জিসা গুপ্তার ছবি- facebook.com

বিয়ের অন্তত তিনমাস আগে থেকে শুরু করে দেওয়া দরকার মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি। তেমনটাই মত বিশিষ্ট বিউটি কনসালট্যান্ট, আয়ূর্বেদ ও ভেষজ বিশেষজ্ঞ তথা গ্রুমিং এক্সপার্ট শ্রীমতি জিসা গুপ্তার। কাউন্সেলিং থেকে শুরু করে ডায়েট, রূপরুটিন সবকিছুতেই চাই যত্ন আর সময়। বাংলালাইভকে বিয়ের আগে তিনমাসের প্রস্তুতিপর্বের টিপস দিলেন জিসা গুপ্তা। শুনলেন কস্তুরী ভারভাদা। 

 

স্মার্ট বিয়ে কাকে বলে? অবজেকটিভ ধরনের প্রশ্ন হলে উত্তর হবে, দু’জনের মত নিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে। কিন্তু যদি ৫ বা ১০ নম্বর থাকে, তাহলে আপনাকে আরও একটু বিশদে জানতে হবে।

এখন বিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে ঠিক করা হয়। কেনাকাটা, বাড়িভাড়া, কার্ড ছাপানো সব প্রস্তুতিই শুরু হয় বিয়ের প্রায় আট ন’মাস আগে থেকে। তাহলে নিজের যত্নের বেলায় তাড়াহুড়ো কেন? বিয়ের একমাস আগে কনে যদি বলে বসেন, আমার খসখসে চুল, ব্রণভরা গাল চট করে মসৃণ রেশম কোমল করে দিন, তা কি সম্ভব? হ্যাঁ, কিছু ইনস্ট্যান্ট রেমেডি অবশ্যই প্রযোজ্য। কিন্তু তার জন্যও অন্তত মাসখানেক সময় তো দিতেই হবে!

বিশিষ্ট বিউটি কনসালট্যান্ট, আয়ুর্বেদ ও ভেষজ বিশেষজ্ঞ গ্রুমিং এক্সপার্ট জিসা গুপ্তার মতে, “রূপচর্চা ও গ্রুমিংয়ের জন্য বিয়ের আগের তিনটি মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই তিনমাসের প্রস্তুতি এবং খানিক পরিশ্রম আপনার জীবনের কাঙ্খিত দিনটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারবে। প্রথমেই একজন গ্রুমিং এক্সপার্টের সঙ্গে দু থেকে তিনটি সিটিং আপনাকে দিতে হবে। তিনি বর বা কনের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে ঠিক করবেন, তাদের ঠিক কোন কোন জায়গায় কিঞ্চিৎ ঘষামাজার প্রয়োজন আছে।”

আজকালকার যুগে একটি মেয়ের বিয়ে হল আর রাতারাতি শ্বশুরবাড়ি এসে সবরকমের পরিবর্তন মেয়েটি হাসিমুখে মেনে নিয়ে সকলকে সুখি করার চেষ্টায় নিজের জীবনপাত করল– এরকম দিন আর নেই। ফলে অনেকেই বিয়ের আগে কিছু স্পেশাল গ্রুমিংয়ের কথা ভাবছেন। সেটা কীরকম? ধরা যাক, একটু ছোট শহর বা শহরতলির মেয়ে কলকাতায় পেয়িং গেস্ট থেকে পড়াশোনা করেছে, ভালো চাকরিও পেয়েছে নামি সংস্থায়। তবে মনেপ্রাণে সে এখনও ছোট শহরের লাজুক মেয়েটি। এ দিকে বাবা-মা অনেক দেখেশুনে তার বিয়ে ঠিক করলেন দক্ষিণ কলকাতার পশ পরিবারের বিলেতফেরত ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে যাঁরা কিনা আদবকায়দায় প্রায় সাহেব! মানিয়ে চলা তো সমস্যা হবেই মেয়েটির পক্ষে! এমনকি অনেকক্ষেত্রেই ছেলেটির পক্ষেও। সেখানেই দরকার উভয়পক্ষের গ্রুমিং। বিশেষজ্ঞরা গোড়াতেই কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে দেখে নেন মেয়েটির চাকরির জায়গা কোথায়, চাকরির ধরন কেমন, ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ কেমন ছিল এবং বিয়ের পর কী ধরনের পরিবেশে যাবে?

আবার ধরুন মফস্বলের ছেলে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া দক্ষিণ কলকাতার ঝাঁ-চকচকে মেয়েকে বিয়ে করে কাজের সূত্রে পাড়ি দেবে মার্কিন মুলুকে! সেক্ষেত্রে ছেলেটির আত্মবিশ্বাসের অভাব হতেই পারে। মেয়েটির সঙ্গে অ্যাডজাস্টমেন্টের পাশাপাশি প্রথম বিশ্বের দেশে গিয়ে দুজনে মিলে সংসার করা, নিজেরা জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সামলানো, নতুন আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, ইংরেজি বা অন্য কোনও বিদেশি ভাষায় অনর্গল কথা বলা, কর্মক্ষেত্রে নতুন কলিগদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, এ সবের জন্যই প্রয়োজন লাইফস্টাইল এক্সপার্টের সঙ্গে পরপর কয়েকটি সেশন। জিসার মতে, বাঙালিরা স্বভাবত খুব বুদ্ধিমান এবং অল্পদিনের প্রশিক্ষণেই দ্রুত পিক-আপ করতে পারে, ফলে খুব একটা অসুবিধে হয় না।

forced marriage no counselling
কোনওরকম মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই জোর করে ছেলে বা মেয়েকে পরিবর্তনে বাধ্য করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ছবি সৌজন্য – zawaj.com

বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া মেয়েদের ক্ষেত্রে জীসা মনে করেন, মেয়েটি যে অবস্থায় ও পরিবেশে বড় হয়েছে এবং বর্তমানে বসবাস করছে, তার সঠিক বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। সেসব কিছু না-ভেবে বিয়ের পরেই তার ওপর নতুন সংসারের পরিবর্তনের একগাদা বোঝা চাপালে ফল ভালো হবে না। এখন প্রায় সব মেয়েরাই চাকরি করে। উচ্চশিক্ষা শেষ করে, চাকরির প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরিতে সেটল করতে করতে ত্রিশের কোঠা চলে আসে অনেকক্ষেত্রেই। পুরনো বাঙালি মতে এটা বিয়ের পক্ষে বেশি বয়স! আজকাল সে কথা বিশেষ পাত্তা না পেলেও এটা ঠিক যে এই বয়সে এসে মেয়েদের একটি স্বতন্ত্র মতামত ও ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়ে যায়। শুধুমাত্র বিয়ের জন্য সবকিছু পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়। অথচ বিয়ে মানেই তো বদল! নতুন সংসারে বৌমার কাছ থেকেই প্রত্যাশা থাকে সবচেয়ে বেশি। তাহলে মেয়েটি কী করবে? জিসার কথায়, “এই মন্ত্রটিকে মাথায় রেখে এগোতে হবে যে, কী কী মডিফিকেশন দরকার এবং মেয়েটির আগের পরিবেশের অভ্যাস যথাসম্ভব বজায় রেখে কতটা নতুন পরিবেশে তাকে স্বচ্ছন্দ করে তোলা যায়। কাউন্সেলিং সেশনের মাধ্যমে এটা বিচার করে তবেই বিয়েতে এগনো উচিত। মনে রাখবেন, প্রতিটি মানুষ ও তাদের চিন্তাধারা ভিন্ন। ফলে এক ফর্মুলা সকলের ওপর প্রয়োগ করলে ফল ভালো হবে না।”

এ বার আসা যাক চেহারা ও রূপচর্চার কথায়। আগেই বলা হয়েছে যে আজকাল উচ্চশিক্ষা এবং তারপর কেরিয়ারে ঠিকমতো সেটল্ করে বিয়ে করতে সব মেয়েরই অন্ততপক্ষে ত্রিশ হয়েই যায়। ফলে নববধূ বলতেই যে ‘অপুর সংসার’-এর শর্মিলা ঠাকুরের ‘ঢলঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি’র কথা আমাদের মনে আসে, সেই ‘লুক’ এই বয়সে পাওয়া মুশকিল। জীসা গুপ্তার কথায়, ‘কোনও মেয়ের শরীর রোগা থাকে, গাল দু’টো বেশি ফোলাফোলা হয়ে যায়, কারও বা বসে বসে কাজ করার ফলে পেটের কাছে বা বুকে মেদ জমে। শরীরের কোন জায়গায় কারেকশন দরকার সেটা বুঝে প্রথমে এক্সারসাইজ দিতে হবে। নিয়মিত এক্সারসাইজে ওজন তো কমবেই ফিটনেসও বাড়বে। ফলে বিয়ের দিনের একটানা ধকলের মোকাবিলা করা সহজ হবে।”

এরপর আসে ডায়েটের প্রসঙ্গ। জিসার মতে, এই তিনমাসের জন্য একটা সঠিক ডায়েট চার্ট খুব জরুরি।

detox water
ডিটক্স ওয়াটার শরীর থেকে বর্জ্য বের করে দিতে সাহায্য করে। ছবি সৌজন্য – upfitness.com

কিন্তু সমস্যা হল, যে মেয়েটি প্রতিদিন মশলাদার খাবার খেতে অভ্যস্ত, তার পক্ষে হঠাৎ করে সেদ্ধ বা হাল্কা খাবার খাওয়া সম্ভব নয়। তাকে একটু একটু করে পরিবর্তিত রুটিনে আনতে হবে। গোড়ায় সবজি দিয়ে, পেঁয়াজ-রসুন-আদাকুচি দেওয়া হাল্কা চিকেন স্টু দিতে হবে। তারপর সবুজ শাকসবজি এক চা-চামচ তেলে ফোড়ন দিয়ে নেড়ে দিতে হবে। কিছুটা স্বাদের পরিবর্তনে অভ্যাস হলে সেদ্ধ দিতে হবে। ওজন তিনমাসে ১৫/২০ কেজি না কমলেও ৫ থেকে ৭ কেজি কমবেই– সেটাও কিন্তু কম নয়! যেই সে একবার দেখবে তার ওজন কমছে, সে নিজের ইচ্ছেতেই ডায়েট ফলো করতে থাকবে।

আবার যাদের ওজন কম বা যারা খুব রোগা তারা এই সময় একটু ওজন বাড়ানোর দিকে মন দিন। কারণ বিয়ের কোনওরকম সাজই খুব রোগা হলে খুলবে না। প্রতিদিন ফ্যাট ও চর্বি জাতীয় খাবার খেতে আরম্ভ করুন। কিন্তু সবটাই করতে হবে কনেকে তার নিজস্ব জায়গাটিতে বসিয়ে। আচমকা ‘সব পাল্টে ফেলুন’ বলে নয়। আপনার পরামর্শ যদি তার ভালোই না-লাগে, বা অতিরিক্ত জ্ঞান বা বোঝা চাপানো মনে হয় তবে কিন্তু কোনও কাজ হবে না। কারণ প্রতিটি আত্মবিশ্বাসী মেয়েরই নিজেকে বদলানোর সময় প্রাথমিক ভাবে এটা মনে হওয়ায়ই স্বাভাবিক যে, ‘আমিই বা কম কিসে? আমার চেহারা কি খারাপ?’ বিষয়টা যে ‘দেখতে ভালো বা দেখতে খারাপ’-এর নয়, বা উল্টোদিকে যে বসে আছে সে যে সবজান্তা আর আপনি কিছুই জানেন না, এমনটা নয়, এটা তাকে বোঝাতে হবে। এবং সেটাই সফল ভাবে করাটাই গ্রুমিং এক্সপার্টের কাজ বলে মনে করেন জীসা গুপ্তা।

এরপর আসা যাক চুলের যত্নের কথায়। এক একরকম চুলের জন্য আলাদা আলাদা রকমের যত্ন প্রয়োজন।

তৈলাক্ত চুল– যাদের চুল অতিরিক্ত অয়েলি তারা স্বাভাবিক ভাবেই তেল ব্যবহার করবেন না। দই-বেসনের প্যাক একদিন অন্তর লাগান। আধ ঘণ্টা রেখে কোনও হার্বাল শ্যাম্পু দিয়ে চুল ভালো করে ধুয়ে নিন। সপ্তাহে অন্তত বার দু’য়েক করতে পারলে চুলে শাইন আসবে এবং প্রানহীন দেখাবে না। বিয়ের আগে চুলে ড্যানড্রাফ ট্রিটমেন্ট করান।

শুষ্ক চুল– শুষ্ক চুলের ক্ষেত্রে নিয়মিত অয়েল মাসাজ খুব জরুরি। শ্যাম্পু করার কয়েক ঘণ্টা আগে তেল লাগান। তারপর গরমজলে তোয়ালে ভিজিয়ে নিংড়ে নিয়ে সেটা চুলে জড়িয়ে রাখুন বেশ কিছুক্ষণ। এছাড়া মাঝে মাঝেই চুল ট্রিম করান স্প্লিট এন্ডসের সমস্যা এড়াতে। প্রত্যেকদিন চুলে জল না-লাগানোর চেষ্টা করুন।

চুলের মতোই এক একরকম ত্বকের জন্যও আলাদা আলাদা রকমের যত্ন চাই।

তৈলাক্ত ত্বক – মুখ ঠান্ডা জলে বারবার ধোবেন। তৈলাক্ত ত্বকের লোকজনেরা মূলতানিমাটি ও গোলাপজল বেশি করে ব্যবহার করবেন। যে কোনও একটি ফলের রসের সঙ্গে বেসন মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে সপ্তাহে দু’দিন লাগান। কারণ তৈলাক্ত হলেও ত্বকের আর্দ্রতার দরকার থাকে। ফলের রস সেই চাহিদা পূরণ করবে। তৈলাক্ত ত্বকের ক্ষেত্রে কোনও প্যাকে দুধ ব্যবহার করবেন না।

শুষ্ক ত্বক– ত্বক খুব শুষ্ক হলে মাঝে মাঝে অলিভ অয়েল দিয়ে মাসাজ করতে পারেন। শসা ব্লেন্ডারে দিয়ে রস করে সেটা ছেঁকে বোতলে ভরে রাখতে পারেন। মাঝে মাঝে মুখে স্প্রে করলে ভালো টোনারের কাজ করবে। সারারত আমন্ড ভিজিয়ে পরেরদিন বেটে নিয়ে দুধে মিশিয়ে তৈরি করুন ঘরোয়া রূপটান। সপ্তাহে দু’বার লাগালেই কাজ দেবে।

এছাড়া বিয়ে একদম কাছে এসে গেলে সালঁতে গিয়ে ফেশিয়াল করাতে পারেন। সনা বাথ নিতে পারেন। হেয়ার স্পা করাতে পারেন। এর সবগুলোই আপনাকে সেই বিশেষ দিনটির জন্য আরও একটু বেশি করে প্রস্তুত করে তুলবে!

কস্তুরী ইতিহাসে এমএ পাশ দিয়েছেন। চাকরিও করেছেন বেশ কিছু কাল। এখন ফ্রিলান্স লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রিকায়। বেশ কিছু বছর আনন্দবাজার পত্রিকার "উৎসব" পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন। গান শুনতে আর সিনেমা দেখতে ভারী ভালবাসেন।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *