শান্তিনিকেতনে কালবৈশাখীর রূপ, এটা যে না দেখেছে তাকে বোঝানো মুশকিল।

আমার বেড়ে ওঠা শান্তিনিকেতনের লাল মাটিতেই। পড়াশোনার শুরু, জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষও সেখানেই। একেবারে ছোট্টবেলা বই বগলে যেতাম আনন্দ পাঠশালায়। একটু বড় হওয়ার পর পাঠভবন, তারপর উত্তরশিক্ষা। তিন পাঠকেন্দ্রেই ক্লাস বলতে কিন্তু আমের বীথি, জারুলের ছাওয়া, পাতাবাদামের তলা, ঘাসের ওপর বসা, পড়া ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের তাক করে কাঁকরকুচি ছোড়া। প্রকৃতির সঙ্গে এমনই এক নিবিড় আলিম্পন-আলাপনে আমার বড় হওয়া। ছোটবেলা থেকে যেমন স্বাভাবিক নিয়মে নাচ, গান, ভাস্কর্য, ছবি আঁকা এসব করতাম, তেমনভাবেই যেন জীবনে ঢুকে পড়েছিল প্রকৃতির অকৃপণ দান। প্রতিটি ঋতুর প্রস্থান, আগমন, চলন, ছন্দ, প্রতিটি প্রত্যূষ, প্রতিটি রাত্রি, জোছনার কিরণ, অমানিশার আঁধার যেন আনমনেই সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নিয়েছি বেড়ে ওঠার পথে।

তাই শান্তিনিকেতনের কালবৈশাখী নিয়ে লেখনের অনুরোধ যখন এল, তখন মনে মনে ভাবনাগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখলাম চোখের পাতায় ফুটে উঠছে একটার পর একটা ছবি। ঈশান কোণে মেঘের ঘনিয়ে আসা, সেই উথালপাথাল হাওয়া, সেই শুকনো পাতা ওড়ার সরসর শব্দ, ধুলোর ঘূর্ণি সব যেন একাকার হয়ে ঘনিয়ে এল। আর মনে হতে লাগল, আমি কবি কিম্বা পেশাদার লেখক হলে বেশ হত, কেমন মানসপটের ছবি অক্ষরে ফুটিয়ে তুলতে পারতাম অনায়াসে!

শান্তিনিকেতনে, বলা ভালো গোটা রাঢ়বঙ্গেই কালবৈশাখীর দাপট বাংলার অন্যান্য অংশের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশিই। তার প্রমাণ তো গুরুদেবের অজস্র গানের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে। আমি গানের মানুষ, তাই ঝড় উঠলেই মনে হয়, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’-এর প্রতিটি মীড়েই কি ধরা নেই লাল মাটির উপর কালবৈশাখীর তাণ্ডব? কিম্বা ‘ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে, বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে, আঁচলখানি দোলে’-র সুরের দুলুনিতে তো প্রায় বৃষ্টির ফোঁটা হাওয়ার টানে ছিটকে এসে পড়ে গানের খাতার ওপর! ‘হৃদয় আমার ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড়’ না গাইলে বুঝি কালবৈশাখীর বাউল বাতাসকে শরীরে অনুভব করা যায় না! ‘ওই বুঝি কালবৈশাখী’ গানে যেমন করে কালবৈশাখীর রূপের মধ্যে অরূপের বাণী তুলে আনেন কবি, সে যে জীবনের করালঝড় সামলে চলার শিক্ষা!

“তোর সুরে আর তোর গানে, দিস সাড়া তুই ওর পানে।
যা নড়ে তায় দিক নেড়ে, যা যাবে তা যাক ছেড়ে,
যা ভাঙা তাই ভাঙবে রে– যা রবে তাই থাক বাকি।”

একি কেবল কালবৈশাখীর বর্ণন? এ যে অনন্তের সত্য, ধরিত্রীর প্রাণের কথা! কালবৈশাখীকে কবির মতো করে অন্তরে অনুভব করতে আর তাকে কলমের ডগা দিয়ে, তুলির আঁচড় টেনে প্রকাশ করে ফেলতে আর যে তেমন কেউ পারেননি, সে কথা বোধহয় আলাদা করে না বললেও চলে। তবু শান্তিনিকেতনের কালবৈশাখীর কথা বলতে গেলে রবীন্দ্রসৃষ্টির কথা না মনে করে আমাদের একটি পা-ও এগোবার উপায় নেই। তাঁর গান গলায় নিয়েই বসন্তের শেষে প্রখর গ্রীষ্মে ভরদুপুরবেলা ক্লাসে বসে অপেক্ষা করেছি ঝড় ওঠার, আবার পৌষের ভোরে জমে যাওয়া শীতে বৈতালিকে হেঁটে বেড়িয়েছি। তাই শান্তিনিকেতন, কালবৈশাখী, প্রকৃতির রূদ্ররূপ আর রবীন্দ্রনাথের গান, এ যেন আর আলাদা করতে পারি না পিছনে তাকালে।

এবার সরাসরি চলে আসা যাক শান্তিনিকেতনের কালবৈশাখীর গল্পে। একটা গল্প তো বোধ করি আমাদের সকলেরই বহুশ্রুত, তবু আজও মনে করলে গায়ে কাঁটা দেয়!

দিনান্তিকা চা-চক্রে সারা দিনের কাজের পর একটা আসর বসত। কখনও গুরুদেবও থাকতেন তার মধ্যমণি হয়ে। এমনই এক চা-চক্রের স্মৃতি ধরা আছে রবীন্দ্রানুরাগী অমল হোমের লেখায়। তিনি লিখছেন, “দীনেন্দ্রনাথের বেণুকুঞ্জে গানে গল্পে আড্ডা জমিয়েছি কালীদাস নাগ আর আমি। বৈকালিক চা-পর্ব সবে শেষ হয়েছে, দিক-দিগন্ত ধুলোয় ঢেকে ছুটে এল ঝড়। আমরা দেখছি দাঁড়িয়ে বারান্দায়। হঠাৎ দিনদা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওই দ্যাখো রবিদা আসছেন!’ দেখি সেই ঝড়ের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছুটে আসছেন। তাঁর বেশবাস, তাঁর শ্মশ্রুকেশ উড়ছে। জোব্বাটাকে চেপে ধরেছেন বাঁ হাতে আর ডান হাতে চেপে ধরেছেন চোখের চশমাটা। আর একটু এগিয়ে আসতেই শুনতে পেলাম গলা ছেড়ে তিনি গাইছেন। মেঘমন্দ্রের সঙ্গে তাঁর কণ্ঠ উঠছে গর্জে– ‘যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি।’ বারান্দাতে উঠেই বললেন, ‘দিনু এই নে।’ ঘরে এসে বসে পড়লেন দীনেন্দ্রনাথের ফরাসে। তারপর নামল বৃষ্টি মুষলধারে। আর নামল অজস্রধারায় কবির ও দীনেন্দ্রনাথের গান। সেদিন খুলে গিয়েছিল কবির কণ্ঠ।”

আমার বড়মাসি (অবনীন্দ্রনাথের আদরের ‘আকবরি মোহর’) কণিকার সঙ্গে গুরুদেবের প্রথম দেখাও কিন্তু এমন এক কালবৈশাখীর দিনে। শ্যামলী বাড়ির বারান্দায় বসে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এমন সময় দেখলেন প্রবল ঝড়ের দাপটে  হতে তিন চারটি আশ্রমবালিকা এসেছে আম কুড়োতে। ফ্রক পরা, খালি পা। হাওয়ায় উড়ছে ধুলোয় রুক্ষ চুল। কবি একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন তাদের দিকে। তাদেরই মধ্যে একজন ছোট্ট অণিমা। তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় সাদা দাড়িওলা ঋষিপ্রতীম মানুষটি সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন, কী রে, গান গাইতে পারিস? এর মধ্যেই নামল প্রবল বৃষ্টি। অগত্যা শ্যামলীর বারান্দাতে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর গতি রইল না মেয়েদের। গুরুদেব মুচকি হেসে বললেন, একটা গান শোনা দেখি! ছোট্ট আশ্রমবালিকা কি আর অত জানে, কে গান শুনতে চাইছেন! নিঃসংকোচে গান গাইল অণিমা। গান শুনে অবাক কবি জিজ্ঞাসা করলেন, কার মেয়ে তুই? অণিমা বলল, আমার বাবার নাম শ্রীসত্যচরণ মুখোপাধ্যায়। শুনে একগাল হেসে কবি বললেন, ও! তুই সত্যর মেয়ে! কদিন পরেই দাদুকে ডেকে বললেন, তোমার মেয়ের কণ্ঠটি বড় সুমধুর। সেই থেকেই অণিমার যাতায়াত বাড়ল কবিসমীপে। তৈরি হল অসমবয়স্ক সখ্য। অণিমা নাম বদলে গেল কণিকায়। রবীন্দ্রনাথের অসীম স্নেহ কালবৈশাখীর বৃষ্টির মতো আমৃত্যু সুস্নাত করেছে তাঁর আদরের কণিকাকে।

storm in santiniketan
শান্তিনিকেতনের আকাশে তখন ঘনিয়ে আসছে মেঘ। ছবি- প্রিয়ম মুখোপাধ্যায়

এবার আমার ছেলেবেলার কালবৈশাখীর স্মৃতির কথা। আমার কালবৈশাখীর স্মৃতি বলতেই মনে পড়ে দিগন্তবিস্তৃত ধূ ধূ নিসর্গ। দুপুর থেকে প্রবল গুমোট। গরমে নিঃশ্বাসও আটকে যাচ্ছে যেন। বিকেলের দিকে আকাশপারে দেখা গেল সেই দৃশ্য যা আমরা দেখেছি বারবার রামকিঙ্কর, নন্দলাল কিংবা শান্তিনিকেতন ঘরানার শিল্পীদের তুলিতে। একেবারে উপরে কালো কিম্বা ঘন গাঢ় নীল রঙের মেঘখণ্ড ক্রমেই আকাশের দখল নিচ্ছে। তার ঠিক নিচে সূর্যালোকের একফালি রেখা আকাশের এপার থেকে ওপার ঝলসে দিচ্ছে। ক্রমে থমথমে ভাবটা বাড়ছে আর কালো মোষের মতো উন্মত্ত জলভারাতুর মেঘ একটু একটু করে ঢেকে ফেলছে আলো। এর পরেই দেখতাম কাল-গোধুলীর আলোয় গোরুর দল ধুলো উড়িয়ে পরিত্রাহি দৌড়চ্ছে বাড়ির পথে। ওরা কী করে যেন ঠিক আঁচ পেত যে ঝড় আসছে! ঘরপোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, সে প্রবাদের জন্ম এমন স্বভাব থেকেই কিনা জানা নেই। কিন্তু এটা ছিল শান্তিনিকেতনে কালবৈশাখী আসার একটা পরিচিত দৃশ্য। সবাই দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতাম সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, যখন হঠাৎ ধুলোয় ঢেকে যেত চারিপাশ। পাতাহারা গাছের ডালগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ত হাওয়ার দোলায় আর সঙ্গে শোঁ শোঁ শব্দ। হাওয়ার তাণ্ডবে মুহূর্তে রণরঙ্গে মেতে উঠত শান্তিনিকেতনের মাঠঘাটগাছপালা। মনে হত যেন নটরাজের নৃত্যরঙ্গ শুরু হয়েছে প্রকৃতিজুড়ে!

আর আমরা আশ্রমবালকের দল ছিলাম অকুতোভয়। ঝড় উঠলে ঘরে থাকতে মন চাইত না। আমবাগানে ছুটতাম আম কুড়োতে। মুহূর্মুহূ বাজ পড়ছে। বিদ্যুৎ ফালাফালা করে দিচ্ছে আকাশটাকে। তারই মধ্যে আমরা ছুটে চলেছি হাহাহাহাহাহাহাহা বালকের দল! মাঝে মাঝে আবার ক্লাসের মাঝখানে ঝড় নেমে আসত। সে আর এক রকমের মজা। মাস্টারমশাই থেকে ছাত্র, কুকুর থেকে গোরু সবাই ছুট ছুট! সবচেয়ে কাছের আশ্রয়ে (পাঠভবন লাইব্রেরি বা শান্তিনিকেতন বাড়ির বারান্দা) গিয়ে মাথা বাঁচিয়ে মজা করে বৃষ্টির ছাঁট পোয়াতাম। সঙ্গে সঙ্গেই মাস্টারমশাইয়ের নির্দেশে কেউ হয়তো ধরল ঝড়ের গানের একটি কলি। আর ওমনি ঝড় ছাপিয়ে খোলা গলায় গান ধরল বাকিরাও।

কখনও কখনও নামত শিলাবৃষ্টি! আর পায় কে! ঝোলা ব্যাগ মাথায় তুলে শিল কুড়নো, আমের কুশির সন্ধানে ছোটা! সত্যি, আজ যখন সেসব কথা মনে করি, আর তাকিয়ে দেখি নতুন প্রজন্মের দশ বাই দশের কুঠরিতে বড় হয়ে যেন শিশুদের দিকে, বড় কষ্ট হয়। মনে হয় এই যে আমাদের প্রকৃতির মধ্যে লুটোপুটি চড়ুইভাতি, কালবৈশাখীর গলা জড়িয়ে ঝড়ের তাণ্ডবে ওঠা আর নামা, এর মধ্যে লুকিয়ে ছিল আজীবনের শিক্ষা, যাপনমন্ত্র। মোবাইল হাতে, টেলিভিশনের কার্টুনে চোখ বাঁধা শিশুর দল জানল না, কিসের স্বাদ তারা পেল না। বড় কষ্ট হয়। মনে হয় এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন ফের অনুভব করুন অভিভাবকেরা, যেখানে অন্ধকার আকাশে তারা গুণে, মত্ত হাওয়ায় চোখেমুখে ধুলোর পরত মেখে ঝড়ের দাপট অনুভব করার আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয় আমাদের নবীন প্রজন্ম। তাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত হোক এই বাণী –

যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি।
ঝড় এসেছে, ওরে, এবার ঝড়কে পেলেম সাথি।
আকাশ-কোণে সর্বনেশে ক্ষণে ক্ষণে উঠছে হেসে,
প্রলয় আমার কেশে বেশে করছে মাতামাতি।
যে পথ দিয়ে যেতেছিলেম, ভুলিয়ে দিল তারে,
আবার কোথা চলতে হবে গভীর অন্ধকারে।
বুঝি বা এই বজ্ররবে নূতন পথের বার্তা কবে,
কোন্‌ পুরীতে গিয়ে তবে প্রভাত হবে রাতি।

অনুলিখন – পল্লবী মজুমদার

প্রিয়মের জন্ম ১৯৭৮-এ শান্তিনিকেতনে। পড়াশোনা বিশ্বভারতীতে। ইতিহাস এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্নাতকোত্তর এবং সঙ্গীতভবন থেকে এম ফিল। গানের হাতেখড়ি মাসি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। গানই ধ্যানজ্ঞান। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবামও রয়েছে বেশ কিছু। শখ, অভিনয় করা, ছবি তোলা আর লেখালিখি। বর্তমানে এলমহার্স্ট ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত।

5 Responses

  1. খুব ভালো লেখা। ঘটনাগুলোর উল্লেখ খুবই উপযুক্ত হয়েছে। শান্তিনিকেতনের কালবৈশাখি শুনলেই আমার মনে পড়ে গৌতম ঘোষের মোহর ডকুমেন্টারিতে ব্যবহৃত এক ভয়ঙ্কর সুন্দর কালবৈশাখির দৃশ্য। এটি দেখেছিলাম দিল্লির ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, সম্ভবত ১৯৮৯ সালে। এখনও চোখ বন্ধ করলে দৃশ্যটি মনে ভেসে ওঠে।

  2. প্রিয়ম দা কি লেখনী !অসাধারণ শব্দ চয়ন।প্রকৃতি আপনার লেখায় উঠে এসেছে তাঁর নিজস্ব রূপ নিয়ে।প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা গড়ে না উঠলে এমন লেখা সম্ভব নয়।সাধু,সাধু।আরো লেখা চাই সম্মৃদ্ধ হওয়ার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *