ফুটবল থেকে অবসর নেবার পর দীর্ঘ কুড়ি বছর কলকাতা বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ময়দানের নামজাদা ফুটবলার সুকুমার সমাজপতি। ধারাভাষ্যকার হিসেবে। টেলিভিশন আসার আগে (এবং পরেও) রেডিয়ো ধারাভাষ্য ছিল খেলাপাগল, মাঠে যেতে-না-পারা আমজনতার একমাত্র ভরসা। চোখে দেখতে না-পাওয়া খেলার উত্তেজনা ছোট্ট কালো ফুটোওলা বাক্স বেয়ে ছড়িয়ে পড়ত গোটা বাংলায়। বল জালে জড়ালে বাজারে-দোকানে-ছাদে-রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকা আটপৌরে বাঙালি হাত তুলে লাফিয়ে উঠত গো-ও-ও-ও-ল বলে। সেই বেতার ধারাভাষ্যকার জীবনের খুঁটিনাটি শোনালেন সুকুমার সমাজপতি। 


 

সত্তরের দশকের কথা। ফুটবল মরশুম সবে শুরু হয়েছে। সকালের কাগজেই দেখেছি, বিখ্যাত ফুটবলার প্রদীপ ব্যানার্জী ম্যাচের ধারাবিবরণী দেবেন। প্রদীপদা চিরকালই খুব ভালো কথা বলেন, অতএব ফুটবলের ধারাভাষ্য দেওয়া ওঁর কাছে জলভাত। সেদিন দুপুরেই অফিসের কাজে ইংরেজি বিভাগের প্রোগ্রাম একজিকিউটিভের কাছে যাই। নাম অরুণ দত্ত। অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। উনি তখন সাময়িকভাবে স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের কাজও দেখছেন। হঠাৎই আমাকে ফস করে বললেন, ‘সুকুমারবাবু আপনি বাংলা ধারাভাষ্যে কেন আসছেন না?’ ব্যাপারটাকে আমি প্রথমে আমলই দিইনি। অরুণবাবু কিন্তু নাছোড়বান্দা, কয়েকদিন বাদে বাদেই আমাকে অফিসে টেলিফোন করতে লাগলেন। আমি তো ভেবেই পাচ্ছিনা কী করে ধারাভাষ্য দেব। এমনিতেই আমি ছিলাম স্বল্পবাক ও লাজুক প্রকৃতির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এড়াতে পারলাম না ওঁর অনুরোধ। দুদিন পরে আকাশবাণীর রিসেপশনে যেতেই দুই শ্যামল (শ্যামল বসু ও শ্যামল ব্যানার্জী) চোখ পাকিয়ে বললেন, আমি ধারাভাষ্যে রাজি না হলে, রেডিও অফিসে আমাকে ঢুকতেই দেবে না।

বাধ্য হয়েই অরুণবাবুর কথায় রাজি হলাম। উনি বিনয় করে বললেন, নিয়মরক্ষার খাতিরে ছোট্ট একটা অডিশন দিতে হবে অর্থাৎ একটা খেলা দেখে মিনিট পাঁচেক ধারাবিবরণী দিতে হবে। তাই-ই হল। ইডেন উদ্যানে একটি ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের কিছুক্ষণ ধারাবিবরণী দিলাম। তখন সারামাঠ জুড়ে স্টেডিয়াম ছিল না। কমেন্টেটার্স বক্স ছিল কাঠের দোতলাএকটা স্ট্রাকচার এবং তা ময়দানের দিকে। মাঠে প্রচণ্ড ভিড় থাকলেও, ওই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি ছিল। অতএব অডিশনে মন:সংযোগে আমার কোনো অসুবিধেই হল না। অডিশন দিয়েই মনে হয়েছিল, বোধহয় মন্দ বলিনি। হয়তো উতরে যাব। দু’দিন পরেই অরুণবাবু টেলিফোনেই জানালেন, ওঁদের অডিশন বোর্ডের নাকি আমার বলাটা খুব পছন্দ হয়েছে। বললেন, কদিন পরেই জানাবেন আমার প্রথম ধারাভাষ্যের দিন। আমি মনে মনে ঠিকই করে রেখেছিলাম যে, দু’দলেরই খেলোয়াড়দের ভালো করে না চিনলে, আমি কিছুতেই প্রথমদিন ধারাভাষ্য দেব না। এটা উনিশশো একাত্তর সালের ঘটনা। সে বছর টালিগঞ্জ অগ্রগামী আই এফ এ শীল্ড ফাইনালে উঠেছিল। আমাকে রেডিয়োর পক্ষ থেকে ওই ফাইনাল ম্যাচে ধারাবিবরণীর জন্য বলা হল। আমি কিন্তু রাজি হলাম না। কারণ, টালিগঞ্জ অগ্রগামীর ছেলেদের আমি ভালো করে চিনতাম না। আকাশবাণীর ওঁরা একটু আশ্চর্যই হলেন।

Sukumar Samajpati
কলকাতা ময়দানের দুই নক্ষত্র। চুনী গোস্বামী ও সুকুমার সমাজপতি। ছবি সৌজন্য – sites.google.com

বাহাত্তরে মরশুমের লীগের প্রথম পর্বের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলায় আমাকে ধারাভাষ্য দিতে বলা হল। সঙ্গে থাকবেন বহু পরিচিত কৃতী ধারাভাষ্যকার ও সাংবাদিক অজয় বসু। অজয়দার সঙ্গে বহুদিন আগে থেকেই আলাপ ছিল। অতএব কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু আসল অসুবিধাটা হল অজয়দার ধারাভাষ্যকার হিসেবে যশ ও খ্যাতি। আমি অবশ্য খুব একটা ঘাবড়াইনি। কারণ, খেলার টেকনিক্যাল দিকটা সম্বন্ধে আমার আত্মবিশ্বাস ছিলই। আর, এও জানতাম যে অজয়দার মতো সুচারু ভাষার জোগান আমার কখনোই আসবে না। ভাবলাম, নিজের মতো করেই আমি বলার চেষ্টা করব। শুনেছি, অনেকেই প্রথমবার ধারাভাষ্য দেবার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সড়গড় করার চেষ্টা করে। আমি কিন্তু ওসবের মধ্যেও গেলাম না। যা থাকে কপালে ভেবে মাঠের দিকে রওনা দিলাম। তখন সব কাগজে ছোট্ট বক্স করে ধারাভাষ্যকারদের নাম জানানো হত। সুতরাং, সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আগেই জানতে পারতেন, কারা ভাষ্যকার। মাঠে যাওয়ার সময়ে অগণিত কৌতূহলী চোখের সামনে দিয়ে যেতে হল।

বক্সে উঠে অজয়দার প্রথম কথাতেই অভিভূত না হয়ে পারিনি। আমাকে বললেন, ‘সুকুমার, তুমি শুরু কর।’ আমি সবিনয়ে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে ওঁকেই শুরু করতে বললাম। মনে মনে স্নায়ুর চাপ তো ছিলই। তবুও ধারাভাষ্য মোটামুটি খারাপ না করলেও আমারই মুদ্রাদোষের ফাঁদে আমি জড়িয়ে পড়লাম। দু’দলের খেলোয়াড়রা কিছু ভুল করলেই ‘না’ শব্দটা প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল। এবং তা এতই শ্রুতিকটু লেগেছিল যে, পরে আমি টেপ শুনে খুবই লজ্জিত হয়ে পড়েছিলাম। তবে আমার মনে হয়েছিল, আমি বোধহয় ধারাভাষ্যে খেলার টেকনিক্যাল দিকটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলাম। কিছুটা শক্তিও পেলাম প্রথম দিনের পর। কিন্তু এটাও ঠিক, শ্রোতারা আমার মুদ্রাদোষটা ভুলতে পারেননি। কয়েকদিন না, না বিদ্রুপটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে অনেক জায়গা থেকেই শুনতে হয়েছিল।

Sukumar Samajpati
এখনও তিনি মাঠে মানেই পাপারাৎজির ভিড়! ছবি সৌজন্য – youtube.com

খেলার টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি মিশিয়ে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে অবশ্য প্রথম দিকে অনেকরকম সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অনেকেই বলত, মাঠে যা দেখছ, তাই-ই বলবে। কী হলে কী হতে পারত বা কী করা উচিত ছিল, তা বলা ধারাভাষ্যকারের কাজ নয়। আমি কিন্তু মনে মনে ‘কমিটেড’ ছিলাম যেমনভাবে বলছি, ঠিক সেই ধারাই বজায় রাখব। কারণ, আমার মনে হত, তাতে মাঠের পরিস্থিতিটা শ্রোতার কাছে অনেক বেশি করে পরিষ্কার করা যায়। একদিন আমাকে তুলসীদাস বলরামও বলল, ‘সমাজ, তোর কাজ মাঠে প্রকৃতপক্ষে যা ঘটছে বা খেলোয়াড়রা যা করছে, তাই বলা। উচিত-অনুচিত তো আপেক্ষিক ব্যাপার। তোর যেটা মনে হচ্ছে, আমার সেটা নাও হতে পারে।’  বলরামকে বলেছিলাম, ‘আমি তোর কথা মানছি। কিন্তু, আমার ফুটবলবোধ থেকে সাধারণভাবে যা অনুভব করি, তা বলতে আপত্তিটা কোথায়?’ বলরাম আর তর্কাতর্কিতে যায়নি। সম্ভবত আমার কথাটাও ওর গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। আমার কথাটা যে ভিত্তিহীন ছিল না, তা বুঝেছিলাম যখন বেশ কিছুদিন পরে যাঁরা চক্ষুষ্মান নন, তাঁরাও বলতেন,  ‘সুকুমারদা, আপনার ধারাভাষ্য শুনলে আমাদের মনে হয় যেন খেলাটা আমরা দেখতে পাচ্ছি।’ ধারাভাষ্যকার হিসেবে এটা ছিল আমার পরম প্রাপ্তি।

Sukumar Samajpati
ডান পায়ের ছোঁয়ায় মাঠে ঝড় তুলছেন। ছবি সৌজন্য – সন্দীপন সমাজপতি

ধারাভাষ্যে আমার নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে অনেকের মনেই হয়তো সন্দেহের অবকাশ ছিল। মূলত আমি ইস্টবেঙ্গল দলেই খেলেছিলাম বলে। সাধারণভাবে মোহনবাগানিরা আমাকে বলত, আমি নাকি রঙিন চশমা চোখে ধারাভাষ্য দিই। তবে, যাঁরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে খেলার ধারাভাষ্য শুনতেন, তাঁরা অনেকেই বলতেন আমার মধ্যে কোনো পক্ষপাত ছিল না। সত্যি বলতে কি, আমি যখন বক্সে উঠতাম, তখন আমার একমাত্র চেষ্টা থাকত, কত বেশি করে শ্রোতার কাছে খেলাটাকে স্বচ্ছ করে তুলতে পারি। অনেক কট্টর মোহনবাগানিও তাই আমার ধারাভাষ্যের প্রশংসা করতেন। উনিশশো পঁচাত্তর সালেও যখন ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে পাঁচ গোলে হারিয়েছিল, আমি কিন্তু ধারাভাষ্যে সমানে বলে গিয়েছিলাম যে, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দু-দলের খেলায় দর্শকরা মাঠে আসেন হাড্ডাহাড্ডি খেলা দেখতে। তাঁদের কাছে এতখানি ব্যবধান কখনই ভাল লাগে না। তবে, সেইসঙ্গে ইস্টবেঙ্গলেরও ভূয়সী প্রশংসা করতে কুন্ঠাবোধ করিনি।

Sukumar Samajpati
মঞ্চে সংবর্ধনার মুহূর্তে মুসা ও মজিদের সঙ্গে। ছবি সৌজন্য – facebook.com

আমি পাকাপাকি ভাবে ইস্টবেঙ্গলি বলে ব্র্যান্ডেড হয়ে গেলাম ঊনিশশো-ছিয়াত্তর সালে। সেই ম্যাচে মোহনবাগান এক গোলে জিতেছিল, খেলা শুরুর বত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই আকবরের হেড করা গোলে। সে দিন খেলেছিল ইস্টবেঙ্গল, আর জিতেছিল মোহনবাগান। এবং যে  দৃষ্টিকটুভাবে মোহনবাগানের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা বরাবরই ইস্টবেঙ্গলকে প্রতিরোধ করতে না পেরে বল সাইড-লাইনের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল, তা আর যাই হোক ফুটবল ছিল না। সে কথা আমি বরাবরই ধারাভাষ্যের মধ্যে বলেওছিলাম। সে দিন থেকেই মোহনবাগানিদের কাছে আমি খলনায়ক চিহ্নিত হয়ে গেলাম, মূলত গোলের সঠিক বিবরণ দেওয়ার জন্যে। এবং আমি আমার বিবেকের কাছে একশো শতাংশ পরিষ্কার ছিলাম। মাঠ থেকে বেরোবার সময়েই বুঝলাম আবহাওয়া গরম। বেশ কিছু উল্টোপাল্টা মন্তব্যও শুনতে হল। সে দিন আর ব্যাপারটা বেশি দূর গড়ায়নি। কিন্তু, মোহনবাগানের সমর্থকরা কতখানি ক্ষেপে আছে, তা টের পেলাম পরের ম্যাচে মোহনবাগান মাঠে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে। শুরু থেকেই গালিগালাজ নিক্ষিপ্ত হতে থাকল আমার দিকে। এবং ওখানেই থেমে না থেকে, কোনো কোনো অত্যুৎসাহী সমর্থক আমার দিকে বড় বড় ইঁট মারতে শুরু করল। তবে আমি ছিলাম অকুতোভয়। যদিও ওই ইঁটের একটা আমার মাথায় লাগলে মাথা ফেটে যেত।

সাতাত্তর সালে মোহনবাগান ক্লাব উত্তর আমেরিকার ‘কসমস’ দলকে কলকাতায় খেলতে এনেছিল। ‘কসমস’ দলে ছিল দুনিয়ার একনম্বর নামি খেলোয়াড় পেলে। পেলে সেই সময়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছিলেন। পেলেকে কলকাতায় সশরীরে দেখার আগ্রহেই সারা কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ইডেন উদ্যানে অনুষ্ঠিত ওই খেলা বর্ষার দাপটে আর ফুটবল রইল না। সে দিন রেডিওর ধারাভাষ্যে ছিলাম পুষ্পেনদা (সরকার) ও আমি। অবশ্যই ওই দিনটা ছিল আমার জীবনে ‘রেড-লেটার ডে।’ মনে মনে বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম। সে দিন লক্ষ করলাম — মাঠ দেখে পেলের প্রচণ্ড বিরক্তি। ওই উচ্চতার খেলোয়াড় সারা জীবনই মখমলের মতো মাঠে খেলে অভ্যস্ত ছিলেন। বৃষ্টির ইডেনে তাই ওয়ার্ম-আপের সময়েই যখন বলটা ড্রপ খেয়ে মাটির থেকে আশানুরূপ উচ্চতায় উঠল না, তখনই ডান পা-টা  মাটিতে সজোরে ঠুকে পেলে তাঁর প্রচণ্ড বিরক্তি প্রকাশ করলেন। আমরাও বুঝলাম, ওই মাঠে আন্তর্জাতিক মানের খেলা আমরা দেখতে পাব না। এবং সে কথার উল্লেখ আমরা ধারাভাষ্যের মধ্যে বারবারই করলাম। অবশ্য একটা-দুটো বল ধরা-ছাড়ার মধ্যেই পেলের জাত চিনে নিতে আমাদের অসুবিধা হল না। কলকাতার সেই খেলায় মোহনবাগান কসমস দলকে আটকে দিয়েছিল, ১-১ গোলে খেলা অমীমাংসিত রেখে।

Sukumar Samajpati
একটি অনুষ্ঠানে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ছবি সৌজন্য – insidesport.co

বেতারে ধারাভাষ্যের সুযোগেই আশি সালের ষোলোই আগস্টের দুঃসহ বেদনাময় স্মৃতি আজও ভুলতে পারি না। ওই ইডেনেই খেলা ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের তখন ইডেনের ক্লাব হাউসের একদম ওপরের টায়ার থেকে ধারাভাষ্য দেওয়া হত। সারা মাঠে অবশ্য কংক্রিটের গ্যালারির স্টেডিয়াম তখনও হয়নি। সেদিনের ধারাভাষ্যে অজয়দা আর আমি। খেলার মধ্যে দু-দলের খেলোয়াড়রাই চোরাগোপ্তা মারপিটে জড়িয়ে পড়েছিল। গ্যালারি তাই প্রথম থেকেই উত্তপ্ত হয়েছিল। পুরোনো রঞ্জি স্টেডিয়াম আকাশবাণী ভবনের গা ঘেঁষে। যা কিছু উত্তেজনা অথবা গোলমালের সূত্রপাত সাধারণত রঞ্জি স্টেডিয়াম থেকেই হত। সেদিনও কিছু ব্যতিক্রম ছিল না। দ্বিতীয়ার্ধে, মোহনবাগানের লেফট-উইং বিদেশ বসু ইস্টবেঙ্গলের রাইট-ব্যাক দিলীপ পালিতকে একবার টপকাতে গিয়ে দু-জনের মধ্যে সংঘর্ষ হল। দিলীপের পরিষ্কার ফাউল ছিল। কিন্তু, বিদেশ মাথা ঠিক রাখতে না পেরে, দিলীপের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ল। সেই উত্তেজনার আগুন তখন কিন্তু মাঠের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিশেষ করে রঞ্জি স্টেডিয়ামের কংক্রিটের গ্যালারিতে। আমরা বক্স থেকে দেখলাম, উত্তুঙ্গ ওই স্টেডিয়ামের চারপাশে দর্শকেরা দৌড়োদৌড়ি করছে। ওদিকে দেখতে পেলাম, পুলিশ লাঠি চালাচ্ছে। অত হুড়োহুড়ির মধ্যে আসল ঘটনাটা কী ঘটছে, কিছুই বুঝতে পারিনি। তা ছাড়া মাঠে গণ্ডগোলের প্রশমনে তখন খেলাটাও আবার শুরু হয়েছে। খেলার দিকেই তাই ছিল নজর। অজয়দা এবং আমি দুজনেই আমাদের ভাষ্যে ওই উত্তেজনার বিবরণ দিচ্ছিলাম। কিন্তু, তার চেহারা যে ছিল কী সাংঘাতিক, তা আমরা কল্পনাতেও আনতে পারিনি। বাড়ি পৌঁছে, রেডিয়ো মারফৎই জানতে পারলাম হাতাহাতির খবর। রাত যত বাড়তে লাগল, ঘটনার বীভৎসতাও ততই মানুষের কাছে উন্মোচিত হতে থাকল। রাত দশটার রেডিয়োর খবরে জানা গেল, তরতাজা ষোলো জন তরুণ ‘স্ট্যাম্পেড’-এ প্রাণ হারিয়েছে। নির্বাক হয়ে গেল কলকাতা তথা সারা পশ্চিমবঙ্গ।

দীর্ঘ আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে আকাশবাণীতে ফুটবলের ধারাভাষ্য দিয়েছি। তার মধ্যে ঘরোয়া ফুটবল যেমন ছিল, তেমনই ছিল আন্তর্জাতিক ফুটবল। আশির দশকেরই প্রথম দিকে এআইএফএফ শুরু করল নেহেরু-কাপ। ভারতবর্ষে সেই প্রথম আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্ট শুরু হল। আন্তর্জাতিক ওই সব ম্যাচে ধারাভাষ্য দিয়ে, সত্যি বলতে কি, অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দ পেয়েছি। আসলে, খেলা যখন হয় উঁচু মানের, ধারাভাষ্যের মানও আমাদের অজ্ঞাতেই তখন প্রায় অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে যায়। সাতাশি সালের নেহেরু কাপের আসর বসেছিল শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে। কলকাতা থেকে বাংলায় ধারাভাষ্য দিতে গিয়েছিলাম প্রদীপদা আর আমি। সেবার ফাইনালে সোভিয়েত রাশিয়া চ্যাম্পিয়ন হল পোল্যান্ডকে হারিয়ে। দুর্দান্ত রাশিয়ার কাছে পোল্যান্ড দাঁড়াতেই পারল না। এই প্রসঙ্গে বলতে দ্বিধা নেই যে, ধারাভাষ্যে প্রদীপদার সঙ্গে আমার চমৎকার অলিখিত এক বোঝাপড়া ছিল। ফুটবলবোধ থেকে দুজনেরই দৃষ্টিকোণ প্রায় হুবহু মিলে যেত এবং আমাদের কারুর মধ্যেই একজন আর একজনকে ছাপিয়ে যাওয়ার কোনো চেষ্টা থাকত না। তবে, দৃষ্টিকোণের বিরাট পার্থক্য হয়ে গেলে, ধারাভাষ্য কিছুটা ত্রূটিপূর্ণ হয় একথা অনস্বীকার্য।

ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে বহুবার বহু জায়গায় কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছে, এবং সে অভিজ্ঞতার মধ্যে বৈচিত্রের স্বাদ অবশ্যই ছিল। দু-জায়গায় দুটো ঘটনার কথা না বলে পারছি না। একটা ঘটনা ছিল বার্নপুরে। আইএফএ শীল্ডের ক্লাস্টারের খেলাকে কেন্দ্র করে, আর একটা কটকে অনুষ্ঠিত সন্তোষ ট্রফি খেলার। বার্নপুরে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল গাড়িতে। আমার পৌঁছতে দেরি হওয়ায় গাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু আমি হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে খেলার আধঘণ্টা আগে মাঠে পৌঁছে যাই। বাকিদের তো আমায় দেখে প্রায় ভূত দেখার অবস্থা। তবে, সব কিছু শুনে ওঁরা আমার দায়িত্ববোধের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। সত্যিই, রেডিয়োর ধারাভাষ্যকে আমরা খুবই গুরুত্ব দিতাম এবং কাজটাকে আমাদের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করতাম।

Sukumar Samajpati
নিজের বাড়িতে সস্ত্রীক। ছবি সৌজন্য – indiatimes.com

কটকের ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। সেবার কটকে সন্তোষ ট্রফির আসর। সেমিফাইনাল খেলা বাংলা বনাম গোয়া দলের। কলকাতা থেকে যাচ্ছিলাম সুব্রত কুমার ও আমি। ধারাভাষ্যও তাই হওয়ার কথা ছিল পর্যায়ক্রমে বাংলা ও ইংরাজিতে। আগের রাতে হাওড়া পৌঁছে দেখলাম, ট্রেনের গোলমাল। ট্রেন ছাড়বেই না। কিন্তু সেই রাতেই সুব্রতর এক পরিচিত ভদ্রলোকের সুবাদে পরদিন সকালের ফ্লাইটের টিকিট জোগাড় করে ভুবনেশ্বর পৌঁছই। সেখান থেকে ট্যাক্সিতে কটকে। আমাদের দায়িত্ববোধ দেখে প্রোগ্রাম একজিকিউটিভ আশ্চর্য না হয়ে পারেননি। তবে, সত্যি বলতে কি, কটকে ধারাভাষ্য দিতে দিতে সারাক্ষণই ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম। কারণ, কটক রেডিও কর্তৃপক্ষ এবং কটক ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ধারাভাষ্যের ব্যাপারে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে অদূরদর্শিতার পরিচয় রেখেছিলেন। আমাদের ধারাভাষ্যের ব্যবস্থা হয়েছিল স্টেডিয়ামের ছাদের কার্ণিশের ওপরে দুটো টেবিল আর গুটিকয় চেয়ার পেতে। কার্ণিশটা নিঃসন্দেহে চওড়া ছিল, কিন্তু ওখান থেকে সবকিছু নিয়ে ভেঙে পড়লে কিছু করার ছিল না। খেলাটা অবশ্য খুবই ভাল হয়েছিল।

একবার আশির দশকের মাঝামাঝি আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ ইংরাজিতে এক ঘন্টার এক আলোচনার আয়োজন করেছিলেন। সেই আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন অতীতের কয়েকজন খ্যাতনামা খেলোয়াড়।  ছিলেন ব্যোমকেশ বসু, চুনী গোস্বামী, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (পিকে), অরুণ ঘোষ এবং সঙ্গে আমিও। প্রখ্যাত ইংরাজি ধারাভাষ্যকার শিবাজি দাশগুপ্ত ছিল ‘কমপিয়ার’। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, ‘ভারতীয় ফুটবলের উন্নতিকল্পে কী করা উচিত’। শিবাজি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রোগ্রামটা বেশ খাপছাড়া হল। দোষটা অবশ্যই ছিল আমাদের, যারা ওই দিনের আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম। আমরা তড়িঘড়ি করে একজনের কথার মাঝখানে অন্যজন বলতে গিয়ে, পুরো প্রোগ্রামটাই প্রায় একটা হট্টগোলে পরিণত হল। আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের সাধু উদ্দেশ্যটা তেমনভাবে ফলপ্রসূ হল না।

আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে রবীন্দ্র সদনে একটা সুন্দর অনুষ্ঠান হয়েছিল। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে যে সব শিল্পী বিভিন্ন সময়ে আকাশবাণীর নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন, সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের ওপরে একটা ‘ডকুমেন্টারি’ দেখানো হল। তাতে জীবিত ও প্রয়াত অনেক শিল্পীকেই দেখা গেল। আমাদের সকলের কাছে ওই ডকুমেন্টারি ছিল শিক্ষণীয়। তা ছাড়াও, রবীন্দ্রসংগীতের প্রবাদপুরুষ দেবব্রত বিশ্বাস স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে হারমোনিয়ামটি কোলের ওপর টেনে নিয়ে শ্রোতৃমণ্ডলীকে মুগ্ধ করলেন গানে। সেই শেষবারের মতো শুনেছিলাম ওঁর গান। ওই সব কথা ভাবলে মনটা কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

আশির দশকের মাঝামাঝি ডাক পড়ল রেডিয়োর নাটক বিভাগ থেকে। মতি নন্দীর ফুটবল নিয়ে লেখা বিখ্যাত নাটক ‘স্টপার’ বেতারে অভিনীত হবে। নামভূমিকায় জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। সেই সময়ে সম্ভবত জগন্নাথ বসু ছিলেন নাটক বিভাগের প্রোগ্রাম একজিকিউটিভ। আমাকে ওঁরা বললেন, আরো বেশি রিয়েলিস্টিক করার জন্যে নাটকের মধ্যে আমার একটু ধারাভাষ্য চান। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। সেও এক নতুন অভিজ্ঞতা। নামী শিল্পীদের মধ্যে গলা দিতে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমিও যেন মূল নাটকের অঙ্গীভূত হয়ে গেছি।

Sukumar Samajpati
ফুটবল থেকে অবসরের পর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতই ধ্যানজ্ঞান। ছেলে সন্দীপনের সঙ্গে রেওয়াজে। ছবি সৌজন্য – bangalnama.wordpress.com

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পঁচিশে বৈশাখের সকালে রেডিয়ো এক অভিনব অনুষ্ঠান করে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষকে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ানোর। তাতে ছিলেন বিজ্ঞানী ড. পার্থ ঘোষ, আইএএস দীপক রুদ্র, অভিনেতা সন্তু মুখার্জী ও আমি। সকলেই একটা করে গান গাইলাম। আমি গেয়েছিলাম ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ গানটা। পুরো অনুষ্ঠানটাই শ্রোতাদের প্রশংসা অর্জন করেছিল। কিন্তু সেদিন সকালে আমার আসল প্রাপ্তি ছিল প্রবাদপ্রতিম রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হওয়া। আমরা যখন স্টুডিয়ো থেকে বেরোচ্ছি, হুইলচেয়ারে করে ওঁকে তখন স্টুডিয়োয় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা প্রণাম করলাম। এটা ছিল আমার জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

সম্ভবত ২০০৪ সালের ঘটনা। পয়লা বৈশাখের ভোরবেলা এক গানের আড্ডার আয়োজন হয়েছিল রেডিওর উদ্যোগে, তাতে অনেক নামী শিল্পীরা ছিলেন। যেমন, নির্মলা মিশ্র, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, চন্ডীদাস মাল, সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ, আরো কয়েকজন এবং ছিলাম আমিও। ছিল শিবাজি দাশগুপ্তও বক্তা হিসেবে। আমি আহির ভৈরব রাগের একটা বিলম্বিত বন্দিশ গেয়েছিলাম। গলাটা ছিল খুবই খারাপ। গেয়েছিলাম আরো খারাপ। মাঝখানে একটা বিরতিতে, নির্মলাদি আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। জানতাম উনি চিরকালই খুব স্পষ্টবক্তা। আমাকে হঠাৎ বললেন, সুকুমারবাবু কিছু মনে করবেন না, একটা স্কেল নামিয়ে গাইলে আপনার গানটা ভাল হত। খুবই লজ্জা পেয়েছিলাম, কিন্তু ওঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গিয়েছিল।

আকাশবাণীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের। সেই ১৯৬৩ সাল থেকে যখন চুটিয়ে ফুটবল খেলছি। এখনো মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাকেন ওঁরা। যাই, কিন্তু খুব বিমর্ষ লাগে। রেডিওর সেই রমরমা পরিবেশটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! স্মৃতির পাতা উলটে তাই প্রায়ই সেই দিনগুলোর কথা ভাবি আর মনটা চলে যায় সুদূর অতীতে, যার অনেক ঘটনার অংশীদার ছিলাম আমিও। ধারাভাষ্য, গানের অনুষ্ঠান, আলোচনায় অংশ নেওয়া, সেখানকার সব কর্মীদের সঙ্গে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব – সব মিলে মনে হত আকাশবাণী যেন এক আনন্দ নিকেতন।

*কৃতজ্ঞতা – শ্রী অভীক চট্টোপাধ্যায়, শ্রী ভবেশ দাশ ও শ্রী সন্দীপন সমাজপতি 
*উপরোক্ত নিবন্ধটি ভবেশ দাস ও প্রভাতকুমার দাস সম্পাদিত “কলকাতা বেতার” (পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, জানুয়ারি ২০১১) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল। লেখক ও সম্পাদকের অনুমতিক্রমে কিঞ্চিৎ সম্পাদনার পরে বাংলালাইভে মুদ্রিত হল। মূল নিবন্ধের বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তীত। 

সুকুমার সমাজপতি কলকাতা ময়দানের প্রখ্যাত ফুটবলার। ১৯৫৫-তে ইয়ং বেঙ্গলে ক্রীড়াজীবন শুরু। ১৯৫৯-তে যোগ দেন এরিয়ানসে। ১৯৬০-এ এক বছরের জন্য মোহনবাগানে। ৬১ থেকে পাকাপাকি ভাবে ইস্টবেঙ্গলে। ওই বছরই ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন মারডেকা কাপে। এরপর রাজ্য এবং দেশের হয়ে বহুবার খেলেছেন যার মধ্যে রয়েছে ১৯৬৪ সালের প্রি অলিম্পিক। ১৯৬৮ সালে পায়ে আঘাতের কারণে অবসর নিতে বাধ্য হন। পারিবারিক সূত্রে সঙ্গীতের নেশা ছিল গোড়া থেকেই। অবসরের পর থেকে সঙ্গীতের জগতেই বিচরণ। তালিম নিয়েছেন মানস চক্রবর্তীর কাছে। বেতারে ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার হিসেবে দীর্ঘদিন সফলভাবে কাজ করেছেন।

5 Responses

  1. বাংলা ধারাবিবরণীর জগতে একটি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও সম্মাননীয় নাম সুকুমার সমাজপতি। খেলার টেকনিক্যাল বিশ্লেষণে অনন্য তিনি, এক আশ্চর্য দক্ষতায় শ্রোতাদের মানসচক্ষে সারাটা মাঠকে তুলে ধরার নিপুণ কারিগর উচ্চাঙ্গসংগীতে কৃতী সমাজপতি।

  2. বাংলা ধারাবিবরণীর জগতে একটি সম্ভ্রান্ত ও সম্মাননীয় নাম সুকুমার সমাজপতি। খেলার টেকনিক্যাল বিশ্লেষণে অনন্য তিনি, শ্রোতাদের মানসচক্ষে সারাটা মাঠ তুলে ধরার আশ্চর্য দক্ষতার এক সুকুমার কারিগর সমাজপতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *