রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতবিতান’ গ্রন্থখানি যেন শত-সহস্র আলোর কণায় পূর্ণ স্বয়ম এক আলোক উৎস। যিনি নামের ভিতর সূর্য ধারণ করে আছেন, তাঁর অন্তরে সেই সূর্য ও তার আলোক ক্রমাগত হয়ে উঠল এক আশ্চর্য প্রতীক। ‘রবি’ শব্দটি তিনি বহু গানে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু রবি প্রতীকায়িত নয়। হয়তো রবি শব্দ-সম্বলিত একটি বাক্যবন্ধ কোনও দার্শনিকতার আভাস দেয়, কিংবা তার অর্থ পরতে পরতে আত্মউন্মোচন করতে থাকে ভিন্নতর অর্থে, কিন্তু রবি সেখানে ধ্রুব হয়েই বিরাজ করেন। যেমন,

নবীন রবি উঠবে হাসি বাজাবে মেঘ সোনার বাঁশি
কালোয় আলোয় যুগল রূপে

এ গানের  প্রথম পঙ্‌ক্তি “শ্যামল ছায়া নাইবা গেলে”। ভৈরবী রাগিণীর অঙ্গীয় রূপে, ষাট বছর বয়স পার করে এ গান লিখেছেন তিনি। ষষ্ঠী তালের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে গানখানি বাদলবেলার বিদায়কালে বিষাদবিধুর। অথচ শুধু বিষাদ নয়, নতুন সূর্য হেসে উঠে মেঘে মেঘে ছড়িয়ে দেবে সোনার আলো, সেই আলোর সোনা কুড়িয়ে বাঁশি বানিয়েছে মেঘের দল, বাজাবে বলে। শুধু কি সুর বাজাবে? সেই  আশ্চর্য বাঁশির সুর আরও এক আনন্দময় সংঘটন সম্ভব করবে। সে মহাশূন্যে কালো ও আলোর যুগলরূপের মিলন ঘটিয়ে তুলবে।

এখানে রবির কাজ আলোর বিকিরণ, সে কাজ  ধ্রুব। কিন্তু আলোর ব্যঞ্জনায় প্রতীকায়িত অর্থ বহুমাত্রিকতা নিয়ে এল অনায়াসে। কালো কখনও পরিহার্য  হচ্ছে না। কালো ও আলো যুগল, অবিচ্ছিন্ন। ভারতীয় পুরাণের রাধা ও কৃষ্ণের প্রতীক এখানে বাঁধা পড়তে পারেন অনায়াসে, কালো ও আলো ভাল ও মন্দের অস্তিত্ব হতে পারে। অভিপ্রেত ও অনভিপ্রেতর অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কও স্থাপিত হতে পারে। অর্থাৎ বৈপরীত্যের চিরন্তনী প্রতীক রূপে আলো ও অন্ধকার রবীন্দ্রনাথের চেতনায় একাকার হয়ে ছিল।

Alo
কালোয় আলোয় যুগল রূপে…। ছবি সৌজন্য – randomrants.com

গানের ভুবনে রবীন্দ্রনাথ দ্রষ্টা ও দার্শনিক। মহাজগতের প্রাণপ্রবাহে তিনি প্রতি মুহূর্তে নিজেকে চিনতে চিনতে চলেছেন। সেই চেনার ভিতরকার উপলব্ধি দিয়ে গান রচনা করছেন, ঠিক যেমন করে মেঘ বাজিয়ে তুলছে সোনার বাঁশি। তাই তাঁর গান দর্শন ও প্রকাশ। দার্শনিকতার তাত্ত্বিক প্রকরণে প্রবেশ না করে, এই যে তিনি কথা ও সুরের তুলিতে, তালের রঙে, রাগ-রাগিণীর আবহে উপলব্ধির ছবিকে গান করে তুললেন, তার তুলনীয় শক্তিমান আর কিছুই হতে পারে না। এই কথার সঙ্গে সকলের একমত হয়ে ওঠার প্রয়োজন নেই। সেই প্রত্যাশাও নেই। মানুষ আজ পর্যন্ত কোনও বিষয়েই একমতে পৌঁছতে পারেনি। তাতে কোনও সমস্যাও নেই।

রবিগানের সঙ্গে আলোর সম্পর্ক বিষয়ে ভাবলে প্রথমেই মনে পড়ে ,

আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন –ভরা
আলো নয়ন-ধোয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা।।

‘আলো’ শব্দ দিয়ে গীতবিতানের সূচীপত্র সন্ধান করলে প্রথমেই এই গানটি পাওয়া যাবে। আগাগোড়া এই গান আলোর একমাত্রিক অর্থ নিয়েই প্রবাহিত হয়। গানটি বর্ণনাধর্মী। এখানে আলো রবিকিরণ মাত্র। আলোর স্রোতে প্রজাপতি পাল তুলেছে, মল্লিকা-মালতী মেতে উঠেছে, মেঘে মেঘে সোনা হয়ে গেছে আলো, পাতায় হয়ে উঠেছে হাসিরাশি। সারা ভুবন যেন আলোকস্নাত উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত। এমন ধারাবিবরণী গান রবীন্দ্রনাথ অনেক লিখেছেন। আপাতচক্ষে এ গান তেমন ভাবায় না, কিন্তু একটি শব্দবন্ধে এসে চুপ করে ভাবতে ইচ্ছে করে। ‘আলো নয়ন-ধোয়া আমার’। সাধারণত নয়ন ধুয়ে দেয় অশ্রু। এখন সে কাজ করছে আলো। এই দুইয়ের প্রক্রিয়া কি সম? নাকি বিপরীত? অশ্রুও যেমন সর্বদা দুঃখের ধারা হয়ে আসে না, তেমনি আলোর বিভাসের পূর্বকথা কোনও বিষাদাচ্ছন্নতা হতে পারে না কি? অন্ধকারে কোনও গাঢ় বিষাদ আলোক মন্ত্রে তরল আলোর ধারা হয়ে নয়ন ধুয়ে দেয়, অকারণ আনন্দে মন ঝলমলিয়ে ওঠে। মনখারাপের আঁধারে প্রকৃতির যে অবিরাম আনন্দ, কোলাহল দর্শন হতে বঞ্চিত ছিল চিত্ত, আলোর পরশে মুহূর্তে তা সেই স্ফূর্তির অংশ হয়ে উঠল। এখানেই রবীন্দ্রনাথের  বৈশিষ্ট্য। সহজ-সরলের মধ্যে অনায়াসে তিনি ধরিয়ে দিতে পারেন গভীর বোধ। এ গানও তিনি ভৈরবীর সুরে ধরেছেন, রচনা করেছেন একেবারে মধ্যবয়সে, যখন তিনি ঠিক পঞ্চাশ। যদিও বিষয়টি  মোটে এমন নয় যে আলোর অনুষঙ্গ থাকলেই ভৈরবীর সুরের আভাস লাগবে। একটি বহুল প্রচলিত গান ধরা যাক।

চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে।।
ধরায় যখন দাও না ধরা  হৃদয় তখন তোমায় ভরা,
এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে।।

এ গানও লিখেছেন মধ্যবয়সে। দাদরা তালে বাঁধা, ইমনের সুরবিভঙ্গে। আলোর কথা এখানে বার বার আছে। ইমন দিনান্তের রাগ, কিন্তু গানের কোথাও সূর্যাস্তের প্রসঙ্গ নেই। এ গান বর্ণনা নয়, এ গান প্রকৃতি-বিমুগ্ধতাও নয়, এ হল আত্মগত সঙ্গীত। ইমনের কথা মনে রাখার কোনও দায় নেই এ গানের। কোনও কোনও গানে সে দায় পূর্ণ মাত্রায় আছে। যেমন,

মনোমোহন, গহন যামিনীশেষে
দিলে আমারে জাগায়ে।।
মেলি দিলে শুভপ্রাতে সুপ্ত এ আঁখি
শুভ্র আলোক লাগায়ে ।।

ঝাঁপতালে, কোমল ঋষভ আশাবরীর অঙ্গে এ গান কেবল সুরের ধর্মেই ভোরবেলাকার নয়, এর কথা ও সুর, ভাব ও প্রকাশ, পরস্পরকে জড়িয়ে আছে দুই প্রেমাশ্লিষ্ট নরনারীর মতো। এর কাল নির্দিষ্ট। আশাবরী যে সকালবেলার ভাব বয়ে আনে, তার বাইরে যাওয়া চলবে না এ গানে। গহন রাতের শেষে আমায় জাগিয়ে দিয়েছ তুমি। আমার এ বন্ধ চোখ মেলে দিয়েছ শুভ্র আলোক পরশে। এ গানে আরও এগিয়ে গেলে দেখা যাবে মিথ্যে স্বপ্ন মিলিয়ে যাচ্ছে এই আলোর প্রভাবে, অন্ধকারও মিলিয়ে যাচ্ছে। আভোগে এসে যখন পৌঁছচ্ছে গানটি, তখন এ কেবল ঘুম-ভাঙানিয়া গান না হয়ে মস্ত অর্থ সমেত বিকশিত হয়েছে। সেখানে আছে,

শান্তিসরসী- মাঝে চিত্তকমল
ফুটিল আনন্দবায়ে

যে জাগরণের পর চিত্তকমল শান্তির সরোবরে সানন্দে প্রস্ফুটিত হল, সেই জাগরণ কি কেবল শারীরিক নিদ্রাভঙ্গ? “কেন যামিনী না যেতে জাগালে না”— যে লজ্জা ও ব্রীড়ার সাক্ষ্য দেয়, এই জাগরী তেমন নয় মোটেই। এ গানের শুরুতেই যে আলো, সে আলো শুভ্র, একটু ভোর গড়িয়ে যাওয়া সকালবেলার আলো। আবার এ আলো শুভ্র বলেই এর মধ্যে নির্মল পরশ আছে। এ যেন এক আবিল থেকে, এক মিথ্যার মায়া থেকে, লোভ-লালসা-আকাঙ্ক্ষাদীর্ণ অন্ধকার থেকে চেতনাকে নিয়ে এল শান্তি ও পবিত্রের নির্মোহ সত্যে। এ গানের ‘গহন যামিনী’ এক অন্ধচেতনের যাত্রা কাল।

Alo
চোখের এই আলো দিয়ে দৃষ্টির সীমা ছাড়ানো দর্শন ঘটে গেছে। ছবি সৌজন্য – newsnation.com

জাগরণের এই প্রতীকায়ন ঘটছে বলে এই গানও আলো-অন্ধকারের সঙ্গে সকালবেলায় বাঁধা পড়েছে। কিন্তু “চোখের আলোয়” গানে এ বন্ধন নেই। গোড়াতেই এই আলো অন্তরের আলো। চোখের এই আলো দিয়ে দৃষ্টির সীমা ছাড়ানো দর্শন ঘটে গেছে। চোখ যা দেখিয়ে দেয়, সেই দেখা দিদৃক্ষু মনের দেখা আরও বাড়িয়ে তোলে। সেই বিশালতর দৃষ্টিপাত শেষ পর্যন্ত যখন অন্তরে পৌঁছয়, তখন আলোর কাজ ফুরিয়েছে। অন্ধকারেরও কোনও ভূমিকা নেই। তখন শুধুই চেতনা, শুধুই সত্তা, সংশোধন হতে হতে যা প্রায় পুনর্জন্ম পেয়ে যায়। যত ক্রিয়াকর্ম, মনে হয় অর্থহীনের খেলা। জীবনের ঝড় সেই সব খেলা ভেঙে এক কঠোর সত্যের কাছে এনে দেয় ওই চেতনাকে। আমি আর আমার হৃদয়, অবশিষ্ট জগৎ ভগ্ন বীণার মতো সুর ফিরিয়ে নেয়। এই অন্তরে আলোকহীন দেখার মধ্যে এক প্রগাঢ় বিষাদ টের পাওয়া যায়। বোঝা যায় ব্যাখ্যাতীত একাকিত্ব। এখানে শান্তিসরসী অনুপস্থিত। এ গান যেন, আলোক – অন্ধকারের পরোয়া না করা এক নিঃশব্দ আর্ত চিৎকার শেষ পর্যন্ত।

এর ঠিক বিপরীত দিকে রয়েছে এক আনন্দরূপিণী আলোর গান।

আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো।
আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো।।

মধ্যবয়সের ঠিক আগে আগে এ গান লেখা। ভৈরব রাগের আধারে, তেওড়া তালে এ গান কেবল আনন্দের বিস্তার করে যায়। এর সুর এমন, ভৈরব রাগের গাম্ভীর্য  থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে এ নন্দিত পক্ষীর মতো তরঙ্গায়িত ডানা মেলে উড়ে যায়। এ গানের ভাব ও অর্থ মনোমোহন ‘গহন যামিনী’ গানটির কাছাকাছি। এর আভোগ পর্বে আছে,

তোমার আলো ভালোবেসে পড়েছে মোর গায়ে এসে,
হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো।।

যিনি আলোরও আলো, তিনিই এমনটি ঘটিয়ে তুলছেন।

আলো শব্দটি দিয়ে যে গানগুলি শুরু, তার  অধিকাংশই ভৈরবীর তারে গড়া। তবে রবীন্দ্রনাথের গানে রাগ অস্থি মাত্র। অবয়বের বাকি বিষয় তাঁর নিজস্ব সুরের শৈলী, তাঁর তাল বিষয়ে অপরিমিত জ্ঞান ও পারদর্শিতা এবং অতুলনীয় কথায়  জগতের মহত্তম সৃজন। তাঁর গীতবিতান তাঁরই সেই আলোর আলো।

তিলােত্তমা মজুমদারের জন্ম উত্তরবঙ্গে। কালচিনি চা-বাগানে ইউনিয়ন একাডেমি স্কুল, আলিপুরদুয়ার কলেজ এবং স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা। ১৯৯৩ থেকে লিখছেন। সাহিত্য রচনার প্রথম অনুপ্রেরণা দাদা। ভালবাসেন গান ও ভ্রমণ| ‘বসুধারা' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার এবং সেইসঙ্গে পেয়েছেন আরও অন্যান্য সাহিত্য পুরস্কার। ২০১৭-তে অংশ নিয়েছেন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সাহিত্য কর্মশালায়।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *