পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের আসন্ন ছবিকে কেন্দ্র করে ফের সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে সুভাষচন্দ্র বসুর অর্ন্তধান রহস্য। উত্তরপ্রদেশের গুমনামি বাবা আদৌ এলগিন রোডের বসু পরিবারে জন্ম নেওয়া বাঙালির চিরকালীন নায়ক ছিলেন কি না, তা নিয়ে নতুন করে তর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সোস্যাল মিডিয়া- কার্যত আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে বাঙালি। ছবিটি বাণিজ্যিক বা শৈল্পিক ভাবে কতখানি সফল হবে, তা পরের মাসেই জানা যাবে। কিন্তু সাত দশক পেরিয়েও এই বিতর্ক ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সুভাষচন্দ্র নামটির আশ্চর্য গণসম্মোহিনী ক্ষমতা, যা হয়তো তাঁকে বাঙালির বীররসের ব্যক্তিকৃত প্রকাশে পরিণত করেছে। সৃজিতের ছবি মুক্তির মাসখানেক আগে ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে এক বার দেখে নেওয়া যাক সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু বা অন্তর্ধান সংক্রান্ত তত্ত্বগুলিকে। পাশাপাশি কেন গুমনামি বাবাকে নিয়ে এত বিতর্ক সে দিকেও নজর দেওয়া যাক।
১৯৪৫ সালের অগস্ট মাসে বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি সুভাষচন্দ্রের পক্ষে অত্যন্ত সংকটজনক হয়ে উঠেছিল। অক্ষশক্তির বিপর্যয়ের পাশাপাশি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ বিশ্বযুদ্ধের শেষ অঙ্ক রচনা করেছিল। অন্য দিকে অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে ব্রিটিশ সেনার প্রতিরোধ ভেঙে ভারতে ঢুকে পড়েও প্রবল বর্ষা এবং জাপানি সাহায্যের অভাবে অধিকৃত অঞ্চল ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ। এই পরিস্থিতিতে নিশ্চিত সামরিক পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শেষ বেতার বক্তৃতায় সাময়িক বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করেও ভারতের আসন্ন স্বাধীনতার বিষয়ে প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন সুভাষচন্দ্র। এর কিছু পরেই তাইপের বিমান দুর্ঘটনা এবং সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান বা মৃত্যু সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন তত্ত্বের অবতারণা।
১৯৪৬ সালের ২৫ জুলাই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্নেল জন ফিগিস আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রধানের শেষ পরিণতি সম্পর্কে একটি রিপোর্ট জমা দেন। ফিগিস জানান, বিমান দুর্ঘটনার পর সুভাষচন্দ্রকে তাইহোকুর সেনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশ বিপজ্জনক ভাবে পুড়ে গিয়েছিল। তার জেরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন সুভাষ। পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সালে জাপান সরকারের একটি রিপোর্টেও এই মতের সমর্থন মিলেছে। যদিও জাপানের রিপোর্টটি প্রকাশ্যে এসেছে অনেক পরে, ২০০০ সালে।
স্বাধীন ভারতে সুভাষচন্দ্রের শেষ পরিণতি সংক্রান্ত তিনটি কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৫৬ সালে প্রথম কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম কুশলী সেনাপতি, সুভাষচন্দ্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ট শাহনওয়াজ খান। তিনি তখন সাংসদ। শাহনওয়াজ কমিশন জানায়, বিমান দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছে সুভাষের। ১৯৭০ সালে পঞ্জাব হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জি ডি খোসলার নেতৃত্বের ফের কমিশন গঠন করে কেন্দ্রীয় সরকার। এই কমিশনও ফিগিস ও শাহনওয়াজ কমিশনের সঙ্গে সহমত পোষণ করে। কিন্তু তাতে বিতর্ক থামেনি।
১৯৯৯ সালে, সুভাষচন্দ্রে জন্মশতবর্ষের ২ বছর পরে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মনোজকুমার মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় তৃতীয় কমিশন। তিন দফায় এই কমিশনের মেয়াদ বাড়ে। ৬ বছর তদন্তের পর ২০০৫ সালের নভেম্বরে কমিশন জানায়, বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর কোনও অকাট্য প্রমাণ নেই। ২০০৬ সালের ১৭ মে সংসদে ওই রিপোর্ট পেশ করা হয়। কিন্তু সরকার সেটি খারিজ করে দেয়।
এর পর সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান সংক্রান্ত বিতর্কের জল আরও গড়িয়েছে। বসু পরিবারের পক্ষ থেকে একাধিক বার দাবি করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত সরকার সুভাষচন্দ্র সংক্রান্ত ফাইল প্রকাশ করুক। ২০১৫ সালে রাজ্য সরকার এবং ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই সংক্রান্ত মোট ১৬৪টি নথি প্রকাশ করে। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পর তিনি জীবিত ছিলেন কিনা, সেই বিষয়ে ওই নথিগুলি কোনও আলোকপাত করতে পারেনি।
কমিশনের রিপোর্ট যা-ই বলুক, ভারতবাসীর এক বিপুল অংশ বিশ্বাস করেন বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়নি। তিনি স্বাধীন ভারতে দীর্ঘ দিন বেঁচে ছিলেন। কখনও শৈলমারির সাধু, কখনও গুমনামি বাবা, কখনও আবার চেন্নাইয়ের এক বৃদ্ধকে সুভাষচন্দ্র বলে মনে করা হয়েছে। তবে গুমনামি বাবাকে নিয়েই বিতর্ক সবচেয়ে বেশি।
ছয়ের দশকের শুরুতে এক দীর্ঘদেহী, সুদর্শন, বয়স্ক সাধু উত্তরপ্রদেশের নেমিসা এলাকায় আসেন। তিনি থাকতেন অযোধ্যা বস্তি এলাকায়। স্থানীয়দের সঙ্গে বিশেষ মিশতেন না, কথা বলতেন পর্দার আড়াল থেকে। নাম জানতে চাইলেন বলতেন, তাঁর বহুদিন আগেই মৃত্যু হয়েছে। তবে মহাকাল, মহাভূত বা মৃত্যুভূত নামে তাঁকে ডাকা যেতে পারে। ওই সাধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অনুগামী, শ্রীসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী লীলা রায়। এর পর বেশ কয়েক বছর ওই সাধুর কোনও খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি।

১৯৮২ সালে ফৈজাববাদে ফের ওই সাধুর দেখা মেলে। ফৈজাবাদ শহরের অ্যালিসন ম্যানসনের পিছনে বেশ কয়েকটি বাড়ি ছিল। সেগুলির মালিক ছিলেন প্রভাবশালী সিং পরিবার। ১৯৮২ সালে এক সাধুর বসবাসের জন্য মাসিক ৪০০ টাকায় রাম ভবন নামে একটি বাড়ি ভাড়া নেন স্থানীয় এক চিকিৎসক। সেখানেই জীবনের শেষ তিন বছর কাটিয়েছিলেন নেমিসার ওই সাধু। স্থানীয়রা তাঁকে গুমনামি বাবা, ভগবানজি, মহাকাল বাবা বলে ডাকতেন। সিং পরিবারে সদস্য তথা বিজেপি নেতা শক্তি সিং পরে জানান, গুমনামি বাবা শুক্তো এবং মাটন কিমা খেতে পছন্দ করতেন। তাঁর পছন্দের তালিকায় ছিল দামি ৫৫৫ সিগারেট এবং রোলেক্স ঘড়ি। ১৯৮৫ সালে গুমনামি বাবার মৃত্যুর বছর খানেক পরে রাম ভবনে যান সুভাষচন্দ্রের ভাইঝি ললিতা বসু। গুমনামি বাবার ব্যবহার করা জীবনপত্র দেখে কেঁদে ফেলেন তিনি। এর পর ওই সাধুর প্রকৃত পরিচয় জানতে চেয়ে আদালতের দারস্থ হন ললিতা-সহ সুভাষচন্দ্র অনুরাগীদের একাংশ।
বাবার ব্যবহৃত জিনিসপত্র ২৪টি ট্রাঙ্কে করে নিয়ে যাওয়া হয় ফৈজাবাদের জেলা ট্রেজারির ডবল লক সেকশনে। সেই জিনিসপত্রের বিবরণ সামনে আসার পর চাঞ্চল্য ছড়ায়। সেখানে ছিল সুভাষচন্দ্রের বাবা-মা জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর ছবি-সহ আরও অসংখ্য ছবি, জার্মানি ও ইতালির সিগার, গোল ফ্রেমের চশমা, একটি রেডিও, বায়নাকুলার, রোলেক্স ঘড়ি, বেলজিয়ান টাইপরাইটার-সহ এমন অসংখ্য জিনিস, যা কোনও সাধুর কাছে থাকা সম্ভব নয়। ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের আধিকারিকদের নামের তালিকা, সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে একাধিক বই, আর্ন্তজাতিক রাজনীতি সম্পর্কিত অসংখ্য বই, সাইবেরিয়ার মানচিত্র, স্বাধীনতার আগে-পরের প্রচুর সংবাদপত্রের কাটিং। ট্রাঙ্ক থেকে মিলেছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের শীর্ষ আধিকারিকদের বেশ কিছু টেলিগ্রাম, যেগুলি তাঁরা ওই সাধুকে ২৩ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন এবং দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে পাঠিয়েছিলেন। আরএসএস প্রধান এম এস গোলওয়াকরের একটি চিঠি পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে গুমনামি বাবাকে বিজয়ানন্দজি মহারাজ বলে সম্মোধন করেছিলেন তিনি। মুখার্জি কমিশন গুমনামি বাবার ব্যবহৃত ৩০০০টি জিনিসপত্রের ৮৭০টি পরীক্ষা করেছিল। ১৯৮৫ সালে গুমনামি বাবা মারা যান। তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দেন মাত্র ১৩ জন ব্যক্তি।
সুভাষচন্দ্রের পরিবারের সদস্যদের অধিকাংশই অবশ্য গুমনামি বাবাকে সুভাষচন্দ্র বলে মানতে রাজি নন। কিন্তু তাতে বিতর্ক থামেনি। দশকের পর দশক ধরে বাঙালি তথা ভারতবাসী বিশ্বাস করে এসেছে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়নি। সেই আবেগ ও রহস্যই সৃজিতের ছবির প্রধান ইউএসপি।