আমার পরবর্তী গন্তব্যস্থান নৈনিতাল পেরিয়ে কইঞ্চিধাম। অনেকের কাছে হয়তো অজানা, মার্কিনি দুনিয়ার দুই বিখ্যাত শিল্পপতি- অ্যাপল ও ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জোবস, মার্ক জুকেরবার্গ ও প্রখ্যাত অভিনেত্রী জুলিয়া রবার্টস এখানে এসেছিলেন। স্টিভ জোবসের জীবনীতে ইঙ্গিত-উল্লেখের পর বহু মানুষের কাছে একথা অবিদিত নয়, যে এই তিন বিশিষ্ট ব্যক্তি নিব কারোরি বাবার (প্রচলিত নাম: নিম কারোলি) আশীর্বাদ পেয়ে অসামান্য সাফল্য লাভ করেছেন।
কইঞ্চিধামে এই বিগত মহাত্মার চিরন্তন আশীষ মাথায় নিয়ে যাত্রা করলাম আমার হিমালয় ভ্রমণের প্রথম কারণ- পরমহংস যোগানন্দের “অটোবায়োগ্রাফি অফ এ যোগী” তে উল্লিখিত কুকুচিনার প্রত্যন্ত জঙ্গলে, বাবাজি মহারাজের আর এক গুহা দেখতে। এখানেই নাকি যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীকে তিনি ক্রিয়াযোগে প্রশিক্ষিত করেন। কৈশোরে পড়া ভারত-সাধকের সে গল্প এখনও আমাকে আকর্ষণ করে।

রানিক্ষেত থেকে কৌশানির পথে দ্বারহাট যাবার রাস্তা, আর সেখান থেকেই ধুনাগিরির পার্বত্য অঞ্চল শুরু। দ্বারহাট ছেড়ে বেরোতেই চারদিকের শোভা বদলে গেল। কোথায় মৌসুমী বৃষ্টি? ধুনাগিরির পাহাড়ে হেমন্তের রেশ। শ্রাবণের মেঘ কেটে ঝকঝকে আকাশে সাদা মেঘের ঢেলা। নীলাম্বরী পাহাড়ের বিন্যাস অপরূপ শৈলিতে গাঁথা আর তাতে সতেজ সবুজের আলপনা। মনে হল ধুনাগিরি বিধাতার এক অনন্য সৃষ্টি।
প্রকৃতির কিছু রূপ অন্তর দিয়ে উপভোগ করতে হয়, চর্মচক্ষে সাধ মেটে না, আলোকচিত্র তো দূরের কথা। ভাবলাম ভালই করেছি ক্যামেরা আনিনি। লেন্সে এই সৌন্দর্যকে ধরা তো যেতই না বরং হতাশা আরও বাড়ত। তার থেকে পানকৌড়ির মতো আমি একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম, কখনও চোখ বুঁজে ধুনাগিরিকে অনুভব করার চেষ্টা করলাম।
অবশেষে পৌঁছলাম ধুনাগিরি মায়ের মন্দিরে। কুমায়নের ৮০০০ ফিট উচ্চতায় প্রসিদ্ধ শক্তিপীঠ। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর হিমালয় সফরে এই পুণ্যস্থানে ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন। রাস্তায় মধ্যাহ্নভোজের সুযোগ হয়নি, ঘড়ির কাঁটা তিন প্রহরে। জঠরাগ্নি জ্বলে উঠলে আর কোনওদিকে খেয়াল থাকে না। মন্দিরের ৩৬৫টি সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় খাবার চিন্তায় মন ব্যাকুল ছিল। ধুনাগিরি মা দয়াময়ী- তিনি সন্তানকে অভুক্ত রাখেননি। মাতৃদর্শনের পর ভাণ্ডারাতে সুস্বাদু তরকারি ও সুজি সহযোগে উপাদেয় লুচি ভোগ (যা বহু বাঙালির মতো আমারও সবচেয়ে প্রিয়) পরম তৃপ্তি দিয়েছিল। এখনও সে স্বাদ ভুলতে পারিনি।

ধুনাগিরি থেকে কুকুচিনার দূরত্ব অল্পই। সেখানে যোশির গেস্ট হাউসে রাত্রিবাস। তার সঙ্গে আগে বহুবার ফোনে কথা হয়েছে। তাই আয়োজনের কোনও ত্রুটি ছিল না। যোশির বাবা আর এ গ্রামের প্রায় সবাই বাবাজি মহারাজের আশীর্বাদধন্য। পরদিন সকালে বাবাজি মহারাজের গুহা দর্শনে রওনা হলাম। সেখান থেকে পাণ্ডবখোলি- পর্বতশিখরে প্রশস্ত চারণভূমি। কিংবদন্তি আছে, যে পবনপুত্র এই পর্বতচূড়াকেই বগলদাবা করে আকাশপথে পাড়ি দিয়েছিলেন লক্ষ্মণের প্রাণরক্ষা করতে।
তবে পাণ্ডবখোলির নামকরণ হয়েছিল পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর এখানে অজ্ঞাতবাসের জন্য। সাহিত্যসৃষ্টি সমাজ ও স্থানীয় অঞ্চলকে ঘিরেই হয়। তাই ব্যাসগুহা মানাগ্রাম থেকে অনতিদূরে, কিন্তু বিচ্ছিন্ন এই পাণ্ডবখোলি গুপ্তাবাসের জন্য নির্বাচন অতি সমীচীন।

যোশির গেস্টহাউস থেকে যেতে যেতে ভাবলাম ১৫৭ বছর আগে রেলকর্মচারি এক বাঙালি তরুণ, শ্যামাচরণ লাহিড়ী এ পথে হেঁটেছিলেন, আর তাঁর প্রথম দেখা হয়েছিল হিমালয়ের মহানায়ক বাবাজি মহারাজের সঙ্গে। বাকি সব ইতিহাস। এখন সুদূর ক্যালিফোর্নিয়াতে যোগানন্দ স্থাপিত সেলফ-রিয়ালাইজ়েশন ফেলোশিপ এই প্রসিদ্ধ গুফার সংরক্ষণের ভার নিয়েছে। প্রতি বছর ইউরোপ-আমেরিকা থেকে দলে দলে বহু বাবাজি-অনুগামী এখানে আসেন।
পথে আবার বৃষ্টি শুরু হল। আমার পিঠে ভারী ব্যাকপ্যাক। হাতে ট্রেকিং পোল। রাস্তা পিচ্ছিল। রাকেশের অভাব বোধ করছিলাম। বিদেশি প্রভাবে এ পথে কিছু নিশানা-চিহ্ন ও যোগানন্দের বাণীর তকমা লক্ষ করলাম। বাবাজি গুফার আগে সেলফ-রিয়ালাইজ়েশন ফেলোশিপের একটি ছোট কর্মশালা। বুঝলাম শুধু ক্রিয়াযোগ অথবা বাবাজি-অনুগামিত্ব নয়, বিদেশি কিংবা অনাবাসী ভারতীয় হিসাবে ডলার না দেখালে এখানে বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এরপর বিখ্যাত বাবাজি গুফা দর্শন। তবে সত্যি-বলতে, হেইড্যাখানে গৌতমী গঙ্গার তীরে আদিম গুহাতে যে অধ্যাত্ম-শান্তি লাভ করেছিলাম, এখানে সে অভিজ্ঞতা হল না। এই গুফা অপেক্ষাকৃত অনেক বড়, ভিতরে বেশ কিছু দর্শনার্থী যারা কলরবে মুখর।

বাবাজী গুফার পাশ দিয়ে পাণ্ডবখোলিতে ওঠার রাস্তা অত্যন্ত দুরূহ। প্রতিপদে বিপদের সম্ভাবনা। এই খাড়াই পথে আরোহণের একটিই উপায়। যোশি বলেছিল- বৈদ্যুতিক তারের নিশানা অনুসরণ করতে হবে। ভুলক্রমে পথ হারালে ৮৮০০ ফিট উচ্চতা থেকে যমরাজের দক্ষিণ দুয়ারে সরাসরি রাস্তা। তুমুল বৃষ্টিতে চারিদিক কুয়াশাছন্ন। আর পিঠের ব্যাকপ্যাকে জল ঢুকে গুরুভার বেড়েই চলেছে। নিম্নগামী জলের ধারা খরস্রোতা। নামার ঝুঁকি বেশি- তাই চলতে হবে অতি সাবধানে। স্নায়বিক দুর্বলতা কাটাতেই হবে। মনের সমস্ত শক্তি জড়ো করে প্রতি পদক্ষেপে একাগ্রতা রাখলাম। আর ভাবলাম যদি বাবাজি মহারাজের মক্ষিরূপে গমনের উপায়টা জানতাম!
অবশেষে জীবনহানির বহু আশঙ্কা কাটিয়ে পাণ্ডবখোলির ধর্মশালায় পৌঁছলাম। এখানের বাসিন্দা রামসিং ও তাঁর তরুণ পুত্র জীবন। যোশি আগেই তাদের বলে রেখেছিল। মন্দিরের একটি মাটির ঘরে স্থান হল। ছুটি কাটাতে কেউই পাণ্ডবখোলি আসে না। তাই ধর্মশালায় যেমন সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিশেষ ব্যবস্থা নেই, তেমন বাণিজ্যও নেই। হিমালয়ের এই প্রত্যন্ত স্থানে অর্থকরী ব্যবসা এখনও প্রধান হয়ে ওঠেনি। সেবাই এদের ধৰ্ম। মাটির উনুনে হাপর টেনে জীবনের হাতে তৈরি গরম রুটি আর সবজি বড় উপাদেয়।
মুশকিল হল একটাই। পরদিন গ্রামের একটা বড় দল রামলীলার অনুষ্ঠান উপলক্ষে এখানে পৌঁছল। খাবার ছাড়া আর সমস্ত সুবিধা তো সীমিত। সাধনার জন্য না হলেও শৌচালয়ে ভিড় এড়াতে ব্রাহ্মমুহূর্তের অনেক আগে উঠে পড়তাম। পাণ্ডবখোলির চত্বর টেবলটপ্ আকৃতির বারান্দার মতো। পাহাড়ের শিখরে মখমলের মতো তৃণভূমিতে গরু চরছে। প্রতি কোণ থেকে অভাবনীয় প্যানোরামিক দৃশ্য। রাকেশের মতো এখানেও এক অগ্রদূত জুটে গেছিল। ট্রেকিং নয়, হাঁটা রাস্তায় সে আমাকে নিয়ে গেছিল পান্ডবখোলির পশ্চিমপ্রান্তে।
এ জায়গা দ্রৌপদী বিহার নামে খ্যাত। দ্রৌপদী সত্যিই ছিলেন কিনা আর থাকলেও তিনি এখানে বৈকালিক ভ্রমণে আসতেন কিনা, তার প্রমাণ নেই কোনও। তবে এখান থেকে হিমালয়ের দৃশ্য অবর্ণনীয়। অর্ধচন্দ্রাকৃতি বারান্দার সামনে পাহাড়ের সারি। যেদিকে দু’চোখ যায়, শুধু সবুজ মখমলে মোড়া পাহাড় আর বাঁকে বাঁকে ঝর্ণার ধারা। শ্রাবণের হিমালয়ে স্থানীয় মানুষ ছাড়া এত উপরে সচরাচর কেউ আসে না। পথে প্রায়শই ধস নামে। আর পাণ্ডবখোলি তো পর্যটকদের ত্রিসীমানার বাইরে এক পাণ্ডববর্জিত জায়গা, যার মধ্যমণি দ্রৌপদীবিহার। এর সৌন্দর্য সত্যই অপার্থিব।
শেষদিন ধর্মশালার ছাদে রামলীলার পর গ্রামের সাধারণ মানুযের সঙ্গে লুচি আর পায়েস খাওয়া হল। পাণ্ডবখোলিতে তিন রাত্রি বসবাসের পর ফেরার পালা। রামসিং আর তার পরিবাবের লোক আমাকে সাশ্রুনেত্রে বিদায় জানাল। মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় তাদেরই পরিবারের একজন।
এই সফরে আলমোড়া, রানিক্ষেত ও কৌশানির নিকটবর্তী আরও অনেক জায়গায় আমি গিয়েছিলাম যার বিস্তারিত বিবরণে যাব না। আদি শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত যাগেশ্বর ধাম এক অধ্যাত্মচেতনাসম্পন্ন স্থান। স্বামী বিবেকানন্দ দুটি বিশিষ্ট জায়গাতে তাঁর অধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। আলমোড়ার নিকটবর্তী কসার দেবীর মন্দিরে স্বামীজি ধ্যানমগ্ন হন এবং এখানেই তাঁর চেতনায় অনুরণিত হয় সেই বিখ্যাত বাণী– “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”
হিমালয়ের গভীর গহনে সাধনারত না হয়ে মানুষের সেবা করার পাঠ স্বামীজি এই কসার দেবীর মন্দিরেই পান। এই স্থান এখন পৃথিবীর একটি ভূচৌম্বক ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে নাসা। হিমালয় শিখরের এই অনন্য স্থান পৃথিবীর অনেক প্রখ্যাত শিল্পী, লেখক ও গায়ককে বারবার আকর্ষণ করেছে। বিশিষ্ট ব্রিটিশ সাহিত্যিক ডি এইচ লরেন্স ও নোবেল পুরস্কারজয়ী বব ডিলান এই কসার দেবীর মন্দিরে বিশেষ অনুভবের উপলব্ধির জন্য বারবার ফিরে গেছেন।
এযাত্রা আমার হিমালয় ভ্রমণের শেষ স্থিতি ছিল কাকড়িঘাট। আলমোড়ার উপত্যাকায় কোসাই নদীর তীরে এক ছবির মতো গ্রাম। পরিব্রাজক বিবেকানন্দ এখানে ১৮৯০ সালে একরাত কাটিয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধের মতো তিনিও এক বটবৃক্ষের নিচে ধ্যানস্থ হয়ে বোধিলাভ করেছিলেন। এই প্রাচীন গাছটি ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছিল। পরে এখানে স্থানীয় পুরাতাত্ত্বিক আধিকারিক আর একটি বৃক্ষ রোপণ করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের পরে কাকড়িঘাটে আরও অনেক মহাত্মার আগমন হয়।

যাত্রাশেষে কাকড়িঘাট গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় স্মৃতিচারণ করছি। বাবার মৃত্যুর পর দু’সপ্তাহ হিমালয়ে কাটিয়ে গেলাম। এবার দেশে এসে কী পেলাম, কী হারালাম জানি না। তবে সম্পূর্ণ একা, পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া এই হিমালয় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যে এক পরম প্রাপ্তি, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কী আশায় আমি এসেছিলাম, পিতৃবিয়োগের শোক ভুলতে, নাকি মহাত্মাদের আশীর্বাদ নিতে নাকি ভবিষ্যতের যাত্রাপথ নির্ধারণ করতে, তা আজ আর মনে পড়ে না।
ইচ্ছে হল ফিরে যেতে ধরাভৃতের গভীর গুফায় কিংবা পর্বতশীর্ষে, এক শিখর থেকে আর এক শিখরে পাড়ি জমাতে, বাঁধনছাড়া ঝরনায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে। হিমালয়কে আরও নিবিড়ভাবে পাওয়ার ইচ্ছা আমাকে নাড়া দিয়ে চলেছে। রাত্রি নেমে আসছে। কোসাই নদীর মধ্য চড়ায় একটি গাভী একা দাঁড়িয়ে। কী করে নদী পেরিয়ে সে ফিরে যাবে? জানি না সে ওখানে এলই বা কী করে। তার রাখাল কি ভুলে গেল, যে এই গাভী নিখোঁজ? হঠাৎ নজর পড়ল ওপারে এক গ্রামের ছেলে নদী পেরচ্ছে। এদিকে গাভীও চড়া ছেড়ে নদীতে নেমে পড়ল। নদীর মধ্যে রাখালের সঙ্গে তার মিলন, তারপর ঘরে ফেরা।
হয়তো এই রাখালের সন্ধানেই আমার জীবনের বাকী দিনগুলো কেটে যাবে। খোঁজার ইচ্ছেটুকু বুকের গভীরে নিয়ে পাহাড়ের কোলে নেমে আসা রাত্রির দিকে চেয়ে রইলাম। আগামীকাল ফেরার পথ ধরতে হবে।
সৌমেন চট্টোপাধ্যায় পেশাগতভাবে অর্থায়ন ও বিনিয়োগ বিভাগের সঙ্গে জড়িত। নেশা বেড়ানো ,পাহাড়ে চড়া ও ছবি তোলা। হিমালয়ের প্রতি আকর্ষণ আশৈশব। বর্তমানে কাজের সূত্রে শিকাগোয় বসবাস।