মঞ্চের আলো প্রসঙ্গে আলোচনা হলেই, আমার কৈশোরকালের একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমি বড় হয়েছি একটি ছোট মফস্সল শহরে। শীত পড়লেই পাশের মাঠে যাত্রার আসর বসত। কলকাতা থেকে নামীদামি যাত্রা কোম্পানির আগমনবার্তা ঘোষণা করে পাঁচিল, আলোকস্তম্ভ, গাছের গুঁড়ি ছয়লাপ হয়ে যেত পাতলা কাগজে ছাপা লিথো পোস্টারে। সেবার এক পালার পোস্টার বেশ সাড়া ফেলে দিল। পালার নাম মনে নেই, কিন্তু মনে আছে সেই পোস্টারে বড় বড় করে লেখা ছিল, “সম্পূর্ণ রঙিন যাত্রাপালা”। সবার মতো আমিও কৌতূহলী। অনেক যাত্রা দেখেছি জীবনে, কিন্তু কখনও সাদা-কালো পালা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তাহলে রঙিন যাত্রাপালা ব্যাপারটা কী? সুতরাং উনিশ পয়সার টিকিট কেটে যাত্রা দেখতে যেতেই হল।
প্রথমটা কিছু বুঝতেই পারিনি। কিন্তু পালা শুরু হতেই রহস্য উদ্ঘাটন। অর্কেস্ট্রা শেষ হতেই মঞ্চে জ্বলে উঠল অসংখ্য রঙিন আলো। পালার নির্দেশক, মঞ্চের উপর বেশ কিছু থিয়েটারের আলো (par-can) লাগিয়েছেন, আর প্রতিটি আলোর উপর রঙিন জেল। পালা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে ডিমারের উপর আলোকশিল্পীর আঙুলের ছোঁয়ায় নানা রঙের আলো জ্বলতে-নিভতে থাকল যাত্রার আবহসঙ্গীতের তালে তালে। খান দু’য়েক ফলো স্পটের সামনে লাগানো রঙিন জেলের চাকা দু’জন আলোকশিল্পী নানা গতিতে, কখনও সঙ্গীতের তালে, কখনও বেতালে, ঘুরিয়ে যেতে থাকলেন। আর এই রঙিন আলোর খেলার মাঝে অভিনেতারা অত্যুৎসাহে অভিনয় করে যেতে লাগলেন। ব্যস, জমে গেল সম্পূর্ণ রঙিন যাত্রাপালা।
আমি অবশ্য সম্পূর্ণ রঙিন যাত্রাপালা, বা সেই রকম কিছু নিয়ে আলোচনা করতে বসিনি। আমার বিষয় থিয়েটার বা নাট্যমঞ্চের আলো। আরও বিশদ করে বলতে হলে, আমি প্রধানত আলোচনা করব একজন নাটককারের কাছে থিয়েটারের আলোর ভূমিকা কী, এবং তার সঙ্গে একজন নাট্য নির্দেশক ও আলোকশিল্পীর কী সম্পর্ক, তা নিয়ে। আমি জানি, আপনি হয়তো ভাবছেন একজন নাট্যকার আলো নিয়ে কেন ভাবছেন? তাঁর তো নাটকের প্লট, সংলাপ, চরিত্র — এই সব নিয়ে ভাবার কথা। আলো, মঞ্চ এসব নির্দেশকের উপর ছেড়ে দেওয়াই ভাল নয় কি? কথাটা অযৌক্তিক নয়। প্রযোজনার দায়িত্ব যখন নির্দেশকের, তখন মঞ্চে কখন কোথায় কী আলো জ্বলবে, সেটা তাঁকে ঠিক করতে দেওয়াই ভাল। কিন্তু ব্যাপারটা হল, আলোর ভাবনাটা কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে নাটকের প্রথম সংলাপ লেখার আগেই শুরু হয়ে যায়। অধিকাংশ আধুনিক নাটকের স্ক্রিপ্টের শুরুতেই লেখা থাকে “মঞ্চে আলো আসতে দেখা যায়…” বা ওইরকম কিছু।

নাটক লেখার আগেই নাট্যকার কল্পনা করে নেন, তাঁর চরিত্রেরা ঠিক কী রকম পরিস্থিতিতে দৃশ্যমান হবেন। অবশ্য পর্দা ওঠার কথা আজকাল অনেক নাট্যকার ব্যবহার করেন না, কারণ অনেক মঞ্চে নাটক শুরু হবার আগে পর্দা ওঠেই না। দর্শক যখন হলে প্রবেশ করেন তখন মঞ্চ উন্মুক্ত এবং সম্পূর্ণ দৃশ্যমান থাকে। খোলা মঞ্চে একটা হাল্কা আলো (stage warmer) এক অদ্ভুত রহস্যময় আবহাওয়া সৃষ্টি করে। দর্শক নাটকের মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করেন সংলাপ উচ্চারিত হবার আগেই। স্যামুয়েল বেকেট তাঁর নাটক “প্লে-” তে এ বিষয়টা আরও নির্দিষ্ট করে বলেছেন। উনি নাটকের প্রারম্ভিক নির্দেশেই (যাকে আমরা stage direction বলে থাকি) লিখছেন,
“…Their speech is provoked by a spotlight projected on faces alone. The transfer of light from one face to another is immediate. No blackout, i.e. return to almost complete darkness of opening, except where indicated. The response to light immediate….”
এই নাটকে বেকেট আলোর ব্যবহারকে এতটাই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যে আলো একটি সম্পূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছে।
বেকেটের নাটক অবশ্যই একটি বিশেষ আঙ্গিকের নাটক, যা হয়তো রিয়ালিজ়মের বাঁধাধরা নিয়ম বহির্ভূত। সুতরাং এখানে আলো যে একটি বিশেষ ভূমিকা নেবে সেটা আশ্চর্যের নয়। কিন্তু রিয়ালিস্টিক নাটকের নাট্যকারকেও মঞ্চের আলোর কথা মাথায় রাখতে হয় প্রতি মুহূর্তে। আমরা জানি, আলো আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আলোর তারতম্যের সঙ্গে আমাদের মানসিক (এবং শারীরিক) পরিবর্তন ঘটে। এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। ভোরের আলোয় আমাদের যে মেজাজ থাকে, ভরদুপুরে অথবা মধ্যরাতে তা থাকে না। আলো ঝলমলে দিনে মনের অবস্থা ও মেঘলা দিনে মনের অবস্থাও এক থাকে না। সুতরাং শুধু সময় এবং পরিবেশ (বাইরের দৃশ্য না ঘরের ভেতরের) বোঝাতেই নয়, চরিত্রের মানসিক অবস্থানের একটা আন্দাজ জোগাতেও নাট্যকারকে আলোর ইঙ্গিত স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে হয়। তাই যে কোনও দৃশ্যের শুরুতেই নাট্যকারকে জানাতে হয়, দৃশ্যটি কোথায় ঘটছে — ঘরের ভেতরে না বাইরে। কোন সময়ে ঘটছে, দিনে না রাতে। দিনরাতের কোন সময়ে ঘটনাটি ঘটছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্টের যে স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহৃত হয় (বিশেষত হলিউডে) সেখানে প্রতিটি দৃশ্যের সময় এবং স্থান (INT, EXT) খুব স্পষ্ট করে লিখে দিতে হয় চিত্রনাট্যকারদের।
স্যামুয়েল বেকেটের “প্লে” নাটকের মতো অত স্পষ্ট করে না হলেও, স্থান এবং কাল জানিয়ে নাট্যকার নির্দেশক এবং আলোকশিল্পীকে তাঁর ভাবনা পৌঁছে দেন। এডওয়ার্ড এলবির “জ়ু স্টোরি” নাটকের প্রারম্ভেই নাট্যকার লিখেছেন,
“It is Central Park; a Sunday afternoon in summer; the present. There are two park benches, one toward either side of the stage; they both face the audience. Behind them: foliage, trees, sky…”
এই নির্দেশনাটুকু পড়ে আলোকশিল্পী পরিষ্কার বুঝতে পারেন তাঁকে কী করতে হবে। একটি রবিবারের বিকেল — সুতরাং উষ্ণ আলোর প্রয়োজন। উষ্ণ আলো সাধারণত হলুদ বা অ্যাম্বার রং ঘেঁষা হয়ে থাকে, আর শীতল আলো নীলের দিকে। যদিও আলোর তাপমান বা টেম্পারেচারের হিসেবে কেলভিন স্কেলে মাপা হয়ে থাকে, আলোর ক্ষেত্রে উষ্ণ বলতে কিন্তু বেশি টেম্পারেচার বোঝায় না। দিনের আলো সাধারণত ৫০০০ ডিগ্রি কেলভিনের আশপাশে। আবার মেঘাচ্ছন্ন আকাশ হয়তো ৬০০০ কেলভিন। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত ২০০০ থেকে ২৫০০ কেলভিন। কিন্তু আলোর উত্তাপ বা রং হলেই তো হবে না। আলো কোনদিক থেকে এসে মঞ্চে এবং চরিত্রের উপর পড়বে, সেটাও ভাবতে হবে। এলবি লিখেছেন, বেঞ্চের পেছনে গাছপাতার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায়। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বিকেলের আলো এসে পড়েছে দেখাতে পারলে সঠিক পরিবেশ হয়তো সৃষ্টি হবে। আলোর সামনে একটা পাতা কাটা গোবো (Gobo) রাখলে সেই পরিবেশ তৈরি করা যেতে পারে। কিন্তু সরাসরি অভিনেতার পেছন থেকে আলো এলে দর্শকের অসুবিধের কারণ হতে পারে। অভিনেতার মাথার উপর থেকে এই আলো দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে অভিনেতার মুখে ছায়া যাতে না পড়ে সেটা লক্ষ রাখতে হবে। সামনে থেকে আলো দিয়ে সেই ছায়া কাটানো যেতে পারে। মঞ্চে অভিনেতাকে আলোকিত করতে নানা দিক এবং উচ্চতা থেকে এক বা একাধিক আলোর উৎস ব্যবহার করা যেতে পারে। সিঙ্গল পয়েন্ট লাইটিং, অর্থাৎ একটি আলোর উৎস থেকে যখন অভিনেতাকে আলোকিত করা হয়, তা একটি নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করতে পারে স্বল্পক্ষণের জন্য। এই ধরনের আলো অভিনেতার প্রতি দর্শকের দৃষ্টি সরাসরি আকর্ষণ করে। নাট্যকার ব্রাত্য বসু তাঁর “শহর ইয়ার” নাটকের দ্বিতীয় অর্ধের শুরুতে লেখেন ,
“…মঞ্চে আগের সংগীতের রেশ নিয়ে হালকাভাবে গুনগুন করছে। প্রায় অন্ধকার। তার মধ্যে আমরা বাবুকে দেখতে পাই। একটা আলোকবৃত্ত তাকে ধরে।”
দর্শকের সম্পূর্ণ মনোযোগ যাতে বাবু চরিত্রটির প্রতি আকর্ষিত হয়, তাই নাট্যকার স্পষ্ট করে নির্দেশ দিয়ে দেন নির্দেশককে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই ধরনের একক আলোর ব্যবহার চরিত্রটিকে দ্বিমাত্রিক রূপ দিতে পারে। তাই সাধারণত একজন অভিনেতাকে সম্পূর্ণ ত্রিমাত্রিক দেখাতে আলোকশিল্পীরা একাধিক আলোর উৎস ব্যবহার করে থাকেন। যেমন, টু পয়েন্ট লাইটিং-এ দু’টি আলোর উৎস অভিনেতার সামনে থেকে ন্যূনতম তিরিশ ডিগ্রি বা তার বেশি উচ্চতা থেকে তার ডান এবং বাঁদিক থেকে নিক্ষিপ্ত হয়। আবার থ্রি পয়েন্ট লাইটিং-এ, এই দুই আলোর সঙ্গে যুক্ত হয় আর একটি আলোর উৎস, যা অভিনেতার মাথার উপরে অথচ পেছন দিকে অবস্থিত। এই তিন আলো নানান মাত্রায় এবং নানান রঙের মাধ্যমে মঞ্চের চরিত্র গড়ে তোলেন একজন আলোকশিল্পী।

সিনেমা এবং থিয়েটারের মধ্যে একটা বিশেষ পার্থক্য হল, সিনেমার পরিচালক ঠিক যতটুকু দেখাতে চান, দর্শক কেবল সেটুকুই দেখতে পারেন। নাটকের দর্শক, সাধারণত, মঞ্চের যে অংশ দেখতে চান তাই দেখতে পারেন। কিন্তু নাট্যকার যখন মঞ্চের একটি বিশেষ অংশের উপর দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান, তখন আলোর ব্যবহার তাঁর কাছে আবশ্যক হয়ে পড়ে। উপরে বেকেটের নাট্যাংশে তার উদাহরণ পাওয়া যায়। এছাড়া, অনেক নাট্যকার একই মঞ্চের নানা অংশকে ব্যবহার করেন ভিন্ন ভিন্ন স্থান বা কাল বোঝাতে। সেক্ষেত্রে জ়োনাল লাইট ব্যবহার না করে উপায় নেই। অনেকসময় দৃশ্যান্তরে সেট পরিবর্তন না করে মঞ্চের বিভিন্ন অংশকে ব্যবহার করেন নির্দেশক। সে ক্ষেত্রে মঞ্চকে ভাগ করতে জ়োনাল আলোর ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
মঞ্চে সেট, সেট প্রপার্টি, আসবাব ইত্যাদি জড় পদার্থগুলির রং, ঔজ্জ্বল্য, টেক্সচার, সব কিছুই গল্প বলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই মঞ্চে কেবল অভিনেতাদের আলোকিত করলেই চলে না, মঞ্চের যাবতীয় আসবাব এবং সেট প্রপার্টিগুলিকে আলোকিত করা আবশ্যক। আর্থার মিলারের “প্রাইস” নাটকের ঘটনা ঘটে একটি আসবাবপূর্ণ ঘরে, যে আসবাব এক ধূসর অতীতের গল্প বলে, এক পরিবারের গল্প বলে। নাটকের প্রারম্ভে নাট্যকার লিখছেন,
“Two windows are seen at the back of the stage. Daylight filters through their sooty panes which have been X’ed out with fresh whitewash to prepare for the demolition of the building. Now daylight seeps through a skylight in the ceiling, grayed by the grimy panes. The light from above first strikes an overstuffed armchair in center stage. It has a faded rose slipcover….”
এই প্রারম্ভিক নির্দেশ থেকেই নাট্যকার, নির্দেশক এবং আলোকশিল্পীকে সম্পূর্ণ নাটকের রং এবং টেক্সচারের একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে দেন। আলো এবং মঞ্চ এখানে দৃশ্যের মেজাজ এবং নাটকের সুর ধরে থাকে।

তবে সব নাট্যকারই যে নাটক লেখার সময় আলোর ব্যবহার সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে লেখেন, তা নয়। এমন অনেকে আছেন, যাঁদের হয়তো নাট্য প্রযোজনার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। সে ক্ষেত্রে তাঁরা হয়তো এমন এক একটি দৃশ্য লিখতে পারেন যা মঞ্চে পরিবেশনা অত্যন্ত কঠিন কাজ। অবশ্য প্রযুক্তির দৌলতে আলোকশিল্পীরা আজকাল মঞ্চে ম্যাজিক দেখাতে পারেন। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত এসব কিছুই আর আলোকশিল্পীর কাছে অসম্ভব নয়। আধুনিক কম্পিউটার সফটওয়ারের এবং ডিএমএক্স কন্ট্রোলের মাধ্যমে মঞ্চের প্রত্যেকটি আলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তিনি। ডিজিটাল প্রজেকশনের মাধ্যমে মঞ্চের পেছনের সাইক্লোরামার এক ভিন্নতর ব্যবহার প্রযোজনায় এক বিশেষ মাত্রা দিতে পারে, যা আগে সম্ভব ছিল না। ফলে একজন নাট্যকারের স্বাধীনতাও অনেক বেড়ে গেছে। তিনি অনেক কিছুই লিখতে পারেন, যা হয়তো আগে সম্ভব হত না। নিউ ইয়র্ক শহরে ব্রডওয়েতে যখন লায়ন কিং বা আলাদিন প্রযোজিত হয়, তখন তার টেক্সটের রচয়িতাকে ভাবতে হয় না, কী করে মঞ্চে সেরেঙ্গেটির সূর্যাস্ত দেখানো যায়, অথবা কী ভাবে জাদু কার্পেটে শহরের উপর দিয়ে উড়ে যাবে আলাদিন।
কিন্তু এই প্রযুক্তি তো সর্বত্র পাওয়া সম্ভব নয়। অধিকাংশ মঞ্চে অত্যন্ত সীমিত আলোর যন্ত্র পাওয়া যায়। কলকাতা (তথা ভারতবর্ষের) শহরের অধিকাংশ নাট্যদল অত্যন্ত প্রাচীন এবং বিপজ্জনক যন্ত্র নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু সেই সীমিত সাধ্যের মধ্যেই, কেবল প্রতিভার জোরে, আজও মঞ্চে ম্যাজিক ঘটে। তৈরি হন তাপস সেন অথবা জয় সেনের মতো শিল্পীরা।
আমি মনে করি, মঞ্চের আলো কেবল গল্প বলার হাতিয়ার নয়, সে নিজেও গল্প বলে। একজন নির্দেশক যেমন নাট্যকারের লেখা স্ক্রিপ্ট এবং কয়েকজন অভিনেতা অভিনেত্রীকে নিয়ে মঞ্চে গল্প বলেন, তেমনই একজন প্রতিভাবান দক্ষ আলোকশিল্পী সেই স্ক্রিপ্ট এবং তার পার-ক্যান, লিকো, ফ্রেনেল, গোবো, জেল, ডিমার বোর্ড ইত্যাদি ব্যবহার করে নাটকের ভেতরে আর এক নাটক বোনেন। তবে খেয়াল রাখা দরকার, সেই গল্প যেন মূল গল্প থেকে দর্শককে সরিয়ে নিয়ে না-যায়। যে মুহূর্তে মঞ্চের আলো দর্শককে নাটক থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, সেই মুহূর্তেই তা কেবল গিমিক বলেই গণ্য হবে, শিল্প নয়। আর তখন সেই প্রযোজনা “এক সম্পূর্ণ রঙিন” পালা হয়ে ওঠে মাত্র, সার্থক নাট্যশিল্প হয়ে ওঠে না।
সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।
বাংলা লাইভ
সম্পাদক সমীপেষু,
আমার সাম্প্রতিক “আলো, নাটক ও নাটককার” রচনাটি প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ। লেখাটি পড়ার সময় লক্ষ করলাম, “নাটককার” শব্দটিকে বহু জায়গায় “নাট্যকার” করে দেওয়া হয়েছে। ফলত রচনাটিতে একটা অসঙ্গতির সৃষ্টি হয়েছে। একটু ব্যাখ্যা করে বলি।
ইংরেজি “প্লেরাইট” (playwright) শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে “নাট্যকার” শব্দটি এককালে ব্যবহৃত হলেও, ইদানীং চলতি প্রতিশব্দ হল “নাটককার”। “নাটককার” শব্দটি ব্যবহার খুব সম্ভত শুরু করেছিলেন শ্রী শম্ভু মিত্র। উনি “নাট্যকার” তাকেই বলেছেন যিনি নাট্য বা নাট্যকলা সৃষ্টি করেন। “কাকে বলে নাট্যকলা” বইটিতে উনি নাটক ও নাট্যের মধ্যে তফাৎ বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, নাটকের লিখিত রূপ (বা টেক্সট) আর মঞ্চে যে নাটক অভিনীত হয় তা এক নয়। প্রথমটি “নাটক”, যেটি সৃষ্টি করেন একজন “নাটককার” আর দ্বিতীয়টি “নাট্য” যা সৃষ্টি হয় একাধিক শিল্পীর যৌথ প্রয়াসে। এই “নাট্যের” যিনি কর্ণধার, তাকেই প্রকৃত “নাট্যকার” বলা উচিৎ।
মানছি, এই যুক্তি তর্ক সাপেক্ষ, এবং চুলচেরা বিচারে কে জয়ী হবে সেটা নির্ণয় করা সহজ নয়। “নাট্য” একটি তৎসম শব্দ, এবং এই শব্দদ্বারা আমাদের সংস্কৃত নাট্য জগত নাটকের টেক্সটকে, না প্রযোজনাকে চিহ্নিত করতেন, তা আমার জানা নেই। তাই “নাটককার” না “নাট্যকার”, একজন নাটক রচয়িতাকে কোন শব্দে ভূষিত করা উচিৎ সে তর্কে না গিয়ে এটুকু বলা ভাল, যে আধুনিক বাংলা থিয়েটার মহল কিন্তু “নাটককার” শব্দটিকেই বেছে নিয়েছে। সেই কারনে আমি আমার রচনাতে “নাটককার” শব্দটি আগাগোড়া ব্যবহার করেছি। তবে যারা থিয়েটারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন, তারা অনেকেই হয়ত এই পরিভাষা পরিবর্তনের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন। সুতরাং নানান মাধ্যমে “নাট্যকার” শব্দটি আজও ব্যবহৃত হয় “প্লেরাইটের” প্রতিশব্দ হিসেবে। কিন্তু আমার মনে হয়, এখন সময় এসেছে যে কোন একটিকে বেছে নেবার। অধিকাংশ বাংলা নাট্য কর্মী “নাটককার” শব্দটিকেই বেছে নিয়েছেন আর আমিও সেই দলে।
শুভেচ্ছান্তে ইতি,
সুদীপ্ত ভৌমিক
নভেম্বর ২৬, ২০২০
নিউ জার্সি।
শ্রীসুদীপ্ত ভৌমিক মহাশয়
মান্যবরেষু,
আপনার ‘ আলো, নাট্য ও নাটককার’ শীর্ষক মূল্যবান নিবন্ধটির জন্য বাংলালাইভ ডট কম পত্রিকা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। রচনাটিতে ‘নাট্যকার’ ও ‘নাটককার’ শব্দ দুটির অর্থ সংক্রান্ত সংশয় ও বিভ্রান্তির জন্য সম্পাদকীয় বিভাগ আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
অভিবাদন ও ধন্যবাদ।
সম্পাদকীয় বিভাগ
বাংলালাইভ ডট কম
নাট্যকার
এই নিবন্ধটি লেখার জন্য সুদীপ্ত দা কে অনেক ধন্যবাদ। এ থেকে অনেক জিনিস শিখলাম। এটি সমস্ত থিয়েটার প্রেমীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধন্যবাদ আবার সুদীপ্ত দা।
তর্করত্ন উপাধি পাওয়ামাত্র আমার গেরেম্ভারী ভাব বাড়িয়াছে। গুরুতর বিষয় পাইলেই মনোমধ্যে টিকটক করে। টিকটকের যুগে অধিক টক উচিৎ নহে। কে কী অর্থ করিয়া বসে। এইদিকে নাট্যকার নাটককার লইয়া মস্তিষ্কে বড় উৎপীড়ন চলিতেছে। ” আলো, নাট্য ও নাটককার ” শীর্ষক নিবন্ধে শব্দ দুইটি একাকার হইয়া গিয়াছিল। অতঃপর দেখিলাম, লেখকের অভিপ্রায় অন্য ছিল। ভাষায় যত নূতন শব্দ আসে তত ভাল। নাটককারের যুক্তি মানিলে, আজ হইতে যিনি চিত্রনাট্য লিখেন, তিনি চিত্রনাটককার। গান যিনি লিখেন, গীতিকার, যিনি গাহিবেন, সংগীতকার। আর কী। যত ভাবিতেছি, তত সকল গুলাইয়া গুগল হইতেছে। শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক শব্দগুলির আর প্রয়োজন কী। ” কার” দিলেই দিব্য চলিয়া যায়।
ইতি রসিকলাল তর্করত্ন
সুদীপ্তদা, লেখাটি একইসঙ্গে মনোজ্ঞ ও তথ্যসমৃদ্ধ। এ দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটানো খুব সহজ নয়। কিন্তু তুমি সফল সে কাজে। খুব ভাল লাগল লেখাটি।
আমি নাটক বিভাগের ছাত্রী। আপনার লেখা পড়ে অনেকাংশে সমৃদ্ধ হলাম।