বাজ্গা বেগম ছিলেন ধবধবে ফর্সা, ছোটখাটো চেহারা, মুখখানা ধারালো কাটাকাটা বুদ্ধিদীপ্ত। সাধারণত রঙিন বা সাদা জর্জেট ধরনের শাড়ি পরতেন। তিনি লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপিকা ছিলেন, তাঁর মাতৃভাষা ছিল উর্দু, যদিও বাংলা ভালই বলতেন। হবে না কেন, তাঁর জন্ম ও পড়াশোনা উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌতে হলেও কর্মজীবন কেটেছে কলকাতায়। তাঁর স্বামীও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যতদূর জানি ফার্সিই পড়াতেন। শুনেছি ওরা থাকতেন ইলিয়ট রোডে বইপত্রে আচ্ছন্ন একটি ছোট ফ্ল্যাটে। আমার মতো পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়ের সঙ্গে, যার জন্ম ও বড় হওয়া হাওড়ার শিবপুর ও যাদবপুরে, বাজ্গা বেগমের আলাপ পরিচয় হবার কোনো সুযোগই ছিল না। উর্দুভাষী মুসলমান কাউকেই আমি চিনতাম না জীবনের তেইশটা বছর পার করেও। আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে অথবা স্কুলের সহপাঠী কিংবা শিক্ষিকাদের মধ্যে কোনো মুসলমানই ছিলেন না। এমনকী প্রেসিডেন্সি কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁদের কাউকে সহপাঠী বা অধ্যাপকরূপে পাইনি। আজ ভাবলে সত্যি অবাক লাগে। দেশভাগের ঝড়ঝাপটা খাওয়া পরিবার আমাদের, ধর্মের ভিন্নতার জন্যই যে দেশভাগ হয়েছে এবং আমাদের বাড়িঘর, জমিজমা খোয়াতে হয়েছে সেই আক্ষেপ শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। দাঙ্গার সময় মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয়ঙ্কর কাহিনিও শুনিনি তা নয়। বাবা কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, বাড়িতে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা একেবারেই হত না। তার জন্য বাবা- মা’র কাছে পরম কৃতজ্ঞ আছি৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ছোটমামার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মুসলমান বন্ধু এপারে এসে আমার মামারবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে নিজেদের কোনো পার্থক্য বুঝিনি, আপাদমস্তক বাঙালি, মাছভাত খাওয়া, জোরালো বাঙাল টানে কথা বলা মানুষ ছিলেন ঐ পাতানো মামারা। তাঁদের ও ছোটমামার সূত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থসংগ্রহে নেমে পড়েছিলাম আমরা কয়েকজন বন্ধু।
বাজ্গা বেগম কত রকমের কাবাব আনতেন – শামী কাবাব, বটি কাবাব, রেশমি কাবাব, গলৌটি কাবাব, সঙ্গে পাতলা চাকতি করে কাটা শসা, টোমাটো, পেঁয়াজের সালাড থাকত – নরম আটার রুটিও। একটি কাবাবের সঙ্গে আরেকটির তফাৎও মজা করে বুঝিয়ে দিতেন। টিফিনের ঐ সময়টুকুতে আমাদের টেবিলের কোণটিতে পাঠান মোগল আমলের রন্ধনকলা যেন বাদলকিনারি দোপাট্টা মেলে বসতো।
লেডি ব্রেবোর্নে অধ্যাপনার চাকরিতে যোগ দিয়ে দেখলাম একটি লম্বা টেবিলে বেশ কয়েকটি ভাষা ও সাহিত্যবিভাগের অধ্যাপিকারা বসেন। বাংলা বিভাগ মস্ত বড়, কিন্তু উর্দুতেও আছেন চার পাঁচজন অধ্যাপিকা, আতেয়া মুর্শেদ, মিসেস পারভেজ, মালকা মেহের নিগার প্রমুখ, এছাড়া ছিল ফার্সি বিভাগ, সেখানেই ছিলেন হুস্না বা’জী ও বাজ্গা বেগম। এঁরা আমার বাংলাদেশি মামাদের মতো নন, নিজেদের মধ্যে উর্দুতেই কথা বলেন। কী সুন্দর যে লাগত ওঁদের বনেদি টানে বলা সেই উর্দুভাষা। কিন্তু বাজ্গা বেগমের সঙ্গে পরিচয়টা একটু অন্য ধরনের হল, তিনি আমাকে দেখেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তারপর ফিসফিস করে কী বললেন পাশে বসা হুস্না বা’জীকে, তিনিও স্মিত হেসে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন, তারপরই বাজ্গা বেগম আমাকে ডেকে নিলেন পাশে। খুবই ভয়ে ভয়ে গিয়ে বসলাম কারণ দু’জনেই অত্যন্ত সিনিয়র অধ্যাপিকা। বাজ্গাদি আমার হাতটা মুঠোয় ধরে বললেন, ‘তুমি ঠিক আমার মতো দেখতে’। শুনে হেসে বাঁচি না, বলেও ফেললাম, ‘আপনি যে টুকটুকে ফর্সা, আমি কেমন কালো দেখুন। মিল কোথায় পেলেন আপনি’? উনি স্থির প্রত্যয়ে ঘাড় নাড়লেন, ‘কমপ্লেক্শনে কিছু আসে যায় না, আমি আমার ইয়ং বয়সের ফোটো আনব, তুমি বলবে কি তোমার ফোটো আছে’। হুস্না বা’জীও দেখলাম ওঁর মত সমর্থন করছেন। বাংলার সিনিয়র অধ্যাপিকারা মুখ টিপে হাসছেন।
অতঃপর বাজ্গা বেগম তাঁর আর আমার সাদৃশ্য প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন এবং আমাকে ‘মেয়ে’ ডাকতে শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে দুটি রুমাল থাকত, একটি বড় সুন্দর রুমাল সিল্কের বটুয়া থেকে বার করে লাইব্রেরির একটি নিরালা কোণে পেতে তিনি নামাজ পড়তেন। আমি ক্লাসের বাইরে অনেকটা সময় লাইব্রেরিতে কাটাতাম। বইয়ের সেলফের কোণে তাঁকে দেখতাম, নিয়ম অনুসারে শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে অত্যন্ত সম্বৃতভাবে প্রার্থণা করছেন। সাধারণত ‘আসর’ বা ‘মগরিবের’ নামাজ পড়তেন – নিকটবর্তী মসজিদ থেকে তখনি আজানের ধ্বনি আসত। ততদিনে মুসলমান সহকর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে ওঁদের ধর্মীয় আচার সম্বন্ধে ধারণা স্বচ্ছ হতে শুরু করেছে। ব্রেবোর্নে একটি সহজ সুন্দর আবহাওয়া ছিল – রোজার সময় যে মুসলমান সহকর্মীদের সেকেন্ড হাফে পরীক্ষার ডিউটি দেওয়া হবে না– তা ইন্দিরাদি বা অন্য যাঁরা ডিউটি রোস্টার তৈরি করেন তাঁদের বলে দিতে হত না। ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে ছাত্রীদের পরম নির্ভর দুই ল্যাব আসিস্ট্যান্ট শামসুদ্দিন ও ফকরুকে রোজার সময় বিকেলের আগে ছেড়ে দিয়ে অন্য দুই আসিস্ট্যান্ট সনাতন ও সুভাষ পুরো কাজ সামাল দিত। এই যে হাঁকডাক না করে নীরবে পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া এটি আমার অসম্ভব ভালো লাগত এবং আজও লাগে।
এবার বাজ্গা বেগমের দ্বিতীয় রুমালটির প্রসঙ্গে আসি। সেটি মোটা কাপড়ের সাদা রঙের, তাতে বেঁধে তিনি টিফিন বাক্স আনতেন এবং টেবিলে সেটি রেখে ক্লাসে চলে যেতেন। তাঁর পাতানো মেয়ে হবার সুবাদে অচিরেই ঐ রুমালের গিঁট খুলে টিফিন খাবার সময় আমার জন্য একটা মোটা অংশ বরাদ্দ হত। অমন রসালো সুস্বাদু কাবাব আমি আগে কক্ষনো খাইনি। সত্যি বলতে কি মধ্যবিত্ত বাড়ির হেঁসেলে রবিবারে পাঁঠা বা মুরগির মাংসের ঝোল রান্না হলেও কাবাব টাবাব হত না। ঠাকুরদা যতদিন বেঁচে ছিলেন মুরগির মাংস বা ডিমও ঢোকেনি বাড়িতে। বাজ্গা বেগম কত রকমের কাবাব আনতেন – শামী কাবাব, বটি কাবাব, রেশমি কাবাব, গলৌটি কাবাব, সঙ্গে পাতলা চাকতি করে কাটা শসা, টোমাটো, পেঁয়াজের সালাড থাকত – নরম আটার রুটিও। একটি কাবাবের সঙ্গে আরেকটির তফাৎও মজা করে বুঝিয়ে দিতেন। টিফিনের ঐ সময়টুকুতে আমাদের টেবিলের কোণটিতে পাঠান মোগল আমলের রন্ধনকলা যেন বাদলকিনারি দোপাট্টা মেলে বসতো। একটা চ্যাপ্টা ডিম্বাকৃতি স্টিলের ডিবেতে করে পান আনতেন বাজ্গা বেগম – তার অন্দরের সুগন্ধি মশলা বেনারস বা লক্ষৌ থেকে আনানো। স্টাফরুমে অনেকেই তার সমাঝদার ছিলেন। ডিবের মালিক তো পানের রসে ঠোঁটদুটি প্রায় সর্বদা রাঙিয়ে রাখতেন।
বহু বছর কেটে গেছে। বাজ্গা বেগমের দেওয়া ওঁর নিজের প্রৌঢ় বয়সের একটি সাদাকালো ফোটোগ্রাফ ক্রমশঃ মলিন হয়ে এসেছে আমার অ্যালবামে। আলিগড় ইউনিভারসিটিতে গিয়েছি একটি মানবীবিদ্যাচর্চার সম্মেলনে। এক সন্ধ্যেতে ওখানকার প্রথিতযশা অধ্যাপিকা বান্ধবী শিরিন মুসভি নৈশ ভোজের নিমন্ত্রণ করলেন নিজের বাড়িতে।
একবার সপ্তাহখানেক তাঁকে দেখিনি। শুনলাম শরীরটা নাকি ভাল নেই। এইটুকু বুদ্ধি আমার হয়নি, অফিস থেকে ঠিকানা নিয়ে তাঁর বাড়ি চলে যাই। দিন সাতেক পর নোটিসবোর্ডের সামনে দেখা, চশমাটা বাগিয়ে নোটিস পড়ছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন আছেন এখন? ঠিক আছে শরীর’? আমার মুখের দিকে তাকালেন, চোখ দুটি কাচের আড়ালে জলে ভরে উঠল, ‘আমার মেয়ে জিজ্ঞেস করছে কেমোন আছেন আপনি’? আমি একেবারে অপ্রস্তুত। সেই অভিমান অবশ্য থাকেনি বেশিক্ষণ। সবিস্তারে নিজের অসুখ, স্বামীর সযত্ন শুশ্রুষার কথা বললেন।
২
কলেজে যেদিন দুপুরে তাঁর চিরশান্তির দেশে চলে যাবার খবর এল, আমি তখন ক্লাসে। পিরিয়ড শেষ হবার পর ফিরে এসে শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। প্রিন্সিপাল ততক্ষণে ফুলের মালা, বোকে, ইত্যাদি নিয়ে তাঁর বাড়িতে যাবার জন্য অধ্যাপিকা ও শিক্ষাসহায়ক কর্মীদের একটি দল পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমিও যে যেতে চাই তাঁকে একবার শেষ দেখা করতে। কিন্তু ইলিয়ট রোড যে একেবারেই চিনি না- আমি খুঁজে পৌঁছতে পৌঁছতে ওঁরা হয়তো বেরিয়ে পড়বেন গোরস্থানের উদ্দেশ্যে। মনের মধ্যে তুমুল আলোড়ন হচ্ছে, চোখ উপ্চে আসছে জল, পারুলদি বলছেন, ‘তোমার যাওয়া উচিৎ গোপা, তোমাকে উনি মেয়ে বলতেন’। কতক্ষণ এইভাবে গেছে জানি না, হঠাৎ স্টাফরুমের সকলকে সামনের চত্বরের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলাম। শুনলাম ওঁরা বাজ্গা বেগমকে তাঁর প্রিয় কর্মস্থল ব্রেবোর্ন কলেজে শেষবারের মতো নিয়ে এসেছেন। কী আশ্চর্য ব্যাপার। আমি যে মনপ্রাণ দিয়ে ওঁকে একটি নমস্কার জানাতে চাইছিলাম। কলেজের বাগানের কয়েকটি ফুল এবার আমার নমস্কারের সঙ্গী হল।
বহু বছর কেটে গেছে। বাজ্গা বেগমের দেওয়া ওঁর নিজের প্রৌঢ় বয়সের একটি সাদাকালো ফোটোগ্রাফ ক্রমশঃ মলিন হয়ে এসেছে আমার অ্যালবামে। আলিগড় ইউনিভারসিটিতে গিয়েছি একটি মানবীবিদ্যাচর্চার সম্মেলনে। এক সন্ধ্যেতে ওখানকার প্রথিতযশা অধ্যাপিকা বান্ধবী শিরিন মুসভি নৈশ ভোজের নিমন্ত্রণ করলেন নিজের বাড়িতে। প্রকাণ্ড পুরনো আমলের ওভালশেপ খাবার টেবিলে সাদা লেসের টেবিলক্লথ- তার ওপর চমৎকার সুদৃশ্য সব পাত্রে রকমারি পোলাও, পরোটা, কাবাব– রেশমি, গলৌটি, বটি… । বাড়িতে বানানো সেই কাবাবের স্বাদগন্ধ স্মৃতিতে ঝড় তুলে ফিরিয়ে আনল বাজ্গা বেগমকে। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম শিরিনও বাজ্গা বেগমের মতো লক্ষ্ণৌয়ের বনেদী মুসলমান বাড়ির মেয়ে। শিরিন তখন বলছে কোনটা বানাতে কী কী উপকরণ লেগেছে। আমি যেন ফিরে গিয়েছি সেই যে ভারতীয় রন্ধনশৈলী ও জীবনচর্চার কাছে যার সঙ্গে বাজ্গা বেগম কবে আমার প্রাণ ভালবাসার সোনালি জরির সুতোয় বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন ।
চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
আমাদের কলেজের দিন গুলিতে ফিরে গেছিলাম । না, আমরা ওঁকে পাইনি । তবে সবকিছুই খুব চেনা । বেকবাগান এলাকায় বড় হয়েছি বলে ।
খুব ভালো লাগল পড়তে
Respected Gopadi, asadharon laglo Smt. Bazegha Begum er opor apnar lekha pore. Satyi mormosporshi. Ami Dipankar Sengupta, MTPS Colony, Mejia r DAV Public SchoolerS.Sc. Teacher. Ami onek lekhalekhi kortam eksamay — womenoriented. Pranam janalam.