মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের এক বিদুষী ব্যতিক্রম। সাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি তিনি সে যুগে মহিলাদের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। এই সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক ও প্রবন্ধকারের জন্মবার্ষিকীতে বাংলালাইভের পাঠকদের তাঁর কর্মজীবন তুলে ধরলেন পীতম সেনগুপ্ত।
উনিশ শতকের শেষ দিকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের একটি দৃশ্যে চোখ রাখা যাক —
‘…তরকারি কোটার আসরে বড়ো-মাসিমা, সেজ-মাসিমা ও ছোট-মাসিমা, বড়-মামী, নতুন-মামী, ন-মামী এবং সরোজা দেবী ও সুশীলা দিদি — এই কজনের নিত্য উপস্থিতি দেখতে পেতুম। দিদিও যেতেন। আমার মা কখনো আসতেন না।… মাসিমারাই ঘরকন্নার কাজে নিযুক্ত থাকতেন। দৈবাৎ কখনো কোন উৎসবাদি উপলক্ষ ছাড়া এদিকে নামতেন না।…’
এই স্মৃতিকথা সরলা দেবী চৌধুরানীর। এখানে আলাদা করে সকলের পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন বোধ করি। বড়-মাসিমা হলেন সৌদামিনী দেবী, সেজ-মাসিমা শরৎকুমারী দেবী, ছোট-মাসিমা বর্ণকুমারী দেবী, বড়-মামী সর্বসুন্দরী দেবী, নতুন-মামী কাদম্বরী দেবী, এবং ন-মামী প্রফুল্লময়ী দেবী। সরোজা দেবী হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা, সুশীলা দেবী হলেন শরৎকুমারী দেবীর কন্যা এবং দিদি হলেন সরলা দেবীর অগ্রজা হিরন্ময়ী দেবী। মা হলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। প্রত্যেকের আলাদা করে পরিচয় দেওয়ার কারণ, সেই সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে একটা আপেক্ষিক ধারণা দেওয়া। এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে সরলা দেবীর মাতৃদেবী অর্থাৎ স্বর্ণকুমারী দেবী, ঘরকন্যার কাজের সঙ্গে কখনওই তেমনভাবে যুক্ত ছিলেন না বা হতেন না।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র-কন্যাদের খুব সচেতনভাবেই পড়াশোনা এবং গান বাজনায় উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষিত করে তোলার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এই ইতিহাস থেকেই জানা দেবেন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা, সৌদামিনী দেবীকে বেথুন ইস্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা বেশিদূর গড়ায়নি। ফলে অন্যান্য মেয়েদের তিনি আর স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেননি। বাড়িতেই তাঁদের জন্য শিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন এবং সেইভাবেই তাঁরা নিজ নিজ প্রতিভার বলে গড়ে উঠেছিলেন। তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজের উপাচার্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশী ঠাকুরবাড়ির মেয়েদেরকে পড়াতে আসতেন। অঙ্ক, সংস্কৃত, ইতিহাস, ভূগোলসহ ইংরেজি স্কুলপাঠ্য বই পড়াতেন। আর সকলের মতো স্বর্ণকুমারী দেবীও এই পাঠাভ্যাসে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকেন। এই ‘তৈরি হওয়া’টি এতটাই মজবুত ছিল যে তিনি ঠাকুর পরিবারের সেই সময়ের আর পাঁচজন নারীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
তিন সন্তানের জন্মের পর ১৮ বছর বয়সে তিনি উপন্যাস রচনায় হাত দেন। ১৮৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘দীপনির্বাণ’ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই সাহিত্য সমাজে বিপুল আলোড়ন দেখা দেয়। অতি আশ্চর্যের ব্যাপার যে, সেই সময় এই বইটিতে লেখকের নাম ছিলনা। তাই পাঠকসমাজে নানা রকম জল্পনা শুরু হয়েছিল।
ঠাকুর পরিবারের অন্তঃপুরের মেয়েদের মধ্যে তিনি যেন একটি হীরকখণ্ড। নিজের প্রতিভার দীপ্তিতে দিনকে দিন তিনি উজ্জ্বল ভাস্বর হয়ে উঠেছিলেন। উপন্যাস, কাব্য, সঙ্গীত, নাটক, ছোটগল্প, রম্যরচনা, গীতিনাট্য ও প্রবন্ধসহ, বিজ্ঞানমনস্কতা, সাংবাদিকতা, পত্রিকা সম্পাদনা, সমাজসংস্কারমূলক কাজকর্ম, সমিতি স্থাপন – প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই নিজের উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। সমকালীন স্বদেশী এবং বিদেশী বহু বিদ্বানের কাছে তিনি উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের এক বিদূষী পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাত হন। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে যায় শিক্ষিত,সমাজসচেতন যুবক, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে। ঠাকুরবাড়িতে বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীসহ বাপের বাড়িতেই থাকবার প্রথা হলেও স্বর্ণকুমারী ও জানকীনাথ তা করেননি। বিয়ের আগেই তাঁর লেখকজীবন শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পরও তা অব্যাহত ছিল। এবং এটা বলা বাহুল্য যে সাহিত্যে তাঁর প্রতিভার পূর্ণতা প্রকাশ পায় বিয়ের পর।
তিন সন্তানের জন্মের পর ১৮ বছর বয়সে তিনি উপন্যাস রচনায় হাত দেন। ১৮৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘দীপনির্বাণ’ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই সাহিত্য সমাজে বিপুল আলোড়ন দেখা দেয়। অতি আশ্চর্যের ব্যাপার যে, সেই সময় এই বইটিতে লেখকের নাম ছিলনা। তাই পাঠকসমাজে নানা রকম জল্পনা শুরু হয়েছিল। কার লেখা বই এই নিয়ে অনেকেই কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি ঠাকুরবাড়ির প্রভাবশালী ব্যক্তি স্বর্ণকুমারীর মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ বিলেতে বসে যখন এই বইটি হাতে পান তখন তিনিও উপন্যাসটি জ্যোতিরিন্দ্রের রচনা ভেবে তাঁকে একটি অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছিলেন – ‘জ্যোতির জ্যোতি কি প্রচ্ছন্ন থাকিতে পারে?’ তবে ‘সাধারণী’ কাগজে এই উপন্যাসের প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল, ‘… শুনিয়াছি এখানি কোন সম্ভ্রান্তবংশীয়া মহিলার লেখা। আহ্লাদের কথা। স্ত্রীলোকের এরূপ পড়াশোনা, এরূপ রচনা, সহৃদয়তা, এরূপ লেখার ভঙ্গি বঙ্গদেশ বলিয়া নয় অপর সভ্যতর দেশেও অল্প দেখিতে পাওয়া যায়।…’

তাঁর সাহিত্য চর্চার ব্যাপারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘… জানকী বিলাত যাইবার সময়, আমার কনিষ্ঠা ভগিনী শরৎকুমারী আমাদের বাড়িতে বাস করিতে আসায়, সাহিত্যচর্চায় আমরা তাঁহাকেও আমাদের একজন যোগ্য সঙ্গীরূপে পাইলাম।…’ এইসময় স্বর্ণকুমারী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরে গান তৈরি করতেন। এর ফলস্বরূপ তাঁর পরবর্তী উপন্যাস ‘ছিন্নমুকুল’-এ একটি গান পাওয়া গেল, যে গানের আদলে রবীন্দ্রনাথ ‘কালমৃগয়া’য় ‘ঝমঝম ঘন ঘন রে বরষে’ এবং ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’য় ‘রিমঝিম ঘন ঘন রে’ গান রচনা করেছিলেন।
স্বর্ণকুমারীর তেরোটি উপন্যাস, চারটি নাটক,গীতিনাট্য ‘বসন্ত-উৎসব’ ছাড়াও বিজ্ঞানবিষয়ক সাতাশটি প্রবন্ধের সংকলন ‘পৃথিবী’ উল্লেখযোগ্য কীর্তি। লেখক থেকে সম্পাদকে উত্তীর্ণ হতেও বেশি সময় লাগেনি তাঁর। একসময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাদম্বরী দেবীকৃত, ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার নিয়েছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। সেটা ১৮৮৫ সাল। খেপে খেপে মোট
তিনবার তাঁকে সম্পাদক হতে হয়েছিল। প্রথমবার এগার বছরের জন্য। পরের বার ১৯০৯ থেকে আরও আট বছর এবং শেষে ১৯২৬ থেকে আরও দুবছর, সর্বমোট ২১ বছর, তাঁর সম্পাদনায় সমৃদ্ধ হয়েছিল, ‘ভারতী’ পারিবারিক সাহিত্যপত্রিকাটি। এছাড়া
শৈশবে বিজ্ঞানের পাঠ শুরু হয়েছিল যাঁর কাছে, সেই মহর্ষি পিতাকেই নিজের লেখা বিজ্ঞান প্রবন্ধের বইটি উৎসর্গ করেছিলেন। এমন পিতৃঋণ শোধ সকলকে প্রাণিত করে।
তাঁর আর এক মৌলিক কাজ হল বাংলায় বিজ্ঞানের পারিভাষিক শব্দ তৈরি করা। বিজ্ঞানবিষয়ক-প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে দেখলেন বিজ্ঞান বিষয়ের প্রবন্ধ ও আবিষ্কারের বিষয়গুলিতে লিখিত ইংরেজি শব্দগুলিকে বোঝাবার জন্য সাধারণের সহজবোধ্য বাংলা শব্দের অর্থাৎ পরিভাষার একান্ত অভাব। সুন্দর, শ্রুতিনন্দন এবং যথোপযুক্ত বাংলা শব্দচয়ন বা নতুন পরিভাষা সৃষ্টি করে তিনি ‘বিজ্ঞানের পরিভাষা’র এক উল্লেখযোগ্য ভাণ্ডার গড়ে তুললেন।
বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ লেখা শুরুর আগে তাঁর শিক্ষা মজবুত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিজ্ঞান-রহস্য’ অধ্যয়ন করে। এর সঙ্গে দেশে-বিদেশের বড় বড় বিজ্ঞানীদের ইংরেজিতে লেখা বিজ্ঞানের নানা বিষয়ক প্রবন্ধও তিনি নিবিড়ভাবে পাঠ করেন। তারপর নিজেই লিখতে শুরু করলেন সে জাতীয় লেখা। প্রথমে সাতটি প্রবন্ধ ভূবিজ্ঞান বিষয়ে। বলা যায়, তিনি এইভাবে বাংলার মেয়েদের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার সূচনা ঘটিয়ে দিলেন।
ঐতিহাসিকরা বলেন, তাঁর আর এক মৌলিক কাজ হল বাংলায় বিজ্ঞানের পারিভাষিক শব্দ তৈরি করা। বিজ্ঞানবিষয়ক-প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে দেখলেন বিজ্ঞান বিষয়ের প্রবন্ধ ও আবিষ্কারের বিষয়গুলিতে লিখিত ইংরেজি শব্দগুলিকে বোঝাবার জন্য সাধারণের সহজবোধ্য বাংলা শব্দের অর্থাৎ পরিভাষার একান্ত অভাব। সুন্দর, শ্রুতিনন্দন এবং যথোপযুক্ত বাংলা শব্দচয়ন বা নতুন পরিভাষা সৃষ্টি করে তিনি ‘বিজ্ঞানের পরিভাষা’র এক উল্লেখযোগ্য ভাণ্ডার গড়ে তুললেন। এই পরিভাষার সৃষ্টি হওয়াতে সেইসময়ে এবং পরবর্তীতে অনেক বিজ্ঞানবিষয়ক বই বা প্রবন্ধ বাংলাভাষাতে অনুবাদের কাজ শুধু সহজ নয়, সহজবোধ্যও হয়ে উঠেছিল।
এছাড়া তাঁর আরএকটি পরিচয় মেলে সমাজের অবহেলিত বা সম্বলহীন মেয়েদের জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য। সহায় সম্বলহীন, লেখাপড়া না জানা কুমারী মেয়েদের আর বিধবা মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে ১৮৯৬ সালে তাঁর উদ্যোগে আর পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সখি সমিতি’। তাঁদের দিয়েই বিভিন্ন বাড়ির অন্তঃপুরের মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর চাকরি দিয়ে স্বনির্ভর করে তোলা হত। এঁদের থাকা খাওয়ার সব দায়িত্ব নিত ‘সখি সমিতি’।

পাশাপাশি অনাথ শিশুদেরও আশ্রয় আর শিক্ষার ব্যবস্থা করে তাঁদের মানুষ করে তোলার কাজ করতে সমিতি। কিন্তু ব্যয়সাপেক্ষ এই সমস্ত কাজ প্রথমদিকে সমিতির সদস্যাদের আর্থিক অনুদান ও সাহায্যে চলত। চাঁদা ছিল মাসিক মাত্র এক টাকা। ক্রমে কাজের পরিসর বাড়ায় অর্থসংকট দেখা দিল। টাকা জোগাড়ের জন্য স্বর্ণকুমারী তখন নতুন পরিকল্পনা করলেন। হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন তিনি। সমিতির কাজের জন্য অর্থ রোজগার, সেইসঙ্গে মেয়েদের হাতের কাজকে প্রকাশ্যে এনে সে কাজকে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়া ও তাঁদের পরিশ্রমের অর্থমূল্য দেওয়া, সেই ছিল প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য। এই দূরদর্শিতার মধ্য দিয়েই এদেশের বুকে ‘শিল্পমেলা’র বীজ বপণ হয়েছিল, যা আজও আমরা শহর এবং শহরতলীতে দেখতে পাই।
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।
সম্বৃদ্ধ হলাম।