গত হপ্তায় একদিন সকালবেলা পেটটা একটু আইঢাই করছিল। বাড়িতে বলতে দুপুরে ভাতের সাথে একটা ঝোল দেওয়া হল। ঝোল বা রসা খেতে আমার এমনিতে বেশ ভালোই লাগে। বেশ একটা কমিউন-কমিউন ভাব থাকে তাতে। আর শীতকাল হলে তো কথাই নেই! কিন্তু পাতে বাটি উল্টোতেই পেঁপে, কাঁচকলা, আলুর পাশে একি! পটল কেন? বছরের এই সময় সে কেন বাটিতে ঢুকল? মুলো, বিন্‌স, গাজর, বিটকে বাইরে রেখে পটলকে স্থান দেওয়া নিয়ে অনুযোগ জানাতেই মুখ ঝামটা খেলাম নোলার জন্যে। মানেমানে খাওয়া শেষ করলাম। কিন্তু এ কি বেয়াদবি! একাধিক অনুষ্ঠান বাড়ির মেনুতে গরমকালে ফুলকপির রোস্ট দেখেছি। জনগণ হামলে পড়ে খায় তা-ও দেখেছি! সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই কবে বলে গিয়েছেন “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে!” তো গরমকালে পটল সুন্দর, শীতে ফুলকপি, সেটা কি বাঙালি ভুলে গেল? গরমকালে পটলের সাথে পেঁপে, লাউ, কুমড়ো, কলমি শাক খাবে আর শীতকালে ফুলকপির সঙ্গী কড়াইশুঁটি, মুলো, গাজর, বিট, ক্যাপসিকাম, বাঁধাকপি আরও কত কি! তা না করে যখন খুশি যা খুশি খেলেই হল! 

যদিও শীতকাল মানেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়া আর পিঠে রোদ্দুর মেখে কোথাও একটা গেলেই হল। একটা সময় ছিল যখন বাঙালি চেঞ্জে যেতো পশ্চিমে, মানে চিত্তরঞ্জন থেকে শিমূলতলা মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায়। এখন সেখানকার বাড়িগুলো মামদো থেকে মাওবাদী বিভিন্ন উৎপাতের এপিসেন্টার হয়ে গিয়েছে। কেউ আর চেঞ্জে যায় না। বাঙালির রুচি বদলে গিয়েছে। পৃথিবী ছোট হয়ে গিয়েছে, সময় মহার্ঘ হয়েছে। কিন্তু খাওয়ার অভ্যেস তো বদলায় নি! বাঙালির পাঁচমিশেলি তরকারি আর বিদেশি ভেজিটেবিল ক্যানালনি বানাতে একই সবজি মোটামুটি লাগে। সতে হোক বা ভাজা – শাক সবজি তো একই! আগে শীতকালে পশ্চিমে গিয়ে মাসখানেক থাকার এক মুখ্য কারণ থাকত বুক ভরা শ্বাস নিয়ে টাটকা সবজি তরিতরকারি খেয়ে স্বাস্থ্যোদ্ধার। বুক ভরা শ্বাস নিতে এখনও ছুটি পেলে দৌড়ায় বাঙালি, কিন্তু বাজারু বাঙালির দৌড় বাড়ির গলির মোড়ের সবজি-বিক্রেতা অবধি। 

এখন কি? না, বেড়াতে যাওয়া মানেই ভাঙা মন্দির-মসজিদ-রাজপ্রাসাদ কিংবা নদীর পাড়। এইসব ভাঙা ইটের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞের মতো যারা ঘাড় নাড়ে, তাদের জন্যে বলি, এইসব টেলিভিশনে হরবখত দেখা যায়। এখন এতোগুলো চ্যানেল হয়ে গিয়েছে যে অনুষ্ঠানের মধ্যে বৈচিত্র আনা এক ঝকমারি কাজ। তাই ঘুরেফিরে তারা এইসব জায়গার ওপর মাঝেমধ্যেই অনুষ্ঠান করে থাকে। এতে খরচ আর ঝক্কি দুটোই কম। ফলে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখার কোনও মানেই হয় না। বেকার ঠান্ডা লেগে যাবে জোলো হাওয়ায়। এর চেয়ে অনেক ভালো কাজ হল কলকাতার আশেপাশে কোথাও দু’একদিনের জন্যে গিয়ে সবজির বাজার ঘুরে প্রকৃত শীতকাল উপভোগ করে মন আর পেট দুটোকেই তৃপ্ত করে শহরে ফেরত আসা। আরে বাবা, ভাঙা ইটের মন্দির-মসজিদ-রাজপ্রাসাদ অথবা নদীর পাড় সারা বছর থাকবে, কিন্তু আমাদের শীত তো চল্লিশ দিনের মাত্র! 

কলকাতার আশেপাশে পরিযায়ী পাখিরা আর বেশি আসে না। পঁচাত্তর মাইল দূরে চুপি-র চরে এখনও কিছু কিছু আসে। তাই শীত পড়তেই পালে পালে লোক সেখানে যায় পাখি দেখতে। বুঝুক আর না বুঝুক! একটু বেড়িয়ে আসা তো হবে সারা দিনের জন্যে! অথচ এই চুপি থেকে মাত্র দশ মাইল দূরে কালেখাঁতলায় কেউ যায় না! যেটা এই বাংলার অন্যতম বড় পাইকারি সবজির হাট! হাট নামেই, কারণ এই বাজার রোজই বসে। আর সবজির দাম আর সাইজ দেখলে চোখ চড়কগাছ হয়ে যাবে। পাইকারি বাজারে যেতে নারাজ? বেশ! গাড়ি নিয়ে চুপি-র চরে যেতে গেলে যেখান থেকে গাড়ি বাঁক নেয়, সেই পারুলিয়া মোড়েই বসে পারুলিয়া বাজার। ছ’কিলোমিটার দূরে কালেখাঁতলা থেকে সবজি কিনে এনে এই বাজারে বিক্রি হয়। কলকাতার বৈদিক ভিলেজে যারা মাঝেমধ্যে শীতকালে চলে যান, তাঁরা প্রায় কেউই জানেন না বৈদিক ভিলেজ থেকে তিন মাইলের চেয়েও কম দূরত্বে পোলেরহাটের কথা, যেখানকার পাইকারি সবজি বাজার কালেখাঁ বাজারের মতোই বিখ্যাত আর বড়। পূর্ব আর উত্তর কলকাতার বাজারে শাকসবজি আসে এই বাজার থেকেই। পোলেরহাটের সবজি বাজার সোমবার আর শুক্রবার বসে, আর বুধবার বসে ভাঙা হাট। এই বাজারের অদূরেই আরেকটা বাজার আছে, যেখানে বাড়িতে কিনে আনার জন্যে খুচরো সবজির বাজার বসে। 

কলকাতার বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে যাদের নেই, তাঁরা একদিন কোলে মার্কেট চলে যান। বিভিন্ন সবজি – ক্যাপসিকাম থেকে করলা যা মনে আসে, তার বিচিত্র সম্ভার দেখে আসুন এক ছাদের তলায়। সবজির দাম আর সাইজ দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন না। এমনিতেই ওখানে দেখবেন আপনার মতো অনেকেই শুধু দেখতে এসেছে, কিনতে নয়! কিংবা উল্টোডাঙার ভিআইপি সবজির বাজারে – বেলা বারোটা থেকে সেটা পাইকারি বাজার। তার আগে এটা মাছের বাজার। দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দেরা বিদ্যাসাগর সেতুর ওপারে ধূলাগড় বা সায়েন্স সিটির উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে চৌবাগা বাজার ঘুরে আসতে পারেন। 

পাইকারি এই সব বাজারে কেন যাবেন শীতকালে? সার্কাস বা মেলায় কেন যান? দেখতে! শুধু দেখতে! রঙের বাহার, আয়তনের বৈচিত্র আর রকম দেখতে। কলকাতার বাইরের বাজারগুলোয় যেতে গেলে বরাত জোরে যাতায়াতের পথে কোনও কৃষকের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে, যে তার জমির সবজি নিয়ে মহাজন পাইকারের কাছে বিক্রি করতে চলেছে। বাড়ির সামনে এগারো টাকায় ফুলকপি পাওয়া যাচ্ছে দেখে বেশ কয়েকটা কপি কিনে বিজয়দর্পে বাড়ি ফেরা আমি যেমন কয়েকদিন আগেই বেকুব বনেছি আসাম রোডে এক চাষার কাছে আরও ভালো এবং আরও বড় কপি পাঁচ টাকাতে কিনে। 

শীতের বাজারে রকমারি সবজি

কলকাতার বাইরে আকাশটা উঁকিঝুঁকি বা ডিঙি মেরে দেখতে হয় না। রোদ্দুর ঠিকে ঝি’র মতো ঘড়ি মেপে আসে না। সক্কাল সক্কাল লেপ থেকে টুক করে বেরিয়ে একটা শাল দিয়ে ভালো ভাবে কান মাথা মুড়ে বারান্দায় ওঁত পেতে বসে থাকা অথবা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়া যেতেই পারে খেজুরের রসের জন্যে। দু’বাটি রস কিনে এক গ্লাস খেয়ে অন্য গ্লাসটা মাথায় চাপা দিয়ে খাওয়ার টেবিলের বা রান্নাঘরের কোণে রেখে সকাল শুরু করলে মন্দ হয় না। তারপরে বাজারের পথে হাঁটা দেওয়া। সেখান থেকে মনের সুখে দেখা আর কেনা। এর পর গর্বিত পদক্ষেপে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা! ব্যাগ থেকে পালং আর মুলো-ফুলকপি উপচে পড়ে শহর দেখতে দেখতে দেহত্যাগ করতে চলেছে। 

বাজার থেকে শাক-সবজি কিনে আনার পরের ধাপই হল গুছিয়ে সারাদিনের মেনুর পরিকল্পনা করে ফেলা, যাতে সারাদিনের খাওয়ায় কোথাও ছন্দপতন না হয়। রান্নার লোককে সব বুঝিয়ে দেওয়ার সময় মুলো চাকাচাকা করে কেটে তাতে লঙ্কা গুঁড়ো, কাসুন্দি আর লেবুর রস দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে টেবিলের এক কোণে ঢাকা দিয়ে রেখে দেওয়া, যাতে মুলো তার চরিত্র না খুইয়ে বসে। জলখাবার মোটামুটি সকাল দশটা নাগাদ মেথি পরোটা সহযোগে। সাথে শালগমের আচার। না থাকলে ধনেপাতার চাটনিও চলতে পারে। মেথি পরোটার বদলে মুলোর পরোটাও চলবে স্বচ্ছন্দে। সঙ্গে সকালে সরিয়ে রাখা খেজুর রসটা, যেটা অল্প গেঁজে গেছে ইতিমধ্যে। শহরের বাইরে গেলে খেজুর রসটাই বাড়তি পাওনা, বাকিটা নিজের বাড়িতে বসেও স্বচ্ছন্দে উপভোগ করা যায়।

দুপুরে ভাতের সঙ্গে ফুলকপির পাতা বাটা, মুলো শাক, সঙ্গে গাজর, বিন্‌স, মুলো, কড়াইশুঁটি দিয়ে ডাল, মেথি শাকের বড়া। এর পরেই পেঁয়াজকলি দিয়ে গরম গরম চুনোমাছের চচ্চড়ি। ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছ। তেঁতুল দিয়ে টোম্যাটোর চাটনি। এক পিস নতুন গুড়ের রসগোল্লা। এরপর? সুড়ুৎ করে লেপের তলায় ঢুকে একখণ্ড নিটোল দিবানিদ্রা। সন্ধ্যের মুখে ফুলকপির শিঙাড়া আর ক্যাপসিকামের চপের সাথে এক কাপ চা। মকাইয়ের রুটি আর সর্ষের শাক এই বঙ্গ পেটের অঙ্গ হতে বিদ্রোহ করতে পারে। তাই রাতে কড়াইশুঁটির কচুরি, ছোলার ডাল আর ছোট আলুর দম। সঙ্গে মাইক্রোওভেনে গরম করা কিছুটা খেজুর গুড়ের মাখা সন্দেশবলতে ভুলেছি, সেই সকালের রাখা মুলো-মাখাটা আর সেদ্ধ কড়াইশুঁটি নিয়ে রাত আটটা নাগাদ পেগ দু’তিন আইরিশ বা বোরবোঁ হুইস্কিএই ভাবে একটা ছুটির দিন সকাল থেকে রাত অবধি গড়ালে খুব খারাপ হয় কি!

পুনশ্চ: এক ছুটির দিনে এই মেনু বাড়িতে বা বেড়াতে গিয়ে খাওয়ার পরিকল্পনা করলে যে প্রবল ঝড় উঠতে পারে, তার দায় একমাত্র পরিকল্পনাকারীর, লেখকের নয়। 

 

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।

3 Responses

  1. খুব ভালো লাগলো। পড়তে পড়তে নিজের মনে একটু হেসে নিলাম।প্রশংসনীয় তোমার লেখনির সাবলীলয়তা। মনে হল আড্ডায় বসে কেউ একটু বেড়ানো নিয়ে জ্ঞান দিয়ে চলে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *