বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর তাতে শীতকালের সার্কাস এক অনিবার্য সংযোজন। আবাল্য এমনটাই জেনে এসেছি। কিন্তু নিয়ম করে শীতকাল এলেও, পরিযায়ী পাখির মতোই সংখ্যায় কমে আসছে সার্কাস। নানা অসুবিধার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কোনও রকম টিঁকে আছে সার্কাসের দলগুলো।

চলতি বছরের ডিসেম্বরেও পোস্টার দেখা গিয়েছে অজন্তা সার্কাসের। মিনিবাসের পিছিনেই হোক বা ইতিউতি ভাঙা দেওয়ালে রঙচঙিয়ে উঠেছে সে সব গুটিকয় পোস্টার। খুঁজে খুঁজে সে ভাবেই কেউ কেউ পৌঁছেছেন সিঁথি মোড় বা টালা পার্ক। হারিয়ে যেতে যেতেও কেন জানা নেই এখানে আজও টিঁকে রয়েছে সার্কাসের ছিটেফোঁটা। মোটামুটি, শীতের তিন মাস ধরে এই সার্কাসের দলগুলো আজও প্রবল মাতানোর চেষ্টা করে বাঙালিকে। হাত-পা ভেঙে যাওয়া রুগির মতোই ছটফট করেন সার্কাস কর্মীরা। কিন্তু কোথায় যেন গরমিল। কোথায় যেন নিয়মহীন,  বেতাল-বেসুর-বেমানান। যেন কিছুতেই সমে পৌঁছচ্ছে না এত উদ্যোগ। কিছুতেই যেন দাঁড়াচ্ছে না সেই মজা!

সার্কাসের ইতিহাসটাও সার্কাসের তাঁবুর মতোই ভারি জমকালো। ১৮৮৭ সালে দ্য বেঙ্গল সার্কাস পত্তন করেছিলেন প্রফেসর প্রিয়নাথ বসু। ছোট জাগুলিয়ায় জন্ম প্রিয়নাথের। ছেলেবেলা থেকেই কুস্তি ও ঘোড়সওয়ারির প্রতি আগ্রহ ছিল। ক্রমে অসংখ্য কুস্তির আখড়ার পত্তনও করেন তিনি। সেই আখড়া থেকেই ক্রমশ সার্কাসের জম্ম। ধীরে ধীরে আখড়াগুলিতে শরীরের কসরত শেখাতে শুরু করেন প্রিয়নাথ স্বয়ং। গ্রাম থেকে গ্রামে শিখিয়ে বেড়াতেন। সেখানেই ক্রমে একদিন ঘোড়ার প্রবেশ ঘটে। আগেই বলেছি, ঘোড়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল তাঁর। সেই ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়েই জম্ম হয় সার্কাসের। ক্রমে ক্রমে প্রবেশ ঘটে আরও জীবজন্তুর। বাঘের মুখে মাথা ঢুকিয়ে খেলা দেখানো শুরু হয়। নাম হতে থাকে সেই সার্কাসের। ক্রমে নানা দেশীয় জমিদার থেকে বিদেশি রাজাদের দফতরেও ছড়িয়ে পড়ে সেই নাম। আসতে থাকে আমন্ত্রণ। রমরমিয়ে চলতে থাকে দ্য বেঙ্গল সার্কাস।

আজকে যাকে টালা পার্কে দেখা যায়, সেই অজন্তা সার্কাসের জন্ম অবশ্য ১৯৬৭ সালে। মাত্র ৫০০০ টাকায় আব্দুল আজিজ এই সার্কাসের পত্তন করেন। কথা হচ্ছিল, বর্তমান ম্যানেজার সঞ্জিত গোস্বামীর সাথে। জানালেন, টিম-টিম করে হলেও,  এই সার্কাস প্রতি শীতকালে চলে তিন মাস। জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন তিনটি করে শো। দুপুর ১টা, বিকেল ৪ টে ও সন্ধ্যা ৭টা। ২৫-৩০ জনের দল নিয়ে প্রতিদিন সেজে ওঠে সার্কাস-রিং। তবে, জীবজন্তু বন্ধ হয়ে যাওয়াটা বড় ক্ষতি, নিজেই স্বীকার করলেন তিনি। একমাত্র হাতির খেলা চালু ছিল। গত বছর থেকে সেটাও বন্ধ করেছে সরকার। ফলে ব্যবসা চূড়ান্ত মার খাচ্ছে।

তবু, ফি সন্ধায় রংচটা জামাকাপড়ে, তাপ্পিমারা তাঁবুতে সেজে ওঠে সার্কাস। বাহারি আলো জ্বলে, অংবং মিউজিক চলে। মুখে সাদা হাসি মেখে ভাঙাচোয়ালে হেসে ওঠে সং। ক্লান্ত তারা, তবু বামন জোকারকে ল্যাং মারে হেসে হেসে। বাইক চালিয়ে ঢুকে পড়ে আগুনগোলকে। মরতে মরতেও আনন্দ দিয়ে চলে। আলো নিভে যাচ্ছে। ওরা ঝুলতে ঝুলতে খপ করে ধরে ফেলছে দড়ি। পড়তে পড়তেও সামলে নিচ্ছে। নতজানু হয়ে শুকরিয়া কুড়োচ্ছে তারপর..

কিন্তু এভাবে কদ্দিন? ম্লান মুখে মাথা ঝোঁকালেন সঞ্জিতবাবু। যার মানে, জানা নেই। সরকার কোনও দায়িত্ব নিচ্ছে না। এত খরচ! যদিও সম্প্রতি মদন মিত্র এসে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। কিন্তু পার্ক সার্কাসের মাঠে মা উড়ালপুল তৈরির সময় থেকেই আর সার্কাস করা যায় না। ফলে প্রাইম লোকেশান মিস। জীবজন্তু নেই।

দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে সঞ্জিতবাবুর বুকের ওপর। আক্ষেপ করেন, বাঙালির হাত থেকে সার্কাস ক্রমেই অবাঙালিদের হাতে চলে গেল। অথচ, বাঙালির হাতেই সার্কাসের জন্ম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, শিল্পের বদলে জরুরি হয়ে উঠল ব্যবসা। হুতোম প্যাঁচার নকশাতেও উল্লেখ ছিল, বাঙালির আদি সার্কাসের প্রবণতার। বুকে প্রদীপ নিয়ে মঞ্চে উঠতেন লোকেরা। উনিশ শতক জুড়েই এমন উদাহরণ অনেক। মতিবাবুর সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখাতেন তুলসী চক্রবর্তী। কিন্তু কোতায় যেন মিলিয়ে গেল সেই স্মৃতি। প্রবেশ ঘটল অবাঙালি ব্যবসায়ীদের। রুচির বদলে পয়সাই হয়ে উঠল মূল খোরাক। আজকাল তো সার্কাসে আর বাংলা ভাষাও শোনা যায় না। শোনা যায় না বাংলা গানও।

“তবে সার্কাসের দুর্দিনের আরও একটা কারণ রয়েছে।” বললেন সঞ্জিতবাবু। কী সে কারণ? উত্তরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,  “মানুষ কি আর যাত্রা দেখে? বা থিয়েটার? দেখে না। মানুষের রুচি বদলেছে। বলা ভালো,  ভোগবিলাস বদলেছে। সেখানে এই রোগা জোকার দেখে শিশুরা হাসবে কেন? আগুনের গোলকও তো পুরনো। গোটা সমাজটাই তো এখন আগুন। মানুষের ভয়ও তাই বদলে  গিয়েছে!”

Inside the circus tent
সার্কাসের তাঁবুতে জনসমাগম এখন দুর্লভ

শুনে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। আমার ছেলেবেলা জুড়ে কিন্তু সার্কাস রঙিন। নব্বই দশক জুড়ে ছোটদের স্মৃতিতে সার্কাস প্রবল ভাবেই উপস্থিত। হরেক জন্তু থেকে সুন্দরী মেয়ে,  অভাব ছিল না কিছুরই। বাবার হাত ধরে শীত মানেই, সার্কাস। পার্ক সার্কাস মাঠে রঙিন চাঁদোয়া। একরাশ বিস্ময়। সেই রঙিন গ্যাসবেলুন একদিন উড়ে গেল হাওয়ায়। বলা ভালো, মিলিয়ে গেল। আমরাও বড় হয়ে গেলাম। কেন যে হলাম! ক্রমেই সিলুয়েটে একা হয়ে কোণঠাসা হয়ে গেল ছেলেবেলার সার্কাসও। মনখারাপের মতো। স্কুলবাড়িতে ফেলে আসা ছোটবেলার মত। দুনিয়ায় আর কোনও বিস্ময় থাকল না। কেউ ছোট থাকল না। এসে গেল পাব-জি। পোকেমান গো। সোনার কেল্লার দুষ্টু লোকের মতোই ভ্যানিশ হল, সার্কাস!!

তবু, ফি শীতে কমলালেবু আর পিকনিকের মতোই নিয়ম করে শহরে সার্কাস আসে। রংচটা বিলবোর্ড আর রোগা রোগা মেয়েদের নিয়ে। আমাদের ছেলেবেলার এই জলসাঘরের আলো নিভে আসছে। একে একে। কী ভবিষ্যৎ এই কর্মীদের? জানা নেই। সঞ্জিতবাবু বললেন,  “আমাদের নেতারা তো বলেই খালাস, সার্কাস দেখাবেন না। তা এই সার্কাস শব্দটা বলছেন, অথচ এই কালচারটা যে মরতে বসল, তার খোঁজ রাখেন না কেন তাঁরা?”

মানুষও আর টেস্ট খেলা দেখে না। টি-টোয়েন্টি দেখে। মধ্যবিত্তের উদাসীনতা তো থাকবেই। তবু না-ছোড়, এই সার্কাসের দল। তাই মিঠে রোদ্দুরে মাইকে এখনও ভেসে আসছে, “আইয়ে জনাব.. অজন্তা সার্কাস মে আপকা সোয়াগাত হ্যায়..”

পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *