উত্তরে বলে পরাঠা, দক্ষিণে পরান্থা আর আমাদের হল গিয়ে পরোটা। উইকি তথ্যভাণ্ডার জানাচ্ছে সংস্কৃত সন্ধি (পরা+স্থঃ,কিংবা স্থিতঃ) এই হিন্দুস্তানি শব্দ ‘পরাঠা’-র উৎসে। কর্ণাটকের দ্বাদশ শতকের শাসক তৃতীয় সোমেশ্বর কর্তৃক সংকলিত সংস্কৃত বিশ্বকোষ ‘মনসোল্লাস’-এ বিভিন্ন শুষ্ক গমের পূরণপুলির উল্লেখ রয়েছে, যাকে ২০০৩ সালে ‘আচায়া পরোটা’ বলা হয়েছে। এ তথ্য সত্য, কারণ পূরণপুলির সঙ্গে আমার পরিচয় কর্ণাটকের হাম্পির এক হেরিটেজ রেস্তোরাঁয়। এখানে বিশেষ একরকমের রুটি বা পরোটাকেই পূরণপুলি বলে। নিজ্জরের “পাঞ্জাব আন্ডার দ্য সুলতানস ১০০০-১৫২৬ এডি” বইতে সর্বপ্রথম পরোটার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর মতে পরোটা তৎকালীন পঞ্জাবে সভ্য এবং অভিজাতদের নিয়মিত পাতে পড়ত।

দিল্লির চাঁদনিচকের আদলে এখন আমাদের শহরেও পরাঠেওয়ালি গলি হয়েছে। সেই গলি দিয়ে জ্যোৎস্না চুঁইয়ে না পড়লেও পরোটার সুবাস ছড়ানো গলি দিয়ে যাতায়াত করলেই আখতারি বাঈয়ের সুর কানে বাজতে বাধ্য কারণ হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যাল মিউজিকের সঙ্গেও পরোটার সম্পর্কটা বেশ মাখো মাখো। আওয়াধি ক্যুইজিনের বৈচিত্র্যময় পুরভরা পরোটা ছিঁড়ে মুখে তুললেই মনে পড়ে যায় মোগল বাদশাদের রাজকাহিনি আর তখন থেকেই লখনউ আর আওয়াধি ঘরানার গাঁটছড়া বাঁধা শুরু আমাদেরও।

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর পতন হয় মোগল সাম্রাজ্যের। ভারতবর্ষ তখন সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসতে থাকে। ফলে মোগল পরিবারের হেঁশেলে বংশপরম্পরায় কাজ করে আসা অনেক খানদানি শাহি পাচক কাজ হারান। তাঁরা যৎসামান্য পুঁজি নিয়ে চাঁদনিচক এলাকায় শুরু করেন খাবার তৈরি ও বিক্রি। গয়াপ্রসাদ শিবচরণ ছিলেন এমনই একজন, ১৮৭২ সালে পরাঠেওয়ালে গলিতে যিনি শুরু করেছিলেন পরোটা বিক্রি। 

আর মোগলদের রাজধানী থেকে ব্রিটিশদের তখনকার খাসতালুক গঙ্গাপাড়ের কলকাতায়। পরোটা প্রবেশ করল বাঙালি হেঁশেলে। নিজামের বিফ কাঠি কাবাবকে পরোটা দিয়ে পেঁচিয়ে রোল করে দিতে বলেছিলেন কোনও এক সাহেবসুবো। তাঁর ছিল রেসকোর্সে গিয়ে ঘোড়দৌড়ের বাজি ধরার তাড়া। সেই যে কাঠিতে গাঁথা শিক কাবাবকে পরোটা দিয়ে ‘রোল’ হল, সেই রোল এখন কলকাতার সেলিব্রিটি স্ট্রিট ফুড। অতএব সেই সাহেব বাজি ধরতে গিয়ে বাঙালির হাতে রোল ধরিয়ে দিয়েছিলেন! ভেতরে আমিষ বা নিরামিষ যা-ই থাকুক না কেন, বাইরে মুচমুচে লাচ্ছাদার পরোটা। 

Egg Chicken Roll
পরোটায় মাংস মুড়িয়ে তৈরি হল কলকাতার জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড – কাঠি রোল

পরোটা কী এবং কেন, কোথায় তার আদি নিবাস এবং কেনই বা তার এত জনপ্রিয়তা, এই নিয়ে আলোড়ন হয়েছিল এই শীতেই। অবাঙালি বিয়েবাড়িতে ভূরিভোজ। সেখানে নিরামিষেই কবজি ডোবাতে হবে। তাই নানারকমের পরোটার স্বাদ নিতে বসেছিলাম। ‘শুভশ্রী’ ছোট পত্রিকার গত বইমেলা সংখ্যা “স্বাদের সাতকাহন”-এ প্রিয়রোটিকা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে আমাদের পরোটাকে। প্রায় পাঁচশো বছর আগে মুঘলদের হাত ধরে পরোটার এদেশে প্রবেশ। মুঘল বাদশাদের জন্য প্রতিটি পরোটা ঘিয়ে চুবিয়ে ভেজে সেই ঘি ফেলে দিয়ে নতুন ঘিয়ে দ্বিতীয় পরোটাটি না ভাজলেই বাদশা বুঝতে পেরে ছুড়ে ফেলে দিতেন পোড়া তেলে ভাজা দ্বিতীয় পরোটাখানি। এমনই ছিল মুঘলদের স্বাদকোরক। আটা আর ময়দায় ঠেসে ময়ান দিয়ে তারপর কিছুক্ষণ রেখে দিয়ে লেচি কেটে বেলার সময় প্রতি পরতে পরতে ঘি মাখিয়ে বেলার রীতি এই পরোটার। আটা আর পরত মিলে এমন নাম বুঝি দিয়েছিল তদানীন্তন বাবুর্চিরা, যা কিনা খাবার সময় পরতে পরতে খুলে যাবে।

Lachha Paratha
পরতে পরতে খুলে যাবে লাচ্চা পরাঠার গিঁট

আদ্যিকালের পরোটা দুধ, ঘি দিয়ে আটা মেখে বানানো আমির ওমরাহদের খুব প্রিয় অভিনব বাখরখানি। কলকাতায় ঢাকা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে পাওয়া যেত এই বাখরখানি। লখনউতে এই বাখরখানিকে আরও কায়দায় বানিয়ে নাম দেওয়া হল শিরমল। দুধ, নুন, চিনি, জাফরান, গোলাপজল আর ঘি দিয়ে ময়দা মেখে বানানো ক্রেপের মতো ফিনফিনে পাতলা এই শিরমল। এটি তন্দুরে বানানো হত সেকালে, পাতি পরোটা যার কাছে কিছুই নয়।  পুরনো দিল্লিরর পরাঠেওয়ালি গলিতে এই পরোটা লস্যি বা দইয়ের ঘোলের সঙ্গে পরিবেশিত হত। দিল্লি, রাজস্থানের পর ধীরে ধীরে পরোটা জনপ্রিয় হয়ে উঠল কলকাতার হিন্দু হেঁশেলেও। আমাদের মায়েদের তিনকোণা পরোটাতেও পরত থাকত। তবে বাঙালীদের পরোটা পুরো ময়দায় তৈরি হত। স্বাস্থ্যসচেতন বঙ্গতনয়াদের এখন মাল্টি গ্রেইন আটায় মজেছে মন। ক্রমশঃ অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি আমরাও।

বাঙালিদের আর এক ঐতিহ্যবাহী পরোটা হল ছেঁড়া বা পেটাই পরোটা। গ্রামবাংলার দিকে যেতে যেতে এখনও দাঁড়িয়ে পড়ি সেই পরোটার সুঘ্রাণ নিতে। লোহার বিশাল মাপের চাটুতে ময়দার বিশাল ফিনফিনে পাতলা রুমালের মত পরোটা বানিয়ে তাকে পিটিয়ে হাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে ওজন করে বিক্রি হয় গরমাগরম। আলুর তরকারির সঙ্গে জমে যায় মফসসলে জন্ম নেওয়া এই ছেঁড়া পরোটা। আম আদমির পকেটে টান পড়ে না। সাধ, স্বাদ এবং সাধ্যের মধ্যে দিব্য কুলায়। পথচলতি শ্রমজীবী মানুষের সুষম ভরপেট আহার।

এবার আসি ভারতবর্ষের হাইওয়ের দুধারে ট্রাক ড্রাইভারদের পাঞ্জাবি ধাবাগুলোর আলু পরোটায়। সে তো অনেক পরের গল্প। পর্তুগিজরা এদেশে আলু আমদানি করার পরে। তার আগে মোগলাই পরোটার জন্ম।  একরাশ খিদের মুখে একখানি জাম্বো আলুর পরোটায় পেটচুক্তি সময়ের সঙ্গে। এখন আবার এই আলু পরোটা বদলে হয়েছে তন্দুরি আলু পরোটা। সেখানে ময়দা টক দই দিয়ে মেখে ফুলিয়ে তারপর আলুর পুর ঠেসে তন্দুরে সেঁকে নিয়ে সামান্য ঘি বা মাখন মাখিয়ে দেবে তারা। সঙ্গে ঘুগনি কিম্বা চানা মশলা। তন্দুরি আলু পরোটার পরেই মনে পড়ে পরোটার তুতোভাই নান এবং কুলচার কথা। আমাদের রাজ্যের না হয়েও এরা স্বমহিমায় আজ প্রতিষ্ঠিত।

Sheermal
মোগলাই বাখরখানিকে আরও কায়দায় বানিয়ে নাম দেওয়া হল শিরমল

সুলেখক পিনাকী ভট্টাচার্য তো আমির খুসরু থেকে আলমগির- এঁদের সবার দস্তরখানের জনপ্রিয় নানকে পরোটার এক দাদা বলে উল্লেখ করেছেন। বাকি মুঘল বাদশাহরা মাংসের সঙ্গে নান খেলেও ঔরঙ্গজেব তাঁর নিরামিষ খাবারের সঙ্গে নাকি এই নান খেতে পছন্দ করতেন। শাহজাহান তাঁর নির্বাসনের দিনগুলোতে বিরিয়ানির চেয়ে নান খেতেই বেশি পছন্দ করতেন।

কুলচা নাকি হায়দ্রাবাদের নিজামের রাজ্যের আবিষ্কার! দিনকয়েক আগে এক অবাঙালি বিয়েবাড়িতে পাঞ্জাবি কাউন্টারে অমৃতসরের চুরচুর কুলচা খেলাম। অপূর্ব তাঁর স্বাদ। এই “চুর চুর” কনসেপ্ট কিন্তু আমাদের ছেঁড়া পরোটার অনুরূপ। পুর ভরা পরোটাকে তাওয়ায় রেখে ঘি দিয়ে ভেজে তারপর হাতের তালুতে নিয়ে যাকে বলে স্কুইজ করে চটকে দেওয়া হল। তিনি চুর চুর হয়ে পরম আদরে আমার উদরে চালান হলেন আর আমি তৃপ্তিতে সুখঢেঁকুর তুলে বাড়ির পথে হাঁটা দিতে লাগলাম। এমনি হল এই চুর চুর কুলচার মাহাত্ম্য। 

kulcha
কুলচার স্থান নিজামের হেঁসেলে

পিনাকীবাবুর লেখাতেই পেলাম কুলচা নিয়ে দারুণ এক গল্প। সুফি পির হজরত নিজামুদ্দিন ঔরঙ্গাবাদি, মির কামরুদ্দিনকে নেমন্তন্ন করে তাঁকে এক টুকরো হলুদ কাপড়ে করে কুলচা পরিবেশন করে খাওয়ান। ক্ষুধার্ত কামরুদ্দিন সাতখানা কুলচা খেয়ে নেন, এতই খিদে পেয়েছিল তাঁর! হজরত নিজামুদ্দিন ভবিষ্যদ্বাণী করেন কামরুদ্দিন একদিন রাজা হবেন আর তাঁর বংশধরেরা সাত প্রজন্ম ধরে রাজত্ব করবে। এই মির কামরুদ্দিন হচ্ছেন হায়দ্রাবাদের আসফজাহি বংশের প্রতিষ্ঠাতা আসফ জাহ। তিনি কুলচাকে স্থান দেন নিজামের হেঁসেলে আর নিজামের পতাকায়।

তা বাপু পড়শি রাজ্যের প্রভাবেই হোক কিম্বা উপনিবেশবাদ, পুরভরা পরোটা এখন বাঙালির রান্নাঘরে প্রাতঃরাশ কিম্বা ডিনারে বেশ জাঁকিয়ে বসে পড়েছে।  শীতকালে মেথি পরোটা থেকে ফুলকপির পরোটাই হোক কিম্বা কড়াইশুঁটির পরোটা থেকে পনির পরোটা, এসবই রীতিমত জনপ্রিয়তার তুঙ্গে এখন। সারাবছর চলে ডিম অথবা ছাতুর পরোটা, ধনেপাতা কিম্বা কসুরিমেথির পরোটা। কালেভদ্রে মাংসের কিমার পরোটা অথবা রুইমাছের পুর ভরা পরোটাও চলতে পারে।

পরোটার অন্যতম একটি স্বাস্থ্যকর দিক হল এটি তাওয়ায় সেঁকে নিয়ে ঘি বা রিফাইন্ড তেল ছড়িয়ে ভাজা হয় অনেকক্ষণ ধরে। তাই ডিপ ফ্রায়েড লুচি বা পুরির মতো অতটা মারাত্মক ক্ষতিকর নয়। তা সে শের-ই-পঞ্জাব ধাবার তন্দুরি আলুর পরোটা হোক কিম্বা অনাদি কেবিনের মোগলাই পরোটা। আফটার অল প্রিয়রোটিকা নাম তার।

Regional Parathas
ভারতের নানা অঞ্চলের পরোটার রকমফের

 মোগলাই পরোটা সংস্কৃতি যে আমাদের দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও দাপিয়ে বাড়াচ্ছে তার প্রমাণ পাই শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী” বইখানিতে। এরমধ্যে পড়ে মহারাষ্ট্রের গরম চাটুতে অল্প তেলে সেঁকে নেওয়া “ঝিংগে কি রোটি” বা কুচো চিংড়ির পুর দেওয়া অভিনব পরোটা বা মালাবার উপকূলীয় “ইরাচি পাথিরি” বা মাংসের কিমার পরোটা, পঞ্জাবের “সতপুরা পরাঠা” যা চিজ় দেওয়া মশলাদার। আবার লখনউয়ের “মোল্লা দো পেয়াজ়া কি রোটি” এখন অনিয়ন পরোটা হিসেবে সর্বত্র বিক্রি হতেও দেখি। এখানে উল্লেখ করতেই হয় দিল্লির পরাঠেওয়ালি গলিতে পাওয়া পাঁপড়ের পরোটা, যার সঙ্গে থাকে সবজি, দই ও আচার। (“আমার ঠাকুমা দিদিমার রান্না” (আনন্দ)  শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায় ) মশলা দেওয়া মোটা মোটা পাঁপড় আটার সঙ্গে মেখে নিয়ে বানানো হয় এই পরোটা। সঙ্গে থাকে কুচোনো পেঁয়াজ, ধনেপাতা, আদাবাটা, লংকাবাটা আর আমচুর। বাঙালির ঘরে গুড় দিয়ে পরোটা এক আবেগ বৈকি! আর তাই বুঝি সুকুমার রায়ের “ভাল ছেলের নালিশ”-এও পরোটা না খেতে পেয়ে ভালো ছেলের মনখারাপের কথা ওঠে!

মাগো!
প্রসন্নটা দুষ্টু এমন! খাচ্ছিল সে পরোটা
          গুড় মাখিয়ে আরাম ক’রে বসে-
আমায় দেখে একটা দিল,নয়কো তাও বড়টা,
          দুইখানা সেই আপনি খেল ক’ষে!

 

*ছবি সৌজন্য: Cookpad, Pakwangali, curlytales, Youtube

Indira Mukhopadhyay Author

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।

One Response

  1. জিভে জল করে টলমল । পরাঠা বা পরোটা বা পুরনপললী …যে নামেই ডাকি, পরোটা’র জবাব নেহি ! পরোটা মাঙসো, পরোটা গুড় দিয়ে, পরোটা আলুর দম দিয়ে… পরোটা সবার সাথেই ঘর করতে পারে। আমার গিন্নি তো একটু আচার পেলেই হলো… আবার আমার একসময় শখ ছিল চা দিয়ে পরোটা। তাই পরোটা সর্বত্র গামী ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *