ব্যঙ্গচিত্রী বা কার্টুনিস্টের সামাজিক দায়িত্ব কি কেবল হাস্যরসের উদ্রেক করে বিনোদনের জোগান দেওয়া? এ নিয়ে নিঃসন্দেহে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু সমাজতত্ত্বের নিরিখে দেখতে গেলে, একমাত্র ব্যঙ্গচিত্রীই তাঁর শিল্পের মাধ্যমে রাজনীতির কারবারিদের স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন, যে বাপু হে, তুমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ। জনতা জনার্দনের দয়াতেই তুমি শাসকের কুর্সিতে আসীন! আর সেই জনতা আদপেই মূর্খ নন। তোমার খদ্দরের ধুতি-চাদরের আড়ালে যে লোভ-লালসা-দুর্নীতিবাজ-প্রতিহিংসাপরায়ণ বিশ্রি চেহারাটা রয়েছে, সেটা শিল্পীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগে না। এর উল্টোটাও একই রকম সত্যি! বাইরে কাঠখোট্টা রাগি চেহারার নেতা মহোদয় যে আসলে স্নেহপ্রবণ-ঠাট্টাপ্রিয়-ভোজনরসিক সাদাসিধে মানুষটি, সে-ও ব্যঙ্গচিত্রীদের কাছে গোপন থাকে না।

এর বহু বহু উদাহরণ আমরা বিখ্যাত সব ব্যঙ্গচিত্রে আগেও পেয়েছি, আজও পেয়ে থাকি। দেখেছি, ব্যঙ্গচিত্রীরা এমনভাবে মুখ আঁকেন যাতে সেই মুখমণ্ডলের অধিকারী বুঝে যান যে তাঁর বাইরের চেহারার অন্তরালে আর একটা চেহারা আছে, যেটা ব্যঙ্গচিত্রী ধরে ফেলেছেল। বলা যেতে পারে, আদালতের বিচারপদ্ধতি ও ব্যঙ্গচিত্রীর অঙ্কনপদ্ধতি একেবারে বিপরীতমুখী। একটা আইনের হাত ধরে, অন্যটা মননের। আদালতে বিচারক মূলত এটা ধরে নিয়েই বিচার শুরু করেন, যে আসামী নির্দোষ। পুলিশকে প্রমাণ করতে হয় আসামী দোষী। কিন্তু একজন ব্যঙ্গচিত্রী বা কার্টুনিস্টের থিয়োরি হল ‘All politicians are dishonest till proved innocent।’ ব্যঙ্গচিত্র বর্তমান দুনিয়ার একটি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-সামাজিক হাতিয়ার। একজন সৎ ব্যঙ্গচিত্রী কখনও কোনও ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষকে মহান ভাববে না, এটাই পেশার শর্ত। বাইরের আভরণ নয়, অন্তরের আচরণকে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করবে। কারণ ব্যঙ্গচিত্রী সর্বদাই পাঠকের কাছে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ, কোনও নেতা-মন্ত্রী-খেলোয়াড়-চিত্রতারকার কাছে নয়।
মনে করা যাক পঞ্চদশ শতাব্দীতে জার্মানিতে মার্টিন লুথারের কথা, যিনি পোপের বিলাসিতার বিরুদ্ধে প্রচারে নেমেছিলেন। সে সময়েও তিনি সাহায্য নিয়েছিলেন একদল ব্যঙ্গচিত্রীর। তাঁরা সারা শহর জুড়ে পোপের অজস্র ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন। এদিকে ইতালিতে পোপও বসে ছিলেন না। তিনিও ব্যঙ্গচিত্রীদের সাহায্যে লুথারের বিরুদ্ধে প্রচারে নেমেছিলেন। এর আগে পর্যন্ত ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হত নিছক মজার জন্য। তবে এই সময় থেকেই সমাজ বিবর্তনে রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রের ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়, এ কথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হয় না।

মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পূর্বে শাসকেরা ব্যঙ্গচিত্র আঁকতেন শত্রুপক্ষের শাসককে ব্যঙ্গ করে। বিভিন্ন শিল্পী সেগুলো আঁকতেন এবং একসঙ্গে একই ছবির চার-পাঁচটা করে কপি করতেন। এর একটা কারণ ছিল। চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে মানুষের মূল জীবনধারাটাই ছিল বাণিজ্যকেন্দ্রিক এবং বন্দর-প্রধান। দূরদেশের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র সহায়ক ছিল জাহাজ। ফলে শাসকের আদেশে ব্যঙ্গচিত্রীরা তাঁদের আঁকা ক্যারিকেচার সেঁটে দিতেন বন্দরের দেওয়ালে, বাজার বা চক্-এর মাঝখানে। ফলে সেটা বিদেশ থেকে আসা আগন্তুকদের চোখে পড়ত প্রথমেই। ফলে শত্রুমিত্রের বিচারটা তাঁদের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠত।
মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে এই ধরনের ব্যঙ্গচিত্র উঠে আসে কাগজের পাতায়। তবে গোড়াতেই কিন্তু ব্যঙ্গচিত্র কাগজে জায়গা করে নিতে পারেনি। ইটালি এবং জার্মানিতেই প্রথম ব্যঙ্গচিত্র ছাপা শুরু হয়। পঞ্চদশ শতকে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যঙ্গচিত্রীরাও সেই নতুন আবিষ্কারের ব্যবহারে সামিল হন। মার্টিন লুথার যখন তাঁর ‘রিফরমেশন মুভমেন্ট’ শুরু করেন তখন বইয়ের পাতায় ছবির ব্যবহার পর্যন্ত শুরু হয়ে গেছে। জার্মানরা মুদ্রণ প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকার দরুণ ক্যাথলিক চার্চ তাদের প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যঙ্গচিত্র ব্যবহার করতে শুরু করে। বলা যেতে পারে, একটি নির্দিষ্ট বক্তব্য সামনে রেখে ব্যঙ্গচিত্রের অভিযান শুরু হয়। মার্টিন লুথারের নিজের লেখা প্রচার পুস্তকে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়। নাম – ‘Pope, donkey of Rome.’ আর একটি ব্যঙ্গচিত্রের নাম ছিল – ‘The Monk of calf of Freiberg.’ এতে পোপের ব্যঙ্গচিত্রে তাঁকে একটি হৃষ্টপুষ্ট গো-শাবক হিসেবে আঁকা হয়েছিল। লুথার বিরোধীরাও অবশ্য বসে থাকেননি। লুথারকে যখন – Diet of worms (ধর্মসভা)-এ দাঁড় করানো হয় (১৫২১ সালে), তখন তাঁকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্রও প্রচার করা হয়, যাতে দেখানো হয়, লুথারের নাকটিকে খোদ শয়তান একটি বাঁশি হিসেবে ব্যবহার করছে।

ভারতের ক্ষেত্রে পঞ্চদশ শতক চৈতন্যদেবের আবির্ভাব কাল। ধর্মীয় সংকীর্ণতা, অন্ধত্বের বিরুদ্ধে তখন ঘুরে ঘুরে প্রচার চালাচ্ছেন চৈতন্যদেব। তিনি কিন্তু কোনও প্রচার মাধ্যমের সাহায্য পাননি, যে সুযোগটা পোপের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে গিয়ে পেয়েছিলেন মার্টিন লুথার। লুথারের সবথেকে বড় সহায়ক ছিল মুদ্রণযন্ত্র। চৈতন্যদেবের সময় ভারতে ব্যঙ্গচিত্র দূরে থাক, মুদ্রণকৌশলই জানা ছিল না। তবু ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে সে সময় কয়েক যোজন তফাতে অবস্থিত দুই দেশে যে একই আন্দোলনের ধারা বয়ে গিয়েছিল সেটাই সব থেকে বিস্ময়ের। লুথার আর পোপের সেই সংঘর্ষের মাধ্যমেই জন্ম নেয় ব্যঙ্গচিত্রের এক নতুন আঙ্গিক। ‘অ্যাগ্রেসিভ কার্টুন’ – Aggressive Cartoon। ভারতবর্ষের ব্যঙ্গচিত্রে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক প্রভাব অবশ্য পড়েছিল অনেক অনেক পরে।

বাংলায় প্রথম নিখাদ রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র আমরা দেখতে পাই কাফি খাঁ ওরফে পি.সি.এল (প্রবোধচন্দ্র লাহিড়ী)-এর আঁকা থেকে। এর আগে মূলত সামাজিক ব্যঙ্গচিত্রই আঁকা হত বেশি। এর পরবর্তীতে অবশ্যই শৈল চক্রবর্তী, প্রমথ সমাদ্দার, চণ্ডী লাহিড়ী, অমল চক্রবর্তীর তুলিতে রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র এক অন্য মাত্রা পায়। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই নাম করতে হয় শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের। পেশাগতভাবে নিখাদ ফাইন আর্টের শিল্পী হলেও বেশ কিছু ব্যঙ্গচিত্রও এঁকেছেন তিনি। বিশেষতঃ রাজনৈতিক প্রয়োজনে। স্বাধীন ভারতবর্ষে নির্বাচনী প্রচারে ব্যঙ্গচিত্রকে দলীয় প্রচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে দেয়াললিখনকে ব্যঙ্গচিত্র নাম দিয়ে বাংলায় প্রথম শুরু করেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়।

কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র বলতে আজকে আমাদের চোখের সামনে যেটা সবচেয়ে আগে ভেসে ওঠে তা হল সংবাদপত্রের ব্যঙ্গচিত্র, যা তাৎক্ষণিক সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আঁকা। রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রে ঝুঁকির পরিমাণও স্বভাবতই বেশি। কারণ, অনেক নেতা বা তথাকথিত বিদগ্ধজনেরা নিজেদের ব্যঙ্গরূপ দেখে মোটেই সন্তুষ্ট হন না। ফলে ব্যঙ্গচিত্রীদের পড়তে হয় ‘রাজরোষে’। এর বিপরীত ছবিও অবশ্য আছে। শোনা যায়, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু নিজের কোনও ভালো ব্যঙ্গচিত্র পেলে সেটি সংগ্রহ করে নিতেন। দুঃখের বিষয়, আজকের ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র অনেকটাই মন জুগিয়ে চলার পন্থা নিয়েছে এবং সামাজিক ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমেই রাজনৈতিক মতবাদকে পিঠ বাঁচিয়ে প্রচার করা হচ্ছে।

সাধারণ পাঠককে রাজনীতি সচেতন করে তোলা একজন কার্টুনিস্টের দায়িত্ব। অথচ অনেকেই এ দায়িত্ব পালনে সৎ থাকছেন না। দায়িত্ব পালন করছেন না প্রতিষ্ঠিত কাগজের মালিকও। তাঁরাও (যেহেতু সংবাদপত্র এমন বৃহৎ একটি শিল্প) আর্থিক নিরাপত্তা খুঁজছেন – আর এই আর্থিক নিরাপত্তা দেন যে সব সংস্থা ও সরকারি বিজ্ঞাপন, রাজরোষে পড়ে মালিকেরা তা হারাতে চান না। অথচ, ব্যঙ্গচিত্র হচ্ছে একমাত্র মাধ্যম, যার দ্বারা সরকারকে সরাসরি আক্রমণ করা যায়। অথচ সংবাদপত্রের মালিকরা এখন মোটেই অ্যাগ্রেসিভ কার্টুন ছাপতে রাজি নন।
কিন্তু তা বলে পাঠকের ‘সেন্স অফ হিউমার’ কমে গিয়েছে, একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ফলে প্রতিষ্ঠিত কাগজ-মালিকরা যদি এই শিল্পটির দিকে বিশেষ নজর না দেন, তাহলে অচিরেই এই ‘Most contemporary and instant art’ এর মৃত্যু ঘটবে। রাজনৈতিক প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার এই মাধ্যমটিকে বাঁচিয়ে রাখার দায় আমাদের সকলেরই।
১৯৬১ সালে কলকাতায় জন্ম। সাংবাদিকতা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করার পর লেখালিখি শুরু 'মহানগর' পত্রিকায়। পরে পিয়ারলেস সংস্থায় জনসংযোগ আধিকারিক হিসেবে যোগদান এবং দীর্ঘ দু'দশক পরে স্বেচ্ছাবসর। ১৯৭৮ সাল থেকে 'কিঞ্জল' পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। পুরনো কলকাতা নিয়ে গবেষণাই ধ্যান জ্ঞান। 'কলকাতার কথকতা' দল তৈরি করেছেন পুরনো কলকাতার নানা হারিয়ে যাওয়া বিষয় নিয়ে চর্চার জন্য। কবিতা যখন কবিতা, হ্যাপি হোম ক্লিনিক, গণসংযোগ, বঙ্গদর্শনে রবীন্দ্রনাথ, কার্টুন ক্যালকাটা-সহ একাধিক বই লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন।
Thank you Chabdranathda. Chandi Jethu r sathe eyi niye galpo korechhilam, seyi jonno eta amaar bhison priyo ekti bishoy. Tumi jatno kore likhle ebong chhabi dilay bolay amaar Banglalive er sobaar toroph theke ek ta bishal dhonnobad
Bah khub tathyavittik lekha.Porey sombriddho holam.Anek suveccha roilo
সমৃদ্ধ হলাম।
কম কথায় অনেক বড় বিষয়ে আলোকপাত ৷ খুবই আকর্ষক৷
খুব ভালো তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। ঋদ্ধ হলাম।