গাছ লাগান। পরিবেশ বাঁচান। প্লাস্টিক হঠান। রক্ষা করুন বাস্তুতন্ত্র।
খবরের কাগজ থেকে ইউটিউব, সর্বত্র চলেছে পরিবেশবান্ধব হওয়ার প্রচার। কিন্তু কার তাতে কী? আমরা যদি এই আকালেও অন্ধ থাকি!

আমাদের চোখে পলক পড়ে না। টনক নড়ে না। রমরমিয়ে বেড়ে চলেছে প্লাস্টিকের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতলে ঠান্ডা পানীয়। কেন? না, সুবিধে। এদিকে পায়ের তলার মাটি, মাথার উপরকার আশমান আর নদীর বুকের জলটা না বাঁচলে,  প্যাকেট- বোতলের সুবিধে নিয়ে বাবুমশায়েরা যে কী করবেন, সেটা ঈশ্বর জানেন। নাস্তিকেরা কাকে শুধোবেন জানি না।

অথচ ফেসবুকে-ট্যুইটারে গ্রেটা থুনবার্গের ভিডিও না শেয়ারিলে জাত খোওয়াবার ভয়! যেখানে দেখিবে ভিডিও, শেয়ারিবে তৎক্ষণাৎ! নইলে ভার্চুয়ালে ভার্চু কম পড়িবার প্রবল সম্ভাবনা! আমাজনের আগুন নিয়ে কদিন আগেই তোলপাড় হয়েছিল তামাম দুনিয়া। আলিয়া ভট্ট থেকে ও পাড়ার বেঁটে বড়দা, সকলেই পোস্ট দিয়েছেন। কেউ ছানা-কোলে বানরের চিৎকার, কেউ শিম্পাঞ্জির দুহাত বাড়িয়ে কোলে উঠতে চাওয়ার ছবি। একবারও খুঁজে দেখেননি ছবিগুলো আদৌ আমাজনের কিনা! পরে দেখা গিয়েছিল একটাও ছবি আমাজনের নয়। কিন্তু কার তাতে কী? আমরা যদি এই আকালেও অন্ধ থাকি!

নেটিজেনদের কিঞ্চিৎ বিপ্লব হল, আমি কিনা হেব্বি পরিবেশ-সচেতন তার বিজ্ঞাপন হল, লাইক-কমেন্টের বন্যা বইল। আর হাটে-বাজারে? দিন-দুনিয়ায়? প্লাস্টিক আছে প্লাস্টিকেই। গাছ সাফ করে উঠছে আকাশঝাড়ু বাড়ির দল। সে বাড়ির পেন্টহাউসের সামনে মেকি ঘাসে ঢাকা সবুজ লনে মেহগনি কাঠের গা-ডোবানো কেদারায় বসে অরগ্যানিক চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমরা বলছি, এত্ত অশিক্ষিত লোক চতুর্দিকে… দিলে পৃথিবীটার বারোটা বাজিয়ে!

বারোটা? বলি সতেরোটা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গিয়েছে। খবর এসেছে, ইন্দোনেশিয়ার সাম্প্রতিক দাবানলে আমাজনের দ্বিগুণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন হয়েছে। সংখ্যাটা ৭৮০ মিলিয়ন টন!আর সেই আঁচ কাটতে না কাটতেই আরেক বিধ্বংসী আগুনে জ্বলে যেতে বসেছে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। নিউ সাউথ ওয়েলস-কুইন্সল্যান্ডের বিপুল অংশ এখন আগুনের গ্রাসে। আর সেখানেই বাস শ’ছয়েক কোয়ালা ভল্লুকের, ইতিমধ্যেই যাদের শ’খানেক পুড়ে মারা গিয়েছে। ন্যাটজিও-র দৌলতে কোয়ালার উলি-বাবালি মুখশ্রী এখন অনেকেরই চেনা। কিন্তু এরা যে খুব শিগগিরই বিপন্ন প্রজাতি প্রাণীর লাল তালিকাভুক্ত হবার দিকে এগিয়ে চলেছে, সে খবর কজনের কাছে আছে? তার উপর দাউদাউ করে এগিয়ে আসা এই করাল অগ্নিগ্রাস, যা ইতিমধ্যেই ছাই করেছে পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার আড়াই মিলিয়ন একর এলাকা। পোড়া কোয়ালার আর্তচিৎকারে কাঁপছে অরণ্য।

সে পথ দিয়েই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন মধ্যবয়স্কা টোনি ডোহার্টি। এলাকাটা ছিল নিউ সাউথ ওয়েলসের পোর্ট ম্যাকুয়েরি। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে কোয়ালার কান্না শুনতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ নেমে জ্বলন্ত জঙ্গলে দৌড়ে ঢুকে পড়েন তিনি। গাছের মগডালে আটকে থাকা পোড়া কোয়ালাকে নামাবেন কী ভাবে? লহমায় পরনের শার্ট খুলে তাই দিয়ে জড়িয়ে নেন তাকে। আগুনের বাইরে এনে জলের বোতল থেকে জল ঢালতে থাকেন তার ক্ষতে। ওই বোতলই ধরেন তার মুখে। জল খাওয়াতে থাকেন। সঙ্গীর সাহায্যে কম্বলে মুড়িয়ে তাকে নিয়ে যান হাসপাতালে। নাতির নামে কোয়ালার নাম রাখেন এলেনবরো লিউইস। আর সেই ভিডিওই মুহূর্তে হয়ে যায় ভাইরাল। টোনি ইন্টারনেট সেনসেশন! শেয়ার-লাইক-কমেন্ট-ট্যুইট-রিট্যুইট-ইন্সটা-ফেসবুক-স্ন্যাপচ্যাটে ঘুরতে থাকেন জ্বলন্ত জঙ্গলে ছুটন্ত টোনি আর তাঁর কোলে আধপোড়া কোয়ালা।

কিন্তু তারপর? কী হয়েছিল তারপর? পশুচিকিৎসকেরা তার হাত-পায়ের পোড়া ক্ষতে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন। অসহ্য যন্ত্রণা থেকে কিঞ্চিৎ রেহাই দিতে তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়। হপ্তাখানেক ধরে মৃত্যুর সঙ্গে প্রাণপণ যুঝে অবশেষে হাল ছাড়ে সে। ঘুম আর ভাঙে না। ২৮ নভেম্বর, ২০১৯, বৃহস্পতিবার মারা যায় সে। তা নিয়ে অবশ্য বিশেষ উতরোল হয়নি সোশ্যাল মিডিয়ায়।

কারণ আমরা তখনও মজে কোয়ালা উদ্ধারের ভাইরাল ভিডিওয়। ভিডিওর নেপথ্যের ঝ্যাং ঝ্যাং হলিউডি বাজনার তালে তালে উঠছে নামছে আমাদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস। কারণ আমরা বধির। আমরা অন্ধ। আমাদের হুঁশ নেই যে ওই নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের বাতাসটুকুও আর কদিন পরে অমিল হবে। ইতিমধ্যেই ২৯৯ টাকায় অক্সিজেন বিক্রি শুরু হয়ে গিয়েছে রাজধানীতে। কলকাতাতেও এল বলে। টোনি ডোহার্টির অসীম মমতা আর অসমসাহসও শেষরক্ষা করতে পারেনি। আমাদের জন্য এগিয়ে আসবেন কোন ডোহার্টি? শেষরক্ষা হবে তো?

নাকি মানব-সভ্যতার ধ্বংসলীলাও কেউ দেখবে কোনও এক ভাইরাল ভিডিওতে?

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *