উদয়পুরে লোকে বেড়াতে যায়। আর আমি চাকরি করতে! তবে রাজস্থানের এই শহরে পৌঁছে বেশ ফুর্তি হয়েছিল। কিন্তু সেই পুলকের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র এক বেলা। সন্ধ্যেবেলা স্থানীয় বাজারে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিজের আস্তানার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে দেখি এক ফলের রসের দোকানে বেশ ভিড়। সেটা ফাল্গুন মাস ছিল, বেশ ভালো গরম পড়ে গিয়েছে রাজস্থানে। এক গেলাস ফলের রস খেলে মন্দ হয় না এই ভেবে আমিও দোকানে লাইন দিলাম। রসওয়ালা হাতে গোলাপি রসের গেলাস ধরাতে যতটা ঘাবড়ালাম, তার চেয়ে বেশি ঘাবড়ালাম এক চুমুক দিয়ে। গোয়েন্দা করমচাঁদ আর খরগোশ ছাড়া কেউ ফাল্গুন মাসে গাজর খায়, এই বাঙালি পেট তা জানত না। তাই মানে মানে সেই গেলাস রেখে আস্তানার উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম।

ঈশ্বর আরও বড় চমক রেখেছিলেন পরের দিন। আমার সাথে দালবাটির আলাপ করানোর জন্যে, যার পরে আর জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে টিফিনবক্সে করে পাঁউরুটি-মাখন নিয়ে বেরতে শুরু করলাম। বাঙালি পেটের সঙ্গে যার আবাল্য পরিচয়। এই ভাবেই রাজস্থানি খাবারকে গালাগাল দিয়ে পাঁউরুটি চিবিয়ে দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু একদিন পাশের শহর ষাট মাইল দূরে ভিলওয়ারা যাওয়ার সময় টিফিন নিতে ভাগ্যিস ভুলেছিলাম! কিছুতেই আর স্থানীয় খাবার খেয়ে নিজের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করব না যতই মনে করি, একসময় খিদের চোটে রাস্তায় নামতে হল। এদিক ওদিক খোঁজ করতে নজরে এলো একটা সাইন বোর্ড — পরোটা প্যালেস। যাক! চেনা খাবার পেয়েছি এই আনন্দে ঢুকে পড়লাম। মেনু দেখে চক্ষু চড়কগাছ! এত রকমের পরোটা হয় জন্মে জানতাম না। আমার দৌড় ছিল আলু পরোটা অবধি! আর এখানে কপি, মুলো, গাজর, পালং, পনির থেকে কিমা পর্যন্ত সবকিছুর পরোটা। শুরু হল আমার পরোটা পরিক্রমা। প্রত্যেক সপ্তাহে আমায় ভিলওয়ারা যেতে হতো, আর প্রতি সপ্তাহে আমি বিভিন্ন রকমের পরোটা চেখে দেখতাম। যাতায়াতের পথে নাথদোয়ারা পড়ত, সেখানেও পরোটার এক ঠেক আবিষ্কার হল। তীর্থযাত্রীদের জন্যে নিখাদ নিরামিষ পরোটা। কিন্তু ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন মশলা আর সবজি।   

পরোটা কিন্তু ভারতে ঢুকেছে বেশি দিন আগে নয়। মাত্র সাড়ে চারশো বছর আগে মোঘলদের হাত ধরে।  এ দেশে এসে বসবাস করতে করতে স্থানীয়দের ঘি আর তেলে ভাজা পুরি খেতে দেখে আটার লেচি বেলার সময় পরতে পরতে ঘি দিয়ে এক বিশেষ রুটি বানিয়েছিল মোঘল জমানার বাবুর্চিরা। পরত আর আটা মিলিয়ে তার নামকরন হল পরোটা। প্রথম যুগের পরোটা ছিল দুধে আটা মেখে বানানো বাকিরখানি, যেটা খুব কম দিনেই আমির ওমরাহ্‌দের অন্যতম প্রিয় পদ হয়ে উঠলো। লখনউতে মাহমুদ নামে এক শ্যেফ সেই বাকিরখানিকে আরও কেতাদুরস্ত করে শীরমল বানিয়েছিল – যা পরোটা-কুলতিলকের সম্মান পেতে শুরু করলো। এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠলো মাহমুদের তৈরি শীরমল যে শাহী উৎসবে আর বিশেষ অনুষ্ঠানে দিনে মাহমুদকে এক লাখ শীরমল বানাতে হতো। শুরুর দিকে পরোটা থাকত পার্শ্বচরিত্র হিসেবে। মূল চরিত্রে থাকা মাংসের বিভিন্ন পদকে আরও আকর্ষণীয় আর মুখরোচক করার জন্যে। কিন্তু অচিরেই এই পরোটা আমিষ দস্তরখানের বাইরে বেড়িয়ে হিন্দু হেঁসেলে তার খোশবাই ছড়াল সমগ্র উত্তর ভারতে। 

ইতিহাসের ইতিবৃত্ত ছেড়ে আবার রাজস্থানে ফেরত গিয়ে দেখি আমাদের কলকাতায় যেমন দুপুরে ঠেলাগাড়িতে করে আচার বা হজমির গাড়ি ঘোরে, রাজস্থানে সেরকম পরোটার ঠেলাগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে ইস্কুলের সামনে, অফিসের পাশে, পাড়ার মোড়ে। আলু পরোটা, গোবি পরোটা, মুলি পরোটা আর পাঁচমিশালি সব্জির পরোটা ইচ্ছে মত বানিয়ে দেবে। সঙ্গে দেবে একটা লঙ্কার লাল চাটনি আর ধনেপাতার সবুজ চাটনি। পাশের ঠেলাতে ছাস, মানে ঘোল। পরোটা খাও। শেষে ঘোল/ বিকেল সন্ধ্যে, পেটটা ঢোল… এই মন্ত্রে স্ব-দীক্ষিত বাঙালি প্রাণকে আর রোখে কে?

নিত্য পরোটা অভিযান চলল! রাজস্থান থেকে সেই সময় বেশি ট্রেন সরাসরি কলকাতায় আসত না, দিল্লি হয়ে আসতে হত। সেথায় চাঁদনি চকের পরোটাওয়ালি গলি তো পরোটা-প্রেমীদের তীর্থক্ষেত্র! দেড়শো বছর ধরে পরোটা খাইয়ে চলেছে বলে দাবি করে, কিন্তু আমার তো মনে হয় সেটা বিনয়বশত। একটুও অবাক হব না যদি জানতে পারা যায় সম্রাট শাহ্‌জাহান এই চাঁদনিচক তৈরি করার পর বিকেলে মেয়ে জাহানারার সঙ্গে এই পরোটা-বিক্রেতাদের পূর্বপুরুষদের দোকানে ঢুঁ মারতেন। এখানে আবার পরোটার দোকানের পাশে ঘোল নয়, পুরোদস্তুর লস্যি! ভোরের গাড়িতে দিল্লি পৌঁছে মালপত্র নতুন দিল্লি স্টেশনে জমা দিয়ে একটা অটোরিক্সা নিয়ে সটান পরোটাওয়ালি গলি –কলকাতা যাতায়াতের পথে এটাই হয়ে উঠল দস্তুর! মন্ত্র গেল বদলে! পরোটাওয়ালির পরোটা, তার সঙ্গে লস্যি, নির্বাণপ্রাপ্তিও যে ইহার কাছে নস্যি!

কিন্তু সুখ আবার বেশি দিন সয় না আমার, তাই কলকাতায় ফেরত এলাম। কিন্তু সেই কলকাতা বা বাংলায় যাওয়ার আগে পরোটার অন্য দুই ভাইয়ের কথা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। 

উত্তর ভারতের পরোটার এক দাদা আছে, নান। উন্নাসিকতা আর ল্যাদের জন্যে বলরাম বা মাইক্রফ্‌ট হোমসের মতো নিজের ভাইদের পিছনেই থেকে গেল সে। যদিও পরোটার জন্মের প্রায় আড়াইশো বছর আগে থেকেই বাদশা নবাবদের থালায় একে পাওয়া যেত। আমির খুসরু থেকে আলমগির — সব্বার প্রিয় ছিল এই নান, যা দিয়ে মাংসের পদ খাওয়া হতো সেই জমানায়। শুধু আমিষ নয়, ঔরঙজেব তাঁর দস্তরখানের নিরামিষ খাবারের সঙ্গে নানই খেতেন। শাহ্‌জাহান নাকি তাঁর নির্বাসনের দিনগুলোতে বিরিয়ানির চেয়ে নান খেতে বেশি পছন্দ করতেন। সাধারণ মানুষের কাছে পৌছতে না পেরে পিছিয়ে পড়ার কষ্ট এতদিনে নানের কমছে… নিজের রূপ এক রেখে আয়তন বদলে বেবি নান হয়ে সাধারণ মানুষের পাতে পৌঁছে যাওয়ার পর! ইদানিং তো সে বাঙালি যজ্ঞিবাড়ির বুফে স্টলে পর্যন্ত জায়গা করে নিয়েছে! 

এই প্রসঙ্গে নানের এক তুতো ভাই কুলচার কথা না বলে পারছি না। সাধারণের খাবার না হয়েও রাজ্যের পতাকায় নিজের জায়গা করে নিয়েছিল, এতটাই গুরুত্ব পেয়েছিল কুলচা নিজামের রাজ্যে! গল্প আছে, সুফি পির হজরত নিজামুদ্দিন ঔরঙ্গাবাদি, মীর কামরুদ্দিনকে নেমন্তন্ন করে তাঁকে এক টুকরো হলুদ কাপড়ে করে কুলচা পরিবেশন করেন। ক্ষুধার্ত কামরুদ্দিন সাতখানা কুলচা খেয়ে নেন, এতই খিদে পেয়েছিল তাঁর! হজরত নিজামুদ্দিন ভবিষ্যদ্বাণী করেন কামরুদ্দিন একদিন রাজা হবেন আর তাঁর বংশধরেরা সাত প্রজন্ম ধরে রাজত্ব করবে। এই মীর কামরুদ্দিন হচ্ছেন হায়দ্রাবাদের আসফজাহি বংশের প্রতিষ্ঠাতা আসফ জাহ। তিনি কুলচাকে স্থান দেন নিজামের হেঁসেলে আর নিজামের পতাকায়।  

অনেক বাইরে বাইরে ঘোরা হল। এ বারে ফেরা যাক নিজের ঠেকে। সেখানে তাহলে পরোটা-বৃত্তান্ত কী দাঁড়াল?

কলকাত্তাই বাবু কি তাহলে পরোটা খান না বাড়ির বাইরে? বাঙালি পরোটা মানেই কি বাড়িতে বানানো ময়দার তেকোনা? কলকাতা ফেরত আসার পর পরোটা খুঁজতে বেরিয়ে ধারণা আমূল বদলে গেল। বাংলার পরোটাতে পুর দেওয়ার প্রচলন নেই বটে, কিন্তু তা বলে পরোটার ক্ষেত্রে মোটেই পিছিয়ে পড়েনি! উল্টে এখানে মেলে এমন এক পরোটা যা এক কথায় অনন্য — পেটাই পরোটা। এ দেশের আর কোথাও খিদে আর রেস্ত ব্যালেন্স করা এহেন পরোটা পাওয়া যায় বলে আমার জানা নেই!

মফঃস্বলে জন্ম নেওয়া এই পরোটা এখন শহরের কুলীন খাদ্যাঞ্চলগুলো বাদে সব জায়গায় রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে! শুধু পথ-চলতি মানুষ, হাটুরে আর শ্রমজীবী নন, এর ক্রেতা এখন সব্বাই। হাইওয়ের পাশের ধাবাগুলোতেও আলু পরোটার পাশে নিজের জোরে স্থান ম্যানেজ করেছে এই পেটা পরোটা। দিল্লি রোডের হিন্দুস্থান হোটেল বা বম্বে রোডের শের-ই-পঞ্জাবে আলু পরোটা খেতে দাঁড়ালে দেখবেন, আশেপাশের দোকানে পেটা পরোটা ঠিক পাওয়া যাবে। কারণ এই পরোটা পেটে বা পকেটে কোথাওই চাপ সৃষ্টি করে না। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, এই পাতলা ফিনফিনে মধ্যবিত্তের শীরমল হজম করাটা এক্কেবারেই ঝক্কির নয়। যে বঙ্গপুঙ্গব চোখের সামনে এক প্লেট আলু পরোটা আর আচার সামনে রাখলে মানসচক্ষে জোয়ানের আরকের শিশি দেখেন, সেই মানুষই একশো গ্রাম পেটাই পরোটা খেয়ে নির্দ্বিধায় আরও পঞ্চাশ গ্রামের অর্ডার দেন। কারণ পেট-পাতলা গড়পড়তা বাঙালির মতো এই পরোটাও পাতলা। বাঙালির স্বপ্নের মতই সুবিশাল। বাঙালির বাস্তবের মতোই সেই বিশাল পরোটার এক মুঠো ছেঁড়া অংশ পাতে আসে। আর বাঙালির উচ্চাশার মতোই ইচ্ছে হলে এক-দু’মুঠো বেশি কেনা যায়, যদি খিদে না মেটে!    

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।

7 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *