“মরবার আগেই আমি মরে বসে আছি,” বললেন সুদীপ্তা রায়।

সুদীপ্তাকে একজন সাধারণ অসহায় মহিলা মনে করার কোনও কারণ নেই। সুদীপ্তা অসাধারণ ছাত্রী ছিলেন। কলেজ পাশ করার পর বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়াশুনা করেন। ফিরে এসে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা এবং শেষমেশ একটি নামী কলেজের অধ্যক্ষ হন। কিন্তু এখন সত্তরে পা দিয়ে সুদীপ্তা আবিষ্কার করছেন তিনি কত একা। আত্মীয়স্বজন, ছাত্র-ছাত্রী, পরিচিত-সুপরিচিত লোকজন সত্ত্বেও সুদীপ্তা দেখছেন তাঁর কথা বলার কেউ নেই।

এই হচ্ছে আমাদের সময়ে একাকিত্বের আসল চেহারা। একাকিত্ব বলতে আমরা এতদিন ভেবে এসেছি সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। অবিবাহিত পুরুষ, বিধবা নারী, স্বজনহীন ব্যক্তি, কাজের প্রয়োজনে নতুন শহরে উপস্থিত নির্বান্ধব কর্মচারি, এরা নেহাত একা, একাকিত্বের শিকার। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে শুরু করেছি যে আমাদের চারপাশে কতজন আত্মীয় বা বন্ধু আছে, তার হিসেব দিয়ে আমরা একাকিত্ব জরিপ করতে পারব না। অনেক অতিব্যস্ত লোক অনেক সময় নিভৃতে দিন কাটাতে চান; কিছু সময় একলা কাটানো তাঁদের পক্ষে শান্তিপূর্ণ ও উপযোগী। অন্যদিকে, অনেকে আছেন যাঁরা সংসার-পরিবৃত বা বন্ধু-বেষ্টিত, কিন্তু তাঁরা দৈনন্দিন অনুভব করেন একাকিত্বের দুর্বহ বোঝা। তাঁদের বিশ্বস্ত স্ত্রী বা দীর্ঘস্থায়ী প্রেমিক থাকতে পারে, তবু তাঁদের মনে হয় কেউ নেই যাঁদের কাছে তাঁরা মন খুলতে পারেন। বাইরে থেকে যাই মনে হোক, তাঁরা আসলে একাকিত্বের শিকার।

একাকিত্ব নানা রকমের হতে পারে। আমরা অনেকেই তার কয়েকটির স্বাদ কোনও না কোনও সময়ে পেয়েছি। কেউ নতুন কলেজে ঢুকেছে বা নতুন কাজ নিয়ে অপরিচিত শহরে এসেছে, রাতারাতি সে বন্ধুহীন, একা। কিংবা তার চারপাশে নতুন সহচর যারা রয়েছে, তাদের পছন্দ অন্যরকম। তারা চায় ক্লাবে যেতে, পার্টি করতে। কিন্তু তার জীবনযাপন ভিন্ন, অন্যদের সঙ্গে সে মিল খুঁজে পায় না। 

হতে পারে আমার অনেক বন্ধু, কিন্তু আমি খুঁজি এমন একজন, যার সঙ্গে আমার মনের মিল। আমি তাকে খুঁজে পাই না, বা পেলেও তার সঙ্গে যোগাযোগে সামাজিক বাধা। উল্টোদিকে, যাদের সঙ্গে আমায় কার্যসূত্রে বা সামাজিক কারণে অনেক সময় কাটাতে হয়, তাদের সঙ্গে আমার একটা ক্ষীণ, অগভীর সম্পর্ক, যা আমাকে বিন্দুমাত্রও তৃপ্তি দেয় না। এও হতে পারে যে তারা সবাই ব্যস্ত, তাদের আছে পরিবার, প্রণয়াস্পদ বা ঘনিষ্ঠ সুহৃদ, তারা আমার সঙ্গে একটা অন্তরঙ্গ সম্বন্ধস্থাপনে ততটা উৎসাহী নয়।

এই ধরণের পরিস্থিতি আগের থেকে এখন অনেক বেশি সম্ভব। কাজের দাবি এখন অনেক বেশি ব্যাপক, অবসরের সুযোগ অনেক বেশি সংকীর্ণ। যেটুকু সময় আমাদের হাতে রয়েছে, তার অনেকটাই হয়তো চলে যায় প্রয়োজনীয় সম্পর্ক রক্ষায়, মায়ের চিকিৎসা-বিধানে বা পিসির অনুরোধ-পালনে। অন্তরের আদানপ্রদানের জন্য যে অবসরের প্রয়োজন, ন্যূনতম সৌহার্দ্যের জন্য যে সময়ের দরকার, তা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এরই একটা লক্ষণ এই যে, আসল সম্পর্ক স্থাপনের অভাবে আমরা অনেকেই চাইছি ইন্টারনেটের মাধ্যমে এক ধরনের দ্রুত খুচরো সম্পর্ক। ফেসবুক, ফেসটাইম, হ্যাং-আউট, ওয়াইবার, ইত্যাদি একাধিক উপায়ে আমরা আমাদের পরিমিত অবসরমুহূর্তে বানিয়ে ফেলছি এক ধরনের বন্ধুত্ব যা বেশি সময় নেয় না, চা বা কফি বানাবার কষ্টস্বীকার করতে হয় না, জুতো-জামা পরতে হয় না, দু’মিনিটে সূত্ররক্ষা করে, বন্ধুত্বের আশ্বাস অক্ষত রেখে আমরা আমাদের ব্যস্ত, আত্মকেন্দ্রিক জীবনে ফেরত যেতে পারি।

মুশকিলটা এই যে, এতে আমাদের একাকিত্বের লাঘব সত্যিসত্যিই হয় না। সাময়িক উত্তেজনার পর আমাদের আবার মনে হতে থাকে যে আমাদের জীবনে কোথাও একটা গভীর অভাববোধ রয়ে গিয়েছে। গবেষণা আমাদের ক্রমান্বয়ে অবহিত করে চলেছে যে, এই অভাববোধ এক বিপজ্জনক অসুস্থতার পূর্বাভাস। ডাক্তাররা বলছেন যারা নিজেদের একা বলে অনুভব করে, একাধিক মারাত্মক উপসর্গের তারাই সাধারণত হয় প্রথম বলি। হৃদ্‌রোগ, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, অন্ত্রসমস্যা, প্রায় সব রোগেরই ক্ষেত্রে, একাকিত্ববোধ মানুষকে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে অনেক বেশি দুর্বল করে দেয়। সাধারণ সর্দিকাশির ক্ষেত্রে গবেষকরা বলছেন, যারা নিজেদের একা মনে করে, তারা বেশি ভোগে ও তাদের সারতেও বেশি সময় লাগে।

আরও বিপদ এই যে একাকিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আর একটা সমস্যা, বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন। যারা নিজেদের একা বলে অনুভব করে, প্রায়ই তাদের প্রবণতা হল বিষণ্ণতার দিকে ঝোঁকা। অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে, যারা দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতায় ভোগে, নানান মানসিক সমস্যা সহজেই তাদের গ্রাস করে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দেখাচ্ছে যে, একাকিত্ববোধের ফলে অনেকের মনে হতে থাকে যে নিজের জীবনের ওপরে তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে, তাদের অস্তিত্ব নিরর্থক, এবং এই ধরনের অনুভূতি থেকেই অনেক ক্ষেত্রে অন্যান্য মানসিক সমস্যার উদ্ভব। আমাদের সামাজিক সূত্রগুলিই আমাদের আত্মবিশ্বাসের পরিকাঠামো; সেই সুতোগুলো ছিঁড়ে গেলে আমাদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস শিথিল হতে আরম্ভ করে।

আমরা সামাজিক জীব, আমাদের দরকার কিছু অবিচ্ছিন্ন সামাজিক সূত্র। যারা সৌভাগ্যবান, তারা সূত্রগুলো অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে তাদের পরিবার বা আত্মীয়স্বজন মারফত। যাদের সে সুযোগ নেই, তাদের নতুন করে ভাবতে হবে, কী ভাবে তারা অন্তত দু’তিনটে সম্পর্ক অটুট রাখতে পারে, যাদের সঙ্গে তারা অকপটে মনের কথা আলোচনা করতে পারে। এই ধরনের সম্পর্কের মূল্য সম্বন্ধে তারা যদি সজাগ হয়, তাহলে সম্পর্কগুলি স্থাপন করতে ও সেগুলি সংরক্ষণ করতে তারা তৎপর হবে। পৃথিবী পালটেছে ঠিকই, কাজের চাপ বেড়েছে অবশ্যই, কিন্তু একই সঙ্গে সম্পর্করক্ষার নতুন পদ্ধতিগুলিও সকলের অধিগম্য হয়েছে।

একটা সময় ছিল যখন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে তার বাড়িতে উপস্থিত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। এখন তুমি তাকে শুধু ফোন করতে পার তাই নয়, নানা পরোক্ষভাবে তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে পার। তাকে চিঠি লিখতে পারও যেটা তার হাতে অবিলম্বে পৌঁছে যাবে, তার ফোনে তাকে তোমার ইচ্ছা জানাতে পার, তিন-চার রকম প্রক্রিয়ায় তাকে তোমার অস্তিত্ব সম্বন্ধে অবহিত করতে পার। যে পুরনো বন্ধু বা সহকর্মীর সঙ্গে বহুদিন তোমার যোগাযোগ নেই, তাকে আজ খুঁজে বার করা আগের থেকে অনেক সহজ। এক কথায়, কেউ যদি উৎসাহী হয়, তাকে হয়তো দীর্ঘদিন নির্বান্ধব থাকতে হবে না।

উৎসাহ একটা বড় কথা। কোনও সম্পর্ক আরম্ভ করতে হলে বা সজীব রাখতে হলে চেষ্টার প্রয়োজন। যোগাযোগ না রাখলে বন্ধুরা হারিয়ে যায়, বন্ধুত্বের রেশ ক্ষীণ হয়ে আসে। সেইজন্য কথা বলা দরকার, বন্ধুদের সময় দেওয়া প্রয়োজন। চিঠি, ফোন, কম্পিউটার এসবের ব্যবহার করা দরকার। মাঝে মধ্যে তাদের সঙ্গে বসে এক কাপ চা খাওয়া দরকার। শুধু নিজের সমস্যা বলা নয়, তাদের সমস্যা শোনা দরকার।

অনেক সময় আমরা আমাদের প্রতিবেশিদেরই চিনি না। শুধু প্রয়োজনে নয়, অপ্রয়োজনেও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে আমাদের জীবন হয়ত আরেকটু বর্ণবহুল হতে পারে। কাজের সূত্রে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ, অল্প আয়াসেই হয়তো তারাও হয়তো আমাদের বন্ধুস্থানীয় হতে পারে। আমরা যদি ভেবে স্থির করি, কিসে আমাদের কৌতূহল এবং কী আমাদের করতে ভাল লাগে, যোগব্যায়াম না সঙ্গীত চর্চা, তাহলে দুয়ার থেকে অদূরেই হয়ত আমরা আবিষ্কার করব কোনও দল বা গোষ্ঠী যেখানে আমি সহজেই যোগ দিতে পারি। 

একাকিত্ব মোচনের একাধিক উপায় আছে। নানা সম্প্রদায় আজকাল এ বিষয়ে অবহিত হয়েছে এবং সাহায্যের বিভিন্ন উপায় ধীরে ধীরে আমাদের নাগালে আসছে। আমরা যদি একাকিত্বের বোঝা সম্বন্ধে সচেতন হই, ভাবতে চেষ্টা করি কী ভাবে আমাদের জীবন অন্যদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে আরও অর্থময় করতে পারি, তাহলে আমাদের সীমিত দিগন্ত অল্প চেষ্টায় সীমাহীন মনে হতে পারে।

মণীশ নন্দী দীর্ঘদিনের প্রবাসী। কর্মজীবনে মার্কিন দূতাবাস ও ওয়র্ল্ড ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর লেখালোখি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আ স্ট্রেন্জার ইন মাই হোম ওঁর সদ্যপ্রকাশিত বই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *