দেশজোড়া লক-এর বাঁধন ক্রমশ খুলতে খুলতে ৮ জুন থেকে খুলে গেল রেস্তোরাঁও। খাদ্যরসিকরা জানেন, লকডাউনের আগে রেস্তোরাঁয় গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হত, এই নতুন অধ্যায়ে তা বদলে যাবে বিলকুল। যত্ন নিয়ে পরিবেশন বলতে আমরা যা বুঝি, রেস্তোরাঁর নয়া জমানায় তা আর থাকবে না। অর্ডার করা, খাবার দেওয়া, খাবার খাওয়া আর বিল মেটানো—এই সব জায়গাতেই যে ‘জিরো কনট্যাক্ট’ নিয়মকানুন আর ‘ডিজপোজেবল’ সামগ্রী প্রবল আঁচড় বসাবে, তা করোনা অধ্যায়ের আগে কি আমরা জানতে পেরেছি! এক এক রেস্তোরাঁ মালিক এ বিষয়ে এক এক রকম ভাবে ভেবে চলেছেন। মূলমন্ত্র একটাই, স্পর্শ চাই না, ব্যবসা চাই।
প্লেনে ওঠা মাত্র এয়ারহোস্টেসরা যেমন ভাবে উড়োজাহাজের নিয়মকানুন শেখান, ঠিক তেমন ভাবেই আড়াই মাস বন্ধ থাকার পরে রেস্তোরাঁ খুললে ওয়েটাররা খাবার খাওয়ার নয়া নিয়ম শেখাবেন কাস্টমারদের। বহু রেস্তোরাঁ চেইন ওয়েটারদের জন্য এমন স্পিচ লেখায় হয়তো তুমুল ব্যস্ত এখন। ধরা যাক, এমনই একটি ‘ভাষণ’ লেখার দায়িত্ব পেয়েছেন কোনও অবাঙালি রেস্তোরাঁ চেইনের এক জুনিয়র, নবাগত মার্কেটিং ম্যানেজার। প্রবাসী বাঙালি। চাকরির এই দুর্দিনে এমনিতেই মনমেজাজ খারাপ। কলকাতার আউটলেটগুলোর জন্য জীবনে এতটা বাংলা হয়তো এই প্রথম লিখে ফেললেন, দায়ে পড়ে! খসড়াটা যোগাড় করা গেল। একেবারে আনএডিটেড।
লেখাটায় এবারে কত কাটাকুটি করবেন, উনিই জানেন!
রেস্তোরাঁয় আপনাদের স্বাগত। খাওয়ার আগে আমার বলা নির্দেশিকা ধ্যান দিয়ে শুনবেন। কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে ও সবাইকে বাঁচাতে পেশ করা হচ্ছে নতুন নিয়ম।
আপনার অবগতির জন্য জানানো হচ্ছে, টেবিলে বসার পরেই ‘মেনু কই?’ জিজ্ঞেস করলে এখন থেকে আর কোনও উত্তর পাবেন না। যদি আশা করে থাকেন, কেউ একটা চামড়া-বাঁধানো ডায়রির মতো মোটাসোটা মেনুবই আপনার টেবিলে এনে অনুগত সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে, তা হলে ভুল করবেন।
না! গরম দেখাবেন না। আপনি গরম নন, থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে এটা প্রমাণ করার পরেই আপনাকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছে নির্দেশ আছে, কোনওরকম গরম দেখানোর সম্ভাবনা দেখলেই আপনাকে রেস্তোরাঁর বাইরে বের করে দেওয়া হবে। মনে রাখবেন, ভিতরে যত লোককে বসার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন তার থেকে বেশি। এ বিষয়ে রেস্তোরাঁ কতৃপক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
আপনার অবগতির জন্য জানাই, বাইরে থেকে যখন ঢুকলেন, তখনই আপনার ফোন নম্বর নিয়ে নেওয়া হয়েছে। কাজেই ফেসবুক থেকে চোখ সরিয়ে হোয়্যাটসঅ্যাপ খুললে দেখতে পাবেন, একটা মেনু ইতিমধ্যেই আপনাকে পাঠানো হয়ে গিয়েছে। এটা হল ই-মেনু। জুম করে নিয়ে দেখতে হবে। করোনাভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে খাবার নিয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য আপনাকে সময় দেওয়া হবে সির্ফ একশো কুড়ি সেকেন্ড। সুতরাং, রিয়েলিটি শোয়ের বাজার রাউন্ডের মতো আপনাকে তীক্ষ্ণ মনোযোগ দিয়ে মেনু পড়তে হবে। আমাদের খানা-এক্সপার্টরা রেকমেন্ড করেন, আগে থেকে ভেবে নিয়ে টেবিলে বসলে আপনার লাভ। লম্বা মেনু বারবার উল্টে পাল্টে দেখে, মানে স্ক্রল আপ আর স্ক্রল ডাউন করে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। মনে রাখবেন, একশো কুড়ি সেকেন্ড পরে আমি ‘টাইম আপ’ বলে দিলে আর কোনও অর্ডার নেওয়া হবে না। আমাদের কাছে নির্দেশ আছে, যদি আপনি কোনও অর্ডার লিস্ট বলতে শুরু করার মাঝখানে আমি টাইম আপ বলে দিই, তা হলে যতটুকু বলা হল, ততটুকুই সার্ভ করা হবে।
তবে আমরা আমরা আমাদের খদ্দেরদের খেয়াল রাখি। ফলে পুরো অর্ডারটাই নেওয়া হবে লিমিটেড পিরিয়ডের জন্য। আমাদের পরামর্শ, পুরো অর্ডারটাই একবারে দিয়ে দিন। সেভেন্টি পার্সেন্ট খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর, “এক্সকিউজ মি, আরও চারটে তন্দুরি রুটি দিন না” বললে সেটা নাও আসতে পারে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, নতুন আইটেম কী বেছে নেবেন, তার জন্য খাওয়া চলাকালীন আপনাকে মোবাইল আনলক করে হোয়্যাটসঅ্যাপ খুলে মেনু অ্যাকসেস করতে হবে। করোনাভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে আমরা আপনাদের এই কাজ অনুমোদন করি না। যদি আপনার স্মার্ট ফোন না থাকে, কিংবা ডেটা সাময়িকভাবে কাজ না করে, তাহলে অন রিকোয়েস্ট আপনাকে আমাদের মেনুর শুধুমাত্র মেন কোর্সের দু’পাতা প্রিন্টআউট দেওয়া হবে। এগুলো ডিজপোজেবল। তাই চার্জ পনেরো টাকা প্রতি পেজ।
অর্ডার দেওয়ার পরে টেবিলে রাখা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ভালো করে স্যানিটাইজ করতে হবে। মনে রাখবেন, স্যানিটাইজার রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের সম্পত্তি। দাম দিয়ে কিনতে হয়। তাই স্যানিটাইজ করার যে প্রক্রিয়া চার ফোঁটায় করা যেত, তার জন্য চল্লিশ ফোঁটা ব্যবহার করবেন না। আপনাদের অবগতির জন্য জানাই, হাসপাতালে যে ভাবে সাধারণ পেট খারাপের রুগিকে তিরিশ হাজার টাকার চিকিৎসা করে সত্তর হাজার কোভিড-১৯ চার্জেস জুড়ে টোটাল এক লক্ষ টাকার বিল ধরানো হয়, আমাদের তেমন কোনও স্টেপ নিতে বাধ্য করবেন না। মনে রাখবেন, স্যানিটাইজড হওয়ার পাশাপাশি মাসের প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্টটাও মেনটেন করা জরুরি। ভাল করে স্যানিটাইজড হওয়ার পরে আপনার সামনে বাসনপত্রে হাত দিতে পারেন।
স্টেইনলেস স্টিলের স্পুন আর ফর্ক দিয়ে সেরামিকের প্লেটে ঠুংঠাং হাল্কা ঠুংঠাং আওয়াজ করার মধ্যে একটা দৈব আনন্দ আছে, এটা আমরা বুঝি। তবে করোনাভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে এমন আওয়াজ এখন করবেন না। অবশ্য ইচ্ছে করলেও এখন করতে পারবেন না, কারণ ডিজপোজেবল প্লাস্টিকের স্পুন দিয়ে মোটা কাগজের প্লেটে বাড়ি মারলে তেমন কোনও আওয়াজ বেরোয় না। এর জন্য আমরা দুঃখিত। খাবার না-আসা পর্যন্ত মুখ থেকে মাস্ক কোনওমতেই নামাবেন না। যদি আমাদের কোনও খদ্দেরকে টেবিলে খাবার সার্ভ না করা অবস্থায় মাস্ক ছাড়া দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা করা হবে। প্লাস জিএসটি।
প্লেট-চামচের প্যাকেট খোলা হয়ে গেলে সেন্টার ওয়ালে রাখা জায়ান্ট স্ক্রিনে চোখ রাখতে পারেন। বিশ্বজোড়া কোভিড-১৯-এর আক্রমণ থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে এই অস্থির সময়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিংবা অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটের বাঘ-হরিণের দৌড় অথবা সমুদ্রের গভীরে হাঙরের ফ্যামিলি অ্যালবাম আমরা দেখাতে পারছি না। তার বদলে পাচ্ছেন আমাদের কিচেন থেকে লাইভ স্ট্রিমিং। এই অতিমারীর মধ্যেও আমাদের মাস্টার শেফরা সমস্ত হাইজিন মেনে কী ভাবে আপনার মনপসন্দ খানা বানাচ্ছেন, সেটা চাক্ষুষ করতে পারবেন। যদি আপনি আপনার চিলি চিকেনে বেশি চিলি অ্যাড করার জন্য স্পেশাল রিকোয়েস্ট করে থাকেন, তা হলে শেফ আপনার জন্য এক্সট্রা লঙ্কা কতটা কাটছেন, চোখের সামনে দেখতে পাবেন। আপনাদের অবগতির জন্য জানাই, পুরো রান্নাটাই করা হচ্ছে ‘জিরো কনট্যাক্ট প্রিন্সিপলস’ মেনে। তবে আপনার অর্ডারটারই যে লাইভ স্ট্রিমিং দেখানো হবে, এ নিয়ে কোনও গ্যারান্টি রেস্টোরাঁ কর্তৃপক্ষ দিতে বাধ্য নয়।
খাবার আসার পরে মুখ থেকে মাস্ক নামান। হাত আবার স্যানিটাইজ করুন। এবারে দয়া করে একটু অল্প স্যানিটাইজার নিন, অন্তত আগের বারের থেকে কম। ওয়েটারকে খাবার সার্ভ করতে বলবেন না। আমাদের কাছে নির্দেশ আছে, করোনাভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে ওয়েটারদের দিয়ে খাবার সার্ভ করানো এখন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। খাবার যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি খাবেন। আগেই বলা হয়েছে, খেতে খেতে রিপিট অর্ডার করবেন না। শুধুমাত্র নিজের খাবারের দিকে মন দিন। কোনও ডিশ ‘অসাম হয়েছে রে, টেস্ট করে দ্যাখ’ বলতে বলতে নিজের প্লেট থেকে পাশের লোকের প্লেটে চালান করবেন না। নিজের পরিবারের সদস্য হলেও না। ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে নিজে বাঁচুন, প্রিয়জনদের বাঁচান।
ওয়েটারদের বিনা প্রয়োজনে ডাকবেন না। খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আপনি হাত তুলে থাম্বস আপ দেখালেই আমরা বুঝে নেব আপনি বিলের জন্য তৈরি। অবশ্য আপনি ইশারা করার আগেও আপনার হোয়্যাটসঅ্যাপে বিল পাঠানো হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। বিল মেটাতে শুধুমাত্র অনলাইন পেমেন্ট প্রযোজ্য। দুম করে ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড বাড়িয়ে দেবেন না। মনে রাখবেন, কার্ডের সঙ্গে ভাইরাসও আসতে পারে। শুধুমাত্র ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে বিল মেটানোর চেষ্টা করুন। যদি একান্তই তা সম্ভব না হয়, তাহলে এনভেলপে মুড়িয়ে টাকা দিন। প্রতিটি টেবিলের একদম বাঁদিকের পকেটে একটি ডিজপোজেবল খাম রাখা আছে। ক্যাশ পে করলে কেবলমাত্র সঠিক মূল্য দিন। করোনাভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে টাকা ফেরত দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সার্ভিস ভাল লাগলে বেরনোর আগে আপনার ওয়েটারের পেটিএম নম্বরটা জেনে নিতে পারেন।
শেষবার খাবার গেলার সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক যেন ফের আপনার নাকের ওপর উঠে আসে। মনে রাখবেন, আপনি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাধীন। আপনার মূল্যবান ডাইনিং টাইমের শরিক হতে পেরে আমাদের রেস্তোরাঁ চেইন গর্ব অনুভব করে। তবে বিশ্বজোড়া অতিমারীর থাবা থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে এই মুহূর্তে এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজার মতো হাত জোড় করে ‘আবার আসবেন’ বলতে পারছি না। আমাদের খানা এক্সপার্টটা রেকমেন্ড করেন, বাইরের টেক অ্যাওয়ে কাউন্টারগুলো যথাসম্ভব বেশি ব্যবহার করুন। দূরত্ববিধি মেনে চলুন। সুস্থ থাকুন। অতিমারীর থাবা থেকে বাঁচুন। ধন্যবাদ।
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
Uff. Ja likhechis. Eta Shottyi Shottyi niye nite paare restaurant gulo. ‘Pesh’ korar jonyo.
Fatafati concept. Restaurants stay i na chalu kore fele emon niyam.