সময়ের পিদিমফেরানো ডাকে ফুল্লরার রান্নাঘরে বাড়ন্ত হয় সবজে বাতাস। একচিলতে নিকোনো দাওয়ায় তখন রোদ্দুর, আঁচল পাতে আকিঞ্চনে। জিরোন মুহূর্তের পল গুণে মৌসুমী আনে দু’একটা পথভোলা পিছুফেরা। থিরথিরে কানের লতিতে মুখ রাখে পাখিময়তা…
চরণছোঁয়া চড়ুইগুলো চিকচিকোনো বাতাবাহক
বার্তা তো নয় ডাক পাঠানো
কথার ফাঁক
ফাঁকির মধ্যে জোড়াশালিক জোড়াঠোঁট
প্রেমকেদারায় তেহাই ঠোকে
নেত্র ঠ্যাকায় নিত্য ঠ্যালা
ঝাঁপতালেতে বিষমবাহু দশাবতার
দশদিকেতে কূল ঝাঁপানো
দারুণ অগ্নিবাণ
ও তেহাই তোর ঠ্যাকার লগে আর কত দূর ঠকবো বল!
সাঁঝবেলাতে গলায় আঁচল। উঠোন ঘেষে তুলসিতলা। প্রদীপ ভাসায় ফুল্লরা। নোয়ানো মাথায় সংসারী চাওয়া। নিজের জন্য কি যেন চাওয়ার ছিল। মনে পড়ে কি পড়ে না মুখ তুলে দেখে পরান মাঝি-
— ফকিরবাবা জলপড়া দেছে, খেইয়ে লে ফুল্লরা
— আজ রেতে তোর কোলে চাঁদ লামাইব রে
দশ বছরে তামাটে হয়ে যাওয়া কথা। তবু ফুল্পরার চিকন শ্যামল গালে ছোপ ধরে। টেপা ঠোঁটের কোণে টুকরো মেঘ উড়িকিনাউড়ি…
এ কলম গল্প মাগে
কুল্পে একটা গল্প
চর্বচোষ্য সহজপাঠ্য
রঙিন দিনের বাতবাহক বাতলেছিল পরানকথা
গল্পবিহীন দিনের আলো মুখের থেকে মুখোশ খুলে
গাঁথছে কথামালা
কথা তো নয়
গোড়ে ও জোড়ে সুতোর ফাঁসে ফুলওয়ালি
যক্ষ রক্ষ কেতাদুরস ইঞ্চিফুটের বেরাদরি
কৌমুদিও কুটুম্বিতায় কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ
ও পরান তোর পারানির লগে আর কতদূর বাইব বল!
দশ-দশটা বছর। পরান মাঝির নাও বয়ে যায় অকুল দরিয়ায়। তাগা তাবিজ মানত পুজো জলপড়া আর পীরের দাওয়াই। কোনও কুলেই চাঁদের হাটের সওদা জোটে না। চাঁদের কণা ফাঁকি দিয় আকাশ জুড়ে রৌশন লাগায়। পরান মাঝির খড়ের চালে বেবাক অন্ধকার।
কুড়ে ঘরের দখিন্দুয়ার দিনেরাতে কমে ও বাড়ে। মাতাল হাওয়া দামাল পায়ে ছুটদুরস্ত। মনখারাপিয়া পারাবত কড়ি খোঁজে, বুকের কাছে ছোট্ট নরম স্পর্শ…
কন্ঠলগ্ন উজান এ ঘর ওঘর বানভাসি
নিরবধি নীলাম্বরি নদীর কথা
পত্রে লিখে টিল বেধেছি
মেঘের গায়ে
যক্ষপুরী যোজনদূর
থাকা-না-থাকার টেরাকোটা পথ
ও মাঝি তোর চাঁদের লগে নাও নিয়ে আর ঘুরবো কত বল!
– এ বছর কষে মৌ বুনেছে রে। তোর মন পসন্দ লতুন নাও এর লগে ট্যাকা তো চাই
— পরানডা যে ছাড়তে নারাজ গো মাঝি। মধুর লগে মনিষ্যি আর মনিষ্যির লগে দক্ষিণরায়ের বাহন। ডর লাগে গো মাঝি।
— জোয়ানমর্দ দেহ তবে কীসের লগে ক’ দেখি? একটা লয় ডজনখানিক বাঘ মারতি পারে এই হাত।
নৌকার লগি ধরে ধরে কড়া পড়ে যাওয়া হাতের চেটো সামনে মেলে ধরে হেসে ওঠে পরান মাঝি। একঝাঁক পায়রা উড়ে যায় রান্নাঘরের চালে। বাঘ মারার কায়দা কানুন দেখাতে সেই হাতেই ফুল্লরাকে দাওয়া থেকে তুলে ঘরে সেঁধোয় পরান …
এর পরে আর গপ্পকথা
প্রেমের ছাঁদে হাজার কলা ললিতকলার সাজ পরে
সাদাসিধে মাঝির ঘরেও সমান তালে জোছনা ঝরে
সেই আলোতে পথ দেখে নেয়
জোছনা লেগে ডানা মেলে
গভীর নাভি
ব্যাকুল পরান
ভালোবাসার বেভুল কাঙাল
চিলতে খানিক জানলা গলে চাঁদের কণা লটকে পড়ে
হেই দেওতা ছেঁড়া মাদুর দুটো শরীর স্বর্গ রে তোর আর কতদূর বল!
ন্যাড়া হাত দুটো কোলের ওপর রেখে একমনে বনবিবির পাঠ শোনে ফুল্লরা। বনবিবির দয়া বিনে সৌঁদরবনের রাজার থেকে কেই বা বাঁচে। দিন চলে যায় দিনের মনে। হাতের কড়া গোণে ফুল্লরা। গুণতে গুণতে দিনমণির ঘোর লাগে। দিনের দিনে সবাই ফেরে। ফেরে না শুধু পরান তার। সিঁথিতে আগুন নিভতে নিভতে সাদা থানের পাড় খসায়।
গোবরজলে দাওয়া নিকোনোর পাট চুকেছে সেই তো কবে। একেলাপন দাওয়া এখন পড়ে থাকে নিজের মনে। রোদ্দুর রোজই আসে, যায়ও। শুধু রোদপাতা আঁচল কড়ি খুজে সারা …
সারাদিনমান সবজে বাতাস
বাড়ন শুধু শ্বাসের জন্য চিলতে ইচ্ছে
চিলতে খানিক জীবন চাওয়া
যাপনঘন ইচ্ছেগুলো ছড়ায়না পা অঙ্গনে
মৌসুমীও নিজের ঢঙে
হাজিরা দেয় দেদার স্মৃতি
মন্ত্রমুগ্ধ কানের লতি
নিথর আজি
মুখর শুধু পরানস্মৃতি
ও মেয়ে তোর ছেড়া স্মৃতির জিয়ন লগে আর কত নাও বাইবো বল!