সেবার শ্রীমানের আবদারে শীতের মরসুমে বেরিয়ে পড়েছিলাম নগর পরিক্রমায়। কেমন ছিল সে পরিক্রমা, সেটাই আজ তোমাদের বলব।‌ শ্রীমানকে তখন নানা মনীষীর জীবনকথা জানাবার জন্য ছোটদের পড়ার জীবনীগ্রন্থ কিনে দিতাম। সে তখন সবে নিজে নিজে পড়তে শিখছে। সেসব বই পড়ে পড়ে নানা শখ চাপে তার মাথায়। একদিন যেমন বলল 'আমি রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দেখতে যাব।'  আবার একদিন বলল, 'বিদ্যাসাগর কোথায় থাকতেন আমাকে দেখাবে?' আর একদিন বলল, 'আচ্ছা বাবা নেতাজি যে বাড়ি থেকে অন্তর্ধান করেছিলেন, সে বাড়িটায় নিয়ে যাবে?'  এমন সব আবদার লাগাতার শুনে ঠিক করলাম, অবশ্যই খুদের দাবি মানতে হবে। তাই একদিন বিধান সরণি আর বিবেকানন্দ রোডের সংযোগস্থলে ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের মুখে পৌঁছে গেলাম শ্রীমানকে সঙ্গে নিয়ে। আগে থেকে অবশ্য বলিনি, কোথায় চলেছি আমরা।

অনেক বছর আগে এই গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট ছিল সুতানটির অংশ। সে আমলে, অর্থাৎ কিনা উনিশ শতকের কলকাতার এ অঞ্চলে তৎকালীন বহু গণ্যমান্য লোকের বাসা ছিল। তেমনই একজন, রামমোহন দত্ত। তিনি ব্রিটিশদের অ্যাটর্নি কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করে অনেক রোজগার করেছিলেন। এই সিমুলিয়া বা সিমলে পল্লির প্রায় তিরিশ কাঠা জমির উপর একটা পেল্লায় বাড়িও বানিয়েছিলেন সেই আড়াইশো-তিনশো বছর আগে। তখন তো আর এখনকার পায়রার খোপের মতো ফ্ল্যাটবাড়ি হলে চলত না, একান্নবর্তী পরিবার ছিল। তাই বিরাট বিরাট বাড়ি লাগত। অনেক ঘরদোরের প্রয়োজন পড়ত। ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের মুখে দাঁড়িয়ে বাপ-বেটায় এসব গল্প করতে করতে শ্রীমান হঠাৎ বলে বসল 'এই তো চেনা মূর্তি।' আমি বললাম,  'আজ তোমাকে এই বাড়িটাই দেখাতে নিয়ে এসেছি! চল ভিতরে যাই…!'

বিশ্বনাথ দত্ত ওকালতি করতেন বলে তাঁর ইচ্ছে ছিল নরেনও আইনজ্ঞ হোন। কিন্তু হঠাৎ এই শোক নরেনের মা ভুবনেশ্বরী দেবীর কাছে বিপর্যয়ের মতো নেমে এল। তিন পুত্র, তিন কন্যা নিয়ে অথৈ জলে পড়লেন।

প্রধান ফটক পেরিয়ে গিয়ে বললাম,  “১৮৬৩ সালের কথা। জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখ ছিল মকর সংক্রান্তি।” শ্রীমান মকর সংক্রান্তির গল্প জানে। সূর্যের উত্তরায়ণের শুরুর দিন সেটা। “সেই মকর সংক্রান্তির দিন এ বাড়িতেই তিনি জন্মেছিলেন। আর এখানেই তাঁর দুরন্ত ছেলেবেলাটি কেটেছিল।” এতটুকু বলার পর জলের ফ্লাস্ক থেকে খানিকটা জল গলায় ঢাললাম। শ্রীমানও ঢালল খানিক। এবার সে নিজেই বলতে লাগল।

“জানো তো ছোটবেলায় ওঁর নাম ছিল নরেন। মা আদর করে বিলে বলে ডাকতেন। আর বিলের দৌরাত্ম্যে এবাড়ির লোকজন আর পাড়া-প্রতিবেশীরা সকলেই একেবারে অতিষ্ঠ।” আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “ওহ্ তাই নাকি! তারপর কী হল?” শ্রীমান ফের বলতে শুরু করল,  “জানো তো, এ বাড়ির উঠোনে বিলের মা, ভুবনেশ্বরী দেবী ওর রাগ শান্ত করার জন্য ঘড়ায় করে জল ঢালতে থাকতেন ওর মাথায়। আর শিবনাম জপ করতেন। তাতেই বিলে ঠান্ডা হত।”

আমরা গল্প করতে করতে বাড়ির দোতলায় উত্তর দিকের একটা ঘরে ঢুকে পড়লাম। আমি বললাম, “তুমি জানো, খুব বেশি দুষ্টুমি করলে বিলেকে এ ঘরে বন্দি করে রাখা হত?”‌ শ্রীমান জানলার কাছে গিয়ে আনমনে বলল, “জানি তো। একদিন রাস্তার ভিখারিরা এল ভিক্ষে চাইতে। বিলে তখন ঘরে বন্দি। তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে ভিখারিদের দেখে ঘরের আলমারি থেকে সব জামাকাপড় বের করে এই জানালা দিয়ে নীচে ফেলে দিতে লাগল।”‌ আমি শুনে বললাম, “দ্যাখো কাণ্ড! ভারী দুষ্টু তো!” শ্রীমান মুচকি হেসে সায় দিল।

এরপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে যেতে যেতে বললাম,  “জানো তো, নরেন যখন সবে কলেজের পাঠ শেষ করেছেন, হঠাৎ তাঁর বাবা বিশ্বনাথ দত্ত মারা গেলেন।” শ্রীমান কথাটা শুনেই আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। আমি বললাম, “বিশ্বনাথ দত্ত ওকালতি করতেন বলে তাঁর ইচ্ছে ছিল নরেনও আইনজ্ঞ হোন। কিন্তু হঠাৎ এই শোক নরেনের মা ভুবনেশ্বরী দেবীর কাছে বিপর্যয়ের মতো নেমে এল। তিন পুত্র, তিন কন্যা নিয়ে অথৈ জলে পড়লেন। এর মধ্যেই এক আত্মীয় পৈতৃক ভিটে নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন।‌ ফলে নরেনদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হল।”

দেখি শ্রীমানের চোখের কোণ চিকচিক করছে। কথা ঘুরিয়ে বললাম, “এ সময়েই প্রথম রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে নরেনের দেখা হল। তখনও কিন্তু তাঁর ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল না। রামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে বলেছিলেন সেদিন, দেখিস তোর ভাইবোনেদের ভাতকাপড়ের অভাব হবে না।”

১৮৬৩ সালের কথা। জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখ ছিল মকর সংক্রান্তি।” শ্রীমান মকর সংক্রান্তির গল্প জানে। সূর্যের উত্তরায়ণের শুরুর দিন সেটা। “সেই মকর সংক্রান্তির দিন এ বাড়িতেই তিনি জন্মেছিলেন।"

এই গল্পসল্পের মধ্যেই দেখি, একটি ঘরের মধ্যে তিন-চারটি ছোট ছেলের মূর্তি গড়া। একজন তার মধ্যে ধ্যানমগ্ন। তার সামনে ফণা তুলে আছে একটি সাপ। গল্পটা বলতে লাগলাম শ্রীমানকে— “ছোটবেলায় বিলে দুরন্তপনা করলেও তার প্রিয় খেলা ছিল ধ্যান-ধ্যান খেলা। ধ্যানে বসলে বিলের আর কোনও দিকে খেয়াল থাকত না। এমনই একদিন ধ্যানখেলার সময় চুপিসাড়ে ঘরে ঢুকে বিলের সামনে ফণা তুলল বিষধর সাপ। বন্ধুরা তো সাপ দেখে ভয়ে পালাতে লাগল আর চিৎকার করে বিলের ধ্যান ভাঙাতে চাইল। কিন্তু বিলে তো ধ্যানে বিভোর। তার কানে পৌঁছল না এসব হৈ হট্টগোল। সাপটাও অনেকক্ষণ ফণা ধরে থেকে অবশেষে ছোবল না-মেরে নিজের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।” শ্রীমান অবশ্য আগে থেকেই জানত এই কাহিনির কথা। খুব নিচু স্বরে সে কথা বলেও দিল আমাকে।

সেদিন এ বাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে বারবার মনে হয়েছে, এ ঘরের সেই ছেলেই পরবর্তী জীবনে বিশ্বের মানুষকে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর জ্ঞান ও দর্শনের কথা শুনিয়ে। আজ গোটা দেশ তথা বিশ্বের কাছে তাঁর পরিচয় স্বামী বিবেকানন্দ নামে।

*স্বামীজির প্রতিকৃতি এঁকেছেন লেখক।

 

 

 

Pitam Sengupta

প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *