেল। জানা গেল ওরা নতুন এসেছেন এখানে, বাড়ির কর্তা শহরে গেছেন তাই বাড়িতে বাচ্চা ও তার মা–ই আছেন শুধু। ওদের বাড়ি থেকে এগিয়ে এসে দেখি দুই ভাই-বোন ব্যাডমিন্টন খেলছে। জানা গেল, স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, তাই এখন ওদের ছুটি। আরও হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম, কোনও বাড়ির গৃহবধূ হয়তো বাগানে সবজি তুলছে, আবার কোনও বাড়ির বারান্দায় সেই বাড়ির বয়স্ক সদস্য বসে আছেন। ছবির মতো সুন্দর গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কতক্ষণ কেটে গেছিল জানি না, হঠাৎ গায়ে দুফোঁটা বৃষ্টির জল পড়তে চমক ভাঙল। বৃষ্টি নামতেই তাড়াতাড়ি হোমস্টেতে ফিরতে হল।

দুপুরে বৃষ্টি থেমে গেলেও মেঘ আর কাটল না। বারান্দায় বসে দেখতে লাগলাম মেঘের খেলা। যেন মনে হচ্ছে আমাদের সামনে একটা ধোঁয়ার দরজা আর সেই দরজার ওপারে এক আলাদা জগৎ। সেই জগৎ থেকে হঠাৎ করে কোনও মানুষের উদয় হচ্ছে, আবার কিছু দূরে গিয়ে তারা অদৃশ্যও হয়ে যাচ্ছে। শুনলাম, পাহাড়ের গা দিয়ে অনেকটা হেঁটে উপরে গেলে একটা মনাস্ট্রি আছে। আর চা বাগানের রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা নীচে নামলে একটা নদী আছে। নদীর ধারে আমরা যাব না, কিন্তু কাল আকাশ পরিষ্কার থাকলে মনাস্ট্রিতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। ধীরে ধীরে আলো কমে আসায় আমরা আমাদের ঘরে চলে গেলাম।
পরের দিনও আকাশ পরিষ্কার হল না। বরং আবহাওয়া আরও খারাপ হল। আজ এক ফুট দূরত্বেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। এই আবহাওয়ায় আর মনাস্ট্রির দিকে যাওয়া যাবে না। তাই দার্জিলিং চলে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম।নীচের গ্রাম থেকে গাড়ি করে যাত্রী নিয়ে আমাদের হোমস্টের সামনে এলে আমরা সেই গাড়িতে উঠলাম। রাস্তায় এক ব্যক্তি তাঁর বাগানের চা নিয়ে উঠলেন,সেই চা যাবে সুখিয়াপোখরিতে বিডিও সাহেবের বাড়িতে।
দুদিনের এই মিম সফর সত্যিই খুব ভালো লাগল আমাদের। সপ্তাহের শেষে, শহরের কোলাহল ছেড়ে এখানে এসে দুদিন কাটাতে আপনাদেরও ভালোই লাগবে। আমরাও আবার আসব, আর ভাগ্য ভালো থাকলে হয়তো আকাশও পরিষ্কার পাব— দর্শন মিলবে কাঞ্চনেরও।
*ছবি সৌজন্য: লেখক
অঙ্কিতা দত্ত জার্নালিজম ও মাস কমিউনিকেশনে স্নাতক, মিউজিকে মাস্টার্স করেছেন। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর ছাত্রী। বর্তমানে গান শিখছেন অনল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। গানবাজনা ও লেখালেখি — দুইই প্যাশন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশ হয়।
Sotty e darun laglo…… Lekha ta porte porte mone holo jeno ami nijei pouche gchi okhane….. Lekhikake ank dhonyabad o afuran sevevcha❤️🙏🏻