সন ১৩৪৮। প্লেগ অধ্যুষিত ফ্লোরেন্সের রাজপথে সন্তর্পণে হেঁটে চলেছেন রেনেসাঁর অন্যতম লেখক জিওভানি বোকাচ্চিও। খোলা রাস্তায় যত্রতত্র পড়ে আছে গলিত মৃতদেহ। শূন্য বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসছে পচনশীল শবের অসহনীয় দুর্গন্ধ। ভয়ার্ত, আশঙ্কাগ্রস্ত মানুষ দিশাহারা; ভেঙে পড়েছে জীবনের সমস্ত কাঠামো, সামাজিক বন্ধন। ভাই ত্যাগ করেছে ভাইকে, প্লেগগ্রস্ত সন্তানকে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছে মা-বাবা। জনজীবন স্তব্ধ, মহামারী ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে ফ্লোরেনটাইন সভ্যতার পরিপাটি চালচিত্র। বোকাচ্চিওর কলমে ফুটে উঠল দশ বন্ধুর গল্প, যারা ফ্লোরেন্স ছেড়ে গ্রামের এক পরিত্যক্ত ভিলায় গিয়ে উঠেছে। মৃত্যুর খাঁড়া ঝুলছে তাদের মাথায়। কিন্তু মহামারীর নাগরিক কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে, নির্জনতা, মৃত্যুভয়, রোগভয়, বিষাদের মহৌষধি খুঁজে পেয়েছে তারা। তাদের কবচ-কুণ্ডল-বর্ম হয়ে উঠল সখ্যতা ও কথকতা।
প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে আগুনের চারিপাশে বসে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কথা ও কাহিনির জালে বুনেছে জাগতিক-মহাজাগতিক ও সামাজিক মেলবন্ধনের জলছবি। মহামারীর সময়ে, বিচ্ছিন্নতার সময়ে, সেই গল্পবুনন, সেই হাল্কা হাসির, গানের, প্রার্থনার, ক্রিয়াশীলতার ওষধি হয়ে উঠল মহাসঞ্জিবনী। ‘ডেকামেরন’-এ লেখা বোকাচ্চিওর এই প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করে মধ্যযুগে তৈরি হল প্লেগভীতি প্রতিষেধক নানা উপদেশাবলি। ফ্লোরেন্সের তৎকালীন বিখ্যাত ডাক্তার টোমাসো ডেল গারবো বললেন, মৃত্যুচিন্তায় মগ্ন না হয়ে মানুষ গান করুক, কথকতা হোক মধুর গল্প কাহিনির, মানুষ উজ্জীবীত হোক ইতিবাচক কথায় ও কাজে। বার্গোর দার্শনিক নিকোলাস বললেন, মন মুক্ত হোক ভারী চিন্তা থেকে। রাগ-ভয়-দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবার উপায় গল্পে, হাসিতে, ঘুমপাড়ানি গানে, সুরের মাধুর্যে। অবসাদ সরে গিয়ে মন স্থিত হোক আন্তরিক আনন্দনিবেশে, সমাজের শরীরে প্রাণ সঞ্চারিক হোক সহজিয়া রসাস্বাদনে।
[videopress 57AWnbmu]
সন ২০২০। কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণে বিধ্বস্ত বিশ্ব। ভেঙে পড়েছে আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো। পরিচিত জীবন যেন হঠাৎই এক অমোঘ অশরীরী ধাক্কায় আমূল পরিবর্তিত। আতঙ্কের অজানা ছায়ায়, মৃত্যুর কঠিন হিমেল স্পর্শে আমাদের চেনা পৃথিবী কাঁপছে। চারভাগের একভাগ লকডাউন। সমাজের হাড়ে-মজ্জায়-সুষুম্নায় প্রবল করোনাভীতি। আমার প্রতিদিনকার হাসপাতালে কাজে যাবার পথে চেনা মেট্রোয় অচেনা মুখোশ, ইউস্টন রেলস্টেশন গড়ের মাঠের মতো ফাঁকা। কাশির শব্দে জেগে উঠছে আতঙ্ক। প্রিন্স চার্লস থেকে হরিপদ কেরানি, কারওকেই ছাড় দেয়নি করোনার বিষ। সুপারমার্কেটে কিছু ভয়ার্ত মানুষ উন্মাদের মতো কেনাকাটা করছে। কেউ কেউ ‘ডোন্ট কেয়ার’, কেউবা শতাধিকবার হাত ধুয়ে চলেছে। দোকানে-বাজারে-আপিসে কারফিউ। কঠিন সরকারি নির্দেশিকা যেন এক বিষময় ফুঁয়ে নিভিয়ে দিয়েছে সভ্যতার আলো।
কিন্তু কে রুখবে অপ্রতিরোধ্য বসন্তের হাওয়া? চারিদিকের এই মহেঞ্জোদাড়োর শূন্যতার মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুরন্ত ম্যাগনোলিয়া। দু’মিটারের দূরত্ব বজায় রেখে সন্তর্পণে পাড়ায় হাঁটছি আলেকজান্দ্রা প্যালেসের দিকে। মার্চের প্রথম বাসন্তী রোদ গায়ে মেখে। মনে পড়ে যাচ্ছে বোকাচ্চিওর দশ বন্ধুর কথকতা। মহামারী প্রবল অন্ধকারের বুক থেকে ড্যাফোডিল আলো ছিনিয়ে এনে হালকা হাসিতে তারা ছড়িয়ে দিয়েছে বিংশ শতাব্দির করোনার কলোনিতে। এ সময় ভয়ের। এ সময় নির্ভীকতার। এ সময় সামাজিক দূরত্বে দাঁড়াবার। এ সময় ভীতিপ্রদ রক্তচক্ষুর দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকবার। এ সময় আশঙ্কার বুকের উপর দিয়ে বসন্তের রথের চাকা চালানোর সময়। এ সময় ঘরবন্দি হয়ে থাকবার। এ সময় শান্ত, মগ্ন, অন্তর্মুখী হবার সময়। এই অন্তরীণ করোনীয় সময় আসলে এক সুযোগ – বহির্মুখি, আত্মকেন্দ্রিক, মহাব্যস্ত, ব্যবহারিক জীবনকে প্রশ্ন করার সুযোগ, আত্মবিশ্লেষণের, আত্মরূপদর্শনের সুযোগ।
মানুষকে, সমাজকে কোভিড-১৯ যেন এক যুদ্ধকালীন হাঁক দিয়েছে – ‘থেমে থাক’।
এই বিরতি, সভ্যতার এই হঠাৎ থেমে যাওয়া, অনির্দিষ্ট আশঙ্কার মাঝে স্তব্ধতার এই গান – এ কি কোনও নতুনতর জীবনের উদ্যোগ, কোনও নতুন বসন্তের পূর্বরাগ? প্রকৃতির কাছে নতজানু হয়ে, অতীত ভবিষ্যতের ঠিক মধ্যিখানে, ক্ষণ-বর্তমানে কী শিখছি আমরা? এই আবিশ্ব ভাইরাস সন্ত্রাস আমাদের কি কিছু চিরন্তন সত্য মনে করিয়ে দিচ্ছে? মানুষে মানুষে দূরত্বে দাঁড়িয়েও আমরা কি একই সূত্রে গ্রন্থিত নই? আমরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আমাদের স্বেচ্ছারোপিত এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা শুধু কি নিজেদের বাঁচানোর জন্যেই? না অন্যের সুস্থতা কামনাও বটে? আমাদের নিজেদের ভালো থাকা, সুস্থ থাকা মিশে গেছে অন্যের মহানুভবতায়। করোনার সন্ত্রাস কি বেঁধে ফেলেছে আমাদের এক বিশ্নজাগতিক ভ্রাতৃত্ববোধে? এ এক ভয়ানক সময়, তবু এ সময় নতুন ভাবনার, নতুন দরজা খুলে দেবার মহাসন্ধিক্ষণ। যেসব ছোট সুখ, জীবনের ছোট ছোট আনন্দ আমরা ভুলতে বসেছিলাম, অন্তরীন হয়ে এই ‘বিরতি’র মাঝে জীবনের সেইসব ঐশ্বর্য খুঁজে নেওয়ার, জীবনের মানে খোঁজবার উর্বর সুযোগ আমাদের সামনে।
গভীর কৃতজ্ঞতায় অবনত আমাদের প্রতিদিনকার জীবন; প্রথম সূর্যের আলো, হাত পাতলেই কলের জল, গন্ধলেবুর সুবাস, হাতের কোমল স্পর্শ, ফিরতি ট্রেনে রুমাল পেতে হুল্লোড় তাসের আসর, চায়ের দোকানে জমে ওঠা সজীব আড্ডা, শেষ শো-এর সিনেমা দেখে মাইল মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরা, বারান্দায় নিঃশব্দে জ্বলে ওঠা জুঁই, ফেরিওয়ালার চেনা বেসুরো ডাক, মাছের বাজারের আঁশটে গন্ধ, রবীন্দ্রনাথের গান –
বোকাচ্চিও জানতেন না, প্লেগ কী ভাবে ছড়ায়। আমরা জানি কোভিড ভাইরাসের নাড়ি নক্ষত্র। কিন্তু বোকাচ্চিওর ভালো থাকার নিদান অনুসরণ করে দূরত্বে থেকেও আমরা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্ব জুড়ে চলেছে এক অভিনব জাল বোনার উৎসব – মনসংযোজনের নতুন পরিক্রমা! জুম মিটিং, স্কাইপ, হোয়াটস্যাপ, ফেসটাইমে একবিংশ শতাব্দীর ঘাতসহ মানুষ কথকতার আসর বসিয়েছে; গল্পে, গানে, প্রার্থনায়, ভাবের আদানপ্রদানে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে করোনার কালো মেঘমালা। বিচ্ছিন্নতার অবসাদকে ছিন্ন করে মানুষ মানুষকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, রংয়ে রং মিলিয়ে খুঁজে নিচ্ছে বাঁচার রসদ। পার্থেনন ধুলো আজ। ব্যাবিলন ছাই হয়ে গেছে। আমরা পেরিয়ে এসেছি মন্বন্তর, মহামারী। রোমে-মাদ্রিদে–কলকাতার আকাশ আজ মুখরিত হচ্ছে আশার নতুন তোপে – কৃতজ্ঞ হাততালির, ঘণ্টার, কাঁসরের শব্দে। মানুষ পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে নব চেতনার উন্মেষনে, এক নতুন পৃথিবীর দিকে, নতুন বসন্তের আগমনী গান গেয়ে। হাজারও মৃত্যুর মাঝেও আজ ফুল ফোটবার দিন, অপ্রতিরোধ্য বসন্তের দিন।
[videopress g0FDzPpf]
ডঃ অমিতরঞ্জন বিশ্বাসের জন্ম, বেড়ে ওঠা কলকাতায়। ১৯৯৭ সাল থেকে লন্ডনের বাসিন্দা। পেশায় চাইল্ড নিউরো সায়কায়াট্রিস্ট এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কিন্তু প্রবাসযাপন বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি শেকড়ের টান। ছেলেবেলা থেকেই নিয়মিত বাংলা নাটক, নাচ, সিনেমা, সাহিত্যের সঙ্গে বসবাস। হোমাপাখি নাটকের রচয়িতা যার মঞ্চায়ন করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং। সৌমিত্রর সঙ্গে তৈরি করেছেন 'ব্রিজ' নামে চলচ্চিত্র যা একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত। প্রকাশিত হয়েছে দুটি কবিতার বই।
Important.Thanks.
অসাধারণ লেখনিশৈলী ও খুব সময়োপযোগী লেখা ৷ তথাকথিত মহামারীর বিবরণ ছবির মতো আঁকা ৷তখনের মহামারীর সাথে এখনের ব্যবধানও অনেক৷ শুধুই ঘরবন্দী মনখারাপ নয় ,আছে মন ভালো রাখর অনেক উপায় ৷ বিনোদন জগৎ আর ইন্টারনেটের অবদান অনস্বীকার্য ৷
তবে ব্যস্তময় পৃথিবীর এই থেমে থাকা বোধহয় দরকার ছিল৷Pollution e কলুষিত আকশ বাতাস নির্মল করার …আমাদের Ecosystem ta clean up করার দরকার ছিল ৷ দরকর ছিল টাকার পেছনে দৌড়নো mechanised জীবনের গন্ডি ভাঙ্গ৷র ৷
লেখক একজন যাদুকর। এক নিমেষে ইতিহাসকে টেনে এনে বর্তমানে মিশিয়ে দিলেন । আর সেই সঙ্গে যাদুদন্ড ঘুরিয়ে বললেন , ওহে মানুষ, জীবনের প্রতিদিনের ছোট্ট ছোট্ট আনন্দের মধ্যে বাঁচো। সেটাই পরম পাওয়া ।
বিশ্বজুড়ে মৃত্যুভয়ের মধ্যে এক টুকরো বরাভয়।
thank you for your kindest comment