রায়ডাক আগলে রেখেছে ছিপড়াকে।

রায়ডাকের কোলেই বনবস্তিটি। হ্যাঁ, ছিপড়া একটি বনবস্তির নাম। আর সেখানে করোনা ভাইরাস নেই।

বিশ্বজোড়া যার দাপট, তার সাধ্য কী ছিপড়াকে স্পর্শ করে! রায়ডাক আছে না চিনের প্রাচীরের মতো! সংক্রমণকে ধারে-কাছে ঘেঁষতেই দেয় না। সরকারি লকডাউনের প্রয়োজন হয় না এখানে। রায়ডাক প্রাকৃতিক লকডাউন করে রাখে। নিত্যদিন, বছরের পর বছর। স্বচ্ছ জলধারা বিচ্ছিন্ন করে রাখে ছিপড়াকে।

ঠিকই ধরেছেন, রায়ডাক আসলে নদী। তিস্তা, জলঢাকার মতো ডুয়ার্সের আর একটি জলস্রোত। ভূটান পাহাড় থেকে নেমে আসা এই জলস্রোত ছিপড়ার জীবনরেখা। ছিপড়াকে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং শেখায়। বাইরের লোক এখানে আসবেন কী করে? যানবাহনই নেই যে!

প্রয়োজনই বা কী? এখানে বেচাকেনার কিছু নেই। স্কুল-কলেজে যাওয়া নেই। বাণিজ্য করার সুযোগ নেই। সামান্য ক’টা টাকায় বন দফতরের মজদুরি আর জঙ্গলের গাছের তলায় আদা, হলুদ চাষ করে সামান্য রোজগার। তাতে পরিবারের হয়তো চলে যায়, বাড়তি টাকা খরচার বিলাসিতা সম্ভব নয়। ছিপড়ার মতোই টিয়ামারি, শিলটং এমন কত না বনবস্তি রায়ডাকের আশপাশে। রায়ডাক তাদের জল দেয়, মাছ দেয়, জীবনপথে একাগ্র ভাবে বয়ে চলার পাঠ শেখায়, চৌদিকের জঞ্জাল ধুয়েমুছে টেনে নিয়ে মনের কালিমা দূর করার ক্লাস নেয়। আবার বাইরের পৃথিবী থেকে দূরে রাখে বনবস্তিগুলিকে। রায়ডাক নদী যেমন, রায়ডাক জঙ্গলও তেমনই আগলায়। রায়ডাক নদীকে ঘিরেই রায়ডাক বনের বিস্তার। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গল। সেই কবে ব্রিটিশ আমলে লাটবাহাদুররা এসে এই বনে বাঘ মারতেন।

বাইরের পৃথিবীর এখানে প্রবেশাধিকার নেই। ছিপড়াই হোক কিংবা শিলটং, টিয়ামারি অথবা পাম্পু, গদাধর, কালকূট – বনবস্তির জীবনটাই বিচ্ছিন্ন। লকডাউনের প্রাকৃতিক মডেল। শহুরের নাগরিক জীবন তো বটেই, গ্রামীণ চিরাচরিত ছবিটার সঙ্গেও এই যাপনের কোনও মিল নেই। এই বসতগুলি আদতে বন দফতরের সম্পত্তি। জঙ্গলের ভিতর গ্রাম। বন দফতরের বকলমে জনপদগুলির জমিদার স্থানীয় বিট অফিসার, রেঞ্জ অফিসাররা। তাঁদের কদাচিৎ পদধূলি পড়ে এই বসতে। ইদানীং কিছু বাইরের লোক যান বটে। সেটা নিছক বিনোদন। ছিপড়া এখন ছোটখাটো হাফ-ডে পর্যটনের কেন্দ্র। দক্ষিণ পোরোও তাই। সেখানে আবার বিনোদনের নানা আয়োজন। পার্ক, ধাবা ইত্যাদি। এই দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের গ্রামগুলিতে সারা বছরই লকডাউন। বস্তিতে পৌঁছনোর গণপরিবহণ নেই। কোথাও নদী, কোথাও বন বেষ্টন করে আছে জনপদগুলিকে। করোনা ঠেকাতে পাহারাদার ওরাই।

চা-বাগানেও তাই। একদিকে ভূটান, অন্যদিকে অসমের ট্রাই-জংশনে যে সংকোশ, কুমারগ্রাম, নিউ ল্যান্ডস চা-বাগান, সেসব চিরকালই লকডাউনের আওতায়। বাইরের লোকের আনাগোনা তেমন থাকে না। খুব প্রয়োজন আর সপ্তাহান্তে হাট ছাড়া এই বনবস্তি বা চা-বাগানের কেউ বাইরেও যান না। সবজির জন্য হন্যে হয়ে বাজারে যাওয়ার দরকার পড়ে না। ঘরের চালে লাউ-কুমড়ো তো আছেই, ঘর-লাগোয়া একফালি জমিতে কিছু বেগুন, ঢেঁড়শ ফলিয়ে নিতে অসুবিধে নেই। মাছ এখানে কেউ নিত্যদিন খায় না। বরং ঘরের মুরগিটার গলা কেটে নিলেই হল। উৎসবে-পার্বণে তো বটেই, হপ্তায় অন্তত একদিন আদিবাসী প্রথায় শুয়োর বা গোরু কেটে ভালো ভোজ হয়। এসবের কোনওটির জন্যই বাইরে যাওয়ার দরকার পড়ে না। ছিপড়া বা পাম্পু বস্তির অন্দরে বসেই এসবের নাগাল পাওয়া যায়।

দুধের জন্যও কোথাও লাইন দেওয়ার দরকার হয় না কালকূট, গদাধর বস্তির। গ্রামেই প্রচুর দুধ। প্রায় সকলের বাড়িতেই দুধ। কেউ কেউ বরং নিজেরা খেয়ে বাড়তি দুধ বিক্রি করেন। গোয়ালারা বাড়ি বয়ে এসে ওই দুধ নিয়ে কাছের শহরে বা গঞ্জে বিক্রি করেন। প্রকৃতির কোলে, জঙ্গলের ছাউনিতে এই বনবস্তি বা চা-বাগানের কোনওটিতেই কিন্তু মে মাসের শেষপর্যন্ত করোনা ভাইরাসের স্পর্শ লাগেনি। সরকারি নিয়ম মেনে কাজ শুরু করলেও চা-বাগানে কেউ আক্রান্ত হননি। চা-বাগানে পাতা তোলার কাজ হয় সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনেই। দল বেঁধে কাজ, কিন্তু যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। কর্মক্ষেত্রেও তাই সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর এমন প্রাকৃতিক পরিবেশের বাসিন্দারা যদি নিজেরা আক্রান্ত না হন, তাহলে অন্যকে সংক্রমিত করবেন কী ভাবে?

কোদালবস্তিই বলুন কিংবা আন্দু বা কুমলাই বনবস্তি, প্রতিবেশী বলতে তো মানুষের চেয়ে চারপেয়ে জীবের সংখ্যাই বেশি। হাতি তো প্রায় রোজই ঘুরে যায় উঠোনে। কখনও কখনও বাইসন বা গন্ডারও অতিথি হয়। শহর-গ্রামের বাসিন্দারা বরং এখানে ভিনদেশি। ঠিক এই কারণেই প্রাকৃতিক ভাবেই সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে এখানে। আর তার ফলেই বনবস্তি ও চা-বাগানগুলিতে করোনা স্পর্শ করেনি কিনা, তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হতে পারে। জনপদের ভিতর শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকার মডেল হতে পারে চা-বাগান, বনবস্তি। লেবার কোয়ার্টার গড়ে দেয় চা-বাগানের মালিক কিংবা বন দফতর। কিন্তু ট্রাডিশনাল লেবার ব্যারাক বলতে যা বোঝায়, তার সঙ্গে কোনও মিল নেই চা-বাগানের লেবার লাইনের। বনবস্তিতেও তাই।

সারি সারি গা ঘেঁষাঘেষি ঘরের বালাই নেই। কমন টয়লেট বা বাথরুম নেই। বরং ছাড়া ছাড়া ঘর। ঘর ঘেঁষে উঠোন। উঠোনের চারধারে বাঁশের বা ঝোপঝাড়ের বেড়া। দুই উঠোনের মাঝে গেট। জল আনতে হয় একই কল থেকে। কিন্তু সেখানেও ঘেঁষাঘেঁষি খুব কম। জল এনে ঘরের আঙিনায় স্নান বা শৌচের ব্যবস্থা। ছোঁয়াছুঁয়ির উপায় নেই। শৌচের জন্য জঙ্গল, চা-বাগান বা নদীর ধারও আছে। তাতে আর যাই হোক, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিপদ আসে না।

স্যানিটাইজার? খুঁজেও পাবেন না শিলটং কিংবা গারুচিরা বস্তিতে। কেউ চোখে দেখা দূরের কথা, নামও শোনেননি। তার মানে ভাববেন না, আধুনিকতা থেকে অনেক দূরে ওঁরা! পোরো কিংবা গরম বস্তিতে চলুন, গ্রামের ভিতর দোকানে ম্যাগি, চাউমিন পাবেন। মিলবে নানা ব্র্যান্ডের শ্যাম্পুও। জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার ডায়ালগ নিয়ে আলোচনাও শোনা যাবে ঘরে ঘরে। মুখে মুখে হিন্দি গানের কলি ঘোরে ফেরে। কিন্তু স্যানিটাইজার? এখনও নো এন্ট্রি। শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোর জন্য সরকারের শর্ত আছে বলে চা-বাগানে স্যানিটাইজারের ঢাউস ঢাউস বোতল দেখা যাবে। কিন্তু বনবস্তি কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামে কারখানায় তৈরি স্যানিটাইজার এখনও ব্রাত্য। তা বলে জীবাণুনাশকের অভাব নেই। ঝকঝকে তকতকে নিকোনো উঠোন। গোবরের প্রলেপ মাটির দেওয়ালে, ঘরের মেঝেতে। সন্ধ্যায় ধূপ জ্বলে আঙিনায়। কেমন একটা পবিত্রতার ছোঁয়া।

গোবরের স্যানিটাইজেশনে সুরক্ষিত রাভা, ওঁরাও, মুণ্ডা, মহালি, কুর্মি, লোহার উপজাতিরা। করোনা তাই মে মাসের শেষেও ছুঁতে পারেনি ওদের। গোটা বিশ্বের লোক যখন করোনা ভাইরাসের বিপদ থেকে বাঁচতে হন্যে হয়ে উপায় খুঁজছে, ওঁরা তখন প্রাকৃতিক সুরক্ষা বলয়ে নিশ্চিন্ত জীবন কাটাচ্ছেন। অথচ আমাদের সেই নিরাপত্তা বিধি চোখেও পড়ে না। আমরা যাঁরা দু’দিনের জন্য ওদের দেশে বেড়াতে যাই, তাঁদের কাছে ওই মানুষগুলি অসচেতন। স্বাস্থ্যবিধির বালাই ওঁরা জানেন বলে আমরা মনেই করি না। খবরই রাখার চেষ্টা করি না, যে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, স্যানিটাইজেশন ওঁদের সংস্কৃতিতে, ওঁদের প্রথায়, ওঁদের রক্তে। করোনার সাধ্য কী সেই সুরক্ষা বলয় ভেদ করে?

উত্তরবঙ্গে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে দেখে আমাকে মিথ্যাবাদী ভাববেন না যেন! খোঁজ নিয়ে দেখুন, যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের ৯৯ শতাংশই এখনও ভিন রাজ্য থেকে আসা শ্রমিক। যাঁরা হয়তো ভিন রাজ্য থেকে ভাইরাস বহন করেই এসেছেন। এখানে আসার পর কারও উপসর্গ দেখা দিয়েছে, কেউ বা উপসর্গহীন। রুটিন লালারসের নমুনা পরীক্ষায় ভাইরাস চিহ্নিত হয়েছে।

এঁদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের গুলিয়ে ফেলবেন না কিন্তু! এঁরা আদতে এখানকার অধিবাসী হলেও মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এলাকাছাড়া। কর্মসূত্রে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে থাকেন ওঁরা। দৈনন্দিন জীবনে সোশ্যাল ডিসট্যান্সের প্রাকৃতিক এই বন্দোবস্ত, স্যানিটাইজেশনের এই স্বাভাবিক ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে ওঁদের বাস। সেই কারণেই অত সহজে করোনা ওঁদের স্পর্শ করে ফেলেছে! কিন্তু ওঁদেরই স্বজন, স্বগোত্ররা নিজভূমে শান্তিতে রয়েছেন প্রকৃতির ঘেরাটোপে।

কর্মসূত্রে কলকাতায় দীর্ঘদিন বসবাসের পর থিতু শিলিগুড়ি শহরে। নিজেকে ডুয়ার্সের সন্তান বলতে ভালোবাসেন। গ্রামের আদি বাড়ির একপাশে বোড়ো আদিবাসী বসত, অন্যপাশে সাঁওতাল মহল্লা। বক্সার রায়ডাক জঙ্গল গ্রামের কাছেই। শৈশব, কৈশোরে বাড়ির উঠোনে চলে আসতে দেখেছেন হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ। জঙ্গলে কুল কুড়োতে কুড়োতে আর নদীতে ঝাঁপিয়ে বড় হওয়া। প্রকৃতি আর উপজাতিরাই প্রতিবেশী। যৌবনে এই পরিবেশে কিছুকাল বাউন্ডুলে জীবনের পর সিদ্ধান্ত, সাংবাদিকতা ছাড়া আর কোন কাজ নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *