মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার শপথগ্রহণের অনুষ্ঠান। স্থান: ইলিনয় রাজ্য, শিকাগো শহর, রিগলি ফিল্ড। শেষোক্ত জায়গাটি শিকাগো তথা আমেরিকার জাতীয় ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে রিগলি মাঠের ইতিহাস আপাতত মুলতুবি থাক। সে কথা অন্য কোনওসময় হবে। সেই অনুষ্ঠানে ফিরে যাই আবার। প্রায় ৪৫টি দেশের ২৭০ জন মানুষ জড়ো হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে শপথ নিতে। আমার একপাশে বসেছেন এক শেতাঙ্গিনী। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, তাঁর জন্মভূমি হল ইউক্রেন। অন্যপাশে বসেছেন এক কৃষ্ণকায় ভদ্রলোক। বেশ হাসিখুশি মানুষ। হাবেভাবে মনে হল আলাপ করতে আগ্রহী। আমিও এমন সুযোগ ছাড়ার পাত্রী নই। তাঁর মাতৃভূমি কোথায়, জানতে চাইলে একগাল হেসে জবাব দিলেন ‘নাইজেরিয়া।’ বুঝলাম এইজন্যই বোধহয় এঁকে দেখে পর্যন্ত আমার কেমন চেনা চেনা লাগছিল। আমি যদিও নাইজেরিয়া যাইনি কখনও। নাইজেরিয়ান বন্ধুবান্ধবও নেই বিশেষ। তা সত্ত্বেও এহেন আত্মীয়তা বোধের কারণ একটিই। সেটা বলা যাক:

২০১৪-১৫ সাল। নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বুহারি জয়লাভ করেছেন। লাগোস শহরে এক ধনী পরিবারের রাঁধুনি আনন্দে নেচে ওঠে এই খবরে। তার দেশ ঘানা-তে। দূরদর্শনে ঘোষণা হয় ,”চেঞ্জ হ্যাজ় কাম! নাইজেরিয়া উইল থ্রাইভ! দিস ইজ় হোয়াট উই হ্যাভ বিন ওয়েটিং ফর।”

এই নির্বাচনের মাত্র কয়েকমাস আগের কথা। গ্রামের নাম ইকাতি। দূরে কোথাও মোরগ ডাকছে। করুণ ও উদাস সেই ডাক। উঠোনের আমগাছে কাল পাখিরা তাদের সুখী কিচিরমিচির জুড়েছে। আরও দূরে এক চাষি কুড়ুলের ঘা মেরেই চলেছে গাছের গুঁড়িতে- ঠক ঠক ঠক ঠক। কাছের একটি ঘরে উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে কেউ। অন্য আর একটি ঘরে কোনও মা ডেকে তুলছেন ছেলেমেয়েদের। বলছেন লোহার বালতির জল ব্যবহার না করে মাটির পাত্রের জলে মুখ ধুতে। এ সবই প্রতিদিনকার সকালের চেনা শব্দ। কিন্তু আজ এসব শব্দই আদুনির (আদুনি) বুকে ধাক্কা দিচ্ছে সজোরে। মনে করিয়ে দিচ্ছে যে আজ তার বিয়ের দিন। 

আদুনি – চোদ্দো বছরের মাতৃহীন এক মেয়ে। আবি দেয়র-এর লেখা ‘The Girl With The Louding Voice’ বইয়ের নায়িকা। তার মদ্যপ বাবার কাছে সে এক মূল্যবান পণ্য। মোরুফু নামের জনৈক ট্যাক্সিচালক  ত্রিশ হাজার নাইরার বিনিময়ে তিননম্বর বৌ হিসেবে কিনে নিতে চায় তাকে। বিয়ের প্রস্তাবে রাতের অন্ধকারে মাদুরের ওপর বসে বসে আদুনি ভাবতে থাকে, “What is it meaning , to be the wife of a man with two wifes and four childrens? And Papa, why is he wanting to sell me to an old man with no any thinking of how I am feeling ?” তার বুকের মধ্যে ভারী হয়ে ওঠে নানা প্রশ্ন। মা মারা যাওয়ার পর ছোট ভাইটি ও বাবার মুখ চেয়ে নিজের দুঃখ বুকে চেপে সে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। কিন্তু সে দুঃখ কখনও কখনও উঠে আসে তার জিভের ডগায়- প্রশ্ন, প্রতিবাদ আর ক্ষোভ ছটফট করে তার মুখেচোখে। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য সে চায় জোরালো কণ্ঠস্বর। এ কাহিনি আদুনির নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়ার গল্প। 

The Girl with the Louding Voice
এ গল্প আদুনির নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়ার গল্প

মোরুফুর সঙ্গে বিয়ের পরে এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে সে। এগান গ্রামবাসীদের জঙ্গুলে বিচার ও শাস্তি এড়াতে পালিয়ে যায় সে। এবারে নিজের দেশেই দাসপ্রথার শিকার হয়। লাগোসে এক ধনী পরিবারে গৃহভৃত্য হিসেবে তাকে বিক্রি করে দেয় দালাল। কিন্তু সেখানে গিয়েও চুপ করে থাকতে পারে না সে। ধনীগৃহের রাঁধুনি ও গাড়ির চালকের নিষেধ সত্ত্বেও আগের নিখোঁজ পরিচারিকা রেবেকার বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করে বসে মালকিনকে। নানা নির্যাতন সহ্য করেও তার মনে জেগে থাকে এক অদম্য ইচ্ছা। সে স্কুলে যেতে চায়। ভবিষ্যতে ইস্কুলের দিদিমণি হওয়ার বাসনা তার।  নিজের পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কহীন এই ইচ্ছের কারণ হিসেবে আদুনি তার শুভার্থীকে বলে, “My mama says education will give me a voice. I want more than just a voice, Ms. Tia. I want a louding voice.”

সে জানে যে এ কাজটি তার পক্ষে দুরূহ। জানে তার মূল্য নির্ধারিত হয়েছে চারটি ছাগল, দু’বস্তা চাল, কয়েকটা মুরগী আর একটি টিভি সেট। তার মা ছাড়া পৃথিবীতে সকলেই তাকে  বুঝিয়েছে যে তার অস্তিত্ব অর্থহীন। মানবিকতার ন্যূনতম অধিকারটুকুও অনেক সময় দেওয়া হয়নি তাকে। চূড়ান্ত লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেও আদুনি লড়াই চালিয়ে গেছে তার ‘louding voice ‘ খুঁজে পাওয়ার জন্য। কখনও ফিসফিস করে, কখনও বা গান গেয়ে আবার কখনও ভাঙা ইংরিজিতে এ মেয়ে কথা বলেই চলে। যতক্ষণ না নিজের কথা জোরগলায় বলতে পারে, বলতে পারে রেবেকাদের মতো মেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার নেপথ্যের কাহিনি, সে চুপ করে না। সে বিশ্বাস করে, “A day will come when my voice will sound so loud all over Nigeria and the world of it, when I will be able to make a way for other girls to have their own louding voice, because I know that when I finish my education, I will find a way to help them to go to school.”

 

আরও পড়ুন: শুভাশীষ ভাদুড়ির কলমে অগ্নি রায়ের ‘জর্দাবসন্ত’ কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা

 

আদুনি র লড়াই নতুন কোনও ব্যাপার নয়। এ লড়াইয়ের সাক্ষী আবহমানকাল। আবি দেয়র-এর আদুনির অমোঘ উচ্চারণ আমরা শুনেছি বাংলা কবিতাতেও: নিভন্ত ওই চুল্লীতে মা একটু আগুন দে , তাকে দেখেছি রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্রছোটগল্পে। এ বইয়ের বিশেষত্ব হল কাহিনির উপস্থাপনায়। গল্পের গতিশীলতা প্রথম থেকেই মনোযোগ আকর্ষণ করে পাঠকদের। সেইসঙ্গে আছে স্থান, কাল ও পাত্রের বাস্তবানুগ চিত্রণ। ঘটনা যত এগোয়, ভুলে যেতে হয় বই পড়ছি। গল্পের চরিত্রগুলির সঙ্গে  একরকমের মানসিক যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। তাইজন্যই রিগলির ময়দানে পাশে বসা নাইজেরিয়ান ভদ্রলোককে চেনা চেনা ঠেকছিল। মিস্টার কোলা, নাকি কোফি? আবার মোরুফু বা বিগ ড্যাডিও হতে পারেন। গল্পের পাতা থেকে উঠে চোখের সামনে হাজির হয়েছেন হয়তো! আর এখানেই ঔপন্যাসিকের সার্থকতা। মহাশ্বেতা দেবী বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প উপন্যাসের নির্যাতিত চরিত্রদের মতো এ কাহিনির নায়িকা তার রচনাকারীর ওপর নির্ভর করে থাকতে চায়নি নিজের গল্প বলার জন্য। এ ব্যাপারে আদুনি স্বাবলম্বী হতে চায়। তাই বিদ্যালয়ে পড়ার অনুদান পাওয়ার প্রতিযোগিতায় সে জমা দেয় নিজের একটি লেখা, শিরোনাম The True Story Essay of Myself by আদুনি, the Girl With The Louding Voice .

নাইজেরিয়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়া যাক এবারে। কিন্তু সঙ্গে রইল সে দেশের মানুষেরা। ইফেমেলু আর ওবিনজ় ছাত্রাবস্থাতেই প্রেমে পড়ে নাইজেরিয়ায়। দু’জনেই তখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যথাসময়ে স্কুল কলেজের পাঠ চুকিয়ে তারা একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় উচ্চশিক্ষা লাভের আশায়। কিন্তু অচিরেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। ক্রমাগত ধর্মঘটের কারণে তাদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হতে থাকে। পরিস্থিতি পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ওবিনজ় পাড়ি দেয় লন্ডনে। সেখানে ছদ্মনামে শৌচালয় পরিষ্কারের কাজ নেয় সে। মনে আশা, যে বেশ কিছুটা টাকা জমিয়ে নিয়ে সে ছেলেখেলার মতো এক বিয়ে করবে। আর তার লন্ডনের নাগরিকত্ব লাভের পথটি সুগম হবে এভাবে। অন্যদিকে ইফেমেলু ফিলাডেলফিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আংশিক অনুদান পেয়ে চলে যায় আমেরিকায়। সেখানে চূড়ান্ত অর্থসংকটের মুখোমুখি হয়ে কখনও কখনও শরীর বিক্রি করতে পর্যন্ত বাধ্য হয় সে। এভাবেই চিমামান্ডা নগোজ়ি আদিচির তৃতীয় উপন্যাস ‘আমেরিকানা’ পাঠকদের সামিল করে এক বর্ণময় সফরে। 

Americanah Book
চিমামান্ডা নগোজ়ি আদিচির লেখা উপন্যাস ‘আমেরিকানা’

The Girl With The Louding Voice  বা আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে রচিত অন্যান্য বেশ কিছু উপন্যাসে বর্ণিত প্রধান চরিত্রদের মতো উপোসী, অত্যাচারিত বা ধর্ষিত নয় ইফেমেলু আর ওবিনজ়জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়নি তাদের বাসস্থান ও সেই সংলগ্ন অঞ্চল। মোটামুটি মধ্যবিত্ত পরিবারে তাদের বেড়ে ওঠা। লেখাপড়াও শিখেছে তারা ভালমতো। আদিচির উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রদুটি নাইজেরিয়া ছেড়েছে উন্নততর জীবনযাত্রার সন্ধানে। চূড়ান্ত দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে নয়। আসলে অন্যান্য নাইজেরিয়ানদের মতো তারাও “conditioned from birth to look towards somewhere else, eternally convinced that real lives happened in that somewhere else” অভিবাসী জীবনের প্রতিকূলতা বরণ করে নেওয়ার পিছনে তাদের কারণ খুব সম্ভবত “the need to escape from the oppressive lethargy of  choicelessness.” আর এই অন্য কোনখানটি অবধারিতভাবেই পশ্চিমী দুনিয়ার কোনও দেশ।  

ইফেমেলু এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। প্রতিকূলতা ও সেই প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার হাতিয়ার তাই স্বাভাবিকভাবেই আবি দেয়রের নায়িকার থেকে আলাদা। তার অভিবাস জীবনের শুরুতে একা, বিভ্রান্ত ও গরিব (সব অভিবাসীই প্রথমদিকে অর্থসংকটে ভোগেন) ইফেমেলু সম্মুখীন হয় নানা চ্যালেঞ্জের। স্বাভাবিকভাবেই বিদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সে একাত্ম বোধ করে না। “We are too superior /busy /cool /not uptight to bother about how we look to other people, and so we can wear pajamas to school and underwear to the mall.” অবাক লাগে ইফেমেলুর। আমেরিকার অভিবাসী বাঙালি হিসেবে তার এই অবাক লাগা বুঝতে অসুবিধে হয় না।

‘আমেরিকানা’ অবশ্যই একবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন ও আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জীবনের অভিজ্ঞতায় আধারিত এক উপন্যাস। কিন্তু এ বইতে আর একটি স্তর আছে। ফল্গুর মতো যা কাহিনির মূল স্রোতের আড়ালে বহমান। অভিবাসী জীবনের নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের বেদনা ফুটে উঠেছে বইয়ের প্রায় প্রতি পাতায়। কিন্তু সেই বেদনা প্রকাশের জন্য লেখক আশ্রয় নিয়েছেন হাস্যরসের। তাঁর শৈলী মনে করিয়ে দেয় ‘কমেডি অফ ম্যানার্স’-এর কথা। সেনেগালিজ় সেলুনকর্মী, ভণ্ড কৃষ্ণাঙ্গ বোহেমিয়ান, বস্টন শহরবাসী উদারচেতা ধনী, শ্বেতাঙ্গিনী লেসবিয়ান- নানা চরিত্রের মিছিলে সমৃদ্ধ উপন্যাস এটি। আর তাদের স্রষ্টার ভূমিকা হল নীরব দর্শকের। 

ইফেমেলুর মাধ্যমে মূল কাহিনির মধ্যে মধ্যে আদিচি বুনে দিয়েছেন তাঁর নিজস্ব বীক্ষণ- আমেরিকানদের excited শব্দটির অতিরিক্ত ব্যবহার, সবসময় পানীয় জলের বোতল সঙ্গে রাখার প্রবণতা ইত্যাদি। আর তাতেই তৈরি হয়েছে এই বইয়ের বর্ণময় নকশিকাঁথা। আমেরিকাতে ইফেমেলুর  অভিজ্ঞতা ও উপন্যাসের শেষ দিকে সে যখন নাইজেরিয়ায় ফেরে আরও একবার, তখন তার যে অভিজ্ঞতা হয়, তার সঙ্গে জুনো ডিয়াজ়, ঝুম্পা লাহিড়ী বা সুজ়ান চোই-এর মতো লেখক, যাঁরা বিগত প্রজন্মের অভিবাসী অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের কাহিনির নানা চরিত্রের মিল পাওয়া যায়। 

 

আরও পড়ুন: সুশোভন অধিকারীর কলমে সোমনাথ হোরের বইয়ের আলোচনা

 

আমেরিকাতে ইফেমেলুর অভিজ্ঞতায় বর্ণবৈষম্যের বিষয়টি এসে পড়ে সহজেই। কাহিনির শুরুতেই দেখি ইফেমেলু একটি সেলুনের চেয়ারে বসে আছে। সে বুঝতে পেরেছে সেদেশে তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, যদি সে তার চুলগুলিকে রাসায়নিক ব্যবহার করে শ্বেতাঙ্গিনীদের মতো সোজা করে ফেলে। আফ্রিকায়, একজন নাইজেরিয়ান ইগবো হিসেবে সে নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গী বলে জানত না মোটেও। কিন্তু আমেরিকায় এসে তার চামড়ার রং সম্বন্ধে সে সচেতন হয়েছে। উপন্যাসের এক জায়গায় সে বলছে, “I did not think of myself as black and I only became black when I came to America.” এদেশের সমাজ বিশ্বাস করে জাতি বা বর্ণ মানুষের জীবনবোধ নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে ‘self ‘ আর ‘race ‘-এর তফাৎ নেই তেমন। আগের কাহিনীর আদুনির মতো ইফেমেলুও তার স্বর খুঁজে পেয়েছে লেখনীর মাধ্যমে। সে একজন জনপ্রিয় ব্লগার। তার ব্লগের নাম Raceteenth বা Various Observations About American Blacks (those formerly known as Negroes ). তার একটি পোস্টের শিরোনাম ‘A Michelle Obama Shout Out Plus Hair as Race Metaphor.’ আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা এক জটিল, গভীর ও বহুমাত্রিক টানাপোড়েনের বহিঃপ্রকাশ।

এবারে যে বইটির কথা বলতে চলেছি সেখানে শেষোক্ত বিষয়টি ধরা হয়েছে এক বিশেষ তীব্রতায়। আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্য লুইসিয়ানা। সেখানে এক ছোট্ট শহর ম্যালার্ড (Mallard). সেই শহরের দুই যমজ কিশোরী দেজ়িরি আর স্টেলা ভিগনেস। তাদেরই এক পূর্বপুরুষ এ শহরের জনগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। বাঁশের মতো রোগা, গায়ের চামড়া ফ্যাকাশে, চোখ কটা আর ঢেউখেলানো সোনালি চুল- দুই বোনকে হুবহু একরকম দেখতে। লোকে বলে অন্ধও তাদের দু’জনকে দূর থেকে দেখলে চিনতে পারবে। কিছুটা নিঃসঙ্গ তারা। তাদের এক পূর্বপুরুষ এ জনপদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখানে বিশেষত্ব হল “In Mallard nobody married dark.” সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের মানুষের গায়ের রঙ নিয়ে অন্ধ ধারণা বেড়েছে। আর সেইসঙ্গে ম্যালার্ডের কালো মানুষগুলির গায়ের চামড়া ফ্যাকাশে থেকে হয়েছে ফ্যাকাশেতর- ‘like a cup of coffee steadily diluted with cream.’ কিন্তু চামড়ার সাদা রং ভিগনেস পরিবারের পুরুষটিকে বাঁচাতে পারেনি একদল সাদা মানুষের নৃশংস আক্রমণ থেকে। দুই বোনের মনে সে দৃশ্য চিরকালের মতো ছাপ ফেলে গেছে। 

‘আমেরিকানা’ অবশ্যই একবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন ও আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জীবনের অভিজ্ঞতায় আধারিত এক উপন্যাস। কিন্তু এ বইতে আর একটি স্তর আছে। ফল্গুর মতো যা কাহিনির মূল স্রোতের আড়ালে বহমান। অভিবাসী জীবনের নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের বেদনা ফুটে উঠেছে বইয়ের প্রায় প্রতি পাতায়। কিন্তু সেই বেদনা প্রকাশের জন্য লেখক আশ্রয় নিয়েছেন হাস্যরসের।

দেজ়িরি আর স্টেলার মা ধনী শ্বেতাঙ্গ পরিবারে পরিচারিকার কাজ করে নিজের ও দুই কন্যার ভরণপোষণ করেন। এ শহরে দমবন্ধ হয়ে আসে দু বোনের। নিজের মনে তারা ভাবে, দূরে কোনও বড় শহরে পালিয়ে গেলে কেমন হয়? ষোলো বছর বয়স হতেই রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল তারা। গন্তব্য রাজধানী নিউ অর্লিয়ঁ। একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল দোকানে কাজ পেল স্টেলা। সে সময়ে এ কাজের জন্য শুধু সাদা চামড়ার মেয়েদেরই নিয়োগ করা হত। প্রতিদিন সকালে স্টেলা কাজে যায়। সেখানে সে ‘মিস ভিগনেস’। তার কৃষ্ণকায় পরিবারের কথা কেউ জানে না। আবার প্রতি রাতে সে দেজ়িরির বোন স্টেলা হয়ে শুয়ে পড়ে বোনের  পাশে। তারপর একদিন দেজ়িরিকে ‘Sorry honey; but I have got to go my own way’ চিঠি লিখে রেখে উধাও হয়ে যায় সে। কোথায় যেন  মিলিয়ে যায় এক জোড়ার একটি। নিউ অর্লিয়ঁ-তে পৌঁছনোর অল্পদিনের মধ্যেই “Stella became white and Desiree married the darkest man she could find.” উপন্যাসের নাম ‘Vanishing Half’, রচয়িতা ব্রিট বেনেট। এ বইটির কেন্দ্রে আছে এক বর্ণের মানুষের আর এক বর্ণের মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার (Racial Passing) কাহিনি। 

এ ঘটনা নতুন নয়। অনেক অ্যাফ্রো-অ্যামেরিকান নিজেদের শ্বেতাঙ্গ প্রমাণ করতে চান সমাজ সংসারের কাছে। এর কারণগুলি সহজেই অনুমেয়। কখনও দাসত্ব এড়াতে, কখনও বা বর্ণভেদের কারণে হিংসাত্মক আক্রমণ এড়াতে, আবার কখনও বা শ্বেতকায়দের জন্য নির্দিষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধে পাওয়ার জন্য বর্ণ পরিবর্তনের এই প্রয়াস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা উপন্যাস Clotel থেকে শুরু করে ল্যাংস্টন হিউয়ের ছোটগল্প, বা ১৯৫০ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র “Imitation Of Life”- সবেরই কেন্দ্রে আছে এই বিষয়টি। এই বিষয়বস্তু একেবারেই আমেরিকার নিজস্ব। বর্ণ ও বর্ণ সংক্রান্ত নানাবিধ সামাজিক টানাপোড়েনের উপস্থিতি মার্কিন সমাজে সুস্পষ্ট। তাই বহুচর্চিত হলেও বিষয়টি কখনও প্রাসঙ্গিকতা হারায় না।

এ বইয়ের কাহিনির শুরু ১৯৬৮ সালে। সে বছরই এপ্রিল মাসে সিভিল রাইটস আইনে সই হয়েছে বর্ণের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে তফাৎ দূর করতে। চোদ্দো বছর দূরে থাকার পরে দেজ়িরি ফিরে আসে তার জন্মের শহরটিতে। সঙ্গে বালিকা কন্যা জুড। জুডের গায়ের রং কালো মিশমিশে। তা থেকে নীলচে আভা ফুটে বেরোয়। তাকে দেখে  চমকে যায় ম্যালার্ডের লোকজন। বর্ণবিভেদের চূড়ান্ত রূপ লেখিকা তুলে ধরেন জুডের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। সেইসঙ্গে অন্যান্য নানা প্রশ্নের মুখোমুখি তিনি দাঁড় করান পাঠকদের। এক বর্ণের মানুষ নিজেকে যদি সফলভাবে অন্য বর্ণের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে কী হয়? যদি কেউ কখনও চরিত্রটির আসল রূপ জানতে না-ই পারে, তাহলেই বা ক্ষতি কী? সে যদি অনুশোনায় না ভোগে তাহলেই বা কী হয়?

এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাঠক আবিষ্কার করেন যে ব্রিট বেনেটেরVanishing Half’ এই জঁরের পূর্বসূরীদের থেকে আলাদা। কাহিনির গতি দ্রুত। ভিগনেস পরিবারের কয়েক প্রজন্মের কাহিনি বয়ে চলেছে উপন্যাসে। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর (১৯৪০-১৯৫০) ঘটনাক্রম ধরা আছে বইতে। গল্পের কেন্দ্রে ‘রেশিয়াল পাসিং’-এর বিষয়টি থাকলেও এ উপন্যাস আসলে বহুস্তরীয়। দুই যমজ বোনের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা, ব্যক্তির জন্মকালীন বৈশিষ্ট্য বনাম তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ, ভুল আত্মবোধ ও দ্বিধাবিভক্ত আত্মসত্তা- এমনি নানাবিধ বিষয় পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে। গল্পের টানটান গতির সঙ্গে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক নানা বিষয় যেসব নিয়ে তলিয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে তা যুক্ত হয়ে বেনেটের দ্বিতীয় উপন্যাস Vanishing Half সাম্প্রতিককালের একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। 

The Vanishing Half
ব্রিট বেনেটের বেস্টসেলার বই ‘দ্য ভ্যানিশিং হাফ’

তিনটি বই একই আলোচনায় বেছে নেওয়ার কারণ? প্রথমতঃ, তিনটি বইই এমন মানুষদের গল্প পাঠকদের বলে, যাঁরা প্রান্তিক হিসেবে চিহ্নিত। সমাজের মূলস্রোতে নিজেদের জায়গা দখল করতে তাঁদের প্রায়শঃই চড়া মূল্য দিতে হয়। দ্বিতীয়তঃ, তিনটি কাহিনিতেই নানাবিধ সামাজিক শোষণ ও নির্যাতনের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে নানাভাবে। এবং এইসব গল্প বলে চলার প্রয়োজনীয়তা যে আজও ফুরিয়ে যায়নি তার প্রমাণ জর্জ ফ্লয়েড বা স্ট্যান স্বামীর হত্যা। তৃতীয়তঃ, এবং পাঠক হিসেবে আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কারণ, তা হল প্রতিটি বইয়ের গল্প বলার মনোগ্রাহিতা। উপন্যাসগুলি পড়তে পড়তে ডুবে যেতে হয় কাহিনির মধ্যে। শুধু কী ঘটছে তাইই নয়, কীভাবে ঘটছে বা কেন ঘটছে তা জানার জন্যেও উদ্গ্রীব হতে হয়। চরিত্রগুলিকে নিবিড়ভাবে জানতে ইচ্ছে করে। 

যে কোনও বিষয়ে পরিসংখ্যান, তথ্য ও তত্ত্ব নিঃসন্দেহে শক্তিশালী। কিন্তু যেদিন থেকে মানুষ ভাষার ব্যবহার জেনেছে সেদিন থেকে সে গল্প বলে চলেছে। গল্প বলার এই ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও অত্যন্ত কার্যকরী। অস্কার জেতা থেকে নির্বাচনে জয়লাভ- সবই গল্পবলার খেলা। তাই সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে  গেলে গল্প বলতে হবে। মিছিলের প্রতিবাদী স্বর  থেকে এইসব কাহিনির স্বর কোন অংশে কমজোরি নয়। কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবাই সমান রাঙা‘- বাঙালি কবির এই আপ্তবাক্যটি যতদিন না মানুষ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করছে, ততদিন বারেবারে বলা গল্পও বলে চলতে হবে নতুন আঙ্গিকে। একজনের কণ্ঠরোধ হলে আরো হাজার কণ্ঠে বলতে হবে এইসব মানুষগুলির কথা। আর সেকাজ ভারী দক্ষতার সঙ্গে করেছেন আবি দেয়র , চিমামান্দা আদিচি আর ব্রিট বেনেট।. তাঁরা প্রত্যেকেই এক একজন আদুনি – the girl with the louding voice.

*ছবি সৌজন্য: Goodreads 
*ভিডিও সৌজন্য: Youtube

রঞ্জিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর বাসিন্দা। পেশায় শিক্ষিকা। নেশা বই পড়া লেখালিখি।"বাতায়ন" নামের একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন গত ছ বছর। এক দশকেরও বেশি সময় শিকাগোর "উন্মেষ সাহিত্য গোষ্ঠী"র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। রঞ্জিতার বিশ্বাস, সাহিত্য ভৌগোলিক সীমানা পার হয়ে মানুষ, দেশ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটায়।

2 Responses

  1. তিনটি ভিন্ন আখ্যান বিনিসুতোয় গেঁথে ফেলার কাজটি এতই সুচারুভাবে সম্পন্ন এখানে, এবং শেষ প্যারায় আলোচকের যে বিশ্বাস, গল্পের ওপর যে অগাধ আস্থা প্রতিফলিত -তা এই আলোচনাকে একই সঙ্গে গভীরতা ও ব্যাপ্তি দিয়েছে।
    মনে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *