কয়েক মাস আগে যখন ইউরোপে গিয়েছিলাম, অল্প সময়ের জন্য এনিডের সঙ্গে দেখা হল। অকস্মাৎ একটা বড়ো দোকানের করিডরে দেখা। এতদিন বাদে দেখা, দু’জনেরই চেহারার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তবু তৎক্ষণাৎ আমরা পরস্পরকে চিনতে পারলাম। একদিন দু’জনে খুবই কাছাকাছি ছিলাম, প্রতিদিন কথা না হলে দিন অসমাপ্ত মনে হত। নানা অজুহাতে আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে আমরা কোনও না কোনও ভাবে দেখা করতাম। আমার পুরনো সুটকেসে এখনও এনিডের রাশিকৃত চিঠি, ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারিনি। আমরা দোকানের কফিঘরে বসে কফি খেলাম, কিছুক্ষণ গল্প করলাম। তারপর, দ্রুত আলিঙ্গনের পর, বিপরীত পথে নিজেদের পৃথক গন্তব্যে চলে গেলাম। এনিড চলে গেলেও তার একটা রেশ আমার মনে রইল। তার বেশি নয়। আমাদের যে দিন গেছে, একেবারেই গেছে।
কবিতায় ও গানে আমরা যতই অবিনশ্বর প্রেমের কথা পড়ি বা শুনি, সম্পর্ক অতি ভঙ্গুর বস্তু। অল্পেই ভাঙে, এবং কেন ভাঙে আমরা সব সময় নিশ্চিত জানি না। ষোড়শ শতাব্দিতে ফরাসী দার্শনিক মঁতেন আদর্শ বন্ধুত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, সে-বন্ধুত্ব এমনই ব্যাপক ও জীবন-জোড়া যে তাতে দ্বিতীয় কোনও বন্ধুর পরিসর নেই। হায়, তেমন বন্ধুত্ব অনুভব করা দূরে থাক দেখারও সৌভাগ্য আমার এ-জীবনে হল না। আমাদের অধিকাংশেরই জীবনে সম্পর্ক আসে একটার পর একটা, ট্রেনের বিভিন্ন কম্পার্টমেন্টের মতন, সুখের হলেও ক্ষণস্থায়ী, মূল্যবান হলেও অতিনশ্বর।
আমার পুরনো সুটকেসে এখনও এনিডের রাশিকৃত চিঠি, ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারিনি। আমরা দোকানের কফিঘরে বসে কফি খেলাম, কিছুক্ষণ গল্প করলাম। তারপর, দ্রুত আলিঙ্গনের পর, বিপরীত পথে নিজেদের পৃথক গন্তব্যে চলে গেলাম। এনিড চলে গেলেও তার একটা রেশ আমার মনে রইল। তার বেশি নয়।
আমাদের যে দিন গেছে, একেবারেই গেছে।
আমি যখন ছোট, আমার প্রথম বন্ধুত্ব হল পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতাম এবং তাদের সঙ্গ ছাড়া জীবন ভাবাই কঠিন ছিল। যখন নিয়মিত স্কুলে যেতে আরম্ভ করলাম, পাড়ার সম্পর্কগুলি শিথিল হতে শুরু করল। স্কুলের বন্ধুরাই প্রধান হয়ে দাঁড়াল। পাড়ার বন্ধুরা আমার বাড়িতে আসা কমিয়ে দিল। আমারও স্কুলের পরে সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলের মাঠে যাওয়া বাড়তে লাগল। মা মাঝে মাঝে বলত, “আজ রবীন এসেছিল, তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিল।” পাড়ার বন্ধু রবীনের সঙ্গে দেখা হলে ভালই লাগত, কিন্তু দেখা না হওয়াটা তখন আর তত গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়া কমে গিয়েছে।
একই ঘটনা ঘটেছে যখন স্কুল ছেড়ে কলেজে গিয়েছি, এবং পরে কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা দিয়েছি। পুরনো বন্ধুরা যে পুরোপুরি হারিয়ে গিয়েছে তা নয়, কখনও ধীরে কখনও দ্রুত তারা একটা দূরবর্তী অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে। কারণটা অংশত ভৌগোলিক।কলেজটা হয়ত অন্য এলাকায়, আমার পুরনো স্কুল বা বাড়ির চৌহদ্দি থেকে অনেক দূরে। কিংবা অংশত সময়নির্ভর, দায়িত্বপূর্ণ বা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছাত্রের হাতে প্রচুর অবসর নাও থাকতে পারে। অবসর হয়তো আরওই সংকীর্ণ হতে পারে যখন লেখাপড়া শেষ করে কেউ চাকরি নিয়ে জীবিকা অর্জনে মন দেয়। আমার নিজের ক্ষেত্রে চাকরি নিয়েই আমাকে অন্য শহরে যেতে হল।
কিন্তু আসল কথা সেটা নয়। প্রধান ব্যাপার হল এই যে আমাদের সামাজিক জীবন, সেটা বিবর্তমান। যেই আমি স্কুল-কলেজ ছেড়ে একটা অফিসে সারাদিন কাটাতে শুরু করলাম, স্বাভাবিক ভাবেই যে সব সহকর্মীদের সঙ্গে আমি দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছি, তাদের কারও কারও সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকল। কেউ কেউ অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হল। এই ধরনের নতুন সম্পর্ক অবশ্যই আনন্দের ব্যাপার, কিন্তু তার অনিবার্য ফল এই যে, অন্যান্য সম্পর্ক তখন নেপথ্যে যেতে থাকে। আমাদের সময় কম, মনোযোগ আরও কম। যেটা কাছাকাছি, সহজে অধিগম্য সেটাই আমাদের অবসর-জীবনকে ভরিয়ে দিতে শুরু করে। পুরনো কোনও কোনও বন্ধু বা আত্মীয়, এমনকি অন্তরঙ্গ ব্যক্তি, তখন আস্তে আস্তে সুবর্ণস্মৃতির কুয়াশায় হারিয়ে যায়।
সম্পর্ক অবশ্য ভাঙে নানা কারণে। হার্বাটের সঙ্গে সম্বন্ধ চুকাতে বাধ্য হলাম যখন দেখলাম কোকেনের দাপটে ওর ব্যবহার প্রায়ই কাণ্ডজ্ঞানহীন। সুজিতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ হল যখন দেখলাম ওর বন্ধুত্বের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে কার কাছে কত টাকা ধার করা যায়। অরুন্ধতীর সাথে আট বছরের সম্পর্ক রাখতে পারলে খুবই খুশি হতাম, কিন্তু ওর সদ্য-আহৃত স্বামীর অপরিমিত মদ্যপান ও পরিমিত সহ্যশক্তি বাদ সাধল। বন্ধু হারাতে আমি সর্বদাই নিতান্ত অনিচ্ছুক, কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে আমার ভ্রাম্যমান জীবনরীতিতে বন্ধুত্বের সূত্ররক্ষা মোটেও সহজ নয়। না আমার পক্ষে, না অন্যদের পক্ষে।
আমাদের সময় কম, মনোযোগ আরও কম। যেটা কাছাকাছি, সহজে অধিগম্য সেটাই আমাদের অবসর-জীবনকে ভরিয়ে দিতে শুরু করে। পুরনো কোনও কোনও বন্ধু বা আত্মীয়, এমনকি অন্তরঙ্গ ব্যক্তি, তখন আস্তে আস্তে সুবর্ণস্মৃতির কুয়াশায় হারিয়ে যায়।
আজকাল একটা নতুন উপায় জনপ্রিয় হয়েছে। ফেসবুক, আর তার আনুষঙ্গিক ওয়াট্স্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ও মেসেঞ্জারের কৃপায় এখন আমরা নিখরচায় অল্পায়াসে পরিচিতদের সঙ্গে পৃথিবীময় যোগাযোগ রাখতে পারছি। তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি, তাদের দেখতে পারছি। আমার মত লোক, যাদের ঠিকানা প্রতিনিয়ত বদলায়, তাদের পক্ষে যোগসূত্র অটুট রাখার এই এক নতুন পদ্ধতি। চিঠি লিখতে হবে না, ডাকটিকিট কিনতে হবে না, ডাকঘরে যাবার ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হবে না, সে সব বিরাট লাভ তো বটেই। কিন্তু কারও সঙ্গে বসে নিরুপদ্রবে কথা বলার, তার মুখের দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দেবার সৌভাগ্য থেকে এ-লাভেরও তফাত অনেক। দু’কথার বাণী সহজে সারা যায় বটে, কিন্তু অন্যের হাত ছোঁওয়া যায় না। অদম্য উৎসাহে যে সব অপর্যাপ্ত, অযৌক্তিক কথা উদ্গীরণ করার প্রবণতা আমাদের গদ্যমুখর জীবনের একমাত্র অর্থবহ উত্তরণ, তা পৌঁছে দেওয়া যায় না।
ইউরোপের সেই অনিভৃত কফিঘরে এনিড যখন বিদায় নিয়ে নিজের পথে চলে গেল, আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। কিছুতেই নিমেষে মুছে ফেলতে পারলাম না আমাদের দীর্ঘ, মর্মস্পর্শী, সংজ্ঞাহীন, সঞ্জীবনী অতীত। আমাদের যে দিন গেছে, একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি? এ-প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। এনিডও জানে কি না সন্দেহ।
আমি উঠে আমার পথ ধরলাম।
মণীশ নন্দী দীর্ঘদিনের প্রবাসী। কর্মজীবনে মার্কিন দূতাবাস ও ওয়র্ল্ড ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর লেখালোখি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আ স্ট্রেন্জার ইন মাই হোম ওঁর সদ্যপ্রকাশিত বই।
স্পর্শ করল লেখাটা। একাত্ম হলাম।