রবিবার মানেই রান্নাঘরের চারপাশে ম ম করছে গন্ধ… তর সয় না। কখন দুপুর হবে আর সবাই মিলে খেতে বসব, রেডিওতে তখন অনুরোধের আসর। নরম তুলতুলে মটনের টুকরোটা দু আঙুলে ছিঁড়ে মুখে দেব, আর স্বর্গ নেমে আসবে জিভের ওপর! একটা গোটা আলু সঙ্গে, আর ফুঁ দিয়ে নলির ভিতর থেকে মজ্জা টেনে নেওয়া নির্বিকল্প সুখ! সব রোববারে হত না যদিও চার পেয়ে। প্রায়ই দু’পেয়ে-তে খুশি থাকতে হত। এই চার পেয়েটি, অর্থাৎ বাঙালির ঘরের বিখ্যাত ‘মটন’ মানেই রোববারের দুপুর আর কবজি ডুবিয়ে মাংস ভাত!

যদিও বিদেশিরা মাটন বলতে বোঝে বড়ো ভেড়ার মাংস, আর কচি ভেড়া হল ল্যাম্ব। ওদিকে ছাগলের মাংসকে ওরা বলে শেভন। তবে এসব জিভ-ভাঙা নাম যতই হোক, খাসি বা পাঁঠার মাংস মানে বাঙালির ‘মটন’!! ব্যাস…। তো এই ‘মটন’ কিন্তু সারা বিশ্বে সব চেয়ে বেশিই খাওয়া হয় অন্য মাংসের তুলনায়। সাউথ আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া নিউ জিল্যান্ড এমনকী ইউরোপেও জনপ্রিয় বাঙালির অতিপ্রিয় মটন। শুধু যে বেশি খাওয়া হয় তা-ই নয়, এটা বিফ, পর্ক এমনকী চিকেনের চেয়েও কিছুক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর, কারণ এর ক্যালোরিফিক ভ্যালু কম, কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাটও অন্যদের থেকে কম! আমি নয়, রিসার্চ বলছে এসব। যদিও রেড মিট ক্যাটাগরিতেই ফেলা হয় একে।

এই রেড মিট খাওয়া কি আজকের কথা? এর শুরু সেই কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। আর গবেষণা বলছে, মানুষ যে এই মগজাস্ত্রে শান দিয়ে আজকের মানুষ হয়েছে, তাতে এই নানান খাদ্যগুণ সমেত অ্যানিমাল প্রোটিন এর অবদান অনেক বেশি। তাই সপ্তাহান্তে কী রান্না করি ভাবতে ভাবতে, মনে এল, সামনেই বকরি ঈদ, তাও আবার রোববার! তাহলে মাংসই জমিয়ে রান্না করা যাক। 

বকরি ঈদ পালনের গপ্পো মনে আছে তো? ওই যে, পয়গম্বর আব্রাহাম স্বপ্ন দেখলেন, যে আল্লাহ তাঁর কাছ থেকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি চাইছেন। তিনি ঠিক যখন তাঁর ছেলে আইজ্যাককে উৎসর্গ করতে যাবেন, তখন আল্লাহ বলে উঠলেন, মানুষ উৎসর্গ তিনি মোটেই চান না। ভক্তের ভক্তির প্রমাণ তিনি সার্থকভাবে পেয়েই গেছেন। তারপর থেকেই শুরু হয় আল্লাহের নামে ভেড়া বা ছাগল উৎসর্গ। সেই মাংস এক ভাগ ঘরে রেখে দুই ভাগ বিতরণ হয় গরিবদুঃখী মানুষকে। এ সবকিছু মাথায় ঘুরছিল। তাই রোববারের মটন আর বকরি ঈদ মিলিয়ে আজকে মেনুতে রাখলাম তিন রকমের মাংস!

১. আউধি কুন্দন কালিয়া (বেশ গুরুপাক)
২. চট্টগ্রামের কলা ভুনা (এটাও একটু মশলাদার আর ঝাল ঝাল)
৩. কাশ্মীরি হলুদ কালিয়া (একদম হালকা আর কম উপাদানে, কম সময়ে)

Oudh Mutton Curry
আউধি মটন কুন্দন কালিয়া
আউধি কুন্দন কালিয়া

প্রথম দিকে এই কালিয়া খুব হালকাভাবে, অল্প মশলা দিয়ে রান্না হত। তারপর একদিন আউধের নবাব-বাদশারা যখন স্থির করলেন এই কালিয়া খাইয়ে সৈন্যদের মাইলের পর মাইল হাঁটিয়ে যুদ্ধে পাঠাবেন, তখন কালিয়া নানা মশলাসমৃদ্ধ হয়ে নতুন মাত্রা পেল। এই কালিয়ায় যা যা মশলা পড়ে, সবগুলো দিয়ে রান্না করা একদমই হয়তো সম্ভব নয়, হাতের কাছে পাওয়াও মুশকিল। তবু পোস্ত, দুধ আর জাফরানের ব্যবহারটা এখানে উল্লেখযোগ্য। ‘লজ্জত এ তাম’ নামে একটি মশলার মিশ্রণ এখানে বিশেষভাবে ব্যবহার হয়।

১০০ গ্রাম এই মশলার জন্যে লাগে– ৫ গ্রাম করে লবঙ্গ, ছোট এলাচ, গোলমরিচ, গোটা ধনে, অল স্পাইস, নারকোল কোরা, জিরা, শা জিরা, চন্দনগুঁড়ো, গোলাপের পাপড়ি, মাখানা, পোস্ত, মৌরি, শা মরিচ। আর ২ গ্রাম করে দারচিনি, জায়ফল, তেজ পাতা। সঙ্গে এক চামচ কেওড়া জল আর মিঠা আতর। তাও ‘বাওবির’ আর ‘জারাখুশ’ বলে দুটি মশলা বাদই দিলাম। নয়তো এর মধ্যে ওগুলোও মেশানো হয়।

আর কী কী লাগবে

৫০০ গ্রাম মাটন
চারটে পেয়াঁজ লম্বা সরু কেটে, ঘিয়ে ভাজা বেরেস্তা, সেটা একটু হালকা বেটে নেওয়া
আধকাপ ঘি
চার চা চামচ আদা রসুনের রস
আধ কাপ জল ঝরানো টক দই
এক কাপ দুধ, এতে এক চুটকি জাফরান ভিজিয়ে রাখা

এবারে প্রথম মশলাগুঁড়োর জন্যে

তিনটে লবঙ্গ
অর্ধেক জয়িত্রি
৩-৪টে ছোট এলাচ
একটা বড়ো এলাচ
এক ইঞ্চি দারচিনি

দ্বিতীয় মশলাগুঁড়োর জন্যে লাগবে

এক বড়ো চামচ ‘লজ্জত এ তাম’ মশলা
তিন চা চামচ লাল লঙ্কাগুঁড়ো
তিন চা চামচ ধনে গুঁড়ো

বেরেস্তা ভাজার কড়াইতেই আরো ঘি দিয়ে মাংসটা মিডিয়াম আঁচে বেশ ভালো করে ভেজে নিতে হবে প্রায় মিনিট কুড়ি। তারপর আদা রসুনের রস দিয়ে কষিয়ে, প্রথম মশলার মিশ্রণটা দিয়ে কষাতে হবে। তারপর বেরেস্তা পেস্ট আর দই মিশিয়ে ঢেলে দিতে হবে। কষিয়ে নরম আঁচে ১৫ মিনিট ঢেকে রান্না। তারপর দ্বিতীয় মশলা মিশ্রণ দিয়ে কষিয়ে আরো কুড়ি মিনিট ঢেকে রান্না হবে যাতে নরম হয় মাংস। তারপর তাতে দুধ জাফরান গোলা দিয়ে অল্প ফুটিয়ে, গাঢ় গ্রেভি হলে, শেষে কেওড়ার জল দিয়ে নামিয়ে নিতে। 

ভাতে মেখে খেতে খেতে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কে শুকরিয়া অদা করুন দেখি, যিনি এই কালিয়ার রেসিপি নিয়ে আসেন এই কলকাতায় থাকাকালীন! আর শেষমেশ শুনে যান চোখ ছানাবড়া হবার মতো নামকরণ-কাহিনি। এ রান্নার নাম কুন্দন কালিয়া হবার নেপথ্যে রয়েছে নবাব-বাদশার অতুল শৌখিনতার প্রমাণ। কুন্দন অর্থাৎ সোনার পাত বা তবক! এককালে নবাবের খানসামা বা রকাবদারেরা নবাবের মন পেতে মাংসের টুকরোগুলো পাতলা সোনার তবকে মুড়ে ভাসিয়ে দিতেন লাল টকটকে ঝোলে। স্বাদের পাশাপাশি দেখনদারিতে সে যে বাজিমাত করত, সে আর বলতে! তবে কিনা আপনার মডিউলার কিচেনে সোনার তবক দিয়ে রান্না করার সুযোগ আছে কিনা, সে আমার জানা নেই! তবে অত তরিবত না করেও খানিক মানিয়ে গুণিয়ে করেই দেখুন না! জিভে লেগে থাকবে কুন্দন কালিয়ার খোশবাই!

Kala Bhuna Mutton
চট্টগ্রামের কালা ভুনা মাটন
চট্টগ্রামের কালা ভুনা

ম্যারিনেট করার জন্যে লাগবে

এক কেজি মাটন
আধ কাপ পেঁয়াজ কুচি
দুটো তেজপাতা
একটা বড়ো এলাচ
দারচিনি ১ ইঞ্চি
স্টার অ্যানিস দুটো
ছোট এলাচ তিনটে
লবঙ্গ তিনটে
গোলমরিচ ৫-৬ টা
কাবাব চিনি তিনটে
আধ কাপ বেরেস্তা
লঙ্কাগুঁড়ো এক বড়ো চামচ
হলুদ ১/৪ চা চামচ
ধনেগুঁড়ো ১ বড়ো চামচ
আদা আর রসুন বাটা মিলে এক বড়ো চামচ
তেল আধ কাপ

সব দিয়ে ঘণ্টা দুই মাংস ম্যারিনেট হবে। আর রান্নার জন্যে লাগবে:

গোলমরিচগুঁড়ো ১/৪ চামচ
অর্ধেক জায়ফল গুঁড়ো
জিরেগুঁড়ো আর গরমমশলা গুঁড়ো – ১/৪ চামচ করে
রাঁধুনিগুঁড়ো আধ চামচ
নুন আন্দাজমতো

পরে ফোড়নের জন্যে 

সর্ষের তেল আধ কাপ
পেঁয়াজ কুচি দু’কাপ
রসুন আর আদা কুচি আধ বড়ো চামচ করে দুটোই
শুকনো লঙ্কা ৪-৫ টা
রাঁধুনি গুঁড়ো+ গরমমশলাগুঁড়ো মিলে এক চা চামচ

কড়াই গরম করে ম্যারিনেট করা মাংস মশলাসমেত দিয়ে নাড়তে হবে, হাই ফ্লেমে ৫ মিনিট। তারপর কম আঁচে ঢেকে ঢেকে এবং মাঝে নাড়িয়ে দিয়ে ২০-২৫ মিনিট, পাশ থেকে তেল বেরতে শুরু করা পর্যন্ত। মাংসের জলেই রান্না হবে, আলাদা জল পড়বে না, বেশ ভাজা ভাজা মাংস বলে এর নাম ভুনা! তারপর মাংস খানিক সেদ্ধ হলে রান্নার মশলাগুলো দিয়ে কষতে হবে দু’চার মিনিট। আবার ঢেকে রান্না একদম কম আঁচে। সেও মিনিট ১৫। এইরকম করে মাংসের জলেই মাংস সেদ্ধ হবে।

শেষ ধাপে, অন্য একটা ছোট পাত্রে তেল গরম করে তাতে ওই ফোড়নের জিনিসগুলো (শুকনোলঙ্কা গোটা, পেঁয়াজ আদা রসুন কুচি) অল্প লাল করে ভেজে নিয়ে, রাঁধুনিগুঁড়ো, গরমমশলা গুঁড়ো মিশিয়ে, তাতে এক হাতা মতন মাংস সেদ্ধ তুলে নিয়ে মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে, যাতে গন্ধটা মিশে যায় মাংসে। তার মিনিট পাঁচ পর ওই মাংসগুলো বাকি মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে দু’মিনিট ঢাকা দিয়ে রেখে পরিবেশন করা গরম গরম। এই কালা ভুনা, চট্টগ্রামের সিগনেচার ডিশ, মেজ়বান-এর অন্যতম আকর্ষণ। প্রায় সেই সপ্তদশ শতাব্দীর পুরনো রেসিপি, কালা ভুনা রান্না করা হয় খুব যত্নে, অনেকটা সময় নিয়ে।

Mutton Kashmiri Kalia
মাটন কাশ্মিরী কালিয়া
মাটন কাশ্মীরি কালিয়া

কোনও রোববার, যেদিন অনেক লম্বা পদ্ধতিতে রান্না করতে ইচ্ছে করবে না, বা যেদিন হালকা করে রান্না মাংস খাওয়ার ইচ্ছে হবে, ঠিক সেদিনের জন্যে এই মাংস। এই হলুদ কালিয়াটি মূলত, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের রান্না।

যা যা লাগবে:

৫০০ গ্রাম মাংস
দেড় চা চামচ আদাগুঁড়ো
আধ চা চামচ কালোজিরে
এক চা চামচ হলুদগুঁড়ো
দুটো বড়ো এলাচ থেঁতো করা
হিং এক চিমটে
নুন স্বাদমতো
আধ কাপ দুধ
তিন চা চামচ মৌরিগুঁড়ো
এক চা চামচ শাহী জিরে
চারটে লবঙ্গ
চারটে ছোট এলাচ
এক ইঞ্চি দারচিনি
দুটো তেজপাতা
দু টেবিল চামচ সাদা তেল

জল গরম করে তাতে কালো জিরে, শাহী জিরে, হিং, দুধ, আর হলুদ বাদে, সমস্ত কিছু দিয়ে কুকারে বসাতে হবে, হাই ফ্লেমে। মিনিট পাঁচ রেখে একটা সিটি দিয়ে নরম আঁচে বসিয়ে রাখতে হবে সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত। তারপর ঢাকা খুলে দুধে হলুদ গুলে মেশাতে হবে মাংসে। ঢাকা ছাড়াই মিনিট দুই ভালো করে ফুটিয়ে নিতে হবে। অন্য পাত্রে সাদা তেল গরম করে, শাহী জিরে, কালোজিরে, আর হিং ফোড়ন দিয়ে সেটা কুকারে ঢেলে ঢাকা দিয়ে আঁচ বন্ধ করে কিছুক্ষণ, ওই মিনিট পাঁচেক রেখে দিলেই রেডি।

তাহলে বাঙালির রোববার আর বকরি ঈদ মিলেমিশে জমে যাক মাংস ভাতে! বেছে নিন কোনটা আপনার বেশি পছন্দ… রাজকীয় মশলাদার কালিয়া, নাকি ঝাল ঝাল ভুনা, না হালকা মন ঠান্ডা করা কাশ্মীরি কালিয়া…

 

*ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক
Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *