সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন দুনিয়া-কাঁপানো ‘টম এন্ড জেরি’ অ্যানিমেশন সিরিজের পরিচালক জিন ডায়েচ। আমরা যারা ছোট থেকে এই দুষ্টু বিড়াল আর তার সঙ্গী মিষ্টি ইঁদুর এর খুনসুটি দেখে বড়ো হয়েছি, তারা প্রায় সবাই জানি যে এর নির্মাতা ছিলেন উইলিয়াম হানা ও জোসেফ বারবারা। তাহলে এই জিন ডায়েচ কে? কেনই বা তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ দেশবিদেশের অগণিত অ্যানিমেশন-প্রেমী? আসুন একবার চোখ বোলানো যাক তাঁর তৈরি অ্যানিমেশন চরিত্রদের দিকে, যাদের বিচিত্র কাণ্ডকারখানায় এক কালে মজেছিল কচিকাঁচা থেকে বড়োরাও!
আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত মার্কিন-চেক অ্যানিমেশন শিল্পী জিন ডায়েচ এর জন্ম ১৯২৮ সালের ৮ আগস্ট আমেরিকার শিকাগো শহরে। আসল নাম ইউজিন মেরিল ডায়েচ। বাবা ছিলেন সেলসম্যান। রুজি রোজগারের চেষ্টাতেই পরিবার নিয়ে একসময়ে চলে আসেন ক্যালিফর্নিয়ায়। জিন-এর বয়স তখন মাত্র পাঁচ। এই শহরেই তাঁর পড়াশুনো ও বড় হয়ে ওঠা। আশ্চর্যের বিষয় হল, পরবর্তীকালে যে অ্যানিমেশন তাঁকে দিয়েছে যাবতীয় যশ, খ্যাতি ও ভালোবাসা, আদৌ তাঁর সেই পেশায় আসার কথা ছিল না। সেটা ঘটে যায় কিছুটা আকস্মিক ভাবেই। গোড়ার দিকে মার্কিন এভিয়েশন-এর হয়ে এরোপ্লেনের নকশা তৈরি করতেন জিন। যোগ দেন পাইলট প্রশিক্ষণেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডাক পান মার্কিন বায়ুসেনাতে। কিন্তু বিধি বাম। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তাঁকে কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সুস্থ হওয়ার পর শুরু হয় নতুন করে চাকরি খোঁজার পালা।

ছবিটা জিন বরাবরই ভালো আঁকতেন। প্রভাবিত হয়েছিলেন জিম ফ্লোরা ও ওয়াল্ট ডিজনির কাজ দেখে। ১৯৪০ থেকে আঁকতে লাগলেন জনপ্রিয় জ্যাজ় পত্রিকা ‘দ্য রেকর্ড চেঞ্জার’-এর প্রচ্ছদ। এই পত্রিকাতেই প্রকাশ পায় তাঁর আঁকা প্রথম গ্যাগ কার্টুন ‘দ্য ক্যাট’। যদিও এই ‘ক্যাট’ আক্ষরিক অর্থে বিড়াল নয়, বরং চরিত্রটা ছিল এক পাগলাটে রেকর্ড সংগ্রাহকের। জিনের এই সময়ের কার্টুনগুলো জ্যাজ় প্রেমীদের কাছে কৌতুকের উদ্রেক করে। পরবর্তীকালে সেগুলোর একটা সংকলন বই আকারে প্রকাশ করে ফ্যান্টাগ্রাফিক্স। নাম দেয় ‘দ্য ক্যাট অন আ হট থিন গ্রুভ।’

তাঁর আঁকা এই ভিন্নধারার অলংকরণই জিনকে নিয়ে এল অ্যানিমেশনের জগতে । ১৯৫৫ সালে ইউনাইটেড প্রোডাকশনস অফ আমেরিকা (UPA)-তে কাজ শুরু করেন শিক্ষানবিশ হিসেবে। খুব তাড়াতাড়ি সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসেন পরিচালকের ভূমিকায়। ইউপিএ স্টুডিও পঞ্চাশের দশকে অ্যানিমেশন নিয়ে প্রচলিত অনেক ধ্যানধারণা বদলে দিয়েছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে হলিউডের বহু তাবড় তাবড় কার্টুন স্টুডিও একে একে বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। নামী অ্যানিমেশন সংস্থাগুলো বাজেটের অভাবে ছোট পর্দা অর্থাৎ টিভি সিরিজ-এ মনোনিবেশ করতে শুরু করল। এর মধ্যে ইউপিএ-ই সার্থক ভাবে দেখিয়ে দিল অনেক কম খরচেও কিভাবে অ্যানিমেশন বানানো সম্ভব। এখানে থাকাকালীন জিনের পরিচালনায় প্রথম সিরিজ ‘হাউডি ডুডি অ্যান্ড হিজ ম্যাজিক হ্যাট’ মাঝপথেই বাতিল হয়ে যায়। সেটা আর কখনওই দিনের আলো দেখেনি। তৈরি হয়ে যাওয়া প্রিন্টগুলোও নষ্ট করে ফেলা হয়। তাই জিন ডায়েচ এর করা প্রথম অ্যানিমেশনের আজ আর কোনও অস্তিত্বই নেই ।
তবে শুধু অ্যানিমেশনই নয়, ইউপিএ-তে কাজ করার সময় ডায়েচ একটি সংবাদপত্রের জন্য তৈরি করেছিলেন ‘রিয়েল গ্রেট অ্যাডভেঞ্চারস অফ টেরিবল থম্পসন’ নামে একটি কমিক্স স্ট্রিপ। সাত বছরের ছোট্ট শিশু থম্পসন আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ এক শিশু হলেও সে মাঝে মাঝেই সময়ের সারণি বেয়ে পৌঁছে যায় ইতিহাসের নানান অধ্যায়ে! দেখা হয়ে যায় ক্লিওপেট্রা বা নেপোলিয়ন এর মতো চরিত্রদের সঙ্গে! ‘টেরিবল থম্পসন’-এর প্রথম কমিকস্ট্রিপ প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালের ১ অক্টোবর। তবে ডায়েচ-এর পক্ষে তখন অ্যানিমেশনের কাজের পাশাপাশি কমিক্স আঁকার সময় বার করতে অসুবিধে হচ্ছিল। তাই মাত্র কয়েক পর্বের পরই তিনি তাঁর সহকর্মী রুবি ডেভিডসনকে লেখার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে অনুরোধ করেন। প্রায় এক বছর দু’জনে মিলে এই কমিক্স চালানোর পর বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন, কারণ ততদিনে জিনের কাছে চলে এসেছে আমেরিকার বিখ্যাত অ্যানিমেশন ষ্টুডিও টেরিটুনস-এর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর পদে যোগ দেওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব!

টেরিটুনস তখন আমেরিকার সব চেয়ে পুরনো অ্যানিমেশন স্টুডিও যারা ১৯১৯ থেকে একটানা অ্যানিমেশন সিরিজ বানিয়ে আসছে। ‘ফারমার আলফালফা’, ‘মাইটি হাউজ’ বা ‘হেকল অ্যান্ড জেকল’-এর মতো মজাদার সব চরিত্র খুদে দর্শকদের উপহার দিলেও তারা সে সময় ভালো প্লট এর অভাবে ধুঁকছে। এই সময় স্টুডিওটি অধিগ্রহণ করে CBS। তারাই জিনকে নিয়ে আসে দর্শকদের নতুন কিছু দেওয়ার জন্য। আর জিন দায়িত্ব নেওয়ার পর গতানুগতিক সিরিজগুলো থেকে সরে এসে নিয়ে এলেন একদম আনকোরা সব চরিত্রদের। নতুনত্বের ছোঁয়া আনলেন গল্প বলার পদ্ধতিতেও। এমনই এক চরিত্র ‘সিডনি দ্য এলিফ্যান্ট।’ সিডনি আসলে ৪৪ বছরের এক পূর্ণবয়স্ক হাতি, যার মনটা থেকে গেছে শিশুর মতোই সরল। জঙ্গলের জীবনযাত্রায় যে যারপরনাই বিরক্ত। জিনের যৌথ প্রযোজনায় তৈরি ‘সিডনি’জ় ফ্যামিলি ট্রি’ ১৯৫৮ সালে সেরা অ্যানিমেটেড শর্টফিল্ম হিসেবে অস্কারের জন্য মনোনীত হয় । কিন্তু শেষমেশ ভাগ্যে শিকে ছেড়েনি। এরপর তাঁর নিজের তৈরী ‘টেরিবল থম্পসন’-এর অনুকরণে জিন তৈরি করলেন ‘টম টেরিফিক’।
তবে বেশিদিন কিন্তু টেরিটুনস এ থাকা হলো না জিনের। তাঁর তৈরি সিরিজগুলো দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে পারছে না বলে অভিযোগ তুললেন স্টুডিও কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু তাঁর কাজকম্মের পদ্ধতিও তাঁদের পছন্দ হচ্ছিল না। ফলে ১৯৫৮-তেই স্টুডিও কর্তৃপক্ষ জিনকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর জিন চলে যাবার পর তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোও একে একে হারিয়ে গেলো টিভির পর্দা থেকে। একমাত্র ব্যাতিক্রম ছিল ‘সিডনি দ্য এলিফ্যান্ট’, যা চলেছিল একটানা প্রায় ৬ বছর।

ঠিক এর পরের বছর, ১৯৫৯-এ উইলিয়াম স্নাইডার-এর রেমব্রান্ট ফিল্মস এর তত্ত্বাবধানে জিন তৈরি করলেন নিজের স্টুডিও ‘জিন ডায়েচ এসোসিয়েটস ইনকর্পোরেটেড’। এই রেমব্রান্ট ফিল্মস ছিল পূর্ব ইউরোপের অ্যানিমেশনের অন্যতম প্রধান ডিস্ট্রিবিউটর। তাদের সদর দফতর চেক রিপাবলিক-এর (তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়া) রাজধানী প্রাগ শহরে। কাজেই তাদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার জন্য জিনকে সেখানে যেতে অনুরোধ করা হল। কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে প্রাগ-এ যেতে মোটেই উৎসাহী ছিলেন না জিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় সমগ্র পূর্ব ইউরোপ ছিল নাৎসি বাহিনীর দখলে। প্রাগে অবশ্য তখন কমিউনিস্ট শাসন চলছে। হাজারও বিধিনিষেধ। এমতাবস্থায় কে-ই বা পশ্চিমি দেশের আরামের জীবন ছেড়ে সে দেশে যেতে চাইবে? কিন্তু স্নাইডারও ছাড়বার পাত্র নন। অনেক ঝোলাঝুলি কাকুতি মিনতি করে জিনকে ১০ দিনের জন্য প্রাগ-এ যেতে রাজি করলেন। আর যাওয়ার পরেই সে দেশের প্রেমে পড়ে গেলেন জিন। ইউরোপের নিসর্গ, ইতিহাস, প্রাণশক্তি তাঁকে মুগ্ধ করে ফেলল।
তবে অন্য একটা কারণও অবশ্য ছিল। এখানেই জিনের আলাপ হয় অ্যানিমেশন শিল্পী জ়েডেঙ্কা নিউমানোভ এর সঙ্গে। শেষে তাঁকে বিয়ে করে পাকাপাকিভাবে প্রাগ-এই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জিন। আর এই শহরই এরপর ঘুরিয়ে দিয়ে গেল তাঁর জীবনের মোড়।

১৯৬১ সালে জুল ফিফা-র ছোটগল্প অবলম্বনে জিন তৈরী করলেন আট মিনিটের ছবি ‘মানরো’।
মানরো এক চার বছরের শিশু, যাকে ভুলবশতঃ সেনাবাহিনীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে যতই বোঝানোর চেষ্টা করে সে মোটেই প্রাপ্ত বয়স্ক নয়, সদাব্যস্ত সৈনিকদের সে সব শোনার সময় কোথায়? শেষে গত্যান্তর না দেখে মানরোকে তাদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে যুদ্ধে যেতে হয়। নিউ ইয়র্ক শহরে ‘মানরো’ র প্রিমিয়ার হয় অঁদ্রে হেপবার্নের বিখ্যাত ছবি ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’জ’ এর আগে। আর সেই বছরেই সেরা স্বল্প দৈর্ঘ্যের অ্যানিমেশনের জন্য অস্কার মিলে যায় ‘মুনরো’র ভাগ্যে। আমেরিকার বাইরে সেই প্রথম কেউ অস্কার পেল।

এই রেমব্রান্ট ফিল্মস-এর সঙ্গেই যৌথ ভাবে ‘কিং ফিচারস’-এর প্রযোজনায় ১৯৬০ থেকে ৬২-র মধ্যে জিন তৈরী করেন ই সি সেগার-এর বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র ‘পপ-আই’ এর প্রথম টিভি এপিসোড। যদিও এর আগেই এই প্রভূত শক্তিশালী শাকাহারী নাবিককে পর্দায় এনেছিল প্যারামাউন্ট কার্টুন স্টুডিও। টিভি সিরিজে টাকাপয়সার প্রতিবন্ধকতা থাকলেও জিনের অ্যানিমেশনের স্টোরিলাইন ছিল টানটান। প্রায় একই সময় ঘটে যায় আর একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ‘মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার’-এর কার্টুন স্টুডিও বন্ধ হয়ে গেলে তারাও তাদের বিখ্যাত ‘টম অ্যান্ড জেরি’ ফ্র্যাঞ্চাইজি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত উত্তরসূরি খুঁজতে শুরু করে। অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে শেষে রেমব্রান্ট ফিল্মস-এর সঙ্গে চুক্তি করে এমজিএম। ‘টম অ্যান্ড জেরি’ তখনই সারা বিশ্বে ব্যাপক ভাবে সাড়াজাগানো সিরিজ। এমজিএম-এর হয়ে হানা-বারবারার তৈরি আগের ১১৪টি এপিসোড প্রায় এপিক পর্যায়ে চলে গিয়েছে। তাকে নতুন ভাবে ফিরিয়ে আনা কি চাট্টিখানি কথা? জিন কিন্তু পিছপা হলেন না। চ্যালেঞ্জটা নিলেন এবং তৈরি করলেন নতুন ১৩ এপিসোড। প্রতিক্রিয়া হল দু’মুখো। প্রিয় চরিত্রদের ফিরে পেয়ে একদিকে যেমন উচ্ছসিত হলেন ভক্তকুল, পাশাপাশি ধেয়ে এল সমালোচনার ঝড়ও। অনেকের মতেই জিনের তৈরি পর্বগুলো ‘টম অ্যান্ড জেরি’ ফ্র্যাঞ্চাইজি র সবচেয়ে দুর্বল চিত্রায়ণ।
তাহলে কি টম অ্যান্ড জেরির বাইরে জিনের আর কোনও পরিচয়ই নেই? একদমই নয়। জিন ডায়েচকে চিনতে হলে, দেখতে হবে ছোটদের গল্পের আধারে তৈরি তাঁর অনন্যসুন্দর সব কাজ। পূর্ব ইউরোপের অ্যানিমেশন বরাবরই স্বতন্ত্র। পাশ্চাত্যের বাণিজ্যিক অ্যানিমেশনের তুলনায় এগুলো অনেকটাই স্নিগ্ধ ও দৃষ্টিনন্দন। গল্পগুলোকে তাঁর নিজস্ব ছোঁয়ায় অনায়াসেই জিন নিয়ে যেতে পারতেন এক অন্য উচ্চতায়। কাজ করেছেন বহু শিল্পীর সাথে। ১৯৬৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ওয়েস্টন উডস স্টুডিও-র অ্যানিমেশন পরিচালক থাকার সময় ছোটদের ৩৭টি গল্পের সার্থক রূপ দিয়েছিলেন অ্যানিমেশনের পর্দায়।
বিখ্যাত শিল্পী কোয়েন্টিন ব্লেক-এর গল্প ‘প্যাট্রিক’-এর কথাই ধরা যাক! অলস দিনে ঘুরতে ঘুরতে প্যাট্রিক এক যাযাবরদের দোকানে পেয়ে যায় একটা পুরনো বেহালা। তার ছড়ে টান দিতেই সুরে যেন সমস্ত প্রকৃতি নেচে ওঠে! শোনা যায়, প্যাট্রিকের ছবি আঁকার জন্য কোয়েন্টিন নাকি তাঁর নিজের প্যাস্টেলের বাক্স পাঠিয়ে দেন জিনকে, যাতে পর্দাতেও ব্লেকের আঁকার সেই অননুকরণীয় স্টাইল ফুটে ওঠে। নির্বাক এই ছবির শব্দ বলতে শুধু বেহালার সুর, যা নিয়ে অপরূপ এক মন্তাজ বানিয়েছিলেন স্বয়ং জিন। দু’জনের মেলবন্ধনের সার্থক সৃষ্টি এই মিষ্টি ছবিটি।
নিজের ওপর বানানো তথ্যচিত্র ‘দ্য পিকচার বুক অ্যানিমেটেড’-এ জিন খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর কাজের প্রধান সুরটা। তাঁর বক্তব্য, ছোটদের অ্যানিমেশন যদি কোনও গল্পের ছবির ফিল্মিরূপ হয়, তার জন্য কী ভাবে কত রকমের প্রস্তুতি নিতে হয়। যেমন জিন কখনও ব্যবহার করেছেন কাগজের পুতুল, আবার কখনও ছেলেমানুষি অলংকরণ!
তাঁর ছবিগুলোতে উঠে এসেছে সাবেক ইউরোপিয়ান কার্টুন আর্টের ঘরানা। ফ্রেম বাই ফ্রেম ক্লাসিকাল অ্যানিমেশনের যান্ত্রিক পদ্ধতিতেও প্রায়শই পাওয়া যেত তাঁর উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয়। আবহ সংগীত ও শব্দচয়নে ছিল অনুপুঙ্খ চিন্তাভাবনার ছাপ। ঘরোয়া জিনিসপত্রের আওয়াজ থেকে কোথায় কোন বাদ্যযন্ত্র কী ভাবে ব্যবহার করা যায়, তাই নিয়ে নিরন্তর করে গিয়েছেন নানান পরীক্ষানিরীক্ষা।

টম অ্যান্ড জেরি ছাড়াও বিড়াল ইঁদুরের ধুন্ধুমার নিয়ে বানিয়েছিলেন ‘ক্রেজি ক্যাট’। অন্যান্য কাজের মধ্যে ‘নাডনিক’, ‘দ্য ব্ল্যাফারস’, ‘অ্যালিস অফ ওয়ান্ডারল্যান্ড ইন প্যারিস’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ২০০৩ সালে জিনকে তাঁর সারাজীবনের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘উইনসর ম্যাককে’ পুরস্কার দেয় অ্যানিমেশন ছবির অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক সংস্থা ASIFA।

জিন তাঁর আত্মজীবনী ‘ইন লাভ অফ প্রাগ’-এ লিখেছেন ৩০ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের বজ্রআঁটুনির মধ্যে দিয়ে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ডিঙিয়ে একজন মার্কিন নাগরিক হিসেবে কী ভাবে তিনি আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে নিয়ে আসতেন প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও টাকাপয়সা। ৯৫ বছর বয়েসেও শারীরিক অক্ষমতাকে হেলায় হারিয়ে অ্যানিমেশন নিয়ে একটি বই লিখতে শুরু করেছিলেন, যা তাঁর মৃত্যুতে অসমাপ্ত থেকে গেল। যে শহরকে একদিন ভালোবেসে থেকে গিয়েছিলেন, সেই প্রাগে নিজের বাড়িতেই গত ১৬ এপ্রিল জিন চলে গেলেন ফিরে না-আসার দেশে। রেখে গেলেন তাঁর তৈরি করা অজস্র ছোটদের ছবি, যা দেখে হয়তো মুগ্ধ হবে আগামী আরও কত প্রজন্মের শৈশব!
কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা বিবেক পেশাগত ভাবে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। কিন্তু নেশায় আদ্যন্ত কার্টুনিস্ট এবং পর্যটক। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালিখির অভ্যাস ও সম্পাদনা। তাঁর লেখা তিনটি বইও ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। খেলাধুলোয় তাঁর উৎসাহের কথা বেরিয়ে এসেছে সেই বইয়ের মাধ্যমেই। দ্য আমেজিং অলিম্পিকস: ডাউন দ্য সেঞ্চুরিজ়, দ্য ওয়র্ল্ড চেজ়িং দ্য কাপ এবং ফুটবল ফান বুক পাঠকমহলে খুবই সমাদৃত হয়েছে। বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান কার্টুন গ্যালারিতে তাঁর কার্টুন নিয়ে একক প্রদর্শনীও হয়েছে।