কিচেনের এক কোনে একটা কাচের ঘর। ঘরের মধ্যে একটা লম্বা ডেস্ক, তাতে দুটো ফোন। এই ফোনগুলো হোটেলের অন্য ফোনের মতো নয়- এতে কোথা থেকে ফোন এসেছে দেখা যায়। স্পিকার আছে- যেটা অন করে রিসিভার না তুলেও কথা বলা যায়। টেবিলের ওপরে থাকে কে.ও.টি বা কিচেন অর্ডার টিকিট। বোর্ডাররা ফোন করলে খস্খস্ করে তাঁদের খাবারের অর্ডার লিখে নিয়ে কে.ও.টি-র এক কপি দিয়ে দিতে হবে কিচেনে, এক কপি দেওয়া হবে ওয়েটারকে, যাতে সে মিলিয়ে নিয়ে খাবার পিক আপ করতে পারে। আর এক কপি দেখে বিল বানানো হবে, যেটা খাবারের সঙ্গে ওয়েটার নিয়ে যাবে বোর্ডারের ঘরে। সেটা তিনি সই করে দেবেন। পেছনে একটা লম্বা বেঞ্চি, যেখানে ওয়েটাররা বসতে পারে, অর্ডার এলে যাতে তাদের খুঁজতে না হয়। কিচেনের হল্লা কোনওভাবে ফোনের মাধ্যমে হোটেলের বোর্ডারদের কানে পৌঁছলে মুশকিল, তাই সব সময়ে দরজা ভেজিয়ে রাখা হয়। এই কাচের ঘরের নাম “রুম সার্ভিস”।

নবীন চট্টোপাধ্যায় ঠিক কবে থেকে এই ঘরে ঢুকেছেন কারোর মনে নেই। তবে বিভিন্ন রেস্তোরাঁতে হোঁচট খেয়ে এখানে থিতু হয়েছেন, এটা পুরনো লোকেরা জানে। তাঁর দুটো অভিমান। এক, তিনি তাঁর যোগ্য সম্মান পাননি এই হোটেলে। আর দুই, তাঁকে কেউ পিতৃদত্ত নামে ডাকে না। সব্বাই পাঁচু চ্যাটার্জি বা পাঁচুবাবু বলেই ডাকে। হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার বা অ্যাংলো শ্যেফ ম্যাপল সাহেব, যারা পাঁচু উচ্চারণ করতে পারে না তারা “পাঞ্চু” বলে ডাকে। অন্য কোনও শিফটে পেছনের ওয়েটারদের বেঞ্চ ফাঁকা থাকতে পারে, কিন্তু পাঁচুবাবুর শিফটে সব সময়ে অন্তত দুটো ওয়েটার সব সময়ে বসে থাকে। যদি এদিক ওদিক যায়ও, রুম সার্ভিসের ফোন বেজে উঠলে বুলেটের মতো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে কান পেতে অর্ডার শোনে আর শ্যেনদৃষ্টিতে পাঁচুবাবুকে দেখে। ফোন বাজলেই তৎপর পাঁচুবাবু কায়দা করে ফোন ওঠান আর সাহেবি উচ্চারনে “গুড ইভনিং রুমসার্ভিস, মে আই হেল্প ইউ” বলেন। ওয়েটাররা ওঁকে বারংবার অনুরোধ করে হ্যান্ডস-ফ্রিতে কথা বলতে, কিন্তু পাঁচুবাবুর তাতে ইজ্জতে লাগে।
পাঁচুবাবুর সহকর্মী আলম ইউনিয়নের বড় নেতা। আমাদের মতো মানুষদের দেখলেই বাঁকা হাসে আর ফিসফিস করে ওয়েটারদের কী সব বলে। কোনওদিন কোনও কাজ শেখায়নি। আট ঘণ্টার শিফট শেষ হলে বেরিয়ে চলে যায়, দু’মিনিট অপেক্ষা করে না শিফট হ্যান্ডওভার করতে। পক্ষান্তরে পাঁচুবাবু কাজ বোঝান, হোটেলের পুরনো গল্প বলেন, পরের শিফটের লোকের আসতে দেরি হলে বসে থাকেন তাকে হ্যান্ডওভার দিতে। এত সজ্জন এক মানুষের ওপর ওয়েটারদের এই ঘোর অনাস্থার কারণ বোধগম্য হত না।

অবশ্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না। একদিন বিকেলে সাংঘাতিক গোলমাল রুম সার্ভিসের ঘরে। বোর্ডার গোল্ড ফ্লেক সিগারেট অর্ডার করেছিল, কর্নফ্লেক্স গিয়েছে তার কাছে। তখন জানা গেল ওঁর এই পাঁচু নামের ইতিবৃত্ত। নবীনবাবু মাঝেমাঝেই ঘাড়ে ঝটকা দেন মুখ ঘুরিয়ে। কফিশপে থাকাকালীন এই বেয়াড়া অভ্যেস দেখে অতিথিরা তাই নিয়ে ম্যানেজমেন্টের কাছে অভিযোগ করেন। চাকরি বাঁচাতে মেডিকেল সার্টিফিকেট জমা দেন নবীনবাবু, যেখানে উল্লেখ করা ছিল যে ওঁর ঘাড় লক হয়ে যায় মাঝেমাঝে। তাই এই ঝটকা দিয়ে উনি লক্ খোলেন। জেনারেল ম্যানেজারকে করুণ কণ্ঠে জানান, শৈশবে তাঁর মরণাপন্ন রোগ হয়েছিল। পাঁচু ঠাকুরের থানে মানত করে প্রাণরক্ষা হয়। সেই রোগের স্মৃতি হিসেবে এই ঘাড় লক হওয়াটা থেকে গিয়েছে। জেনারেল ম্যানেজার কতটা বুঝেছিলেন জানা নেই, কিন্তু নবীনবাবুকে কফিশপে ঘাড় ঝটকা দিয়ে অতিথিদের ঘাবড়ে ব্যবসা চৌপাট করার ঝুঁকি না-নিয়ে পত্রপাঠ ওঁকে রুম সার্ভিসে ট্রান্সফার করেন আর নবীনবাবুকে মিস্টার পাঁচু বলতে শুরু করেন। আর সেই থেকে নবীনবাবু পাঁচু হয়ে গেলেন।
অর্ডার নিয়ে গোলমাল করাটা পাঁচুবাবুর নতুন নয়। ফোনে অর্ডার নিতে নিতে ঘাড় ঝটকা দিতে গিয়ে অর্ধেক অর্ডার শুনতে না পেয়ে এর আগে অনেকবার গোল পাকিয়েছেন উনি। তাই ওঁর শিফটে ওয়েটাররা পেছনে বসে থাকে। এর আগে চায়ের লিকারের সঙ্গে আলাদা করে দুধ সবসময়েই দেওয়া হয়। সেটা ভুলে গিয়ে এক বোর্ডার “টি অ্যান্ড মিল্ক” অর্ডার করেছিলেন। তাঁর ঘরে শুধু দুধ পৌঁছেছিল। এক বোর্ডার “ডাল মাখনির সঙ্গে অনেক ধনেপাতা” অর্ডার করতে তাঁর কাছে শুধু ধনেপাতা পৌঁছেছিল। আর প্রত্যেকবারই ওয়েটাররা গালাগাল খেয়েছে এ সবের জন্য।
অন্যদিকে, কফিশপে এক নতুন গোলমাল শুরু হয়েছে। ড্যালাস মরগ্যান কিছুতেই নাইট শিফট করবে না। সদ্যবিবাহিত ড্যালাস রাতে বউকে ছেড়ে থাকতে রাজি নয়। নাইট শিফট থাকলেই ড্যালাস ডুব দেয় আর ইভনিং শিফটের সুপারভাইজরকে ডবল শিফট করতে হয়। সে পরের দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে মর্নিং শিফটের সুপারভাইজরকে চার শিফট টানতে হয়েছিল, কারণ ড্যালাস যথারীতি রাতে ডুব মেরেছে। কাকুতি মিনতি, হুমকি কিছুতেই ড্যালাস টলবে না। কোথা থেকে এক ডাক্তার জোগাড় করেছে, প্রত্যেকবার মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে হাজির হয়। তাই পার্সোনেল ডিপার্টমেন্ট শাস্তিও দিতে পারে না! পাঁচুবাবুর বিষয়ে ওয়েটারদের সম্মিলিত অভিযোগে পার্সোনেল ম্যানেজার হালে পানি পেল। রুমসার্ভিসে ড্যালাস মার্টিনকে পাঠানো হল এই কড়ারে যে সে সেখানে ইভনিং শিফট করবে। নাইট শিফটে পাঁচুবাবু। রাতে প্রায় অর্ডার থাকে না আর সকালে সেট বেড টি অর্ডার। সকালের শিফটে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চের চাপ আলম সামলে নেবে। দুপুরে মার্টিন চলে আসবে আর ডিনার পর্যন্ত থাকবে। ওয়েটাররা খুব খুশি। ড্যালাস নাকি চ্যাম্পিয়ন লোক।

বেশ চলছিল সবকিছু। ঘটনাবহুল রুম সার্ভিসকে এইরকম ম্যাদা মেরে যেতে দেখে আমরাও মনমরা। কী-যেন-নেই, কী-যেন-নেই! হঠাৎ একদিন রাতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। জেনারেল ম্যানেজার হাজির ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ম্যানেজারের ঘরে। এক ভিআইপি বোর্ডার তাঁর অফিসে এসে তুলকালাম করেছেন আর হোটেল মালিককে তাঁর নামে নালিশ জানিয়ে চিঠি লিখতে বসেছেন। জানা গেল, সেই বোর্ডার ঘরে একটা পার্টি দিয়েছিলেন, যার জন্যে রুম সার্ভিসে খাবারের অর্ডার দিয়েছেন — ভাত, রুটি, ডাল, স্যালাড, মাছ, মাংস, আইসক্রিম, সব মিলিয়ে বিশাল এক মেন্যু। খাবারের অর্ডার দিয়ে উনি জানিয়ে দিয়েছিলেন খাবার নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি রাখতে, সুরাপানের পর্ব শেষ হলে যাতে ফোন করলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘরে খাবার পরিবেশন করা হয়।
ঘর ভর্তি অতিথি। সুরাপানের পর্ব শেষ করে নির্দিষ্ট সময়ে বোর্ডার ফোন করেছেন। কিন্তু তাঁর ঘরে গিয়ে পৌঁছেছে শুধু ভাত, রুটি, ডাল আর স্যালাড। মেন কোর্স একটাও পৌঁছয়নি। বোর্ডার ওয়েটারকে বাকি খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতে সে জানিয়েছে অর্ডারে যা ছিল সবই পরিবেশন করা হয়েছে। অপমানিত লজ্জিত বোর্ডার সোজা জেনারেল ম্যানেজারের অফিসে এসে বসে আছেন। কৈফিয়ত দাবি করেছেন। ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ম্যানেজার দৌড়লেন রুম সার্ভিসে। অনেকদিন বাদে পরিচিত বাতানবরণ ফেরত পেতে রুম সার্ভিসের দরজায় হাজির হয়ে শুনলাম ড্যালাস কৈফিয়ত দিচ্ছে, “কী করব স্যার! এত অর্ডার দিল যে কে.ও.টি-র পাতাটাতে আর লেখার জায়গা ছিল না! যেটুকু পাতায় ধরেছে, সেইটুকুই অর্ডার দিয়েছি!”
পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।