ভোজন-রসিক বাঙালির মিষ্টান্ন-প্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। শীত পড়ল কী পড়ল না, এই বঙ্গভূমিতে পিঠে-পার্বণের পালা শুরু। পিঠের প্রতি বাঙালির এই আকর্ষণ কিন্তু আজকের নয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে শুরু করে, মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যচরিতামৃত সর্বত্রই পিঠের জয়জয়কার। কৃত্তিবাসের রামায়ণে জনক ভূপতি কন্যার বিবাহে অতিথিদের জন্য যা যা আহার্যের ব্যবস্থা করেছেন, তার মধ্যে ‘পরমান্ন পিষ্টকাদি’র উল্লেখ  মেলে। পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে বিজয়গুপ্ত রচিত মনসামঙ্গলকাব্যে বণিকসুন্দরী যে বিশাল রন্ধন-কাণ্ড সম্পন্ন করেছিলেন, তার মধ্যেও নানা প্রকারের পিঠের উল্লেখ অবশ্যই ছিল। “মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস/দুই তিন প্রকারের পিষ্টক পায়স/দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ/ রন্ধন করিয়া হৈল হরষিত মন।”

১৫৭৫-এ মনসামঙ্গল কাব্যে দ্বিজ বংশীদাসের লেখাতে সনকার রান্না করা স্বাদু সব পদের মধ্যেও পিঠে বাদ  যায়নি। “কত যত ব্যঞ্জন যে নাহি লেখা জোখা/ পরমান্ন পিষ্টক যে রান্ধিছে সনকা/ ঘৃত পোয়া চন্দ্রকাইট আর দুগ্ধপুলি/ আইল বড়া ভাজিলেক ঘৃতের মিশালি/। জাতি পুলি ক্ষীর পুলি চিতলোটি আর/ মনোহরা রান্ধিলেক অনেক প্রকার।” ষোড়শ শতাব্দীতের রাঢ়দেশের কবি কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর গ্রন্থে খুল্লনা চণ্ডীদেবীর আশির্বাদ লাভ করে স্বামীর তৃপ্তির উদ্দেশ্যে সর্বমঙ্গলা স্মরণ করে যা যা রেঁধেছিলেন তার মধ্যেও পিঠার উল্লেখ আছে। “কলা বড়া মুগ সাউলি ক্ষীরমোন্না ক্ষীরপুলি/ নানা পিঠা রান্ধে অবশেষে।”

চৈতন্যের জীবনীকার জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গলে’ পিঠেপুলির উল্লেখ কিছু কম নেই। নিমাইয়ের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর বিবাহের পরে নববধূ প্রথমদিন রান্নাঘরে ঢুকেছেন। শাশুড়িমাতাও তাঁকে অনুসরণ করেছেন। মনে শঙ্কা, কী জানি বধূমাতা কেমন ধারা রান্না করেন! রন্ধনপটিয়সী লক্ষ্মীদেবী কী রেঁধেছিলেন সেদিন? “পঞ্চাশ ব্যঞ্জন অন্ন রাঁধিল কৌতুকে/ পিষ্টক পায়স অন্ন রান্ধিল একে একে।” বিভিন্ন জীবনীকারের লেখা চৈতন্যদেবের জীবনীগ্রন্থে বারবার দেখা গেছে মহাপ্রভুর জন্য ভক্তবৃন্দ যাই রান্না করুন না কেন, তার মধ্যে পিঠেপুলি থাকবেই। কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাসগ্রহণের শেষে শ্রীচৈতন্য ঈশ্বরপ্রেমে বিহ্বল অবস্থায় তিনদিন অনাহারে ছিলেন। পরিশেষে গঙ্গা পার হয়ে তিনি শান্তিপুরে অদ্বৈত ভবনে আসেন। সেখানে উপবাস ভঙ্গের সময় প্রভুর জন্য ভক্তরা যে নানাবিধ নিরামিষ ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেছিলেন তার মধ্যে ছিল- “মুদগ বড়া, মাস বড়া কলা বড়া মিষ্ট/ ক্ষীর পুলি নারিকেল পুলি পিঠা ইষ্ট।”

প্রাচীন পালাগান মৈমনসিংহ গীতিকায় যুক্ত একমাত্র রূপকথা ‘কাজল রেখা’-তেও পিঠেপুলির উল্লেখ মেলে। যেমন “নানা জাতি পিঠা করে গন্ধে আমোদিত/ চন্দ্রপুলি করে কন্যা চন্দ্রে আকিরত/ চই চপরি পোয়া সুরস রসাল/তা দিয়া সাজাইল কন্যা সুবর্ণের থাল/ক্ষীর পুলি করে কন্যা ক্ষীরেতে ভরিয়া/ রসাল করিল তায় চিনির ভাজ দিয়া।”

মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলিকে বাঙালির “খাওয়াদাওয়ার খবরের ভাঁড়ার” আখ্যা দিয়েছেন বহু রসিকজন। এই সব কাব্যতে সেযুগের সর্বস্তরের মানুষের ভোজনবিলাসের চিত্রের পাশাপাশি আমরা পাই এক সমাজ সচেতনার কথা। আশ্চর্য লাগে যখন দেখি অষ্টাদশ শতকে ঘনরাম রচিত ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্য গ্রন্থে কবি সস্নেহে বারবনিতাদের রন্ধন-পারদর্শিতার দীর্ঘ বর্ণনা দিচ্ছেন। বারবণিতা বলে কবি তাঁদের অপাংক্তেয় করে রাখেননি। সেখানেও নিরামিষ আমিষ ব্যঞ্জনের শেষে তাঁদের হাতে প্রস্তুত পিঠেপুলির বর্ণনা দিয়েছেন,”উড়ি চেলে গুঁড়ি কুটি সাজাইল পিঠা/ক্ষীর খণ্ড ছানা ননী পুর দিয়া মিঠা।”

ঊনবিংশ শতকের প্রখ্যাত কবি ও সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর খাদ্যপ্রীতির কথা সাহিত্যপ্রেমী বাঙালির অজানা নয়। কবি নিজে যেমন ভোজনরসিক ছিলেন তেমনি অন্যকে খাইয়ে তাঁর সুখ কিছু কম ছিল না। শোনা যায় পিঠেপার্বণের দিনে তাঁর গৃহে অতিথিদের আসার বিরাম থাকত না। গুপ্ত কবির ‘পৌষ পার্বণে’ কবিতায়  পিঠে পার্বণের এক সরস বর্ণনা পাই। “আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর/ গড়িতেছে পিঠেপুলি অশেষ প্রকার/বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ, কুটুমের মেলা/ হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা।” স্বামীদেবতাকে পিঠে খাওয়াতে স্ত্রীর আকুলতার বর্ণনা দিতে কবি লিখলেন, “কামিনী যামিনীযোগে শয়নের ঘরে/ স্বামীর খাবার দ্রব্য আয়োজন করে/ আদরে খাওয়াবে সব মনে সাধ আছে/ ঘেঁসে ঘেঁসে বসে গিয়া আসনের কাছে/ মাথা খাও, খাও বলি পাতে দেয় পিটে/ না খাইলে বাঁকামুখে পিটে দেয় পিটে।”

আর কী কী ছিল সেই পিঠের তালিকায়? “এই মুগের ভাজা পুলি মুগ্ধ করে মুখ/ বাসি খাও, ভাজা খাও, কত তার সুখ।” আর কিভাবে সেই পিঠে প্রস্তুতি পর্বের আয়োজন চলেছিল তার বর্ণনা পাই, কবি যখন  লেখেন, “তাজা তাজা ভাজা পুলি, ভেজে ভেজে তোলে/ সারি সারি হাঁড়ি হাঁড়ি কাঁড়ি করে তোলে/ কেহ বা পিটুলি মাখে কেহ কাঁই গোলে।”

এই পিঠেপুলির প্রতি বাঙালির তীব্র আকর্ষণ আজও অব্যাহত। পঞ্চাশের দশকে তখনও যৌথপরিবারে ভাঙন সেভাবে ধরেনি। সেই সময়ে পিঠে পার্বণ পালিত হত জমকালো ভাবে। কল্যাণী দত্ত তাঁর ‘থোড় বড়ি খাড়া’ গ্রন্থে যথার্থই লিখেছেন, “উৎসবের সেই  দিনগুলিতে মেয়েদের চুল বাঁধার সময় পর্যন্ত থাকত না। সদ্য সদ্য বঙ্গদেশ ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়েছে। জন্মভূমি ছেড়ে এসে এই কলকাতার ভাড়া বাড়িতে তখন আমাদের বাস। বাবা, কাকা, পিসি সবাই মিলে যুদ্ধ চালাচ্ছেন নতুন করে সব কিছু শুরু করতে। তারই মধ্যে আমার মা, ঠাকুমা তাঁদের ছেড়ে আসা জন্মভূমিতে পালিত আচার অনুষ্ঠান তাঁদের পুঁজি অনু্যায়ী, ইটকাঠে গড়া এই শহরেও বজায় রেখেছেন। আগেকার মতোই আমাদের কলকাতার বাড়িতে শীতের উৎসব শুরু হত নবান্ন দিয়ে। শুনেছি অঘ্রাণে নতুন ধান উঠলে, দেশের বাড়িতে আমার ঠাকুরমা নাকি প্রথা মেনে ঢেঁকিবৌদের সঙ্গে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান ভেনে চালের গুঁড়ি দিয়ে পিঠে তৈরি করতেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে ‘পথের পাঁচালি’র ইন্দির ঠাকরুণের কথা- “পৌষ-পার্বণের দিন ঐ ঢেঁকিশালে একমণ চাল কোটা হইত-পৌষ-পিঠার জন্য- চোখ বুজিয়া ভাবিলেই ইন্দির ঠাকরুণ সেসব এখনও দেখিতে পায় যে!” কলকাতার বাড়িতে দেখেছি বড় হামানদিস্তাতে মাকে নতুন চাল গুঁড়ো করতে। আমাদের ছোটদের কাছে নবান্নর প্রধান আকর্ষণ ছিল আমার ঠাকুরমায়ের হাতের চাল মাখা। ভেজানো নতুন আধ-ভাঙ্গা চাল, নতুন গুড়, নারকেল কোরা, নারকেলের জল দিয়ে মাখা হত। দেওয়া হত নারকেলের শাঁস যাকে আমরা ফোপরা বলতাম। এই মিশ্রণের সঙ্গে সামান্য আমআদার রসের আভাস মেলালে তো আর কথা নেই। স্বাদে গন্ধে সে চাল মাখা ছিল আমাদের কাছে অমৃত-সমান।

পৌষ সংক্রান্তির দিন ভোর সকাল থেকে আমাদের বাড়ির হেঁশেলে যজ্ঞিবাড়ির ধূম শুরু হয়ে যেত। খুড়ী, পিসিরা বড় কুরানি নিয়ে বারকোশ ভর্তি করে নারকেল কুরতে বসে যেতেন। তারপরে সেই নারকেল, পাটালি গুড় দিয়ে জ্বাল দেওয়া ছিল এক মস্ত কাজ। স্নান সেরে লাল-পেড়ে সাদা খোলের শাড়ি পরা, আধ-ঘোমটা দেওয়া আমার মা উনুনের সামনে বসে ক্ষীর জ্বাল দিচ্ছেন। উনুনের আঁচের তাপের আভাস মায়ের মুখে। কী অদ্ভুত সুন্দর দেখাত আমার ছোট্টখাট্টো লক্ষ্মীমন্ত মাকে! রান্নাঘরের আরেক কোণে বসে ঠাকুরমা নারকেলের পুর ভরে পুলি গড়ছেন। সব মিলিয়ে সে এক মনোরম দৃশ্য! কাঠের উনুন, কালিঝুলি মাখা রান্নাঘর, অনুজ্জ্বল আলো-এই ছিল আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত রান্নাঘরের চেহারা। মিক্সি, চিমনি, বৈদ্যুতিক নানাবিধ সরঞ্জাম, মাইক্রোওভেন, ওটিজি, গ্যাসের উনুন- কিছুই ছিল না সেযুগে। এসব ছাড়া কী করে সেযুগের মা, দিদিমারা এমন সব স্বাদু, কঠিন সব পদ সৃষ্টি করতেন তা ভাবা যায় না।”

bengali sweetmeats
এমনি করেই মাটির সরায় তৈরি হয় চালগুঁড়োর চিতই পিঠে

আমার বাঙাল বাপের বাড়িতে পিঠে পর্ব শুরু হত চিতই পিঠে দিয়ে। এদেশিরা যাকে আস্কে পিঠে বলে জানেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরি তো এই পিঠের সংগে বিলেতের বিফস্টেকের তুলনা করেছিলেন। মাটির গোল গোল করে কাটা ছাঁচে চালের গুঁড়ির গোলা ঢেলে মা এই পিঠে তৈরি করতেন। গরম গরম সেই পিঠে আমরা নারকেল কোরা আর ঝোলা গুড় দিয়ে খেতাম। উৎসবের দিনে বাংলাদেশে আবার নাস্তায় এই পিঠের সঙ্গে গোস্ত থাকবেই। আমার এক বাংলাদেশি বন্ধুর বাড়িতে দেখেছি চিতই পিঠে, শোলমাছের মুড়ো দিয়ে বানানো লাউঘণ্ট দিয়ে খেতে।

আমাদের বাড়ির ট্রেডমার্ক পিঠে ছিল পাটিসাপটা। খাঁটি গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে ঘন করে তাতে নলেন গুড় মিশিয়ে ক্ষীর প্রস্তুত করতেন মা। পাটিসাপটা বানানোর কঠিন কাজটি করতেন ঠাকুরমা। লোহার তাওয়াতে সামান্য তেল মাখিয়ে তাতে চালের গুঁড়োর পাতলা গোলা ঢেলে তা জমে এলে  তার মধ্যে নির্ভেজাল ক্ষীরের পুর ভরে লম্বা করে মুড়ে একটার পর একটা পিঠে গড়ে খুন্তির ধার দিয়ে অক্লেশে তুলে ফেলতেন তিনি। চিঁড়েকুচা আর চষিপুলি দিয়ে পায়েস করতেন আমার এক পিসিদিদা। নারকেলের শাঁস চিঁড়ের মতো করে মিহি করে কুচিয়ে ঘিয়ে ভেজে চিনির রসে মাখিয়ে শুকিয়ে নিলেই তৈরি ঝুরঝুরে চিঁড়েকুচা। পায়েস বানানোর আগেই আমরা প্রায় শুধু শুধুই খেয়ে ফেলতাম এই দেবভোগ্য পদার্থটি। নিপুণ হাতে চষি বানাতেন তিনি। তারপরে চিঁড়াকুচা, চষি, পুলি, খেজুর রস সমৃদ্ধ ক্ষীরের মধ্যে ফেললেই প্রস্তুত চিঁড়েকুচা-চষি-পুলির পায়েস।

এখন দিন বদলেছে, যৌথ পরিবার ভেঙে খানখান। তবু চাই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক সুস্থ আনন্দময় সমাজ। পিঠে থাক, পার্বণ থাক, নতুন গুড়ের আবাসে সুরভিত হোক পৌষের দিনগুলি। নতুন ধানের শীষে থাক আগামী দিনগুলির জন্য আশা ও স্বপ্ন!

 

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *