আগের পর্বের লিংক:
[লপসি ও লপ্সিকার জন্য বিপ্লব], [বাঙালি পুরুষ যখন রাঁধুনি], [মাছের মাংসের কারি], [রান্নার ক্ষমতা]
রূপ কি কেবল রাঁধুনির? রূপ তো রন্ধন-সামগ্রীর, চাপানো রান্নার। দেখার চোখ চাই, মন চাই। রাঁধুনি রূপময়ী হলে বাড়ির পাকা গিন্নিরা তাকে কাজে রাখার আগে দু’বার ভাবতেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ইন্দিরা উপন্যাসে সুভাষিণীর শাশুড়ি সুন্দরী ইন্দিরাকে রান্নার কাজে রাখতে চাননি। কথোপকথনটি মনে রাখার মতো,
আমি [ইন্দিরা] বলিলাম। “বয়স এই উনিশ কুড়ি।”
গৃহিণী। তবে বাছা, অন্যত্র কাজের চেষ্টা দেখ গিয়া যাও। আমি সমত্ত লোক রাখি না।
সুভাষিণী মাঝে হইতে বলিল, “কেন মা, সমত্ত লোক কি কাজ কর্ম্ম পারে না?”
গৃ। দূর বেটী পাগলের মেয়ে। সমত্ত লোক কি লোক ভাল হয়?
সুভাষিণী বহু কৌশলে শেষ অবধি ইন্দিরাকে রান্নার কাজে বহাল করেছিল। বামন ঠাকুরানির চাকরি গিয়েছিল, ইন্দিরা তার জায়গা নিয়েছিল। বামনি বলেছিল, “এখন রাঁধিতে গেলে রূপ যৌবন চাই।” ইন্দিরা অবশ্য রূপ দিয়ে নয়, রান্না দিয়ে বাড়ির পুরুষদের মন জয় করেছিল। শুধু পুরুষদের মন নয়, সুভাষিণীর শাশুড়িও সেই রান্নায় মজেছিলেন। বলেছিলেন, “এ ত বড় মানুষের ঘরের মত রান্না।’ রান্না বড় মানুষের ঘরের মতো হয় কীভাবে? হয় স্বাদে-গন্ধে আর রূপে।
সেই গন্ধ-স্বাদ-রূপ অনেক সময় উপাদান নির্ভর। উপকরণের অভাবে ব্যঞ্জনের স্বাদ-বর্ণ খোলে না। উচ্চবর্ণ আর বিত্তের যেখানে যোগ, সেখানে বড় মানুষের ঘরের রান্না একরকম, আর যেখানে উচ্চবর্ণের সঙ্গে বিত্তের অযোগ, সেখানে বড় মানুষের ঘরের রান্না আর একরকম। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-তে অপু তার বাবার সঙ্গে গিয়েছে লক্ষ্মণ মহাজনের গ্রামে। মহাজনের ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী আদর করে ছেলেটিকে নিয়ে গেছে তাদের বাড়ি। অপু দেখছে, চোখ ভরে দেখছে সম্পন্ন বাড়ির রূপ।
‘কড়ির আলনা, রং বিরংয়ের ঝুলন্ত শিকা, পশমের পাখী, কাঁচের পুতুল, মাটির পুতুল, সোলার গাছ – আরও কত কি!’
দেখা কি কেবল সেখানেই ফুরিয়ে গেল? গেল না। বউটি অবোধ সুন্দর ছেলেটিকে মোহনভোগ তৈরি করে খেতে দিল। অপু ঘি দেওয়া মোহনভোগ খেয়ে অবাক হয়ে গেল। মোহনভোগে কিশমিশ দেওয়া। সেই ঘি-কিশমিশ দেওয়া মোহনভোগের সঙ্গে মা সর্বজয়ার মোহনভোগের রূপ-গুণের তুলনা করে সে। সর্বজয়া ‘শুধু সুজি জলে সিদ্ধ করিয়া একটু গুড় মিশাইয়া পুল্টিসের মত একটা দ্রব্য তৈয়ারী করিয়া কাঁসার সরপুরিয়া থালাতে আদর করিয়া’ খেতে দেয়। দুই ভোগের রূপ-গুণের অনেক পার্থক্য। অপু জানে তা, স্বীকারও করে। তবে মহাজন বাড়ির রান্নার রূপে তার মন ভোলে না। বরং মায়ের উপর ‘করুণায় ও সহানুভূতিতে’ তার মন ভরে ওঠে। ‘তাহার মা গরীব, তাহারা গরীব।’ ব্রাহ্মণ জাতধর্মের ঊর্ধ্বে, কিন্তু নতুন সময় ও অর্থনীতিতে বিত্তে তারা হীন। সেই বিত্তহীনতা সর্বজয়ার রান্নাকে রূপহীন করতে পারে, কিন্তু তাতে অপুর মন বিচলিত হলেও, লুব্ধ অকৃতজ্ঞতায় মহাজন বাড়ির রান্নায় হারিয়ে যায় না।
রান্নার গন্ধে আর রূপে যার মন হারিয়ে যেত তিনি কমলাকান্ত চক্রবর্তী। ইংরেজি জানা এই ব্রাহ্মণের ইংরেজ উপনিবেশে যথার্থ পে-বিল আঁকার জন্য চাকরি গিয়েছিল। কমলাকান্ত মাসকাবারির পে-বিলে কার্টুনবৎ যে ছবিটি এঁকেছিল, তাতে এক সাহেব ভারতীয় নাঙ্গা ফকিরকে দু’চার পয়সা ছুড়ে দিচ্ছে। ইংরেজ সাহেবরা উনিশ শতকে দু’তরফে এদেশের সম্পদ চুরি করছিল। এদেশ থেকে কমদামে কাঁচামাল ও অন্যান্য সম্পদ নিজেদের দেশে চালান করছিল। আর শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপন্ন তৈরি মাল এদেশের বাজারে বিক্রি করছিল। এই দু-ফেরতা বঞ্চনায় এদেশের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছিল। তবু খাওয়া-দাওয়ার ভাঁড়ারে চূড়ান্ত টান পড়েনি। কমলাকান্ত চক্রবর্তীর মন তাই পাকশালে হারিয়ে যেত। কমলাকান্ত উবাচ,
‘মানি, পাকের ঘরে আমার মন পড়িয়া থাকিত। যেখানে পোলাও, কাবাব, কোফতার সুগন্ধ, যেখানে ডেকচী-সমারূঢ়া অন্নপূর্ণার মৃদু মৃদু ফুটফুটবুটবুট-টকবকোধ্বনি, সেইখানে আমার মন পড়িয়া থাকিত। যেখানে ইলিস, মৎস্য, সতৈল অভিষেকের পর ঝোলগঙ্গায় স্নান করিয়া মৃন্ময়, কাংস্যময়, কাচময় বা রজতময় সিংহাসনে উপবেশন করেন, সেইখানেই আমার মন প্রণত হইয়া পড়িয়া থাকে, ভক্তিরসে অভিভূত হইয়া, সেই তীর্থস্থান আর ছাড়িতে চায় না। যেখানে ছাগ-নন্দন, দ্বিতীয় দধীচির ন্যায় পরোপকারার্থ আপন অস্থি সমর্পন করেন, যেখানে মাংসসংযুক্ত সেই অস্থিতে কোরমা-রূপ বজ্র নির্ম্মিত হইয়া, ক্ষুধারূপ বৃত্রাসুর বধের জন্য প্রস্তুত থাকে, আমার মন সেইখানেই, ইন্দ্রত্বলাভের জন্য বসিয়া থাকে। যেখানে, পাচকরূপী বিষ্ণুকর্ত্তৃক, লুচিরূপ সুদর্শন চক্র পরিত্যক্ত হয়, আমার মন সেইখানেই গিয়া বিষ্ণুভক্ত হইয়া দাঁড়ায়। অথবা যে আকাশে লুচি-চন্দ্রের উদয় হয়, সেখানেই আমার মন-রাহু গিয়া তাহাকে গ্রাস করিতে চায়। অন্যে যাহা বলে বলুক, আমি লুচিকেই অখণ্ড মণ্ডলাকার বলিয়া থাকি। যেখানে সন্দেশরূপ শালগ্রামের বিরাজ, আমার মন সেইখানেই পূজক। হালদারদিগের বাড়ীর রামমণি দেখিতে অতি কুৎসিতা, এবং তাহার বয়ঃক্রম ষাট্ বৎসর, কিন্তু রাঁধে ভাল এবং পরিবেশনে মুক্তাহস্তা বলিয়া, আমার মন তাহার সঙ্গে প্রসক্তি করিতে চাহিয়াছিল।’
এ তো রান্নার বিবরণ নয়, রান্নার পৌরাণিক রূপবর্ণন। লুচি সুদর্শনচক্র, ইলিশ মাছ সতেল ঝোল-গঙ্গায় ভাসমান, সন্দেশ শালগ্রামশিলা। এই রান্নার রূপে রাঁধুনির রূপ তুচ্ছ। এই রান্নার রূপ নির্মাণেই রাঁধুনির গুণবিচার। সেই গুণে কমলাকান্ত হালদার বাড়ির কুৎসিতা রামমণির প্রতি প্রসক্ত। তবে রামমণি মারা যাওয়ায় সে প্রসক্তির অবসান হয়েছিল।
রান্নার রূপ-বর্ণনার এই রীতি বঙ্কিম শিখেছিলেন তাঁর কবিগুরু ঈশ্বর গুপ্তের কাছ থেকে। ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর কবিতায় মাছ-মাংস-ফল এসবের যে রূপ এঁকেছেন, তা দেখার মতো। এমনিতে ঈশ্বর গুপ্তের পদ্য বাঙালি পাঠকেরা খুব একটা মন দিয়ে পড়েন না। তবে খাদ্যরূপের এই বিবরণ যদি মন দিয়ে পড়তেন, তাহলে বুঝতে পারতেন ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা আমাদের কেবল অর্থনীতিতে মারেনি, আমাদের খাদ্য-সংস্কৃতিতেও মেরেছিল। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির হাত ধরে বদলে গিয়েছিল আমাদের ভূমিঢাল, ক্রমশ হারিয়েছিল নদীর নাব্যতা। ফলে যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ঈশ্বর গুপ্ত সেই অপরূপ মাছ-মাংস-ফলের ছবি শব্দে এঁকেছিলেন তা ক্রমে হারিয়ে গিয়েছিল, হারিয়ে গিয়েছিল তাদের রূপ-রস। তোপসে মাছের রূপ বর্ণন করতে গিয়ে গুপ্ত কবি লেখেন,
কষিত-কনককান্তি কমনীয় কায়।
গালভরা গোঁফ-দাড়ি তপস্বীর প্রায়।।
মানুষের দৃশ্য নও বাস কর নীরে।
মোহন মণির প্রভা ননীর শরীরে।।
আনারসের রূপটি চোখে ভাসে।
বন হতে এলো এক টিয়ে মনোহর।
সোণার টোপর শোভে মাথার উপর।।
এমন মোহন মূর্ত্তি দেখিতে না পাই।
অপরূপ চারুরূপ অনুরূপ নাই।।
ঈষৎ শ্যামল রূপ চক্ষু সব গায়।
নীলকান্ত মণিহার চাঁদের গলায়।।
কমলকুমার মজুমদার ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার ভক্ত পাঠক ছিলেন। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার সংকলন করেছিলেন তিনি। বড়ো দেখার মতো সে বইখানি– কমলকুমারের কাঠখোদাই ছবি সে বইয়ের অঙ্গে। কমলকুমার জানতেন বাংলা ও বাঙালির গরিমা আধুনিকে নেই, লোকায়তে আছে। রামপ্রসাদ আর রামকৃষ্ণের লোকায়ত প্রজ্ঞায় তাঁর মন মজেছিল। ঈশ্বর গুপ্তের রূপময় আহারের জগৎকে কমলকুমার লোকায়ত বাঙালির সুতৃপ্ত মনের রূপবিহার বলেই মনে করতেন।
এই যে বাঙালির রান্নার রূপ, রূপ বিহার তা কি একেবারেই হারিয়ে গেল? হারিয়ে যায় না। বাঙালির রান্নার রূপ একদিকে বিশ্বায়নের ফলে নামি-দামি হোটেলের মেনুকার্ডে পুঁজির সহযোগে উঠে পড়ে, আর এক দিকে তলায় তলায় চলতে থাকে সেই রূপসাধনা। সে রূপসাধনার যোগী নানা সময় নানা জন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাজার সফরে সেই রূপ-সাধনার খবর মেলে। আর খবর মেলে তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পদ্যে আর গদ্যে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে তাঁর বাজার করিবার সহজ উপায় বইটি উৎসর্গ করেছেন রজতেন্দ্র। লিখেছেন বাঙালির রান্নাঘরের আবহমান রূপের পদাবলি।
‘শজনেডাঁটারা কচি ল্যাতলেতে লম্বাটে সরু… বকের সবুজ হাঁটু ডুবে আছে ঘুম-ঘুম বালতির জলে… বোধ হয় ডাঁটাকে খেয়ে আমরা ছিবড়ে-ফেলা ইচ্ছেকে খাই…’
খাদ্যের ইচ্ছে, খাদ্যরূপের ইচ্ছে, হেরে যাওয়া বাঙালির, ছিবড়ে হয়ে যাওয়া বাঙালির ইচ্ছে এখনও রান্নার রূপে রূপে বিহার করছে। বিশ্বায়িত রান্নাভূমি তা পুরোপুরি গিলে খেতে পারেনি।
বিশ্বজিৎ রায়ের জন্ম ১৯৭৮-এ, কলকাতায়। রামকৃষ্ণ মিশন পুরুলিয়ায় স্কুলজীবন কাটিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশুনো। উভয় পর্যায়েই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। বর্তমানে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যজগতে সুপরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ: স্বদেশে সমকালে’, ‘সচলতার গান’, ‘সব প্রবন্ধ রাজনৈতিক’। এর বাইরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মুক্তগদ্যের বই ‘ঘটিপুরুষ’, ‘অন্দরবেলা’ ও ‘ইস্কুলগাথা’ এবং পদ্যের বই ‘বিচ্ছেদ প্রস্তাব’ ও ‘গেরস্থালির পদ্য’। ‘ঘটিপুরুষ’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন নীলাঞ্জনা সেন স্মৃতি পুরস্কার।