বিশেষত ছোটবেলায়, বাড়ির খাবার কার আর ভাল লাগে! সবসময় মন ছুকছুক, পাইপ সমেত কেনা বোতলের পানীয় – জুসলা, ফ্যান্টা, কোকাকোলা; না হয় তো রঙিন সিরাপ দেওয়া বরফ জল। পাকাপাকি ভাবে কলকাতাবাসী হবার আগেই শুরু হয় ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে আমার হোস্টেল বাস। সেখানেই সব ছাত্রীদের সঙ্গে আমিও দু’টি কুপন পাই। বন্ধুরা বলে, যত্ন করে রেখে দিতে। কারণ, বাড়ি গিয়ে যে কোনও পানের দোকানে দেখালেই জুসলার বোতল দেবে। সেই প্রথম এমন কিছু পেলাম, যা বইখাতা-পেন্সিল-খেলনা-পুতুলের বাইরেও যত্ন করে গুছিয়ে রাখবার। খড়দায় আর পানের দোকান কোথায়, ভরসা আমাদের তখনকার আস্তানা মতিঝিল হাউসিং এস্টেটের গেটে নগেনদার দোকান। নগেনদাই জানাল যে এগুলি ‘ক্যালকাটার’ দোকানে মিলবে। বিধান সরণীতে ছোট পিসির বাড়ির ফুটপাতেই মিলে গেল। কুপন দেখাতেই এক বোতল সোনালি আভা, সবুজ রংয়ের ঠান্ডা পানীয়, যার স্বাদ না হোক গন্ধে আনারস। এর নাম তাই পাইনাপেল জুসলা। তখন বুঝতে পারিনি যে জুসলা একটি কোম্পানির নাম। এই জুসলা যে বেনো জলের মতো ঘরে ঢুকে এল তা নয়।
আমার চেনাশোনা খড়দা-জীবনে প্রায় সব বাড়িতেই, অন্তত ছোটদের জন্য, ভোর থেকে সন্ধ্যে অবধি চলত, এক অনড় পানীয়ক্রম। আগের দিন রাতে ভেজানো চিরতার জল খালি পেটে, সঙ্গে একমুঠো ভেজানো ছোলা ,আখের গুড় দিয়ে মাখা। গরমের বিকেলে খেলতে যাওয়ার আগে, হয় বেলপানা, না হয় আমপানা, না হয় তো মৌরি ভেজানো মিছরিপানা। আর খেলে এসে কাদা, বালি, মাটি, ঘাস মাখা হাত-পা ধোওয়ার আগেই এক গ্লাস করে পানা নয় – জল। লেবুর জল, নুন চিনির জল, গুড়ের জল, বাতাসার জল। কুঁজো-শীতল। আর সন্ধ্যে বেলা ঢুলুনি কাটাতে চিনি দেওয়া এক গ্লাস গরম দুধ। বিলাসিতা মানে তাতে গোলা এক চামচ বোর্নভিটা বা ড্রিঙ্কিং চকোলেট। হস্টেলে গিয়েও রেহাই হয়নি। সাবিত্রী মাসিমা বা লতিকা মাসিমা বিরাট এক পেতলের হাঁড়ির মধ্যে মস্ত এক হাতা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশের বগি থালায় কাঁচা ছোলা। ঘুমন্ত আমরা লাইন ধরে এগোচ্ছি, মাথাটা পিছনে ঝুলিয়ে হাঁ করে, এক হাতা চিরতা গিলেই, একমুঠো ছোলা মুখে পেয়ে, কচর কচর করে, সকালের টিফিন নিতে। বাড়ির মতোই ব্যবস্থা ছিল। ‘স্টাডি’র সময় দুধ ভক্ষণ। দুধের ঘণ্টা পড়তেই শাশ্বতীর কাঁচা ঘুম ভেঙে যায় আর টেবিলের নিচে গলে যাওয়া বই তুলতে গিয়ে নাকি ঘুমের আবেশে তড়িঘড়ি একপাটি জুতো তুলে সে তার পড়ার ডেস্কে রাখে। ভাগ্যিস দুধের ঘণ্টাটা পড়েছিল, না হলে জ্যোতিদির মোলায়েম কানমলা!
ফলে, এসব পানীয়কে তখন খুব একটা পাত্তা দিইনি। আর এগুলি বানানোর মধ্যে যেহেতু কোনও ঝমঝমাঝম বা হেঁইয়ো ভাব ছিলনা, তাই তেমন বুঝতেও পারিনি। বিশেষত মফঃস্বলে বাগান দেওয়া বাড়িতে আম, বেল বা লেবুর অভাব হত না। চিনির বদলে মিছরি, গুড় আর বাতাসারই চল ছিল। তবে যেটা ছিল, তা হল যত্ন। মরা আঁচে পোড়া আমের খোসা এমন করে ছাড়ানো হতো যে, এক টুকরো কালো ভাসবে না। বড় মাপের গোল মাটির হাঁড়িতে আম চটকে, অল্প অল্প জল মিশিয়ে কাঠের ঘোঁটনা দিয়ে সেটা মোলায়েম করা হত। আর মেশানোর জলটা ঠান্ডা করা হতো মাটির কলসির গায়ে ভিজে শালু জড়িয়ে রেখে। মিছরিও ভিজিয়ে সাদা কাপড়ে ছেঁকে তবে মেশান হত। এইখানেই ধরা থাকতো গিন্নিদের হাতযশ। না ছিল গারনিশিং, না ছিল সারভিং-এর উৎপাত। ঘটি, বাটি, কাপ, গ্লাস – যার যাতে জুটত। আর বেলপানাও যে কত রকমের হত! আটপৌরে বেল পানায় মিছরির জলে, পাকা তেঁতুলের অল্প ক্বাথ মিশিয়ে, হাল্কা টকের একটু আমেজ আনা হত। আর পাকা বেলটা, আঠার থলি-ভর্তি দানা থেকে ছাড়িয়ে, জলে কয়েকটা লেবু পাতা দিয়ে একটু ভিজিয়ে রেখে তারপর ঘোঁটনা দিয়ে ঘাঁটা। মাঝে মাঝে ঠান্ডা দুধ বা দইয়ের বেলপানাও হতো। দিদিমা, মা, মাসিরা যেহেতু দিল্লি-শিমলেতে বহু বছর থাকা, তাই বাড়িতে পাতা দইয়ের ফেনা ওঠা লস্যি মিলত। ধপধপে সাদা। আর বড় টিপের সাইজের মাঠাটা মাঝখানে ভাসছে। বাড়ি বাড়ি চালু পানীয় হল ঘোলা রংয়ের দইয়ের ঘোল আর ফ্যাকাশে দেখতে মাঠার জল। গরমকালে কাঁচা আম কোরা মেশানো জলের টক মিষ্টি পানাও হতো। আমার ঠাকুমা তাঁর ‘রায়সাহেব’ কত্তাকে নাকি দু’টি পানীয় বিশেষ আদরে খাওয়াতেন। এক হল, মুচকুন্দ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো পেস্তার শরবত আর দুই হল, কয়েকটা শুকনো মহুয়া ফেলে জ্বাল দেওয়া ঘন দুধ। বাবা মায়ের বিয়ের আগেই তিনি গত হওয়ায় আমরা সেই ভাগ্যবান ভদ্রলোকটিকে দেখিনি। তবে আমাদের থেকে বছর কুড়ির বড় অন্য দাদা দিদিদের কাছে গল্প শুনেছি। কারণ তারা কেউ কেউ এ দু’টির প্রসাদ দাদুর কাছে অবরে সবরে পেয়েছিল।
এই ছোটবেলাতেই, মানে বছর আটেক বয়সে একবার সকলে মিলে বড়মাসির বাড়ি আলিগড় যাওয়া হল। সে এক বিশাল বাগান দেওয়া জমিদার বাড়ি আর খাওয়া বসা ঘুম এবং বিশ্রামেরও বিপুল আয়োজন আর আরাম। এখানেই প্রথম গোলাপের পাপড়ি দেওয়া শরবত খেলাম, বাড়িরই এক মুসলিম পরিচারক- ‘শরবতিয়াঁ’র বানানো। এই বাড়িতে কাঠের ‘আইস বক্সে’ বরফকুচিও থাকতো। যে চায় সে নেবে। বাড়িতেই বানানো, সবুজ, হলুদ আর রানি রংয়ের সিরাপ, লম্বা গলা বোতলে থরে থরে রাখা। চিনির সিরায় সিরাপ মিশিয়ে একটু নেড়ে ঠান্ডা জল মেশানো। অপূর্ব পোরসেলিন গ্লাসে পরিবেশন। ট্রেতে খান ছ’য়েক গ্লাস সাজিয়ে ‘শরবতিয়াঁ’ হল ঘরে ঢুকলেই আমরা গন্ধ পেতাম। এরা ‘গর্মি’ লাগলেই ‘নিম্বু পানি’ আর ‘জলজিরা’ খেত। আর আসত নানা রকম বাদামের শরবত – আহা! কিসমিস খেজুর মেশানো ! আর খেয়েছিলাম প্রাণ জুড়নো ‘ফ্রুট জুস’। কমলা, মুসাম্বি, আনার, আঙুর, আপেল, তরমুজ, কলা, আনারস, আলুবখরা এইসব দিয়ে। কখনও এটার সঙ্গে ওটা মিশিয়ে, কখনও যে কোনও একটা। সাবেক মানুষরা, মানে পরিচারকেরা অবশ্য বলতো – ‘রস’। সময়ে মিললে, আম রস, জামুন রস, লিচি রস, আম্রুদ রস – ইত্যাদি। এ ছাড়াও এদের প্রিয় ছিল, পালং-বিট-গাজর এসবের কাঁচা জুস – একটু বিট নুন আর লেবু ছড়িয়ে। আর কাচের আলমারিতে সাজানো বিদেশি শরবত সেট, সোনার জলে নক্সা আঁকা, সঙ্গে একটা করে সেট মেলানো বড় জাগ। পরে ভাবতাম যে, এরাই যদি এই হয় তো, প্রিন্স দ্বারকানাথ কেমন পাত্রে শরবত খেতেন! পাত্রটা নিশ্চিত অসাধারণ ছিল বলেই শান্তিনিকেতনে রবি ঠাকুরের নাতিবাবুর হাতে ধরা নিমের সবুজ রসকে কেউ একজন ভুল করে পেস্তার শরবত ভেবেছিল !
সে সময় আটপৌরে সংসারে বিয়ের উপহারে সিঁদুর কৌটোর বদলে শরবত সেট উপহার শুরু হল। হাল্কা আকাশি, গোলাপি, ফিকে সবুজ আর রানি রংয়ের। রঙিন সেই কাচ গেলাসগুলো ঘরের কোণে, একমাত্র শো-কেসটিতে সাজানো থাকতো। একটা দু’টো ভাঙলে তখন বের করে হেঁশেলে ব্যবহার হত, বাইরের লোকদের জল বা পানীয় দিতে। এসব ব্যবহারের শৌখিনতা আটপৌরে সংসারে তখনও ঢোকেনি। যেমন আসেনি সেই রঙিন জল-সিরাপ। তবে উত্তর কলকাতায় থাকতে এসে দেখি শরবতের ছড়াছড়ি। সিনেমা হলগুলোর আশেপাশে, ছোট বাক্সে, কাঠের গুঁড়ো মেশানো বরফে রাখা ঠান্ডা বোতল – সফট ড্রিঙ্কস, পরে যেটা কোল্ড ড্রিঙ্কস হয়ে গেল। আর পাওয়া গেল ‘কিষাণ’ কোম্পানির লেমন এবং অরেঞ্জ স্কোয়াশ। সঙ্গে লেমন বার্লিও। মা খুব পছন্দ করতেন, তাই কেনাও হত। আর সাবাড়ও হতো দ্রুত। চিনি মেশানো জলে গাঢ় করে ঢাললেই শরবত। তখন নেসকাফের সঙ্গে খুব সুন্দর কাটগ্লাসের একটা করে গ্লাস ফ্রি মিলত। তাতেই আমার জীবনে প্রথম নিজে হাতে শরবত গুলে খাওয়া।
তবে বাড়ির কাছেই রাস্তা পার হলেই ছিল সোমনাথদা আর সতীনাথদা-দের ফোয়ারা দেওয়া বাড়ি। বাবা, ঠাম্মা, আর তারা দুই ভাই। মা অকালে চলে যাওয়ায়, ঠাম্মাই সব সামলাতেন। অত ধনী পরিবারের গিন্নি এবং মেয়ে হয়েও খুব সহজ সুন্দর ছিলেন। সাদা পোরসেলিনের গ্লাসে ‘বরফকলে’ (রেফ্রিজারেটার) রাখা পাকা আমের আমরস খাওয়াতেন। ঘন দুধে বানানো, আমেজে ঠান্ডা। ক্রমে আমারা হাতিবাগান চিনলাম। তখন একটাই লোক মাচার মতো উঁচুতে চট পেতে বসে কাঠের ঘড়ঘড়ে মিক্সিতে বাজ পড়ার শব্দে ‘ফ্রুট-জুস’ বানাত। আধ গ্লাস বরফে জল, ফলের পাল্প আর গুঁড়ো দুধ বা দই মিশিয়ে। আর রাস্তায় রাস্তায় আম-পুদিনার দেহাতি শরবত। মস্ত মাটির জালার ভেতর আম পোড়ার জল, বাইরেটা ভিজে শালু দিয়ে ঢাকা। হাঁড়ির গ্লাসের কাছে, হাফ সারকেল কাঠের রেলিংয়ে সাজানো, সস্তার ঘোলা রংয়ের কাচের গেলাস। আর গুচ্ছ গুচ্ছ সতেজ পুদিনাপাতার বাহার যা শরবতের থেকেও লোভনীয়। আর খেতাম, ঠেলা গাড়িতে আখ মাড়াইয়ের কল বসিয়ে ভাঁড়ে করে আখের রস। এবার পা আর একটু স্বাধীন হলে ‘শিবশক্তি’ এবং বাসে ট্রামে চেপে আরও একটু এগোলে ‘প্যারামাউন্ট’। আর তার সঙ্গে ফুরফুরে সাজ। আসলে, ঘরে ঘরে গ্যাস এবং চাকরির চাপ এসে যাওয়ায় পোড়া এবং ঘুটনি দিয়ে ঘাঁটা ব্যাপারটা উঠেই গেল। থেকে গেল শুধু বদহজমে লেবুর জল আর দইয়ের ঘোল। শহরের চরিত্র যে একেবারে অন্যরকম। এখানে সব কিছু কিনতে হয়, মানে ঘুঁটে, ফুল, কলাপাতাও। আর মানুষও তো ফুটপাথে ঘুমোয়। জীবন যাপন এখানে, জীবন সংগ্রামের!
এম.এ পড়বার সময় পঞ্জাবি বন্ধু প্রমীলার বাড়ি দুপুরবেলা গেলেই ওর মা এক গ্লাস পানীয় খাওয়াতেন। ওরা বলত ঠান্ডাই। বাড়িতেই বানানো। প্রাণ জুড়িয়ে যেত। আর খাওয়াতেন ফলের রস- ‘জুস’। ওরা মানে বাবা, মা, তিন ভাইবোন প্রতিদিন নিয়ম করে বাড়িতে বানানো অরেঞ্জ জুস আর লস্যি খেত। সে দই মহিষের দুধে পাতা। লস্যি বা জুসে একটুও জল বা বরফ নেই। অবাঙালি কলেজে পড়াতে এসে আর একটা দারুণ জিনিস খেলাম – সোডা শিকঞ্জি। অবাঙালি দিদিমণিরা অনেক শেখাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আমি সেই ‘দাদা পড়াচ্ছে’, বলে কেটে পড়েছি। কলেজ চত্বরের দোকানে ঠান্ডাই আর শিকঞ্জির বোতলও বিক্রি হয়। তবে উড়িষ্যার প্রায় সব শহরেই ঘরে এবং বাইরে, ফ্রুট জুসের রমরমা। এ রকমটাই দেখেছি বিলাসপুর, অমরকণ্টক, চেন্নাই, উটিতেও। তবে এলাহাবাদ এবং উজ্জয়িনী কুম্ভে দিন দশ করে সাধুসঙ্গে থাকার সুবাদে প্রায় সারাদিন আদাজল পান করে সুস্থ থেকেছি। ক্ষেতি–বাড়ি আশ্রমে থাকা, ওই না-শহুরে সন্ন্যাসীরা শীত গ্রীষ্ম ভেদে আদা জোয়ান ছাড়াও আরও নানা রকম বীজ দিয়ে আরক বানাতে জানতেন। আর মাটির জালাগুলির মুখটুকু বার করে, সরা ঢাকা দিয়ে, বাকিটা পোঁতা থাকে মাটির গর্তে। তাতে ফেলা থাকে ন্যাকড়ায় বাঁধা ফালি ফালি গন্ধলেবু আর পুদিনা। সেই জল আরকে মিশিয়ে বার বার পান। আর পানপাত্রগুলি পাথরের বা কাঠের।
তারপর জম্পেশ শহুরে জীবনে এল কোল্ড টি। ডলি’স টি শপে, মোড়ায় বসে। এবার আসল চায়ে, ফলের সিন্থেটিক পাল্প। লিচি- টি খেতে সময় বার করতে অসুবিধে ছিল না। আর এল মাটির ভাঁড়ে, ফেনা চলকে ওঠা বিটনুন ও লেবু দেওয়া মশালা থাম্পস-আপ। ক্রমে, পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে গলিতে নানা নামের ফুড–পার্লার। এগুলো জুসও নয়, শরবতও নয়। টিন বন্দি ফলের ‘শেক’ এবং ‘স্মুদি’। মজা লাগে দেখে যে কায়দার সব গ্লাস উধাও। তার বদলে ভাঁড়ার ঢুঁড়ে বের করে আনা নানা রকম কাচের শিশি বোতল। আর স্ট্র-এর বাহার? সিধে, ঘাড় বাঁকা, ডোরা কাটা এবং রং মানানো। বাড়ির হাতায় এক পারসি ছেলের পার্লারে, তার বানানো মিল্কসাগু, টারমারিক মিল্ক ( দুধ-হলদি) এবং মিল্ক-উড আপেল শেক (বেলপানা) একেবারে লা জবাব। তবে, এখনও যারা ঘরের পানা ও জল ভালবাসে এবং অপূর্ব বানায় তাদের মধ্যে একজন হল, শান্তিনিকেতনের মিঠুদি। আর তার ঘর সংলগ্ন বাগানে সে সব অনায়াসে হয়। পাখি, কাঠবেড়ালি, প্রজাপতির আনাগোনার মধ্যে দোলনায় দুলে দুলে, পাথরের গেলাসে, সে এক অনবদ্য আরাম। বিশেষত পুদিনার জলজিরা। যবে থেকে সার্বিক জনজীবনে, পান হয়ে দাঁড়াল একটু মাতোয়ারা মাতামাতি এবং দিনে বিয়ার, রাতে হুইস্কি বা ভদকা বা ওয়াইন, আর গ্রামে গেলেই মহুয়া- হাঁড়িয়া- পচাই, তবে থেকে শরবত, পানা, জল বা আরক সবই একটু পেছনের সারিতে চলে গেল। আর তখন থেকেই ঘরের একটা দেওয়ালে সেলার ও মানানসই মাগ ও গ্লাসে, আমরা বেশ ‘শেরি – শ্যম্পেনীয় আধুনিক’। কাজে মন বসাতে, শরীরের ক্লান্তি ঝাড়তে, সাময়িক একটু আগোছালো হতে, অবসাদ কাটাতে সুদৃশ্য বোতলে এল উষ্ণ পানীয়ের এক আবশ্যিক আয়োজন। এমনকি হার মেনে গেল চা কফিও। হট এবং কোল্ড – দুইই।
তবে আবার এক নতুন যে ছাঁদও ইতিমধ্যেই এসে গেছে, তা হল, ডি-টক্স ওয়াটার। ফল ভেজানো জল। বড় বোতলে আনার, আপেল, আঙুর, সবেদা সব গোটা গোটা সারারাত ভিজিয়ে, সেই জল সারাদিন ধরে পান। ন্যাসকানো ফলগুলি তুলে জাস্ট ফেলে দেওয়া, কারণ ওইসব ফলের থেকে ঢের স্বাদের হয়েছে এখন আপ্রিকট, কিউই, ড্রাগনফ্রুট, প্যাশনফ্রুট এই সব। অনলাইনে অর্ডার করলেই এসে যাবে। আর ফলও আর কামড়ে খেতে কেউ ভালবাসে না। তাই তার জায়গা ওই ফ্রুট স্যালাড বা কাস্টার্ডে। শরবত, জুস এখন ভোজবাড়িতে আপ্যায়নের শুরুয়াৎ, হট কফি এবং স্যুপের পাশাপাশি। অবশ্য জলজিরার প্যাকেট এখন যেহেতু কিনতে পাওয়া যায় এবং পাতি বা গন্ধরাজ লেবুর চাহিদাও যেহেতু কমেনি, তাই মনে হয় যে পেট সামলাবার অভ্যেসটা বাঙালির অভিধান থেকে একেবারে মুছে যায়নি।
আমি অবশ্য এখনও কুঁজোর জল, আমপানা (পান্না নয়), বেলপানা, মেথি মৌরির জল, পুদিনার জল আর আয়েশ করে কোল্ড টি খাই। তবে, মাঝে মাঝে ভালবাসা উথলে উঠলে, তরমুজের রসে স্প্রাইট মিশিয়ে শরবত, বা আনারস ফ্লেবারের আইস্ক্রিমে টাটকা আনারস কুচি মিশিয়ে শেক বানাই। আর বানাই ডাবের জলে ডাবের শাঁস মিশিয়ে, তাতে এক ছিটে কর্পূর দেওয়া এক অতি উপাদেয় শরবত। আর তা পরিবেশন করি, সামান্য একটু শৌখিন কাচের গেলাসে। আর হ্যাঁ, ‘গেলাস’গুলো সাজিয়ে রাখি পদ্মকাটা কালো পাথরের থালায়, কিছু চাঁপা বা বেলফুল ছড়িয়ে । ওই থালাটা আমার বাবার ঠাকুমার কাশীর বাসনের মধ্যে একটা। আসলে নরম পানীয়ে স্মৃতির ছবি আঁকি – ‘স্মুদি’।
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
নারকেল কোরা ছড়ানো গলা কাঁঠালের রস, আর মুসলিম পরিবারে খাওয়া শশার বুরহানি -এ দুটি উপাদেয় পানীয় পরে মনে পড়ায়, আফশোসের সীমা নেই। কী আর করা!