সাড়ে ছ’টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে দাঁত মেজে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে টয়লেটে জমিয়ে বসব, মনে পড়ল কাগজ দেওয়া বন্ধ। সোসাইটির আইন মোতাবেক। অগত্যা মুঠোফোন। হালকা হয়ে বেরিয়েই বাসনগুলো মেজে ফেলি। আজ থেকে আশামাসি আসবেন না। আমার যদিও ওয়র্ক ফর্ম হোম, ওঁর কয়েকদিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম। স্ত্রী নিদ্রায়। ইস্কুল পাঠশালা বন্ধ। স্ত্রীকে জাগাতে গেলে এক কাপ চা জরুরি। তাই নিজের হাতে ধোয়া কেটলিতে জল চাপাই। অন্য ঘরে পুত্রও ঘুমুচ্ছে কারণ পরীক্ষা ভণ্ডুল। হঠাৎ উপলব্ধি হল, সত্যিই বাড়িতে থেকে কত কাজই না করছি! এদিকে ন’টা থেকে কনফারেন্স কল। ব্যবসায় জরুরি অবস্থা। কতক্ষণ সেই গুরুত্বপূর্ণ খ্যাঁচাকল চলবে জানা নেই। তাই ড্যামেজ কন্ট্রোলে তৎপর হই।
হাতে ধূমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে একেবারে বিছানার পাশে– ‘মাদাম, আপনার সেবক।’ ঘণ্টাকয়েক হাতে পাওয়া গেল। সাধারণ দিন হলে এই সময়টায় দাপিয়ে বেড়াই। তোয়ালে ও অন্তর্বাস আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। আমি চার্চিলের মতো চিৎকার করে বাথরুমে প্রবেশ করি এবং পরিবার লজ্জা নিবারণের ব্যবস্থা না করলে ওই অবস্থাতেই বেরিয়ে আসার হুমকি দিই। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতি। ওয়র্ক ফ্রম হোম, মানে ডব্লিউ-এফ-এইচ। নিয়ম মেনে আগে কুড়ি সেকেন্ড সাবান জলে হাত কচলাই। তারপর হালকা করে ওঁকে বলি, ব্রেকফাস্ট-এ পাঁউরুটি হলেই চলবে, বাড়িতেই তো আছি। টুকটাক খেতেই থাকব। আজ চান নয়, দাড়ি কামানো নয়। পুরো বেনিয়ম। কিন্তু বিধির বিধান হল করপোরেট পদে পদে পরীক্ষায় ফেলবে তার বিশ্বস্ত কর্মচারিকে। দশ মিনিট আগে খবর এল ভিডিও কনফারেন্স হবে।
অতএব প্ল্যান বি। ঝড়ের গতিতে দাড়ি কামাই। রেজারকে কোদালের মতো ব্যবহার করি। চুলে জল লাগিয়ে টেরি কেটে নিই। সাদা শার্ট পরে লাল টাই দিয়ে গলা আটকাই। কিন্তু প্যান্ট খুঁজে পাই না। আবার একটা বিশ্বযুদ্ধ লাগে লাগে! গিন্নি বললেন, ভাইরাসের চক্করে সব ফুলপ্যান্ট কাচা হয়ে গেছে। তাছাড়া বাড়ি থেকে ভিডিও কল করলে প্যান্ট না পরলেও চলে। আমি চমৎকৃত হই। স্ত্রী না থাকলে যে আমি সাকসেসফুল হতাম না, এটা বার পাঁচেক বলে, তিন ফিট দূর থেকে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে স্টাডিতে ঢুকে যাই। দরজা বন্ধ করার আগে চেঁচিয়ে ছেলেকে জানিয়ে দিই এখন আমার ব্যান্ডউইডথ লাগবে। সুতরাং ইন্টারনেটে সিনেমা দেখা বন্ধ। লকডাউন।
ঘণ্টা দু’য়েক ভাইরাস-চর্চা চলার পর কাল আবার একই সময়ে ভিডিও কনফারেন্সে জমায়েত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমরা, কর্পোরেট হনচোরা, কল শেষ করি। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি রাঙাপিসির মিসড কল। ফোন করলাম। ওঁর দিনদুয়েক বাহ্যি হচ্ছে না। ভাইরাসের লক্ষণ কিনা জানতে চাইলেন। আর ফোনে কাশির আওয়াজ শুনেছিলেন। বাসক পাতার রস খেতে বললেন। ওটা যে ফোন কোম্পানির কাশি সেটা বলে ওঁকে আর দুঃখ দিলাম না। দুপুরে ভাত আর পাঁঠার মাংস খেয়ে চোখ জুড়িয়ে এল। আসলে অফিসে স্ট্রিক্ট ডায়েট ফলো করি। কঠিন দায়ভার সামলাতে একটু শশা আর দই। বিকেলে দুটি আলমন্ড। কিন্তু এখন বডি এই মটনের গুরুপাক নিতে পারছে না। তাই মেসেঞ্জারে ‘ডু নট ডিসটার্ব’ স্ট্যাটাস ঝুলিয়ে সোফায় একটু এলিয়ে নিই। সত্যযুগ, অর্থাৎ নার্সারির দিনগুলির কথা মনে পড়ে। দুপুরে খাওয়ার পর বাধ্যতামূলক এক ঘণ্টা ঘুম। একবার ঘুমোইনি বলে গার্জেন কল হয়েছিল। তারপর থেকে ভয়ে ঘুমিয়েই ছিলাম অনেক বছর। একদিন বাড়ির লোক ‘যে শুইয়া থাকে তাহার ভাগ্যও শুইয়া থাকে’ বলে উত্তেজিত করে তুলল। সে ইস্তক দু’দিন আগে পর্যন্ত কাছা এঁটে দৌড়েছি। এই ভাইরাসের কল্যাণে এতদিনে শরীর ছেড়ে মাথা খাটানোর সুযোগ এসেছে। আর মাথা খাটাতে গেলে ভালো ঘুম যে একান্ত প্রয়োজন তা জানতে কর্পোরেট চাকুরে হতে হয় না।
ছেলের ডাকে ঘুম ভাঙল। ওর মা চা বানিয়েছে। বিকেল থেকে রাতের খাওয়া পর্যন্ত ওদের দায়িত্ব। রাতের বাসন আমি মেজে দেব। কুড়ি সেকেন্ড হাত ধুয়ে কৌটো থেকে দু’টি বিস্কিট বের করি। জমিয়ে চা খাই। কয়েকটি ই-মেইল এসেছে। ‘আর ইউ গাইজ ওকে?’ এই জাতীয় মেইল এ ‘ইয়াপ’ আর প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যাবে কিনা, এই প্যাঁচালো প্রশ্ন বস-কে ফরওয়ার্ড করে হাত ধুয়ে ফেলি। আক্ষরিক অর্থে। স্যানিটাইজার-এ। একটু পচা পচা গন্ধ। তবে ওই একই অ্যালকোহল যখন একটু পরেই স্কচ হয়ে কয়েক টুকরো বরফের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে করতে কাঁচের গ্লাস এ হোঁচট খেয়ে পড়বে, তখন সব গন্ধ মায় ভাইরাসও মায়া।
তিন পেগের মাথায় অসীমের ফোন। নীতার সঙ্গে আজ মাত্র একবার ঝগড়া হয়েছে। তাই খুশি খুশি। ওরা দু’জনেই ডব্লিউ-এফ-এইচ। দু’জনেরই দিনভর কনফারেন্স কল। নীতার মতে অসীমের বেশিরভাগ ফোনই বাহুল্যমাত্র। এই নিয়ে খটাখটি লেগে যাচ্ছে। তবে ঝগড়ার কার্ভটা নিচের দিকে। ভাইরাসের দাপটের ব্যস্তানুপাতিক। অসীম আমার সঙ্গে কথা বলতেই বলতেই পেগ বানিয়ে নেয় এবং আমরা দু’জনেই এই দুর্যোগে আলকোহলের উপকারিতা নিয়ে একমত হই। এবং অবশ্যই ডব্লিউ-এফ-এইচ এর মাহাত্ম্য।
অদ্ভুত ব্যাপার হল, আমাদের দু’জনের দুশ্চিন্তাও একই। এই যে শরীর ও মন, বিছানা, সোফা এমনকি কমোডে বসে কাজ করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, ভাইরাস মরে গেলে তার কী হবে? নিউটন তো ডব্লিউ-এফ-এইচ করছিলেন বলেই মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করতে পারলেন। ইউনিভার্সিটি খোলা থাকলে ওঁর মাথায় আপেলের বদলে বেলও পড়তে পারত। তখন? এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে হালকা তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখি সকাল হয়ে গেছে। বিকট আওয়াজ করে মোবাইল বেজে উঠল। বস। এখনই অফিস যেতে হবে। আমি পড়ি কি মরি করে দৌড়ই। বসের ঘরে ঢুকতেই উনি জ্বলন্ত চোখে তাকালেন– ‘ছি ছিছি ছি ছি!!!’ আমি বললাম, ‘কী হয়েছে?’ উনি বললেন, ‘আয়নায় দেখুন।’
দেখলাম– উসকোখুসকো চুল, এক গাল না কামানো দাড়ি, সাদা জামা, লাল টাই, প্যান্ট নেই, খালি পা। আমি চমকে ঘুরে ফ্যালফ্যাল করে বসের দিকে তাকালাম। উনি বললেন, ‘আপনার শাস্তি হল একমাস অফিসে কোয়ারানটাইন।’ তারপর ভ্যানিশ করে গেলেন। আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘কিন্তু, আমি তো আইনস্টাইন’। একটা ছোট্ট ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। অর্ধাঙ্গিনী। উনি বিধান দিলেন- ‘রাতে খেতে পারবে বলে তো মনে হচ্ছে না। বাসনটা কিন্তু মেজে দিও।’
অনুব্রত নামী বহুজাতিক সংস্থায় অতি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। কিন্তু মনে মনে এখনও স্কটিশের সেই লেখা-পাগল ছাত্রটি। লেখালিখি তাঁর হাড়ে-মজ্জায়। নিয়মিত লেখেন পত্রপত্রিকায়। শখ, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো আর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি।
Darun?
Ha ha ha daruuuuun likhechis. Khub bhalo laglo
ফাটাফাটি লিখেছো। নিজেকে দেখতে পাচ্ছি মনে হল যেন….
Pore Khub ii Moja pelam ?
ভাই । একেবারে চুম্য একটা লেখা ।সকাল বেলা মাথাটা হালকা হলো ।
খুব ভালো লাগলো