দুর্গা পুজো আর কলকাতা এই দুই স্বত্তা ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে একে অপরের পরিপূরক। দূর্গা পুজো আর কলকাতাকে আলাদা করে ভাবতে পারিনি আমি কখনই। তাই ২০১৬ সালে কর্তার কর্মসূত্রে মার্কিন মুলুকে যাওয়ার সময় মনে অনেক আশা আশঙ্কার মাঝেই একটা বড় সড় আশঙ্কা ছিল দূর্গা পুজোতে কলকাতার বাইরে থাকা। কিন্তু এই আশঙ্কাই যে ওই বছর একটা পরম পাওয়ার সুখস্মৃতি হয়ে জীবনের পাতায় জায়গা করে নেবে আগে বুঝিনি।

আমার বর্তমান নিবাস আমেরিকার ওহিও রাজ্যের সিনসিনাটি শহরের কাছে ম্যাসন নামে একটা ছোট্ট জায়গায়। ম্যাসনে বেশ বড়সড় ভারতীয় জনগোষ্ঠী আছে আর তার মধ্যে বাঙালির সংখ্যা কিছু কম নয়। দুর্গা পুজো বাঙালির প্রাণের পুজো আর তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই এখানকার সকল প্রবাসী বাঙালিরা মিলে খুব যত্ন সহকারে এবং অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে প্রত্যেক বছর মা দুর্গার আরাধনা করে থাকেন। Cincinnati Cultural Initiative এর মাধ্যমে বাঙালিয়ানাকে স্বযত্নে ধরে রাখার প্রচেষ্টার অন্যতম হচ্ছে এই দুর্গোৎসব, এবং প্রতি বছর প্রায় ২৫০-৩০০ মানুষ এই পুজোয় যোগদান করেন। সেরামিক গ্লাসের তৈরি অপূর্ব সুন্দর প্রতিমা আছে যেটা প্রতি বছরই নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে পুজো করা হয়।

Cincinnati cultural initiative বা CCI-র দুর্গা পুজো এই বছর ১২-এ পা দেবে। পার্থ ঘোষ দস্তিদার এই পুজোর চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য সদস্যরা হলেন সুগত চক্রবর্তী, প্রবুদ্ধ রায়, বিবেক দে, সৌভিক চক্রবর্তী, বিভাস পাল প্রমুখ যাঁরা নিজেদের ব্যস্ত জীবনের মাঝে মহা উৎসাহে দুর্গা পুজোর মতো বিশাল কর্মকাণ্ডকে বাস্তবায়িত করে থাকেন। এখানে পঞ্জিকার নিরিখে পুজো করা সম্ভব নয় বলে ওই সময়ের আশেপাশে একটা উইকেন্ডে স্থানীয় স্কুলের বাস্কেটবল কোর্ট আর অডিটোরিয়ামে দুর্গা পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় কোনও হিন্দু মন্দিরের পূজারী এই দুর্গা পুজোর পৌরোহিত্য করে থাকেন। শুক্রবারে দেবী বোধনের পাশাপাশি মহাষষ্ঠীর পুজো হয়, এর পর শনিবারে হয় সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পুজো আর রবিবারে হয় দশমী ও দর্পণ বিসর্জন। সবশেষে বরণ আর সিঁদুরখেলাও বাদ যায় না কিন্তু। এরই মাঝে শুক্রবার ও শনিবার দুদিনই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। CCI-র সদস্যরা সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদির পরিবেশনে পুজো প্রাঙ্গণ মুখরিত করে রাখেন। স্বনামধন্য শিল্পীদেরও আমন্ত্রণ করা হয় এই পুজোয়। ২০১৭ তে রূপঙ্কর বাগচী ও সোনা মহাপাত্রর সংগীত পরিবেশনা এই পুজোয় আলাদা মাত্রা এনে দেয়। ২০১৯ এর CCI-এর দূর্গা পুজো 4th, 5th ও 6th October অনুষ্ঠিত হবে। পুজো আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এ বছর মহেঞ্জোদারো নামের fusion band performance থাকছে শুক্রবার এবং CCI-এর প্রতিভাবান সদস্যদের দ্বারা অভিনীত ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পের অবলম্বনে নাটক ‘ মহাপ্রভু ‘ উপস্থাপিত হবে শনিবারে। এই হলো CCI-এর পুজোর সূচি বিবরণ। এবার আসা যাক ভোজনরসিক প্রবাসী বাঙালির প্রিয় অধ্যায়, পেটপুজোয় !! প্রতি বছরের মতো এ বছরও এলাহি খাবা দাবারের আয়োজন করছে CCI। শুক্রবার বিকেলে চা আর চাট-এর পর থাকছে ছোলার ডাল, আলুর দম, ধোঁকার ডালনা, বাটার পনির, চিলি ফিশ, চিকেন কোর্মা। শনিবারের তালিকায় থাকছে খিচুড়ি ভোগ, লাবড়া, ভেজ পাকোড়া, চাটনি, পায়েস আর রসগোল্লা, যা কলকাতার অষ্টমীর ভুরিভোজকে ভুলতে দেবে না এবং রাতে কব্জি ডুবিয়ে মাটন কারি, তন্দুরি চিকেন, মালাই কোপ্তা সহযোগে নবমীর খাওয়া দাওয়া। রবিবারেও একই ভাবে পঞ্চব্যঞ্জন থাকছে বাঙালির মনকে খুশিতে ভরিয়ে দেবার জন্য।

CCI-এর দুর্গা পুজোর অন্যতম আকর্ষণ হল এই পুজোর পরিবেশ। বনেদি বাড়ি আর পাড়ার পুজো যেন মিলেমিশে এক হয়ে যায় এই পুজোয়। পুজোর আঙিনাতে ঢুকলে দেখা যাবে সেই ঘরোয়া আড্ডা, ছোটদের কলতান, বড়দের হই হই, প্রাণখোলা হাসি আর একরাশ আন্তরিকতা। প্রথম বছর সেই ২০১৬-তে এই পুজোয় গিয়ে এক বারের জন্যেও মনে হয়নি যে এখানে আমি নতুন। এক নিমেষে এখানে সকলকে আপন করে নেওয়া হয়। অনেক নতুন পরিচিতিও হয়ে যায়। উইকএন্ডের তিন দিনই CCI-এর সদস্য আর অন্যান্যরা মিলে সকাল থেকেই পুজোর আয়োজনে লেগে পড়েন। ধুপধুনোর সুগন্ধে, লোকজনের বহুল উপস্থিতি আর ঢাকের তালে প্রতি মুহুর্তেই মনে হয় যেন কলকাতারই কোনও বাড়িতে বসে দুর্গা পুজোয় যোগদান করছি। ধুনুচি নাচ, উলু দেওয়া, শঙ্খ বাজানোর প্রতিযোগিতা মনে করিয়ে দেয় পাড়ার পুজোর উল্লাস। সব শেষে আসি দশমীর দেবীবরণ ও সিঁদুরখেলায়। পাড়ার পুজোর মতোই সারিবদ্ধ হয়ে পান, সিঁদুর, ধান ও সন্দেশ বরণডালায় সাজিয়ে মাকে বরণ করি আমরা মেয়েরা। অবশ্য সেরামিকের প্রতিমা হওয়ায় স্পর্শ না করেই মা কে বরণ করতে হয়, তা বলে উৎসাহে কোনো ঘাটতি থাকে না।

মহাসমারোহে সিঁদুর খেলা হয় প্রতি বছর। লাল সিঁদুরে দুর্গা মা’র সঙ্গে সঙ্গে সকলেই সকলকে রাঙিয়ে তোলে। ঢাকের তালে সবাই মিলে হাতে হাত রেখে ‘ আসছে বছর আবার হবে ‘ এই জয়ধ্বনি দিয়েই সকলে এক টুকরো কলকাতা বুকে নিয়ে ফিরে যায় যে যার প্রবাস জীবনে।

পুনশ্চ : অদ্ভুত ভাবেই এই আমেরিকাতেও এই সময়টাতেই নীল আকাশ আর তাতে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের আনাগোনা, হাওয়ায় হালকা শীতের আমেজ আর রাস্তার ধরে কাশ ফুল দেখা যায়, হ্যাঁ ঠিক তাই। প্রায় কাশ ফুলের মতো দেখতে এক ধরনের ফুল গাছের ঝারি রাস্তার ধারে ধারে ভরে যায়। নামটা ঠিক জানা নেই আমার, আসল কাশ ফুলের চেয়ে সামান্য আলাদা। এই সবের মাঝেই আমি প্রবাসে শরতের আলো খুঁজে নিয়েছি, খুঁজে নিয়েছি আমার কলকাতার দুর্গা পুজোকেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *