দীর্ঘ জীবন পাননি খলিল জিব্রানজন্ম ১৮৮৩আর মৃত্যু হয়, ১৯৩১ – মাত্র  আটচল্লিশ বছর বয়সে। একাধারে কবি, দার্শনিক এবং চিত্রশিল্পী। প্যারিসে ভাস্কর্য শিক্ষা এবং বেইরুটে আরবি সাহিত্য। বারবার আবিষ্কার করতে চেয়েছেন প্রেম। আধ্যাত্মিকতা এবং আত্মিকশক্তির স্বরূপও খুঁজে  ফিরেছেন সারাজীবন। পরবর্তীকালে, তাঁর ভাবনার রেখাগুলিকে বলা হয়, ‘জিব্রানিজ়ম’ ১৯২৩ সালে লেখা তাঁর ‘আই অফ দ্য প্রফেট’- মূলত বিবাহ-গাথা হিসেবেই বিয়ের অনুষ্ঠানে পাঠ করা হত। পরে এটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয় আমেরিকায়, সঙ্গে পাতায় পাতায় তাঁরই আঁকা ছবি

এটি ইংরেজিতেই লেখা, কিন্তু তার ধরনটা একেবারে অসচরাচর, ফলে অননুকরণীয়ও বটে।  গদ্য এবং পদ্য– এ দুই থেকেই সরে এসে এ যেন অন্য এক আঙ্গিক, যা শুধু ‘আল মুস্তাফার’ উচ্চারণেই মানায়। এ লেখার মধ্যে দিয়ে জিব্রান সম্পর্কের ভাবনাকে এমন এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন যে, তা যেন নতুন কিছু মিথ হয়ে আমাদের জড়িয়ে জুড়িয়েও রাখে। এ বই সকলের নজরে আসে আরও কয়েক দশক পর। প্রায় শত ভাষায় অনূদিত হয়, বিশেষত এই বইটি। জন্মসূত্রে লেবানিজ় আমেরিকানমননশীলতায় এক ভ্রামক পথিক। তবে স্বভূমে ফেরার টান থেকেই, শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী শুয়ে আছেন লেবাননের মাটিতেই।

প্রাণিত হয়েই এর তর্জমা করেছি এবং সংশোধনও করেছি বারংবার। আসলে এর তর্জমা হয় না। শুধু আচ্ছন্নতা হয় এই অক্ষরমালা পড়ে  যে, “আসলে উপহারের চেয়েও পারিশ্রমিক পাওয়াতেই আমার অধিক গর্ববোধ হয়।” 

বা এই অমোঘ বাক – “তুমিই এই চলাচলের পথ এবং একই সঙ্গে এক পথিকও বটে।” 

kahlil-gibran
মননশীলতায় জিব্রান এক ভ্রামক পথিক

এই সঙ্গে বলি, আমার আকৈশোর সখা (মানিকদা), চিত্রী অশোক ভৌমিকের কথা। তার আঁকা সঙ্গের ছবিগুলিও আর একরকম তর্জমা। আমার তর্জমা এবং জিব্রানের ছবি-সহ ইংরেজি বইটি নেড়েচেড়ে কিছুদিন পর সে জানাল যে, এ কাজ তার পক্ষে অসম্ভব। এই ছবির পর আর কোনও আঁকা হয় না। বলল, ‘এই লেখার সঙ্গে ছবি, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউই আঁকতে পারতেন না।’

কিছুদিন বাদে তার মনে হল, এটি যেহেতু বাংলায় অনুবাদ, তাই বাংলার পট ব্যবহার করলেই হবে। বিস্তর চেঁচামেচি করে বললাম, জিব্রান তো নিজের লেখায় নিজেই এঁকেছিলেন, তাই আমার এই তর্জমাতেও আমি যা পারি এঁকে দেব। মনে হয় এতেই তার টনক নড়ল; এত বড়  একটা সর্বনাশ কী করে হতে দেওয়া যায়!

‘দেখছি, দাঁড়া’ – বলে ফোন রাখল। কিছুদিন পর তার পুত্র ছোটু জানাল, ‘বাবা কাজে বসেছে, আর রাতদিন এক করে মূলের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ে চলেছে তোমার লেখাটাও।’ এই মাসাধিক যুদ্ধের পর যখন সে রাজি হল, তখন শুধু অপেক্ষা, কী ছবি সে এঁকে পাঠায়! তবে লকডাউনে আটকে পড়া ছোটু মানে তার ছোটছেলে অরণ্য এখন যদি  শান্তিনিকেতনে ওদের ওই ‘শাপলা’ বাড়িতে, বাবার কাছে না থাকত, তো এসব কিছুই হত না। জিব্রানের আঁকা সব থেকে ভাল প্রিন্ট-সহ বইটি কুরিয়ারে আনানো থেকে, আমার সঙ্গে যাবতীয় মেল চালাচালি সব করেছে ছোটু। সঙ্গে সীমা বউদির শান্ত সহযোগ। 

এদিকে বাংলালাইভের সম্পাদক মৌসুমীও দারুণ উত্তেজিত। নিউ ইয়র্কে বসে প্রফেটের নানা নির্মাণ বিষয়ে কত কী সমানেই সে পাঠাতে লাগল, স্রোতের মতো। সঙ্গে বাউন্সার, ‘মজুমদার মশাই’ পল্লবী এবং আরও এক তুখোড় কর্মী পল্লবী। তো একদা যা ছিল আমার একার নিভৃতবাসের সঞ্চয়,  ক্রমে তা হয়ে উঠল সকলে মিলে চলার এক শিল্প পথ। 

একটাই আক্ষেপ যে বছর কয়েক আগে এর পান্ডুলিপিটি পাতার পর পাতা দেখে দিলেও, সংশোধনের পর আঁকা-সহ এই প্রকাশ প্রিয় কবি, শঙ্খ ঘোষ মহাশয়কে দেখানোর সুযোগটুকু পেলাম না। এ আক্ষেপ আমার সারা জীবনেও যাবে না।

এ লেখা উৎসর্গ করলাম মণীন্দ্রদাকে, লেখক মণীন্দ্র গুপ্ত 
আমার দেখা সেই ‘আল মুস্তাফা’
  

*প্রতি সপ্তাহে বুধবার করে প্রকাশিত হবে ‘দ্য প্রফেট’-এর এই তর্জমা। 
*খলিল জিব্রানের ছবি সৌজন্য: poetryfounder.com

Mandar Mukhopadhyay

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *