আমরা যে সময় বড় হলাম, তখন জাস্ট রেডিও পেরিয়ে টিভি ঢুকছে ঘরে। ইন্টারনেট স্বপ্ন। কষ্টকল্পনা। ভাতের শেষে রোজ একটু চাটনি না হলেই মন খুঁতখুঁত। রোববার তো মাংস আর তার সঙ্গে সন্তোষকাকুর মিষ্টি দই মাস্ট…। এই শেষ পাতে একটু মিষ্টিকে যে ডেসার্ট বলে, মোটেই জানতাম না। দরকারও তো ছিল না, দই চাটনি হলেই খুশি, যা নামই হোক। তারপর ধর বিয়েবাড়ি গিয়ে চোখ সোজা মেনু কার্ড এর শেষে। পায়েস না আইসক্রিম? আইসক্রিম হলে লাইফ সেট… আমারটা প্লাস বাবারটা প্লাস মায়েরটা…।
তারপর আস্তে আস্তে পরিধি বাড়তে থাকল। ক্ষীর, পায়েস, চাটনি, রাবড়ি থেকে আস্তে আস্তে পৌঁছলাম কেক, পাই, পুডিং, ফাজ, ক্রেপ, মুশ, টার্ট… কিম্বা চাইনিজ় বানানা রোল, ডিমসাম ডেসার্ট, আরও কত কী…। নানান জায়গা আর তার নানান রকম মিষ্টি!
একদিন কোনও এক রেস্তোঁরায় খেতে গিয়ে বাফেতে দেখলাম নানা মিষ্টি খাবার সাজানো। সামনে কাগজের চিরকুট। যে খাবারের সামনে “তিরামিসু” লেখা, তারই এক পিস তুলে আনলাম। স্টার্টার, মেন কোর্স খেয়ে যদিও পেট ভর্তি। বাঙালির বাফেতে পেটপুজো তো, পুরো পয়সা উশুল করে খাওয়া, তার মধ্যেও, ওই ছোট্ট এক পিস মুখে দিতেই কীরকম মুখের ভিতর স্বর্গ নেমে এল। ফেরার পথে মনে হল, যতই উপকরণ জটিল হোক, বা সহজ হোক, এ জিনিস বাড়িতে বানাতেই হবে…

আর জানতে হবে কোন দেশের এ মিঠাই!
তখন এত সহজলভ্য ছিল না ইন্টারনেট, অতএব কোনও এক বই থেকে খুঁজে পাই রেসিপি। রেসিপিতে পরে আসছি। আগে বলি, প্রথম বাড়িতে বানানো তিরামিসুটা একদম ডিজ়াস্টার ছিল, ডিমের কাঁচা গন্ধ, এবং প্রায় সবটা গলা গলা থকথকে। বেশ মনখারাপ হল বটে, কিন্তু তিরামিসু মনে রয়ে গেছিল। পরের দিকে ইন্টারনেটের দৌলতে একদম স্পষ্ট করে জানা গেল খাস ইটালিয়ান তিরামিসু রান্নার পদ্ধতি, ভিডিও-সহ। ও হ্যাঁ, পিৎজার মতো এও ইতালি থেকে উঠে এসে দুনিয়া কাঁপানো ডেসার্ট। এবারে এরকম একটা মিষ্টির উদ্ভাবকের দাবিদার যে অনেকেই হতে চাইবে, সে তো নিঃসন্দেহে। কাজেই নানা মুনির নানা মত।
একটি মতে, তিরামিসু ট্রাভিসোর প্লেজার হাউস-এর এক মাদামের উদ্ভাবন, ১৮০০ র গোড়ার দিকে, তার ক্লায়েন্ট দের জন্য। অ্যাফ্রোডিসিয়াক হিসেবে…! ওই জন্যেই নাকি ‘তিরামিসু’ শব্দের বাংলা তর্জমা করলে মানে দাঁড়ায়, “পিক মি আপ!” কিন্তু অন্য মতে, ট্রাভিসোর এক রেস্তোরাঁ, “লে বেকেরিয়ে”-তে এই ডেসার্টের শুরু, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের শক্তি পুষ্টি জোগাতে। শেষমেশ নাকি বলা হয় ইতালির ফ্রিউলি-তে এর শুরু। মাস্কারপোন স্লাইস নামে ক্ষুধার্ত হাইকারদের খাওয়ানো হত এ খাদ্য। তাঁদেরই কেউ তিরামিসু নাম রাখেন হয়তো।
দারুন একটা দুনিয়া কাঁপানো ডেসার্ট, তার জন্মস্থান নিয়ে দেশ দেশ তো কোন ছাড়, একই দেশের প্রদেশে প্রদেশে লড়াইও অসম্ভব নয়। তাই বলে কি তিরামিসু বানাব না? সেই প্রথম তিরামিসু ডিজ়াস্টারের পর, এবারে একদম সজাগভাবে প্রথমবারের ভুলগুলো শুধরে নেবার পালা…

যেমন ধর:
১. ছ’টা ডিমের কুসুম, আলতো করে পরিপাটি করে আলাদা করে নেওয়া, তাতে চিনি মেশানো, আর একটু ভ্যানিলা এসেন্সও। এবারে একটা কড়ায় জল গরম করে তার ওপরে ওই ডিম এর কুসুম সমেত বাটিটা রেখে সমানে নেড়ে যাওয়া… প্রয়োজনে অল্প দুধ মিশিয়ে।
আগেরবার ভুল করেছিলাম, চামচে লেগে যাওয়া পর্যন্ত না নাড়িয়ে। এবারে গাঢ় হওয়া পর্যন্ত নাড়িয়ে গেলাম। ঠান্ডা হতে দিলাম।
২. ক্রিম ফেটানো। শক্ত পিক না হওয়া পর্যন্ত, ঠান্ডা বরফ বাটির ওপরে ক্রিমের বাটি রেখে হ্যান্ড বিটার দিয়ে ফেটিয়ে যাওয়া, একটু একটু করে চিনি দিয়ে, আর খুব প্রয়োজনে দু’চামচে কর্নফ্লাওয়ার মিশিয়ে দিয়ে… ক্রিম রেডি।
৩. মাস্কারপোন চিজ়, এটায় আগে কোনও ভুল করিনি। তবে এই চিজ় না পাওয়া গেলে, পনির আর অল্প টকদই মিক্সারে মিশিয়ে ফেটিয়ে নেওয়া, দিয়ে ওভারনাইট জল ঝরতে দেওয়া কাপড় বেঁধে। অল্প চিনি মেশানো যেতে পারে এতে।
৪. লেডি ফিঙ্গার বিস্কুট আগে পাইনি, এবারে অনলাইনে পেয়ে গেলাম, চমৎকার! আগেরবার বদলি হিসেবে স্পঞ্জ কেক ওভারবেক করে বিস্কুট বানানোর চেষ্টা করেছিলাম, যাই হোক..।

৫. অল্প এসপ্রেসো কফি আর ডার্ক রাম মিশিয়ে রাখা। আগেরবার ওয়াইন মিশিয়েছিলাম, তবে রাম-এর ফ্লেভারটাই বেশি ভাল লাগল। এটা অবশ্য ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর!
ভুল আর ভুল শুধরানো তো হল, এবারে মাপগুলো বলি। তারপর সাজানোর মজায় আসছি…
উপকরণ:
ডিম এর কুসুম ছ’টি
৩/৪ কাপ চিনি
অল্প দুধ, ওই ধর আধকাপ
সওয়া এক কাপ হেভি ক্রিম
আধ চা চামচ ভ্যানিলা এসেন্স
৪০০-৪৫০ গ্রাম মাস্কারপোন চিজ় কিম্বা ক্রিম চিজ়
১/৪ কাপ স্ট্রং ডার্ক কফি
২ টেবিল চামচ ডার্ক রাম
১ প্যাকেট লেডি ফিঙ্গার বিস্কিট
ওপরে ছড়ানোর জন্যে কোকো পাউডার খানিকটা…

এবার কুসুমের অংশে ক্রিম চিজ় মিশিয়ে নিতে হবে আলতো করে। আর তারপর আলতো হাতে ফেটানো ক্রিমটাও। একটা বেকিং ট্রে-তে সামনে রেখে, একটা একটা করে লেডি ফিঙ্গার, রাম আর কফির গোলায় জাস্ট ডুবিয়েই সঙ্গে সঙ্গে তুলে ট্রে-তে সাজানো পরপর। তারপর যাবে ক্রিম চিজ়ের মিশ্রণের লেয়ার, আবার বিস্কিটের লেয়ার, আবার ক্রিমের লেয়ার…। আর ওপরে খানিকটা কোকো পাউডার ডাস্ট ছড়ানো…। সব সমেত গেল ফ্রিজে।
পরের দিন বা ঘণ্টা ৫-৬ পর বের করে গেস্টদের দিয়ে দেখ তো কী বলেন সবাই!
তিরামিসু… ভ্যানিলা, কফি, রাম, ক্রিম, চিজ়, ডিম… আসলে সব দিয়েই আবার কোনওটারই ফ্লেভার নয়, এমন ফ্লেভার যা অপার্থিব! তাই তো সবাই এর প্রেমে পড়ে!!
*ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।
Khub valo lage tomar lekha porte..besh ki sundor recipe-r sathe koto khaini jante pari👌🏻👌🏻💝💝
Aar khete kirokom?