বর্ষার গভীর মেঘ যেমন পুঞ্জ পুঞ্জ হয়ে জমা হয়, তেমনি গহন সমাবেশ আজ, এই কাছিমপুলের জঙ্গলে। সমস্ত হাতির দল গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। স্তম্ভিত বাকরূদ্ধ। শুধু তাদের ঘন ঘন শ্বাস ফেলা আর শুঁড়ের দ্রুত আন্দোলন অনেক দূর থেকেও অনুভূত হয়। এ যেন এক ভয়ঙ্কর দূর্যোগের পূর্বাভাস। বনের অন্য পশুপাখী এই বিশালদেহীদের জমায়েত কে অত্যন্ত সমীহ করে। নিজের নিজের বাসায় নিশ্চুপে অপেক্ষা করছে। 

হাতিদের দলের মাঝখানে শুয়ে আছে একটা ছোট্ট হাতি, ঐরা। নিথর। আর কোনওদিন সে মা বাবার পিছন পিছন ছুটবে না। স্নানের সময় কাদা মেখে খেলা করবে না। মায়ের বকুনি শুনে বাবার মস্ত শরীরের পিছনে গিয়ে লুকোবে না। 

ইদানিং জঙ্গলের মধ্যে এক নতুন জানোয়ার দেখা গেছে। পঞ্চাশ হাতির মতো বড় তার শরীর। সামনে একটা ভাঁটার মতো চোখ। তার থেকে আগুনের মতো আলো বের হয়। ড্রাগনের মতো তার চলাফেরা। যেমন হঠাৎ করে আসে, তেমনি হঠাৎ করে চলে যায়। মাঝে মাঝে তীব্র শিস দিয়ে জঙ্গল চিরে ফেলে। কাউকে কখনও তোয়াক্কা করে না। বেশিরভাগ প্রাণীই তার আসার শব্দ পেলে দূরে পালিয়ে যায়। শুধু ঐরা ভয় পেত না। মা ওকে অনেকবার নিষেধ করেছিল, কিন্ত ঐরার অদম্য কৌতুহল, ও যাবেই। ড্রাগনের পথে পথে চিহ্ন থেকে যায়। সেই চিহ্ন ধরে ধরে ঐরা ছোটে, গড়াগড়ি খায়। বাবা মা দেখে ফেললে আবার ছুটে পালিয়ে যায়। এমন লুকোচুরি করে দিব্যি চলছিল। আজ সন্ধ্যার পর সমস্ত দলবল নিয়ে ঐরার বাবা জীমূত গভীর জঙ্গলের দিকে আসছিল। সামনে শীত আসছে। এই জঙ্গলে খাবার কম হয়ে যাবে। কী করে সব দিক সামাল দেবে, তাই নিয়ে ভারি চিন্তিত। ড্রাগনের পদধ্বনি খেয়াল করেনি। আর তেমনি খেয়াল করেনি যে, দলছুট হয়ে ঐরা রয়ে গেছে জলের ধারে। জলের ধার ঘেঁষে ওই দৈত্যাকার প্রাণীটি আসে। আসে বলার চেয়ে, বলা ভালো ছুটে চলে যায়। ড্রাগনের যেন ভীষণ তাড়া থাকে সবসময়। কাউকে ধরবে বলে প্রচন্ড জোরে ছুটে চলে যায়। ড্রাগনের পথের ওপর ছোট ছোট নুড়ি পাথর ছড়ানো থাকে। ঐরা সেই পাথর নিয়ে মাঝে মাঝে শুঁড়ে করে খেলা করে। জন্তুটার দৌড়ের সাথে সাথে ওই পাথরগুলো ছিটকে ছিটকে ওঠে। ঐরা ওর ছোট্ট শুঁড় দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল জানোয়ারটাকে, সেই ছোঁয়া যেন ওর কাল হল। প্রচন্ড আঘাতে ছিটকে পড়েছিল টুকরো টুকরো নুড়ি পাথরের ওপর। রক্তে ভিজে ওঠে পাথর। কয়েক ফোঁটা জল নেমে আসে ওর ছোট ছোট চোখ দিয়ে। শেষবারের মতো প্রচন্ড একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। সমস্ত গাছপালা যেন সেই শব্দে কেঁপে ওঠে। 

চলতে চলতে হঠাৎ সেই তীক্ষ্ণ শব্দে যেন জীমূত সম্বিত ফিরে পায়। ঐরার মা স্থূণা একমুহুর্তে বুঝতে পারে এই স্বর তার প্রিয় সন্তান ঐরার। বিরাট শুঁড় তুলে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে। পুরো হাতির দল বোঝে, কোনও বিপদ ঘটেছে। সকলে থমকে যায়, পরক্ষণেই ঐরার আর্তনাদ লক্ষ্য করে ছুট দেয়। সেকি ভয়ানক দৌড়! কাছিমপুল এমন ভয়ানক দৌড় শেষ কবে দেখেছে, মনে পড়ে না। শতাধিক দামাল হাতি ছুটেছে। প্রত্যেকের শুঁড় আকাশের দিকে তোলা। পায়ের তলায় কারা পড়ল, কটা গাছের ডাল যে ভাঙল, কত শত পাখি যে ঘুম ভেঙে উড়ে পালাল তার কোন লেখাজোখা নেই। পায়ের দাপটে উঠল ধুলোর ঝড়। সে ঝড়ে সন্ধ্যের আকাশে নিভে গেল সব তারা। চাঁদ যেন হারিয়ে গেল গহিন অন্ধকারে। সকলে ছুটতে ছুটতে এসে থমকে থামল জলার ধারে। সেখানে পড়ে রয়েছে ছোট্ট ঐরা। স্থূণা শুঁড় দিয়ে আদর করে। তারপর “বাছা আমার” বলে চিৎকার করে জ্ঞান হারায়। জীমূত দলপতি। অমন করে সবার সামনে কাঁদতে পারেনা। তবে বুক তার ফেটে চৌচির হয়ে যায়। কিন্তু মুখে কোনও কথা বলা না। অন্য বন্ধুরা একবার জীমূতের পিঠে, একবার ঐরার শরীরের ওপর শুঁড় বুলিয়ে দেয়। মাঝখানে ঐরা কে রেখে ধীরে ধীরে তারা গোল হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যেকের চোখে শোক। ক্রমশঃ সেই শোক পরিবর্তিত হয়ে উঠছে প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ স্পৃহাতে। 

প্রথম কথা বলে কুম্ভীরক। দলের মধ্যে জীমূতের পরেই যার স্থান।

– আজ আমাদের শোকের সময় নয়। এই ড্রাগনের মোকাবিলা না করলে, আমাদের সমূহ বিপদ।

সব হাতিরা শুঁড় আর মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। কিন্তু কীভাবে? এই প্রশ্নটা সবার মনে জাগে। অল্প বয়সীরা চিৎকার করতে থাকে। “চল চল, আমরা ড্রাগনের এই পায়ের চিহ্ন দেখে যাই। ঠিক তার দেখা পাব।”

এই দলে সবচেয়ে প্রবীণ নিহ্রাদ। জীমূতের আগে সেই ছিল দলপতি। বয়সের ভারে এখন নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছে। খুব ধীরে ধীরে বলে, “হঠকারী কোনও সিদ্ধান্ত নিও না। শত্রু শক্তিশালী। তাকে সহজভাবে নেওয়া ঠিক নয়।”

– তবে কী করা উচিত? আপনি বলুন? 

রাগে দুঃখে দপদপ করতে করতে থাকে জীমূত। নিহ্রাদ বলে চলে,

– শক্তিশালী শত্রুকে আগে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। সে কী করে, কখন করে, তার গতিপথ কী? সব আগে জানতে হবে। তারপর আমাদের রণকৌশল ঠিক করতে হবে।

নিহ্রাদ, যৌবনে এক রাজ পরিবারের সেনা বাহিনীতে কিছুদিন ছিল। তাই যুদ্ধের কূট কৌশল সে জানে। জীমূত মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। কুম্ভীরক বলে, 

– তবে আমরা আজ কী করব?

– আজ আমরা শুধু ঐরা কে স্মরণ করব। তার শেষকৃত্য করব। আর শেষে প্রতিজ্ঞা করব, প্রতিশোধের।

সকলে চিৎকার করে ওঠে “হ্যাঁ হ্যাঁ প্রতিশোধ চাই।”

জীমূত শুঁড় তুলে সবাই কে আশ্বস্ত করে। তারপর ধীরে ধীরে ঐরাকে ঘিরে ধরে তার শরীরের ওপর ছড়িয়ে দেয় মাটি। পুরো শরীর ঢাকা হয়ে গেলে, স্থূণা একটা ফুলসহ কৃষ্ণচূড়া গাছের ডাল ভেঙে মাটির ঢিবির ওপর বসিয়ে দেয়। জীমূত বলে, 

– আজ পুরো চাঁদের পর দ্বিতীয় দিন। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আগামী অন্ধকার রাতে ড্রাগন কে আমি বধ করব। না হলে আমি আর প্রাণ রাখব না।

– আবেগ তাড়িত হয়ো না। খুব সাবধানে, ভেবে চিন্তে কাজ করতে হবে। আমাদের বনের অন্য পশুপাখীদের সাহায্য নিতে হবে। 

– বেশ তবে তাই হোক।

হাতির দল ধীরে ধীরে জলের ধার থেকে পিছু হটে, জঙ্গলের গভীরে যেতে থাকে। আকাশে দ্বিতীয়ার চাঁদ, জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে। হাল্কা হাওয়াতে কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো ঐরার ঢিবির ওপর ঝরে ঝরে পড়ে।

গভীর জঙ্গলে বিরাট সভা বসেছে। ড্রাগনের বিরুদ্ধে লড়াই-এর সভা। সবাই সেখানে উপস্থিত। শিয়াল ভাল্লুক হনুমান বাঁদর গন্ডার অজগর কে নেই! আছে ঝাঁক বাঁধা টিয়ার দল, আছে শামুকখোল সারস, হাঁড়িচাচা, দোয়েল, ফিঙে, চিল, ঈগল আরও সবাই। প্রথমে ঠিক হল, ড্রাগনের গতিপথ মাপা হবে। ঈগল আর চিল কে দায়িত্ব দেওয়া হল। পরের কাজ হল, সময়। দেখতে হবে ড্রাগনের আসা যাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় আছে কিনা। হনুমান আর শেয়াল এই কাজের ভার নিল। মোটামুটি এই দুটি তথ্য পেলে পরের কাজে হাত দেওয়া হবে। 

এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করা হল। ঈগল আর চিল এসে খবর দিল যে, ড্রাগনের নির্দিষ্ট গতিপথ আছে। সেই পথ ছেড়ে তাকে অন্যদিকে যেতে দেখা যায়নি। তবে সে জঙ্গল রাজ্যের বাইরে থেকে আসে আবার জঙ্গল কাটিয়ে অন্য কোথাও ছুটে চলে যায়। সবাই শুনে নিহ্রাদের দিকে তাকায়। নিহ্রাদ মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, 

– এটা খুব মূল্যবান তথ্য। আর এটার একটা ভালো দিক আছে যে নির্দিষ্ট জায়গাতে পৌঁছলে ড্রাগন কে পাওয়া যেতে পারে। 

এরপর হনুমান বলল, 

– জন্তুটা মোটামুটি দিনে চারবার যাতায়াত করে। দুবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে আর দুবার উত্তর থেকে দক্ষিণে। সন্ধ্যের পর একবার যায়, মধ্যরাতে একবার আর দুবার দিনের বেলায় দেখা গেছে। 

শেয়াল এর সঙ্গে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যোগ করে।

– ড্রাগনের রাস্তায় একঠ্যাঙা গাছ আছে। সেগুলোর কয়েকটাতে বড় বড় জোনাকির বাসা। তারা সবসময় বাতি জ্বালিয়ে রাখে। ড্রাগন আসবার সময় হলে একটা নিভিয়ে অন্য বাতি জ্বালায়। চলে যাবার পর আবার বাতি পাল্টে রাখে।

 এই তথ্য শুনে নিহ্রাদ চুপ করে থাকে। বুঝতে পারে না। এর অর্থ কী? আলোর ব্যাপারে, তবে কি জোনাকিদের জিজ্ঞাসা করা হবে? সমস্ত পশুপাখিদের ধন্যবাদ জানিয়ে সমাবেশ সাঙ্গ করা হয়। সবাই চলে গেলে গোপন সভাতে বসে তিন মাথা জীমূত, নিহ্রাদ আর কুম্ভীরক। এখন চাঁদ ক্রমশ ক্ষয় হচ্ছে। মধ্যরাতে উঠছে, আর ডুবতে ডুবতে সূর্য উঠে পড়ছে। ঠিক হল মধ্যরাতই হবে আক্রমণের সময়। তবে আগের কথা অনুযায়ী পুরো অন্ধকার রাতে নয়, আক্রমণ করা হবে তার দুদিন আগেই। এই খবরটা অন্যদের থেকে গোপন রাখতে হবে। বলা যায় না শত্রুপক্ষও হয়তো খবর নিচ্ছে। তাই তারিখ এলোমেলো করে চমকে দিতে হবে। 

পরদিন রাতের প্রথম প্রহর। চল্লিশজন দামাল কে নিয়ে জীমূত আর কুম্ভীরক চলল। নিহ্রাদ রইল বাকি দলের দায়িত্বে। শেয়ালের কথা মতো সেই একঠ্যাঙা গাছের কাছে পৌঁছাল, যেখানে বড় জোনাকি বাতি জ্বেলেছে। অপেক্ষা করতে করতে সরু চাঁদ ডুবে গেল। কিন্তু রাতে বাতি বদল হল না আর ড্রাগনও এলনা। 

হাতির দল ফিরে আসে। সব শুনে নিহ্রাদের ভুরু কুঁচকে যায়। তবে কি ড্রাগন টের পেয়ে গেল? আজ আবার চেষ্টা করা হবে। তবে আক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে হবে। সবাই জিজ্ঞেস করে “কিভাবে?”

– আমাদের বন্ধনী দিতে হবে।

– সেটা আবার কী?

– বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখতে হবে ওই পথের ওপর।

শুনে সকলের বড় আনন্দ হয়। গাছ ওপড়ানো হাতিদের প্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। নিহ্রাদ বলে, 

– তবে তা করতে হবে নিঃশব্দে।

অবশেষে সেই সময় এল। খবর পাওয়া গেছে, সন্ধ্যের সময় ড্রাগনকে দেখা গেছে। আশা করা যায়, আজ রাতে আবার আসবে। কুড়ি কুড়ি দুই দলে ভাগ হয়ে গেছে হাতিরা। একদিকে কুম্ভীরক অন্যদিকে স্বয়ং জীমূত। আজ নিহ্রাদও চলে এসেছে। এসেছে স্থূণাও। ওরা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে। কুম্ভীরক আর তার দল অনায়াসে দুটো বিশাল বড় গাছ উপড়ে ড্রাগন পথের ওপর ফেলে। নুড়ি পাথরগুলো ছিটকে ওঠে। পাখপাখালিরা একবার ঝটাপট ডানা নেড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। নিকষ আঁধার ভেদ করে কৃষ্ণা চতুর্দ্দশীর পাতলা শেষ চাঁদ আকাশে উঠল। সেই নিস্তেজ আলোয় চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে দুজোড়া দাঁত দেখা যাচ্ছে। একটা জীমূত আর অন্যটি কুম্ভীরকের। বাকিরা নিজেদের আড়াল করে রেখেছে। জীমূত প্রত্যেকটি মুহুর্ত বুকের মধ্যে অনুভব করছে। ঐরার মুখটা ভেসে উঠছে। চোখের পাশটা দপদপ করছে যেন। এমন সময় সেই তীব্র শিস শোনা গেল। মু্হুর্তে সবার শুঁড়গুলো শক্ত হয়ে উঠল। মাংসপেশী দৃঢ়তর। কুড়িটি করে চল্লিশটি হাতি দুই দিক থেকে প্রস্তুত। ওই আসছে। দূর থেকে তার চোখটা জ্বলছে। আবার শিস আর সাথে ড্রাগনের ছুটে আসার শব্দ, ঝিকঝিক ঝিকঝিক। এবার জঙ্গলের প্রতিশোধ নেবার পালা।     

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।

4 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *